রাজশাহী শহরে ব্যক্তিগতভাবে আমাদের ভোট দিতে কোনো অসুবিধা হয়নি; কিন্তু ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরতেই শুনতে পেলাম, আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশে বিএনপি সমর্থকদের সাথে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের আরম্ভ হয়েছে মারদাঙ্গা। আর এতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিএনপি সমর্থকেরাই। নিজে কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত নই, কিন্তু এভাবে একটি দলের সমর্থকেরা একতরফাভাবে পিটুনি খাবে, সেটাকেও সমর্থন করি না। বিএনপি না হয়ে অন্য কোনো দলের লোকও যদি তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য ভোট দিতে গিয়ে মারের শিকার হয়, তবে সেটাকে সমর্থন করব না কোনোভাবেই। এটা হলো আমার নীতি-আদর্শের প্রশ্ন।
আমরা ভোট করছি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করার লক্ষ্যে। না হলে করতাম ‘বিপ্লবের রাজনীতি’, যেমন বলেছেন কার্ল মার্কস। কিন্তু আমরা সে রকম কিছু করার কথা ভাবতে যাচ্ছি না। আমরা ভাবছি না বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নতুন কোনো সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করতে। বলছি না, এ ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ পালন করবে ধাত্রীর ভূমিকা।
সংসদ নির্বাচনের ভোট হয়ে গেল। আওয়ামী লীগ ভোটে বিজয়ীই হলো। হার-জিত আছেই। কোনো ভোটেই দুই পক্ষ জিততে পারে না একসাথে। দুই পক্ষ সমান সমান ভোট লাভ করাও বিরল ব্যাপার। কিন্তু এ রকম বিপুল ভোটের ব্যবধানে হার-জিত সারা বিশ্বকে হতবাক করেছে।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা। এতে বলা হয়েছে, এ রকম ভোটের ফলাফল উত্তর কোরিয়ার মতো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আশা করা যায়; কিন্তু বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশে নয় (দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮)।বিলাতের দ্য ইকোনমিস্ট একটা বিখ্যাত ম্যাগাজিন। ওই ম্যাগাজিনের ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি সংখ্যায় বলা হয়েছে- ভোটের ফলাফল অনেক আওয়ামী লীগ সদস্যের কাছেও মনে হচ্ছে বিস্ময়কর। ভোটে যে কারচুপি হয়েছে, সে বিষয়ে বিশ্ববাসীর মনে কোনো সংশয় আছে বলে মনে হচ্ছে না।
ভারতের একসময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চারবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তার সম্পর্কে এ রকম ভোটের কারচুপির অভিযোগ উঠতে পারেনি। ইন্দিরা গান্ধী ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হননি। তিনি খুন হন নয়া দিল্লিতে তার সরকারি বাড়ির আঙিনায়, দু’জন শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে। এই দু’জন ছিলেন ‘খালিস্তান’ আন্দোলনের সমর্থক। অর্থাৎ এরা ছিলেন স্বাধীন ও পৃথক শিখ রাষ্ট্রের পক্ষে। ইন্দিরা গান্ধী কঠোর হস্তে খালিস্তান অন্দোলনকে দমন করেছিলেন। এটা ঘটেছিল তারই প্রতিক্রিয়ায়।
এবার বিএনপি নির্বাচনে হারল। এই হার যে কেবল ভোট ডাকাতির জন্যই হতে পারল, তা কিন্তু নয়। ভোট ডাকাতিটা সম্ভব হতে পেরেছে, তার কারণ বিএনপি নেতাদের আদর্শহীনতা। বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগকে বলছেন একটা ‘ফ্যাসিস্ট দল’। কিন্তু ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করেছিলেন তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ল ই ব্রেজনেভের পরামর্শে, ফ্যাসিস্ট দর্শনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নয়। কিন্তু মির্জা সাহেব আওয়ামী লীগের সমালোচনা করছেন ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে।
শেখ মুজিব সারা জীবন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে। তার সংসার চলেছে ইউসুফ হারুনের টাকায়, যিনি বিশেষভাবে ছিলেন সিআইয়ের সাথে জড়িত। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি ইউসুফ হারুন গড়েছিলেন আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি। শেখ মুজিবুর রহমান ওই কোম্পানিতে গ্রহণ করেন মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনের চাকরি। কেন, কী কারণে তিনি হঠাৎ মস্কোমুখী হলেন, সেটি কারো কাছেই স্পষ্ট নয়। তার এই সিদ্ধান্ত তার জীবনে পরম অমঙ্গল বয়ে এনেছিল। এখন এ কথা মোটামুটি সবারই জানা, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, তাতে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মৌন সম্মতি।
অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ১৫টা রিপাবলিক নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও সব দিক থেকে অগ্রসর এবং ভৌগোলিক আকৃতির দিক থেকে সবচেয়ে বড় ছিল ইংরেজিতে যাকে বলা হতো ‘রাশিয়া’। এর পরে ছিল ইউক্রেন এবং ইংরেজিতে যাকে বলা হয় বাইলোরাশিয়া। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। এর কারণ হলো ইউক্রেন ও বাইলোরাশিয়া চায়নি সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার প্রধান ও প্রাথমিক কারণ হলো জাতিসত্তার সংঘাতের সমাধান করতে না পারা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর অনুমান করা গিয়েছিল ঠাণ্ডা লড়াই শেষ হবে, কিন্তু তা হতে পারল না। রাশিয়াতে এখন দেখা দিয়েছে এক অতি উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদ। আর সেই সাথে মার্কিন বিদ্বেষ। ফলে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের রেশ কাটছে না।
রাশিয়াতে গণতন্ত্র ছিল না। কমিউনিস্টরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসও করেন না। তারা বিশ্বাস করেন তথাকথিত সর্বহারার একনায়কত্বে। আসলে যা হয়ে দাঁড়ায় কমিউনিস্ট পার্টির একচ্ছত্র আধিপত্য। রাশিয়াতে এখন কমিউনিস্ট পার্টি আর ক্ষমতায় নেই। ক্ষমতায় আছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আর তার বন্ধুরা। পুতিন তার নীলনকশা অনুসারে নির্বাচন করেছেন। আবার তিনি ও তার বন্ধুরা আসেন ক্ষমতায়। বাংলাদেশে যে নির্বাচন হয়ে গেল সেটা মিলছে পুতিনের নির্বাচনের ধারার সাথে। এর সাথে ফ্যাসিস্ট দর্শনের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। যদিও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগকে বলছেন ‘ফ্যাসিস্ট’। শেখ হাসিনা কাউকে অনুকরণ করলে, করেছেন পুতিনকে। আর ওই ধারাতেই মনে হচ্ছে চলবে এ দেশের ‘গণতন্ত্র’। পুতিন উল্লাস প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের নির্বাচনী ফলাফলে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা করেনি। বলা যায় না যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে কী নীতি গ্রহণ করবে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে কি না।
মানুষ কাজ করে। তার কাজের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় সম্পদ। একটা দেশে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে তার কর্মশক্তি। একসময় ম্যালেরিয়া ছিল বাংলাদেশে একটা মারাত্মক ব্যাধি; কিন্তু এখন সেটা আর তা নেই। ম্যালেরিয়া কমে যাওয়ার কারণে এ দেশের মানুষের স্বাস্থ্য হতে পেরেছে অনেক ভালো। বাংলাদেশের কৃষক আগের তুলনায় আবাদ করতে পারছে অনেক সুষ্ঠুভাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুসারে, ম্যালেরিয়া কমার জন্য বাংলাদেশে আগের তুলনায় ধানের আবাদ হচ্ছে শতকরা ১৫ ভাগ বেশি। গুটিবসন্ত ছিল বাংলাদেশের আরেকটি মারাত্মক রোগ; কিন্তু এখন আর তা নেই। ১৯৭৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গুটিবসন্তমুক্ত হয়েছে। এর ভাইরাস আর বাংলাদেশে নেই। কলেরায় বহু লোক মারা যেত। কিন্তু কলেরাও এখন আর মহামারী আকারে দেখা দিচ্ছে না। বাংলাদেশের গবেষকেরা কলেরার চিকিৎসার খুবই সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন।
আমাদের স্বাস্থ্য ভালো হচ্ছে। আমরা ভালোভাবে কাজ করতে পারছি। উন্নত হচ্ছে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা। এটা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ফল। কোনো রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে নয়। আমাদের অর্থনীতি এখন বিশেষভাবে নির্ভর করে দক্ষিণ-পশ্চিম মওসুমি বায়ুপ্রবাহের ওপর। আগেকার দিনে খরাজনিত কারণে আমাদের দেশে পাঁচ বছর অন্তর নানা জায়গায় দেখা দিত ভয়াবহ খাদ্যাভাব; কিন্তু এখন আর সেটা হতে পারছে না। এর কারণ উন্নত কৃষিপদ্ধতি। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রচার করছে তাদের কারণেই হতে পারছে আমাদের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি।
শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশেই ধুম পড়েছিল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ার। সেটা করতে গিয়ে অর্থনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছিল বিশেষ বিপর্যয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অর্থনীতিতে আনেন ব্যক্তিগত উদ্যোগকে ফিরিয়ে। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতি লাভ করে বিশেষ গতিবেগ। এটাই ইতিহাস।
দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়দায়িত্ব প্রধানত ক্ষমতাসীন দলের; কিন্তু আওয়ামী লীগ কতটা নিরপেক্ষভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করবে, আমরা তা ভাবতে পারি না। অনেকে মনে করেন- প্রতিপক্ষকে তাই নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য সুসংগঠিত হতে হবে। তারা সংখ্যায় কম নন। তাই তারা যদি নিজেরা সুবিন্যস্ত হন তবে তারা অন্তত আত্মরক্ষা করতে পারবেন, সে বিষয়ে সংশয়ের হেতু নেই।
বিএনপি নেতারা যদি কেবলই পত্রিকায় বিবৃতি না দিয়ে সমর্থকদের সুসংগঠিত হতে উদ্বুদ্ধ করেন তবে তারা মারা পড়বেন না প্রতিপক্ষের হাতে, এই রকমই অনুমান করা যায়। নির্বাচনে হারলেও বিএনপি এখনো বিরাট জনসমর্থনের অধিকারী। ড. কামাল হোসেন একজন ভালো আইনজীবী। কিন্তু কেবল ওকালতির মাধ্যমে জনগণকে রক্ষা করা যায় না। জনগণকে গণতন্ত্রের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে সুসংগঠিত করতে হবে। কেননা, রাজনীতি ব্যাপারটা কেবলই আইনের ব্যাপার নয়।
অন্য দিক থেকে দেখলে বলা যায়, ড. কামাল হোসেন স্বেচ্ছায় হয়েছিলেন তসলিমা নাসরিনের উকিল। কারণ, তিনি ভেবেছিলেন এর দ্বারাই ঘটতে পারবে তার জনপ্রিয়তার প্রসার; কিন্তু তিনি এখন হতে চাচ্ছেন না কোনোভাবেই বেগম খালেদা জিয়ার উকিল, যদিও তিনি হতে চাচ্ছেন ধানের শীষ প্রতীকের সমর্থক।
এবার আওয়ামী লীগ যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছে, তাতে কেবল আছে এ দলেরই লোক। অন্য কোনো দলের লোক নেই। এমনকি দেখা যাচ্ছে, নেই কোনো মার্কিনবিরোধী ব্যক্তি। দীপু মনি ফিরেছেন মন্ত্রিসভায়। তিনি লেখাপড়া করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ চাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পৃথকভাবে সমঝোতায় আসতে। আমরা বাইরের লোক। রাজনীতির শীর্ষ মহলের খবর রাখি না। তবে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতি বেশ জটিল হয়ে উঠছে।
লেখাটি প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে, দৈনিক নয়া দিগন্তে।