আমাদের অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা

অর্থনীতি আর রাজনীতি এক নয়। রাজনীতি করতে হলে এখন সব দলেরই থাকতে হয় কিছু না কিছু অর্থনৈতিক বক্তব্য। অর্থনীতি আর রাজনীতি চলতে চায় একে অপরের হাত ধরে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একটি অর্থনৈতিক কার্যসূচি থাকে। অর্থনৈতিক কার্যসূচি বর্তমান কালের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য হয়ে উঠতে চায় অধিকতর গুরুত্বসম্পন্ন। কারণ অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানের উপায় সম্পর্কে সর্বসাধারণের মধ্যে যে রাজনৈতিক মতানৈক্যের উদ্ভব হয়, তার ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠতে চায় দলীয় রাজনীতি। রাষ্ট্রপতি জিয়া সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত মিশ্র অর্থনীতির সমর্থক। তিনি শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনাকে পরিত্যাগ করে এ দেশের অর্থনীতিকে চান বিশেষভাবে গতিশীল করে তুলতে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময় বিশেষভাবে আরম্ভ হয় বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানি। তার সময় গড়ে ওঠে তৈরী পোশাক শিল্প। গড়ে উঠতে থাকে চিংড়িমাছের ঘের। জিয়া চান স্বেচ্ছাশ্রমকে সুগঠিত করে খাল কেটে কৃষিতে সেচব্যবস্থার উন্নয়ন। আর চান ুদ্র শিল্প বিকাশের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়াতে। এর জন্য তিনি ব্যক্তিকে করেন রাষ্ট্রিক সহায়তা প্রদান। শেখ মুজিব চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে। আর এ ল্েয পৌঁছানোর জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে তিনি গড়তে চান এক দলের রাজত্ব, বাকশাল। তিনি একে আখ্যায়িত করেন দুঃখী মানুষের গণতন্ত্র বলে। রাজনীতিতে জিয়া চাননি এক দলের রাজত্ব। অর্থাৎ বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে থেকেছে বড় রকমের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনার পার্থক্য। জিয়া মনে করেননি কেবল বিএনপি দেশের আর্থিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে। তিনি দিতে চেয়েছেন অন্য দলকেও দেশ ও জাতি গড়ে তোলার সুযোগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ এটা দিতে চায়নি। তারা মনে করে এবং এখনো মনে করে থাকে যে, দল হিসেবে কেবল তারাই পারে এ দেশের মঙ্গলসাধন করতে। এ দেশের ভালো-মন্দের বিচারে কেবল তাদেরই আছে একচেটিয়া অধিকার। এসব কথা মনে পড়ছিল ৩০ মে, ২০১২ জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী উপল।ে কিন্তু মনে হচ্ছে একটা কথা ভাবছে না আমাদের দেশের কোনো রাজনৈতিক দল। তা হলো, আমাদের অর্থনীতি হয়ে পড়ছে খুবই বিদেশনির্ভর। আমরা বিদেশে জনসমষ্টি রফতানি করছি। কিন্তু এই রফতানি নির্ভর করছে বিদেশের পরিস্থিতির ওপর। এক সময় লিবিয়ায় জনশক্তি রফতানি করে প্রচুর আয় করেছি। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না। গোটা মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত। আমরা বিদেশে তৈরী পোশাক রফতানি করে যথেষ্ট আয় করছি। কিন্তু এই আয় বন্ধ হতে পারে উন্নত দেশগুলোতে বাণিজ্য মন্দা (Business cycle) আরো ঘনীভূত হওয়ার ফলে। বিদেশের অর্থনীতি আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। আমাদের রফতানিনির্ভর অর্থনীতি তাই হয়ে উঠেছে খুবই অনিশ্চিত। জিয়া চেয়েছিলেন আখের রস থেকে চিনি তৈরী করে বিশ্বের বাজারে বিক্রি করতে। কিন্তু তিনি এ কাজে সাফল্য পাননি। বিশ্বের বাজারে আমরা পারিনি ইন্দোনেশিয়া ও কিউবার চিনির সাথে দামের প্রতিযোগিতা করতে। তারা আমাদের চেয়ে অনেক সস্তায় চিনি বিক্রি করতে পারে। যেটা আমাদের পে সম্ভব নয়। জিয়া চিনির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য দেশে আখের গুড় তৈরি বন্ধ করেছিলেন। এটা ছিল তার এক বিশেষ ভুল।
আমরা আমাদের অর্থনীতিকে করে তুলতে চাচ্ছি বড় বেশি রফতানিনির্ভর। যেটা ঠিক হচ্ছে না। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ রাউল প্রেবিশ (১৯০১-১৯৮৬) বলেনÑ একটা অনুন্নত কৃষিপ্রধান দেশ যদি একটা উন্নত শিল্পপ্রধান দেশের সাথে বাণিজ্য করে, তবে তাতে সব সময় কৃষিপ্রধান দেশটির তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে অনুন্নত দেশগুলোর উচিত হলো তার অভ্যন্তরীণ বাজার উন্নয়নে ব্রতী হওয়া। অভ্যন্তরীণ বাজার উন্নয়ন না করলে একটা দেশ কখনোই তার অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটাতে পারে না। সে হঠাৎ পড়তে পারে গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটেরই মধ্যে। রাউল প্রেবিশ ছিলেন আর্জেন্টিনার অধিবাসী। আর্জেন্টিনা একসময় ব্রিটেনে মাংস ও গম রফতানি করে প্রচুর আয় করে। কিন্তু ব্রিটেন একপর্যায়ে আর্জেন্টিনা থেকে মাংস ও গম আমদানি বন্ধ করে। শেষে সস্তায় মাংস ও গম কিনতে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ফলে আর্জেন্টিনার অর্থনীতি পড়ে বিরাট বিপর্যয়েরই মধ্যে। প্রেবিশ তাই প্রত্যেক জাতিকে বলেছেনÑ নিজের দেশের বাজারকে উন্নত করতে। তাতে কোনো দেশকে পড়তে হয় না হঠাৎ করে অর্থনৈতিক সঙ্কটে। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাচ্ছি রফতানিমুখীন অর্থনীতিকে নির্ভর করে। আমরা চাচ্ছি বিদেশীরা আমাদের দেশে পুঁজি লগ্নি করুক। কিন্তু বিদেশী পুঁজি গ্রহণ করাতেও থাকে অনেক বিপত্তি। বিদেশীরা এসে একটা দেশের জায়গা দখল করে। সস্তা কাঁচামাল ও শ্রমশক্তি ব্যবহার করে। একটা দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি গিয়ে পড়তে চায় বিদেশের নিয়ন্ত্রণে। বিদেশী পুঁজি নিয়োগের ফলে কোনো দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে উন্নতিটুকু ঘটে তার ফল বিদেশীরাই ভোগ করে বেশি; যে দেশে বিদেশীরা পুঁজি খাটায় সে দেশের মানুষেরা নয়। আমরা একদিন সাবেক পাকিস্তান আমলে বলেছিÑ পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতিরা আমাদের শোষণ করছে। কিন্তু এখন আমরা চাচ্ছি বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার চাচ্ছে ভারতীয় পুঁজির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে। কিন্তু এটা হতে পারে আমাদের জন্য মারাত্মক তির কারণ। ব্রিটিশ শাসনামলে মাড়োয়ারি পুঁজি কব্জা করে ফেলেছিল তখনকার বাংলার অর্থনীতিকে। আবার ফিরে আসতে পারে সেই একই অবস্থা। বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগে আমাদের তাই হতে হবে যথেষ্ট সাবধান। ব্রিটিশ শাসনামলে তখনকার বাংলার পাট নিয়ে ব্যবসা করে ধনী হয়েছে ব্রিটিশ ইহুদি র্যালি কোম্পানি। পরে এ ব্যবসায় ধনী হয় মাড়োয়ারিরা রাজস্থান থেকে বাংলায় এসে। এই ইতিহাস মনে রাখারই মতো। পাট অবশ্য আগের মতো অর্থকারী ফসল নয়। কিন্তু তবু বাংলাদেশে পুঁজি বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারে বিদেশীরা। আর আমরা ব্যবসায়-বাণিজ্যে হারাতে পারি আমাদের নিয়ন্ত্রণ। আমরা পাকিস্তান আমলে আদমজী, ইস্পাহানী, দাদা, সাহাগলদের পছন্দ করিনি। আওয়ামী লীগ তুলেছে ছয় দফা। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে অনুপ্রবিষ্ট হতে দিতে চাচ্ছে ভারতীয় পুঁজিকে। আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির বিরোধ কেবল কেয়ারটেকার সরকার নিয়ে নয়। এই বিরোধের মূল হলো আরো গভীরে প্রথিত। আমাদের সেটা উপলব্ধি করতে হবে।

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ