কোন দেশে কেমন সরকার হবে, সেটা অনেকটা নির্ভর করে সে দেশের মানুষের রাজনৈতিক চেতনার ওপর, যাকে আরেক কথায় বলে ‘জনমত’। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের অনুকূল জনমত আছে। আমরা ভোটের রাজনীতির ধারণা লাভ করেছি ব্রিটিশ শাসনামলে। কিন্তু বর্তমানে যা নেই, তা হলো গণতন্ত্রের পক্ষে এই জনমতকে সুগঠিত করার মতো রাজনৈতিক দল। ভোটে কারচুপি হতে পারল, তার একটা বড় কারণ, কারচুপি রোধের উপযোগী রাজনৈতিক দলের অভাব। বিএনপি যত না একটা রাজনৈতিক দল, তার থেকে হয়ে উঠেছে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদানকারী দল। তারা বলেছিলেন, তারা ভোটকেন্দ্র পাহারা দেবেন; কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায়নি। এ জন্যই হতে পেরেছে ভোটে এত বড় কারচুপি। না হলে ভোটে হয়তো কারচুপি হতো, তবে এত বড় কারচুপি হতে পারত না। ভোটে যে কারচুপি হয়েছে সেটি কেবল আমরা বলছি না, সারা দুনিয়াই বলছে।
The New York Times- একটা জগৎখ্যাত পত্রিকা। এর সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে মন্তব্য করা হয়েছে ‘Bangladesh’s Farcical Vote : Prime Minister Sheikh Hasina probably didn’t need to cheat to win re-election. So why did she? (The New York Times,14 January 2019)” বিশ্ব জনমত গঠনে The New York Times-এর অভিমত নিশ্চয়ই বিরাট প্রভাব ফেলবে। শেখ হাসিনা বলছেন, তার লক্ষ্য হবে দুর্নীতি দমন। কিন্তু বিশ্ব জানল, তিনি বিরাট দুর্নীতির মাধ্যমেই আসলেন ক্ষমতায়। The New York Times-এর মতে, এবার নির্বাচন হয়েছে প্রহসনের নির্বাচন; যা প্রধানমন্ত্রী না করলেও পারতেন। পত্রিকার খবরে পড়লাম, কিছু বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। দাবি করেছেন, বাংলাদেশের এবারের নির্বাচনকে বাতিল করে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের। কিন্তু এ রকম কিছু করার এখতিয়ার জাতিসঙ্ঘের নেই। এটি একটি সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান নয়। অন্য দেশের ঘরোয়া রাজনীতিতে তারা হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।
তাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বাংলাদেশের নাগরিকদের করতে হবে বাংলাদেশেই। বাংলাদেশের মানুষকেই করতে হবে নিজ দেশে নিজেদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। জাতিসঙ্ঘের সিকিউরিটি কাউন্সিল বা নিরাপত্তা পরিষদ কোনো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তা সংরক্ষণের জন্য হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে আছে বৃহৎশক্তির ভেটো প্রদানের ক্ষমতা। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও চীন হলো বৃহৎশক্তি। এরা যদি কোনো প্রস্তাবে রাজি না হয়, নিরাপত্তা পরিষদ তা গ্রহণ করতে পারে না। এখন পরিস্থিতি যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রয়োজনে বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ কামনা করে, তবে চীন ও রাশিয়া তাতে ভেটো প্রদান করে প্রস্তাবটি নাকচ করে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র তাই কোনোভাবেই পারবে না ইউএন বা জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে আমাদের দেশে গণতন্ত্র স্থাপনে সাহায্য করতে; যদিও হয়তো বা তাদের প্রশাসন সেটি করতে ইচ্ছুক হয়।
মনে পড়ে, ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা। এ সময়, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ৫ ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বন্ধের জন্য প্রস্তাব উঠায়, কিন্তু রাশিয়া এতে প্রদান করে ভেটো। ফলে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। পরে যুক্তরাষ্ট্র ৭ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব পেশ করেছিল। প্রস্তাবটি বিপুল ভোটে পাস হয়; কিন্তু ভারত তা মেনে নিতে চায়নি। ভারতের এই মনোভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুব্ধ করেছিল। তারা সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর। যুক্তরাষ্ট্র আভাস দেয় যে, যদি ভারত যুদ্ধ বন্ধ না করে তবে সপ্তম নৌবহর চট্টগ্রাম বন্দর দখল করবে এবং মার্কিন মেরিন সৈন্য সেখানে অবতরণ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধরে নেবে, পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অংশ। আর তা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত।
১৪ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আরেকটি প্রস্তাব উঠায়। কিন্তু এ প্রস্তাবও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রদান করে বাতিল করে দেয়। এ দিকে, সপ্তম নৌবহর এগিয়ে আসতে থাকে চট্টগ্রামের দিকে, যা ভারতকে বিশেষভাবে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। ভারত নেপথ্যে রাজি হয় যুদ্ধবিরতিতে। ঠিক হয় ভারত পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্যকে ভারতে বন্দী করে নিয়ে যাবে। আর পরে ছেড়ে দেবে পাকিস্তানের সাথে বিশেষ চুক্তি করে। অন্য দিকে, ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারত তার সব সৈন্যকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেবে এবং আসতে দেবে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ২৪ হাজার বাংলাভাষী সৈন্যকে। আমরা এখন জানি, এই সৈন্যরা ছিল রুশ-ভারতবিদ্বেষী।
অনেকের মতে, এদের সমর্থনে সম্ভব হতে পেরেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থান। মার্কিন সমর্থন বিশেষভাবেই নিয়ন্ত্রিত করেছিল বাংলাদেশে ইতিহাসের ধারা। না হলে ইতিহাস যে ভিন্নরূপ নিত, সে বিষয়ে সহজেই অনুমান করা চলে। বর্তমানে বাংলাদেশ যে পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছে, তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবার একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হওয়া অসম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেন একত্রে চীন মহাসাগরে করছে নৌ-মহড়া। ব্রিটেন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চাইতে পারে না, বঙ্গোপসাগর চীনের কর্তৃত্বে চলে যাক। এর একটা বড় কারণ হলো, এ রকম কিছু ঘটলে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের নিরাপত্তা চীন কর্তৃক হবে বিপন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন উভয়ের এটা কাম্য নয়। বিশ্বে এখন গড়ে উঠতে চাচ্ছে একটা ইংরেজি ভাষাভাষী ঐক্যজোট। আর এককথায় এটাকে বলা যায় অ্যাংলো-স্যাক্সন (Anglo-Saxons) সাংস্কৃতিক জোট।
১৯৭১ সালের পরিস্থিতি ছিল বেশ কিছুটা ভিন্ন এখনকার চেয়ে। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটা বিরাট শক্তি। আজ রাশিয়া যদিও একটা বিরাট শক্তি, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো নয়। ভারত ও রাশিয়া এখনো সামরিক দিক থেকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি। ভারতের কাছে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র বিক্রি করছে রাশিয়া। তবুও রাশিয়ার সাথে ভারতের কোনো মৈত্রী চুক্তি নেই। ইন্দিরা গান্ধী বিশেষভাবে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে। শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এর অনেক কিছুই দেন বাতিল করে, যা ইন্দিরা গান্ধীকে করেছিল বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ।
ইন্দিরা গান্ধী তার ‘My Truth’ বইতে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন : ‘তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত ভাবপ্রবণ, উষ্ণ হৃদয়ের লোক, যিনি একজন আইনপ্রণেতার চেয়ে পিতৃসুলভ ব্যক্তিত্বের বেশি অধিকারী ছিলেন। উপরন্তু তিনি সংগ্রামের বেশির ভাগ সময় দূরে অবস্থান করেছিলেন। আমি বলতে চাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধ, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয় তার চিন্তাধারা, জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বতন্ত্র ছিল, যারা এসব বিষয়ে অংশ নিয়েছিলেন। আমি মনে করি না যে, তিনি তাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু তারা তার প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। তাই তারা যা কিছু করেছিলেন, তার (মুজিব) নামে ও তার জন্য করেছিলেন। কিন্তু তিনি এসব লোকের গুরুত্ব দেননি, বরং তাদের গুরুত্ব দিয়েছিলেন যারা তার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল। এতে একটি প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল।’ (আমার সত্যকথন, বাংলা অনুবাদ : স্কোয়াড্রন লিডার (অব:) মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ঢাকা, গ্রন্থমেলা ২০১০, পৃ. ১৬২)।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে ভারতে যাননি। তিনি ঠিক কী চেয়েছিলেন, সেটা আজো পরিষ্কার নয়। তবে তিনি যে ভারতের সাথে কোনো ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’য় (Subsidiary Alliance) আবদ্ধ হতে চাননি, সেটি নিশ্চিত। তাজউদ্দীন আহমদ চুক্তি করেছিলেন যে, বাংলাদেশের কোনো স্বতন্ত্র সেনাবাহিনী থাকবে না। থাকবে কেবল মিলিশিয়া এবং বাংলাদেশকে তার পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের সময় ভারতের সাথে আলোচনা করতে হবে। কিন্তু শেখ মুজিব এর কোনোটি চাননি মেনে নিতে। তাই ইন্দিরা গান্ধী হয়েছিলেন তার প্রতি খুবই ক্ষুব্ধ। এ কারণে মনে হয়, সম্ভবত তিনিও চাচ্ছিলেন না শেখ মুজিব ক্ষমতায় থাকুন।
যা হোক, শেখ হাসিনার নীতি সম্পর্কে আমরা ঠিক অনুমান করতে পারছি না। মনে হচ্ছে, তিনি ভারত ও চীনের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে আগ্রহী। তাই তিনি ভারতের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও চীনের কাছ থেকে কিনেছেন দু’টি সাবমেরিন। তিনি চীন ও ভারতের মধ্যে কতটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে পারবেন, আমরা তা জানি না। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে খুবই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে। বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যা কেবল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নয়, জটিল পররাষ্ট্রনীতিরও সমস্যা। সেটি মনে রাখতে হবে। কারণ, বাংলাদেশে ভৌগোলিক অবস্থা এমন, দেশটি একদিন হয়ে পড়তে পারে জটিল সংঘাতক্ষেত্র।
যেমন- পরপর দু’টি মহাযুদ্ধে ইউরোপে বেলজিয়াম হয়ে পড়েছিল ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে । এ দিকে, মিয়ানমার থেকে আসছে দলে দলে রোহিঙ্গা। নিকট ভবিষ্যতে ভারতের আসাম প্রদেশ থেকে আসতে বাধ্য হতে পারে ১৩ লাখ বাংলাভাষী মুসলমান। এসব সমস্যার কথা না ভেবে কেবলই ‘গণতন্ত্র, গণতন্ত্র’ বলে ধ্বনি তোলা হবে ভুল। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করতে হবে বিশ্বরাজনীতির পটভূমিকায়। তবে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাও মনে রাখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না- এর দায়দায়িত্ব কেবলই আমাদের, যা জাতিসঙ্ঘ বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নয়।
প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে, দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায়।