ইতিহাসের ধারায় আরাকান-বাংলাদেশ সম্পর্ক

যে দেশটাকে আমরা এখনো বাংলায় সাধারণভাবে ডাকি আরাকান (বর্তমান নাম রাখাইন) তাকে ফারসিতে বলা হতো AviLO। আবুল ফজল তার আইন–ই–আকবরীতে আরখঙ সম্পর্কে লিখেছেন : সুবে বাঙ্গালহ–ও দক্ষিণ–পূর্বে হলো AviLO রাজ্য। এই রাজ্যে অনেক হাতি পাওয়া যায়। কিন্তু অশ্ব খুবই মহার্ঘ। গাধা ও উট এখানে চড়া দামে বিক্রি হয়। এই রাজ্যে গরু ও মহিষ দেখা যায় না। এখানে মানুষ গাভী জাতীয় একপ্রকার প্রাণীর দুধ পান করে। এই দেশে মানুষ না হিন্দু, না মুসলমান। যমজ ভাতা ভগ্নীর মধ্যে এই দেশে বিবাহ প্রচলিত আছে। মাতা–পুত্র ব্যতীত আর সবার মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হতে পারে। এই দেশে লোকে তাদের পুরোহিতের (ওয়ালির) সম্পূর্ণ আজ্ঞাবহ। এখানে রাজপ্রাসাদে স্ত্রী লোক প্রহরীর কাজ করে। পুরুষ মানুষের মুখে দাড়ি হয় না।

ব্রিটিশ শাসনামলে আরাকান ছিল বর্মার একটি বিভাগ (Division)। এই বিভাগের ছিল চারটি জেলা। যথা : ১. আরাকান হিলট্রাক্টস, ২. আকিয়াব, ৩. সান্ডওয়ে ও ৪. কাউকপিউ। বর্তমানে আরাকান বা রাখাইন হলো মিয়ানমারের একটা প্রদেশ; বিভাগ আর নয়; কিন্তু বর্তমান আরাকান প্রদেশের আয়তন হলো আগের আরাকান বিভাগের চাইতে ছোট। এই ছোট হওয়ার কারণ, আরাকান হিলট্রাক্টসকে জুড়ে দেয়া হয়েছে মিয়ানমারের আরেকটা প্রদেশের সাথে। মিয়ানমার বর্তমানে সাতটা প্রদেশ (Constituent stats) এবং সাতটি বিভাগ নিয়ে গঠিত। এই সাতটি বিভাগে বাস করেন খাঁটি বর্মিভাষী জনসমষ্টি; কিন্তু আর সাতটি প্রদেশের মধ্যে ছয়টির জনসমষ্টির মাতৃভাষা বর্মি বা ম্রনমা নয়। আরাকান হলো এমন একটি প্রদেশ, যার মানুষের মাতৃভাষা খাঁটি বর্মি নয়; কিন্তু বর্মি ভাষার খুবই কাছাকাছি। একে বলতে হয় প্রাচীন বর্মি ভাষার অনুরূপ। অর্থাৎ আরাকান প্রদেশের অবস্থান ভাষাগত দিক থেকে বর্মি পরিবারভুক্ত হলেও বেশ কিছুটা ভিন্ন।

আরাকানের সব লোক মঙ্গল মানবধারার নয়। এখানে অনেক মানুষের চেহারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অনুরূপ। তাদের চোখ আয়ত, নাক সরল ও উন্নত, মাথার চুল মসৃণ। তাদের পুরুষের মুখে দাড়ি গোঁফের প্রাচুর্য থাকতে দেখা যায়। এদের মাথা প্রধানত মধ্যমাকৃতির; কিন্তু যাদের মনে করা হয় একান্তভাবেই আরাকানীয় তাদের মাথার আকৃতি গোল, চুল ঋজু, চোখের ওপর পাতায় থাকে বিশেষ ধরনের ভাঁজ। যে কারণে তাদের চোখ দেখে মনে হয় ছোট এবং বাঁকা। এদের গণ্ডের হাড় হয় উঁচু, যে কারণে এদের মুখমণ্ডল দেখে মনে হয় সমতল। পুরুষের মুখে দাড়িগোঁফের প্রাচুর্য থাকতে দেখা যায় না। এরা অনেক খর্বাকৃতির। মানবধারার দিক থেকে এদের বলা চলে, দক্ষিণ চীনের মঙ্গলধারার।

ভূগোলের দিক থেকে আরাকান বর্মার (ব্রহ্ম) মূল ভূখণ্ড থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন। বর্মা ও আরাকান পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণী দ্বারা। এই পর্বতশ্রেণীকে বলে আরাকান ওমা। এর মধ্য দিয়ে আছে তিনটি গিরিপথ। এই তিনটি গিরিপথের মধ্য দিয়ে কেবলমাত্র একটি দিয়ে বছরে সব সময় যাতায়াত করা চলে। অন্য দু’টির মধ্য দিয়ে বর্ষাকালে যাতায়াত করা কঠিন হয়ে পড়ে। বর্মার মূল ভূ–খণ্ডের সাথে আরাকানের যোগাযোগ ছিল সমুদ্রপথে। জাপান বর্মার মূল ভূখণ্ড দখল করে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে। বর্মার মূল ভূখণ্ড থেকে জাপানিরা ১৯৪২ সালে সমুদ্রপথে স্পিডবোটে এসে করেছিল সম্পূর্ণ আরাকান দখল। আরাকান থেকে স্থলপথে এসে পৌঁছেছিল চট্টগ্রামের মহেশখালী পর্যন্ত। তবে তারা মহেশখালী দখলে রাখতে পেরেছিল না। আরাকানসহ বর্মা জাপানের দখলে ছিল ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে আরাকানে যাওয়া ছিল সহজ। বাংলাদেশ থেকে মানুষ গিয়েছে আরাকানে। আবার আরাকান থেকে মানুষ এসেছে বাংলাদেশে। এটা ঘটেছে বহু যুগ ধরেই।

রোহিঙ্গা নামটির একটি বিশেষ ইতিহাস আছে। সংক্ষেপে তা হলো এই রকম : খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম ভাগে (১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি) নিম্ন ব্রহ্মের রাজা মেং–শো–আই আরাকান জয় করেন। আরাকানের রাজা মেং–শোআ মউন যুদ্ধে হেরে পালিয়ে যান গৌড়ের সুলতান জালাল–আল–দীন শাহ–এর কাছে। তিনি আরাকানের পরাজিত রাজাকে অনেক সৈন্য প্রদান করেন গৌড়ের এক সেনাপতির অধীনে, যাতে করে আরাকানের রাজা মেং–শোআ মউন বর্মা রাজাকে পরাজিত করে আবার আরাকানের রাজা হতে পারেন; কিন্তু গৌড়ের এই সেনাপতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। মেং–শোআ মউন আবার বন্দী হন বর্মার রাজার কাছে। অনেক কষ্টে আরাকানের পরাজিত রাজা আবার গৌড়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। এবার গৌড়ের সুলতান তাকে আর একজন সেনাপতির অধীনে আরো অনেক সৈন্য প্রদান করেন। এই সেনাপতি ও সৈন্যের সহযোগিতায় মেং–শোআ মউন যুদ্ধে জয়ী হন। তিনি আরাকানের নতুন রাজধানী গড়েন বাংলার সীমানার কাছে। এই রাজধানীর নাম দেন রোহং অথবা ম্রোহং। আরাকানের রাজা চান না গৌড়ের সৈন্য ফিরে যাক। গৌড়ের এসব মুসলমান সৈন্য থেকে যায় রাজধানী রোহং শহরে। এদেরই বংশধররা হলো রোহিঙ্গা। রোহং শহরকে বাংলা ভাষায় বলা হতে থাকে রোসাঙ্গ। একসময় রোসাঙ্গ আর আরাকানকে ডাকা হতে থাকে একই রোসাঙ্গ নামে। দৌলত কাজী তার সতী ময়নামতী লিখেছেন–

কর্ণফুলী নদী পূর্বে আছে এক পুরী।
রোসাঙ্গ নগরী নাম স্বর্গ অবতারী।।
তাহাতে মগধ বংশ ক্রমে বুদ্ধাচার।
নাম শ্রীসুধর্ম্মা রাজা ধর্ম্ম অবতার।।
প্রতাপে প্রভাত ভানু বিখ্যাত ভুবন।
পুত্রের সমান করে প্রজার পালন।।

আরাকানের রাজারা গৌড়ের সাথে যোগাযোগ রেখে চলতেন। তারা তাই বাংলা ভাষা শিখতেন। আরাকানের রাজসভায় এই জন্য হতে পেরেছে বাংলা সাহিত্যের চর্চা। দৌলত কাজী ছিলেন আরাকানের রাজসভার একজন খুবই খ্যাতনামা কবি। তিনি জন্মে ছিলেন চট্টগ্রামের অন্তর্গত বর্তমান রাওজান উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে। সেখান থেকে প্রথম যৌবনে তিনি চলে যান আরাকানে। এ সময় আরাকানের রাজা ছিলেন থিরি থুধর্মা (১৬২২–১৬৩৫ খ্রি. রাজত্বকাল)। যার বাংলা নাম দাঁড়ায়, শ্রীসুধর্ম্মা। শ্রীসুধর্ম্মার লস্কর উজির (প্রতিরক্ষামন্ত্রী) ছিলেন আশরাফ খান। আশরাফ খান ছিলেন চট্টগ্রামের বর্তমান উপজেলা হাটহাজারীর অন্তর্গত চারিয়া গ্রামের অধিবাসী। তিনি সেখান থেকে যান আরাকানে। তার সহায়তায় দৌলত কাজী আরাকানের রাজসভায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। দৌলত কাজী খ্যাত হয়ে আছেন সতী ময়নামতী নামক কাব্যগ্রন্থ রচনার জন্য। এটা তিনি রচনা করেন সাধন নামে উত্তর ভারতের একজন কবির লেখা কাব্য ময়না সৎ নামক কাব্যগ্রন্থের অনুসরণে। ময়না সৎ কাব্যগ্রন্থ লিখিত হয়েছে পূর্বী হিন্দিতে। দৌলত কাজী তার কাব্য শেষ করার আগেই হঠাৎ ইন্তেকাল করেন। তার এই কাব্য সমাপ্ত করেন কবি আলাওল বেশ কিছু দিন পরে। কবি আলাওলের একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের নাম পদ্মাবতী। এটি তিনি রচনা করেন মালিক মুহম্মদ জয়সি নামে উত্তর ভারতের একজন সুফি কবির লেখা পাদুমাবৎ নামক কাব্যগ্রন্থের ওপর নির্ভর করে। পদুমাবৎও লিখিত হয়েছিল পূর্বী হিন্দিতে।

বাংলা সাহিত্যের ওপর ফারসি সাহিত্যের প্রভাব পড়েছে। এই প্রভাব বহুদিন আগে থেকেই পড়তে আরম্ভ করে। তবে নতুন করে আবার পড়ে সম্রাট শাজাহানের পুত্র বাংলার সুবেদার সুজার আমলে। সুজা বাংলার সুবেদার ছিলেন প্রায় ২০ বছর (১৬৩৯–১৬৬০)। সুজা আরোঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার হাতে পরাজিত হয়ে আরাকানে প্রস্থান করেন। সুজার সময় সুবে বাংলার রাজধানী ছিল রাজমহল, যা এখন পড়েছে ভারতের ঝাড়খণ্ড প্রদেশে। আলাওল চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ ছিলেন না। ছিলেন ফরিদপুর অঞ্চলের (ফাতেহাবাদ) লোক। তিনি তার পিতার সাথে নৌপথে কোথাও যাওয়ার সময় পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাতে পড়েন। আলাওলের পিতা পর্তুগিজ জলদস্যুদের সাথে যুদ্ধাবস্থায় মারা যান। আলাওলকে পর্তুগিজ জলদস্যুরা ধরে এনে বিক্রি করেন আরাকানে।

আলাওল অনেকগুলো ভাষা জানতেন। বাংলা, উড়িয়া, ফারসি, আরবি, পূর্বী হিন্দি ও সংস্কৃত। আলাওল ফারসি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন হফত পয়কর ও সিকান্দর নামা। আলাওলের যেসব পুঁথি পাওয়া গিয়েছে, তা বাংলা অক্ষরে লিখিত নয়। সবই লিখিত আরবি–ফারসি অক্ষরে। আরাকানে সুজার সাথে আলাওলের বিশেষ সখ্যতা গড়ে ওঠে। আরাকানের রাজা সুজাকে হত্যা করেন। এই হত্যার একটি কারণ ছিল আরাকানের রাজা সুজার এক কন্যাকে বিবাহ করতে চান; কিন্তু সুজা রাজি হন না। সুজার সাথে সখ্যতার জন্য আলাওলকে পড়তে হয় আরাকানের রাজার কোপে। সুজার মৃত্যুর পর তার সৈন্যসামন্ত ও লোকজন সবাই থেকে যায় আরাকানে। রবীন্দ্রনাথ ডালিয়া বলে একটি ছোট গল্প লিখেছেন। যার বিষয়বস্তু হলো– সুজার কন্যার সাথে আরাকান রাজার প্রেম। তবে এটা ইতিহাসের নিরিখে সত্য নয়; কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, আরাকান রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আর কোনো লেখক আরাকান নিয়ে তার সময়ে এ রকম কিছু লিখেননি।

মগ বলতে ঠিক কাদের বোঝাত, তা জানা যায় না। চট্টগ্রামে মগ বলতে একদল বাংলাভাষীকেও বোঝায়। যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এই মগরা বলেন, তাদের পূর্বপুরুষ এসেছিল বিহারের মগধ থেকে। দৌলত কাজী বলেছেন, সুধর্ম্মার পূর্বপুরুষও ছিলেন মগধ থেকে আগত। সম্ভবত এরা পূর্বী হিন্দি সম্বন্ধেও ছিলেন অবগত। তাই আরাকানের রাজসভায় কাব্যচর্চা করতে যেয়ে পূর্বী হিন্দিতে লিখিত বইয়ের অনুবাদ করতে হয়েছেন সচেষ্ট। সাধারণভাবে বাংলাদেশে এখনো মগের মুল্লুক বলতে, লোকে বোঝে চরম অরাজক রাজত্ব। সম্ভাবত মগদের একাংশ পর্তুগিজ জলদস্যুদের সংশ্রবে এসে হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর প্রকৃতির দস্যু। এই দস্যুদের সমূলে ধ্বংস করতে সক্ষম হন আরোঙ্গজেব কর্তৃক নিযুক্ত সুবেদার শায়েস্তা খান।

আরাকান আগে বর্মার অংশ ছিল না। আরাকান বর্মার বিশেষ অংশ হয়ে ওঠে ব্রিটিশ শাসনামলে। যখন একে ব্রহ্মদেশের সাথে একটি বিভাগ হিসেবে যুক্ত করা হয়; কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলেও চট্টগ্রাম থেকে বহু মানুষ গিয়েছেন আরাকানে চাকরি করতে। বিশেষ করে পুলিশ ও শিক্ষা বিভাগে। এ ছাড়া হয়েছেন নৌপথে চলাচলকারী মোটর–বোটের সারেং ও মাঝি–মাল্লা। ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে আরাকানের আকিয়াব বন্দর পর্যন্ত রেল স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল; কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেটা সম্ভব হয়েছিল না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিছু ঘটনা আজকের রোহিঙ্গা সমস্যা বিশ্লেষণে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। জাপান বর্মাকে খুব সহজেই দখল করতে পেরেছিল। এর কারণ, কেবলই সামরিক কৌশল ছিল না। জাপান এ সময় বলেছিল, এশিয়া শাসিত হতে হবে এশীয়বাসীর দ্বারা। জাপান এশীয়। জাপানিরা ছিলেন ধর্মের দিক থেকে অনেকেই বৌদ্ধ। জাপান বলে, এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে তারা সহযোগিতা সৃষ্টি করতে চায়, যা এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রকে করে তুলবে সমসমৃদ্ধ। এর একটা প্রভাব পড়েছিল বর্মার মানুষের ওপর। তারা সহযোগিতা করেছিল জাপানের। বর্মার প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল দোবামা আসিওরে। এরা প্রথমে নেয় জাপানের পক্ষ। এরা আওয়াজ তোলে বর্মা হতে হবে বর্মিদের জন্য। এরা ছিল বিশেষভাবেই বর্মি জাতীয়তাবাদী।

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে প্রায় দশ লাখ মানুষ সমুদ্রপথে বর্মায় গিয়েছিলেন, ব্যবসা–বাণিজ্য করতে। এরা অনেকেই বর্মায় নিয়োজিত হয়েছিলেন অসাধু ব্যবসা–বাণিজ্যে। ঠকিয়েছিলেন বর্মিদের। বর্মি জাতীয়তাবাদ তাই কেবল ব্রিটিশবিরোধী ছিল না, ভারতবিরোধীও ছিল। যুদ্ধের সময় বর্মা ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল এইসব ভারতীয়দের। আরাকানে এ সময় মুসলমানরা জাপানের পক্ষ নিতে চাননি। জাপানিরা বৌদ্ধ। জাপানিরা আরাকানি বৌদ্ধদের যেভাবে সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করবে, তারা মনে করেন মুসলমানদের জাপানিরা সে রকম করবে না। এ সময় ব্রিটিশ শাসকেরা প্রতিশ্রুতি প্রদান করে, তারা উত্তর আরাকানকে একটা আলাদা প্রদেশ করবে।

উত্তর আরাকান মুসলিম প্রধান। কেবল তাই নয়, উত্তর আরাকানের বেশির ভাগ লোক দেখতে বাংলাদেশের অধিবাসীর মতো। উত্তর আরাকানে হাটেবাজারে চলতো চট্টগ্রামের বাংলাভাষা, আরাকানি ভাষা নয়। ১৯৪৬ সালে গঠিত হয় আরাকান মুসলিম লীগ। এরা তোলে আরাকানকে বিভক্ত করার দাবি; কিন্তু আরাকান মুসলিম লীগের এই দাবি জিন্নাহ সাহেব সমর্থন করেন না। তিনি বলেন, বর্মা এখন একটা পৃথক দেশ। আরাকানে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি তুললে ভারতে পাকিস্তান আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আসলে আরাকান মুসলিম লীগ কখনই আরাকানভিত্তিক একটি দল ছিল না। ছিল চট্টগ্রামভিত্তিক একটা দল, যাতে নেতৃত্ব দিতেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। যিনি ছিলেন চট্টগ্রাম শহরের লোক। আরাকানি মুসলিম লীগ কোনো দিনই আরাকানে সাড়া জাগাতে পারে না।

১৯৪৮ সালে বর্মা স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরপর আরাকানি মুসলমানদের একাংশ কাশেম রাজার নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেন; কিন্তু এদের সংখ্যা খুব উল্লেখযোগ্য ছিল না। কাশেম রাজা পেশায় ছিলেন ধীবর। তিনি এক সময় সমুদ্রে মৎস্য শিকার করতেন; কিন্তু তিনি ছিলেন ভালো সংগঠক ও নেতৃত্ব গুণে গুণান্বিত। ফলে হয়ে উঠতে পারেন একজন বিশিষ্ট নেতা। তিনি গড়ে তোলেন মুসলিম মুজাহিদ বাহিনী। কাশেম রাজা পাকিস্তানের কাছে সাহায্য চান; কিন্তু পান না। কাশেম রাজা ১৯৫৪ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এসে ধরা পড়েন ও কারারুদ্ধ হন। আরাকানে মুসলিম মুজাহিদরা হয়ে পড়েন শক্তিহীন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব চান না বর্মার সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কে জটিলতার সৃষ্টি হোক। নাফ নদীর ওপারে ৫ মাইল জায়গা নিয়ে বর্মার সাথে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। আইউব সেটা বর্মাকে ছেড়ে দিয়ে সীমান্ত সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসেন।

বর্মা স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে আরাকানিরা স্বাধীন হতে চেয়েছিল; কেবলই আরাকানের মুসলমানরাই নয়। কিন্তু আরাকানের মোট জনসংখ্যা শতকরা ৩৫ ভাগ মানুষ হলো মুসলমান। জেনারেল নে উইন ১৯৫৮ সালে বর্মায় ক্ষমতায় আসেন। তিনি ছিলেন কঠোর বর্মি জাতীয়তাবাদী। তিনি মনে করেন আরাকানে রোহিঙ্গাদের প্রভাব প্রতিপত্তি কমাতে না পারলে ভবিষ্যতে আরাকান একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যেতে পারে। তার সময় থেকেই শুরু হয় রোহিঙ্গা নির্যাতন। যাতে করে রোহিঙ্গারা আরাকান ছেড়ে পাকিস্তানে চলে আসতে চায়। আজ যে সমস্যা আরাকানে সৃষ্টি হয়েছে, তার মূলে আছে উগ্র বর্মি জাতীয়তাবাদ। রোহিঙ্গাদের ওপর আজ যে জঘন্য নির্যাতন হচ্ছে সেটা করছে মিয়ানমার মূল ভূখণ্ড থেকে আসা বর্মি সৈন্যরা। এর মূলে আছে উগ্র বর্মি জাতীয়তাবাদ, যার উদ্ভব হয়েছে বর্মার মূল ভূখণ্ডে, আরাকানে নয়।

আরাকানে যা ঘটছে, তা ঘটতে পারার একটা কারণ হলো বাংলাদেশ একটা যথেষ্ট সবল রাষ্ট্র নয়। সবল রাষ্ট্র হলে বর্মার সৈন্যরা রোহিঙ্গাদের ওপর এ রকম অত্যাচার করতে কখনো এতটা সাহসী হতো না। বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের কাছে আবেদন জানাচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বহু মুসলমানের বাস। আমাদের চেষ্টা হওয়া উচিত এই দু’টি দেশের জনমতকে বিশেষভাবে পক্ষে পাওয়া। কেননা, এই দু’টি দেশ যদি বর্মার ওপর রোহিঙ্গা নিপীড়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করে তবে তা কার্যকর হবে সবচেয়ে বেশি। তবে একান্তই যদি দেখা যায় যে, রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার বন্ধ হচ্ছে না, তবে মনে হয় শেষ পর্যন্ত উচিত হবে রোহিঙ্গাদের স্বাধিকারের জন্য সব ধরণের সাহায্য প্রদান করা। রোহিঙ্গারা যদি হাতে অস্ত্র পান, তবে লড়াই করে তারা তাদের নিজেদের দাবি–দাবাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন বলে মনে করার কারণ আছে। কেননা, মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডে কারেন, শান, কাচিন প্রভৃতি জাতি তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। বর্মি বাহিনী খুব যে সুবিধার মধ্যে আছে, তা কিন্তু নয়। রোহিঙ্গাদের দমন করার জন্য মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার যদি অধিক সৈন্য পাঠাতে বাধ্য হয়, তবে মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডে অন্য জাতিসত্তাদের সংগ্রাম আরো জোরালো হবে। ফলে মিয়ানমারের সরকারকে পড়তে হবে যথেষ্ট জটিলতায়। মিয়ানমারের সাতটি প্রদেশেই আছে কম বেশি বিচ্ছিন্নতাবাদী তথা স্বাধীনতাকামী প্রবণতা। আজকের মিয়ানমার হলো ব্রিটিশ শাসনের ফল। কোনো খাঁটি বর্মি রাজা এত বড় অঞ্চলকে কখনো শাসন করতে পারেননি।

লেখাটি প্রকাশিত হয় দৈনিক নয়া দিগন্তে, ০২ ডিসেম্বর ২০১৬ এ। 

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ