উপজাতি নিয়ে রাজনীতি

agsamad.com
The CHT Peace Accord was signed on December 2, 1997. agsamad.com

ব্রিটিশ শাসনামলে আদম শুমারের আরম্ভ ১৮৭১ সাল থেকে। আদম শুমারের রিপোর্টে কেবল উপমহাদেশের লোকজনের হিসাবই থাকত না, থাকত এই উপমহাদেশের মানুষ সম্বন্ধে বহু তথ্য। যাদের আমরা সাধারণভাবে উল্লেখ করি ‘উপজাতি’ হিসেবে, তাদের আদম শুমারের রিপোর্টে প্রথম দিকে উল্লেখ করা হতো অ্যানিমিস্ট (Animist) বা আত্মা-উপাসক হিসেবে। পরে ১৯৩১ সালের আদম শুমারের রিপোর্টে যাদের একসময় বলা হতো অ্যানিমিস্ট বা আত্মপূজারী তাদের উল্লেখ করা হয় ট্রাইব (Tribe) হিসেবে। (Kingsley Davis; The Population of India and Pakistan, Prenceton University Press. 1951)। ‘ট্রাইব’ কথাটার বাংলা করা হয় উপজাতি। ‘উপজাতি’ বলতে বোঝানো হয় এমন জনগোষ্ঠীকে, যারা বাস করে প্রধানত অরণ্যে, যাদের জীবনধারা হয়ে আছে আদিম যুগের মতো। এরা অনেকে হলো আহার্য আহরক (Food gathered), আবার কেউ হলো কিছুটা আহার্য উৎপাদক (Food Product)। যারা আহার্য আহরক, তারা বনজঙ্গলে ফলমূল আহরণ ও পশুপাখি শিকার করে খায়। যারা কিছুটা আহার্য উৎপাদক তারা মাটিতে ফসল উৎপাদন করে; মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বীজ বপন করে। কিন্তু এরা প্রকৃত খাদ্য উৎপাদকদের মতো লাঙল দিয়ে চাষাবাদ করতে জানে না। তাদের চার পাশের জনসমষ্টি হলো খাদ্য উৎপাদক; যারা লাঙল দিয়ে চাষ করে এবং গবাদি পশু পালন করে, যাদের আছে একটা লিখিত ভাষা, যারা গড়ে তুলতে সম হয়েছে নগরজীবন বা সভ্যতা।

ব্রিটিশ আমলে এ দেশের মানুষকে নিয়ে নৃতাত্ত্বিকরা যে গবেষণা করেছেন তাতে ট্রাইব কথাটার প্রয়োগ সবক্ষেত্রে হতে পারেনি সুস্পষ্ট। বর্তমানে নৃতাত্ত্বিকরা অনেকেই চাচ্ছেন না আর ‘ট্রাইব’ শব্দটা ব্যবহার করতে। কারণ শব্দটা হয়ে উঠেছে একাধিক অর্থবহ। ইংরেজি ভাষায় Aborigines শব্দটা এসেছে ল্যাটিন ভাষা থেকে। ল্যাটিন ভাষার অন মানে হলো প্রথম আর origine শব্দের অর্থ হলো আরম্ভ। Aborigine বলতে বোঝায় এমন মানুষদের, যারা কোনো দেশে আগে থেকে আছে; যেমন অস্ট্রেলিয়ার কালো মানুষেরা। ইউরোপ থেকে সাদা মানুষ ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে উপনিবিষ্ট হতে আরম্ভ করে। অস্ট্রেলিয়ার কালো মানুষকে তাই বলতে হয় অস্ট্রেলিয়ার Aborigine। অস্ট্রেলিয়ার Aborigine-রা পড়েছিল প্রাচীন প্রস্তর যুগের সংস্কৃতিতে। নিউজিল্যান্ডে অ্যাবরিজিন বলতে বোঝায় মাওরিদের। মাওরিরা পড়েছিল নব্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির অবস্থায়। মাওরিদের বলা যায় নিউজিল্যান্ডের অ্যাবরিজিন। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেড ইন্ডিয়ান মানব সমষ্টিকে বলা যেতে পারে সেখানকার অ্যাবরিজিন।

অ্যাবরিজিন শব্দটার বাংলা করা হয় আদিম নিবাসী অথবা আদিবাসী। এই অর্থে বাংলাদেশে বৃহত্তর জনসমাজকে ধরতে হয় আদিবাসী। কারণ তারা বাইরে থেকে ইউরোপীয়দের মতো এসে এ দেশ অধিকার করেনি। তারা এ দেশেরই ভূমিজ সন্তান। এই দাবির পেছনে এখন দেয়া চলে মাটি খুঁড়ে পাওয়া প্রভূত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ। এক্ষেত্রে দু’টি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচ্য। একটি হলো আদিম যুগ; আর একটি বিষয় হলো আদিম সংস্কৃতি। আদিম যুগে সব মানুষের পূর্বপুরুষই ব্যবহার করেছে প্রস্তর অস্ত্র। কিন্তু পরে কিছু মানুষ আরম্ভ করেছে ধাতু দিয়ে তৈরী অস্ত্র ও জিনিসপত্রের ব্যবহার। গড়ে তুলছে সভ্যতা বা নগরজীবন। কিন্তু অনেক জনসমষ্টি থেকে গেছে সংস্কৃতির দিক থেকে প্রস্তর যুুগের জীবনধারায়। সংস্কৃৃতির দিক থেকে এদের আদিম বলা গেলেও সময়ের বিচারে এদের আদিম বলা যায় না। নিউজিল্যান্ডের মাওরিরা যখন পড়েছিল নব্য প্রস্তর যুুগের সংস্কৃতিতে, তখন ইউরোপের মানুষ ব্যবহার করছিল লোহা দিয়ে তৈরী অস্ত্রশস্ত্র ও জিনিসপত্র। যদিও একসময় ইউরোপের মানুষও কোনো ধাতুর ব্যবহার জানত না, করত প্রস্তর অস্ত্রের ব্যবহার। ইউরোপের অনেক জায়গার মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে প্রাচীন নব্য প্রস্তর যুগের অস্ত্র। কিন্তু বাংলাভাষায় এখন সময়ের দিক থেকে আদিম আর সংস্কৃতির দিক থেকে আদিম এই দু’টি ধারণার মধ্যে পার্থক্য করা হচ্ছে না। ফলে দেখা দিচ্ছে সমস্যা।

বাংলাদেশের অনেক জায়গায় প্রস্তর যুগের হাতিয়ার পাওয়া গেছে। কিন্তু তাদের পাওয়া গেছে মাটির খুব উপরিভাগে। তাই বলতে হয় তাদের বয়সকাল বেশি নয়। এসব অস্ত্র যারা ব্যবহার করেছে, তারা সংস্কৃতির দিক থেকে আদিম হলেও সময়ের বিচারে আদিম নয়। কেন, কিছু মানুষ বনজঙ্গলে প্রাচীন সংস্কৃতিকে আঁকড়ে থাকল আর অন্য মানুষ সৃষ্টি করল সভ্যতা, তার উত্তর এখনো দেয়া যায় না। তবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যেসব মানুষ এখনো প্রস্তর যুগে পড়ে আছে বা কিছুদিন আগেও ছিল, তাদের মনোভাব হলো খুবই রক্ষণশীল। তারা সহজেই নতুন কিছুকে গ্রহণ করতে চায় না। অনুসরণ করতে চায় গতানুগতিক জীবনকে। অর্থাৎ তাদের অনগ্রসরতার একটা কারণ, তাদের রক্ষণশীল মনোভাব। কিন্তু সবক্ষেত্রে এ কথা খাটে না।

বরফের দেশে মানুষ ধাতু দিয়ে অস্ত্র না বানিয়ে অস্ত্র বানিয়েছে পশুর হাড় দিয়ে। কারণ ধাতুদ্রব্য সেখানে সহজলভ্য নয়। সম্ভব নয় সেভাবে আগুন জ্বেলে ধাতু গলানো। অর্থাৎ মানুষের জীবনকে বেশ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে তার প্রাকৃতিক পরিবেশ। সব প্রাকৃতিক পরিবেশের মানুষের সাংস্কৃতিক অগ্রগতি তাই সমভাবে হতে পারে না। অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীরা পশু পালন জানত না। এর কারণ সেখানে ছিল না পালনযোগ্য কোনো পশু। একেকটি সভ্যতা গড়ে উঠেছে একেকটি সময়কে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের বাংলাভাষী মানুষের পূর্বপুরুষ ধান চাষ করেছে বহুদিন আগে থেকে। বাংলাদেশে খাল-বিলের ধারে যথেষ্ট বুনোধান দেখা যায়। এই বুনোধান থেকে বাছাই করে তারা করতে পেরেছে আবাদযোগ্য ধানের উদ্ভব।

বাংলাদেশের মানুষ নৌকা বানিয়েছে। নৌকায় করে সে নানা জায়গায় নদীপথে আসা-যাওয়া করেছে। কেবল যে সে নৌকাযোগে নদীপথে যাতায়াত করেছে তা-ই নয়, বড় বড় নৌকা বানিয়ে করেছে সমুদ্রযাত্রা। করেছে বিদেশের সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্য। গড়েছে সভ্যতা বা নগর সংস্কৃতি। এটা তারা করতে পরেছে আপন চেষ্টায়। বাংলাদেশের মাটিতে তারা গড়েছে উন্নত সভ্যতা, এ দেশের ভূমিজ সন্তান হিসেবে। তারা থাকেনি প্রাচীন জীবন প্রণালীকে আঁকড়ে। কিন্তু এই ইতিহাসকে এখন যেন বিকৃত করার চেষ্টা চলছে। প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে সাঁওতাল ও চাকমাদের মতো উপজাতি হলো এ দেশের আদিবাসী, কিন্তু বাংলাদেশের মূল জনসমাজ তা নয়। সেটাকে সমর্থন করা যায় না। উপজাতি নিয়ে করা হচ্ছে বিশেষ ধরনের রাজনীতি, যা হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ তির কারণ। সেটাকে আমরা দেশের স্বার্থে হতে দিতে পারি না।

সম্প্রতি ভারতের একসময়ের পররাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারি ছিলেন মুচকন্দ দুবে। তিনি ভারতে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম Indian’s Foreign Policy। সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ (Nation; সেপ্টেম্বর, ২০১২), এই বইতে দুবে বলেছেন, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক উন্নত হতে পারেনি। শ্রীলঙ্কার সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটার কারণ হলো, শ্রীলঙ্কার তামিল গেরিলাদের সাথে ভারতের যোগাযোগ। ভারত শ্রীলঙ্কার তামিল নেতা প্রভাকরণকে তার সংগ্রামে প্রণোদনা প্রদান করেছিল। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের একটা কারণ হলো, ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধীনতাকামী চাকমাদের ভারতে আশ্রয় প্রদান। তার এই বই পড়ে উপলব্ধি করা যায়, চাকমা নেতা সন্তু লারমার প্রকৃত শক্তির উৎস হচ্ছে ভারত। ভারত ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের তথাকথিত উপজাতিদের নিয়ে করতে পারে বিশেষ রাজনীতি।

পরিস্থিতি নানা দিক থেকেই জটিল হচ্ছে। ভারতের আসামে বোড়োদের একসময় বলা হতো উপজাতি। কিন্তু এখন তারা হতে চলেছে একটা পৃথক জাতি। এরা আসামে বাংলাভাষী মুসলমানদের ওপর করছে হামলা। কেন এরা এরকম হামলা করছে, তার প্রকৃত কারণ আমরা জানি না। কারণ আসামে বসবাসকারী বাংলাভাষী মুসলমানরা বোড়োদের দাবির বিরোধী ছিল না। সারা আসাম প্রদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩০ ভাগ হলো বাংলাভাষী মুসলমান। এরা সে দেশে বাস করছে বহুকাল ধরে। বরাবরই আসামের ধুবড়ি-গোয়ালপাড়া অঞ্চলের মানুষের সাধারণ ভাষা হলো বাংলা। আসামের কাছাড় (শিলচর) অঞ্চলের মানুষের সাধারণ ভাষা হলো বাংলা। যাকে বলে প্রকৃত আসামী ভাষা, যা এখন হলো আসামের প্রাদেশিক সরকারের সরকারি ভাষা, তার উদ্ভব হয়েছে আসামের শিবসাগর ও ডিব্র“গড় জেলায়। আসামী ভাষা বাংলাভাষার খুব কাছের। বাংলাভাষা মানুষের পক্ষে শেখা মোটেই কঠিন নয়।

আসামের বাংলাভাষী মুসলমান আসামী ভাষাকে আয়ত্ত করে নিয়েছে মাতৃভাষার মতোই। কিন্তু বোড়োদের ভাষা হলো তিব্বতি ভাষার মতো। তার সাথে আসামী ও বাংলা ভাষার ব্যবধানটা যথেষ্ট বড়। তাই সম্ভবত বোরোদের সাথে সৃষ্টি হতে পারছে আসামের বাংলাভাষী মুসলমানদের বিরোধ। বোড়োরা বলছে বাংলাভাষী মুসলমান আসলে হলো বাংলাদেশী। তাই আসামে বাস করার কোনো অধিকার তাদের নেই। তাদের চলে যেতে হবে বাংলাদেশে। অথচ ভারত সরকারের সাথে বাংলাদেশের চুক্তি হয়েছিল এ মর্মে, ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসের আগে যারা বাংলাদেশ (পূর্বপাকিস্তান) থেকে আসামে গিয়েছে তাদের ধরতে হবে ভারতের নাগরিক। এর পরে যারা বাংলাদেশ থেকে আসামে গিয়েছে তারা যদি সে দেশে একটানা দশ বছরের বেশি থেকে থাকে, তবে তারা পেতে পারবে ভারতের নাগরিকত্ব। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পরে যারা আসামে গিয়েছে কেবল তাদেরই ‘বাংলাদেশী’ বলে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যাবে। (Outlook, 3 September 2012)।

বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে সব মুসলমান বাংলাদেশী নয়। কিন্তু ভারতে এখন মহলবিশেষের পক্ষ থেকে তাদের সবাইকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলেছে বাংলাদেশী হিসেবে। পশ্চিম বাংলার বাংলাভাষী মানুষের শতকরা ২৫ ভাগ হলো মুসলমান। তারাও নিকট ভবিষ্যতে আসামে বাংলাভাষী মুসলমানের মতো পড়তে পারে বিপদে। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে বোড়োদের মতো কোনো উপজাতি নেই।

বাংলাদেশের সাঁওতাল ও চাকমাদের ভারতে কোনো দল অথবা সরকার ইন্ধন জোগাতে পারে গোলযোগ সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে আরো দুর্বল করতে। মুচকন্দ দুবে বলেছেন, ভারত একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহীদের প্রশ্রয় দিয়েছিল। দুবে তার চাকরি থেকে অবসর নেন ১৯৯১ সালে।

আমরা অনেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত নই। মোগল আমলে বাংলাদেশ অনেক প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত ছিল। একেকটি বিভাগকে বলা হতো সরকার। প্রতিটি সরকারকে শাসন করতেন একজন ফৌজদার। ফৌজদার শাসন করতেন কিন্তু ফৌজদারি মামলা ছাড়া আর কোনো মামলার বিচার তিনি করতেন না। সাধারণ মামলার বিচার করতেন কাজিরা। কাজির বিচার এলাকাকে বলা হতো জেলা। ইংরেজি District আর মুঘল আমলের জেলার ধারণা এক নয়। কিন্তু ইংরেজ আমলে District শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে জেলা শব্দটি গ্রহণ করা হয়।

১৭৬০ সালে বাংলার নবাব মীর কাশিম চট্টগ্রাম ছেড়ে দিতে বাধ্য হন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬০ সালে সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিভক্ত করে করা হয় পাবর্ত্য চট্টগ্রাম মহাল, যা পরে পরিচিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম হিসেবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসিত হয়েছে অন্য জেলা থেকে কিছুটা স্বতন্ত্রভাবে; ১৮২২ সালের রেগুলেশন অনুসারে। এই রেগুলেশন অনুসারে সেই সব জেলাই শাসিত হয়েছে, যাদের অধিবাসীর জীবনধারা ছিল অন্য জেলার মানুষের তুলনায় খুবই অনগ্রসর। চাকমারা লাঙল দিয়ে চাষ করতে জানত না। তাদের মধ্যে ছিল না কোনো কুম্ভকার ও কর্মকার। তারা মৃৎপাত্রের জন্য নির্ভর করেছে বাঙালি কুম্ভকারের ওপর। লোহা দিয়ে তৈরি দা, কুড়াল, খন্তার জন্য নির্ভর করেছে বাঙালি কর্মকারের ওপর। চাকমারা যে তাঁতে কাপড় বুনেছে সেই তাঁত ছিল খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের। এতে কেবল হাত দিয়ে কাপড় বুনা হয়। এতে পায়ের কোনো ব্যবহার করতে হয় না।

বাংলাদেশে যাদের উল্লেখ করা হয় ‘উপজাতি’ হিসেবে, তাদের বেশির ভাগের বাস পার্বত্য চট্টগ্রামে। এরা জীবনযাত্রার দিক থেকে একসময় পড়েছিল নব্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির পর্বে। কিন্তু সময়ের দিক থেকে এদের বলা যায় না ‘আদিম’। এরা মাটিতে কষ্ট করে বীজ বুনে চাষ করত। যাকে বলে জুম চাষ। জুম চাষ করার জন্য এসব অঞ্চলে বন পুড়িয়ে চাষের জমি বের করা হয়। তারপর সেই জমিতে গর্ত করে বীজ লাগিয়ে উৎপন্ন করা হয় ফসল। কিন্তু এক জমিতে বেশি দিন জুম চাষ করা যায় না। কারণ, জমির ওপরে উর্বর মাটি পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যেতে থাকে। ফলে জমি হয়ে ওঠে অনুর্বর।

জুমচাষিরা বাধ্য হয় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে জুম চাষ করতে। জুম চাষ যে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা করে, তা নয়। উত্তর ভারতের উপজাতিরাও জুম চাষ করে থাকে। কিন্তু সেখানে এই পদ্ধতিকে বলে ‘দাহি’। মিয়ানমারের এই পদ্ধতিতে চাষ করাকে বলে ‘তুঙ্গিয়ান’ (Tong-gyan); ফিলিপাইনে বলে ‘গেইংএস’ (Gainges)। জুম চাষের বিষয়ে বলতে হচ্ছে কারণ, চাকমা নেতা সন্তু লারমার দাবি হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক করে গড়তে হবে জুমল্যান্ড। কিন্তু জুম পদ্ধতিতে চাষ কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামেই যে প্রচলিত তা নয়। ভারতের সুদূর দেিণ কর্নাটক প্রদেশে উরালি উপজাতির মানুষও জুম চাষ করে থাকে। সেখানে একে বলা হয় ঝুম। উরালিরা দেখতে কতকটা সাঁওতালদের মতো। তাদের গায়ের রঙ কালো। চুল সাঁওতালদের মতো। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের সাথে তাদের চেহারার কোনো মিল নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা সবাই হলো মঙ্গোলীয় শাখাভুক্ত মানুষ। কিন্তু এরা তা নয়। সন্তু লারমা কি উরালিদের তার জুমল্যান্ডে ভারত থেকে আসতে দেবেন? কারণ তারাও তো করেন জুম পদ্ধতিতে চাষ। বিশেষ করে ধান চাষ। উরালিরা অবশ্য যথেষ্ট পরিমাণে বন্য ফলমূল আহরণ এবং পশুপাখি শিকার করে তাদের নিজেদের আহার্যের সংস্থান করে থাকে। আর যাপন করে অর্ধ যাযাবর জীবন। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে ‘উপজাতি সংস্কৃতি’ সংরণ করতে হবে। কিন্তু এটা কি বাস্তবে সম্ভব?

উপজাতি সংস্কৃতি বন্য পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাংলাদেশে থাকছে না আর আগের মতো বন। যারা একসময় বনে বাস করত, তাদের সন্তানসন্ততিরা এখন লেখাপড়া শিখে অনেকেই চাচ্ছে শহরে বাস করতে। অর্থাৎ নগরজীবন গ্রহণ করতে। এ ছাড়া উপজাতিরা বিদেশী খ্রিষ্টান মিশনারিদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছে খ্রিষ্টান ধর্ম। খ্রিষ্টান হওয়ার পর তারা অনুকরণ করতে চাচ্ছে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে। অর্থাৎ উপজাতি মানুষ নিজেরাই নিজেদের সংস্কৃতি আর চাচ্ছে না ধরে রাখতে।

উপজাতি মানুষ বাংলা ভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া শিখছে। বাংলা হয়ে উঠেছে তাদের সাধারণ ভাষা। বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটির পক্ষ থেকে ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে (২০০৭)। এত বলা হয়েছে, ‘আদিবাসী’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। ‘আদি’ অর্থ হলো ‘মূল’ এবং ‘বাসী’ অর্থ ‘অধিবাসী’। সুতরাং আদিবাসী কথাটির অর্থ ধরা যায় দেশীয় লোক (Indigenous people)। সঙ্গত কারণে তাই প্রশ্ন উঠছে, আমরা অর্থাৎ বাংলাভাষী মুসলমান কি এ দেশে বিবেচিত হবো বহিরাগত হিসেবে? এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে একধরনের রাজনীতির প্রভাব। সেটাকে আমরা কোনোভাবেই সমর্থন দিতে পারি না। কারণ, সেটা হবে আমাদের জন্য আত্মঘাতী।

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিক উইলিয়াম ত্রুক (W Crooke) ১৯২৪ সালে Islam India নামক বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বলেন, পূর্ব ও উত্তরবঙ্গে একসময় ছিল বহু বৌদ্ধের বাস। এই বৌদ্ধরা গ্রহণ করে ইসলাম। তাই বাংলা প্রদেশের উত্তর-পূর্ব ভাগে মুসলমানের সংখ্যা হতে পেরেছে এত বেশি। ত্রুকের মতকে অনেক দিক থেকে সমর্থন করা যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে মধ্য এশিয়ার তুর্কি মুসলমানরা এসে রাজ্য স্থাপন করেন। কিন্তু তাদের আসার অনেক আগেই সম্ভবত ইসলাম এ দেশে প্রচারিত হতে পেরেছিল। বাংলাদেশে দু’টি প্রাচীন জায়গা ছিল নওগাঁর পাহাড়পুর ও কুমিল্লার ময়নামতি। এই দু’টি জায়গায় আব্বাসীয় খলিফাদের মুদ্রা পাওয়া গেছে। পাহাড়পুরে পাওয়া গেছে খলিফা হারুন অর রশিদের স্বর্ণমুদ্রা। এ থেকে মনে হয়, আরব মুসলিম বণিকেরা এ দেশে আসতেন ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে। আর তাদের মাধ্যমেই প্রথমে হতে পেরেছিল বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ইসলাম প্রচার।

প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনিয়ায় ইসলাম প্রচারিত হয়। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সাথে বাংলাদেশের মানুষের ছিল বাণিজ্য যোগাযোগ। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করার কারণে এ দেশের বৌদ্ধরা ইসলাম গ্রহণে পেয়েছিল প্রণোদনা। তাদেরকে কেউ জোর করে মুসলমান করেনি। যেমন জোর করে ইসলাম প্রচারিত হয়নি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মানুষের মধ্যে। তারা একসময় প্রধানত ছিল বৌদ্ধ এবং পরে গ্রহণ করে ইসলাম।

বাংলাদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে মানসিক দিক থেকে পার্থক্য ছিল। আজকের বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার মূলে আছে বাংলাভাষী মুসলমানের অবদান। বাংলাভাষী হিন্দু পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি। কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমান চেয়েছে। এটা সেই প্রাচীন বৌদ্ধ স্বাতন্ত্র্যবাদী মানসিকতার পরিচয়বহ। কিন্তু আলোচনা না করে আলোচনা করতে ব্যস্ত উপজাতিদের কথা। যে আলোচনা পড়লে মনে হয় বাংলাদেশে বাংলাভাষী মুসলমান যেন একটা আগন্তুক জাতি। এই উপমহাদেশে মধ্য এশিয়া থেকে মানুষ বহুবার এসে সাম্রাজ্য গড়েছে। বাংলাদেশে কুশান সাম্রাজ্যের মুদ্রা পাওয়া গেছে। হতে পারে বাংলাদেশের উত্তর ভাগ একসময় ছিল কুশান সাম্রাজ্যেরই অংশ। মানবধারার দিক থেকে কুশানরা ছিলেন তুর্কি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর যেসব মুসলমান বাংলাদেশ জয় করতে এসেছিলেন তারাও তুর্কি মানব ধারারই মানুষ। তুর্কি ফৌজরা স্ত্রীকে সাথে করে আনেননি। তারা এ দেশের কন্যাদের বিয়ে করে হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের মানবগোষ্ঠীরই অংশ; থাকেননি বিদেশী হয়ে। কিন্তু আজ প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে, বাংলাভাষী মুসলমান আসলে পরদেশী। আমরা এ ধরনের মিথ্যা ইতিহাস লেখার প্রতিবাদ না করে পারি না।

উপজাতি নিয়ে নানা রকম রাজনীতি হচ্ছে। খ্রিষ্টান মিশনারিরা উপজাতিদের করছে খ্রিষ্টান। তারা উদীপ্ত করছে মুসলিমবিরোধী মনোভাব একটা বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে। এটাকে সমর্থন করা যায় না। ব্রিটিশ শাসনামলে খ্রিষ্টান মিশনারিরা বাংলাদেশে প্রতাপশালী ছিল না। কারণ, ব্রিটিশ শাসকেরা মনে করত, মিশনারিদের প্রশ্রয় দিলে এ দেশের মানুষ এদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে পারে, যা ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে এ দেশে ব্রিটিশরাজত্বের জন্য। পাকিস্তান আমলেও খ্রিষ্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ পরিচালিত হয়েছে অনেক সংযতভাবে। এর একটা কারণ ছিল সে সময়ের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাজ ছিল বিভিন্ন দেশে ইসলামী শক্তিকে সংগঠিত করে কমিউনিজম রোখা। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি আর নেই।

মিশনারিরা এখন বিশ্বজুড়ে ইসলামকে তাদের প্রতিপক্ষ ভাবছে। আর বিভিন্ন দেশে চাচ্ছে ধর্ম প্রচার করে ইসলামবিরোধী শিবির গড়তে। বাংলাদেশে উপজাতিদের তারা খ্রিষ্টান করছে এবং তাদের মনে গড়ে তুলছে ইসলামবিরোধী মনোভাব। এটা একটা বড় ধরনের আন্তর্জাতিক রাজনীতির চক্রান্তেরই অংশ। অনেক রকম রাজনীতি হচ্ছে উপজাতিদের নিয়ে। বাংলাদেশে সাঁওতাল উপজাতি নিয়ে রাজনীতি করতে চাচ্ছে ওয়ার্কার্স পার্টি। তারা রাজশাহী শহরে গত মাসের ৯ আগস্ট বের করেছিল একটা বিরাট মিছিল।

এ অঞ্চলে বামপন্থীদের সাঁওতাল নিয়ে রাজনীতি নতুন নয়। পাকিস্তান হওয়ার পরে বাম নেতৃত্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থানায় ঘটেছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ। সাঁওতাল রাজনীতির ফলে অনুরূপ কোনো সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটা অসম্ভব নয়। ভারতীয় অস্ত্র বাংলাদেশে যথেষ্ট অঘটন ঘটাতে পারে। ভারত চাচ্ছে আমাদের জাতিসত্তা সম্পর্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে। এর বিপক্ষে আমাদের দেশ। আমাদের জাতিসত্তার প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের আত্মপরিচয় নিয়ে বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটি কোনো গ্রন্থ রচনা করেছে বলে আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস নিয়ে খুব সামান্যই আলোচনা হয়েছে। অথচ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের সব অধিবাসীকে বিবেচনা করা হবে বাঙালি হিসেবে। ১৯৭৩ সালের ৭ জুন সন্তু লারমার নেতৃত্বে চাকমারা গঠন করে শান্তিবাহিনী। ২০০১ সালের ৩১ মার্চ সন্তু লারমা গঠন করেন ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’। সংখ্যার দিক থেকে সাঁওতালরা এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উপজাতি। এরপর আসে চাকমাদের নাম। সন্তু লারমা চাচ্ছেন চাকমা ও সাঁওতালদের এক করে রাজনীতি করতে। সাঁওতালরা সাঁওতালি ভাষায় কথা বলে, কিন্তু এখন তারা বাংলাদেশে বাংলা ভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া শিখছে। তারা সবাই বলতে পারে বাংলা। তা ছাড়া, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে সাঁওতাল ভাষায় ঘটেছে প্রচুর বাংলা শব্দের অনুপ্রবেশ। চাকমাদের কোনো নিজস্ব ভাষা নেই। বাংলাই হয়ে উঠেছে তাদের মাতৃভাষা। কিন্তু তবুও তোলা হচ্ছে তথাকথিত আদিবাসীদের স্বতন্ত্র ভূভাগ গঠনের দাবি।

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ