মানুষ কথা বলা প্রাণী। মানুষ তার বাকযন্ত্র দিয়ে অনেক রকম শব্দ করতে পারে। সে সামাজিকভাবে স্বীকৃত অর্থপূর্ণ শব্দের মাধ্যমে বাক্য গঠন করে মনোভাব প্রকাশ করে। ভাষা রচনা করে সামাজিক বন্ধন। সৃষ্টি করে জাতীয় ভাব। ভাষাকে নির্ভর করেই গড়ে উঠতে চায় জাতিসত্তা। বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত। কেননা, এক জাতি চাপিয়ে দিতে চাইতে পারে, অন্য জাতির ওপর তাদের ভাষাকে। আর অন্য জাতি চাইতে পারে, এই চাপিয়ে দেয়ার বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। এই উপমহাদেশের ইতিহাসে এর একাধিক নজির আছে।
ব্রিটিশ ভাষাতাত্ত্বিক জর্জ গ্রিয়ার্সনের বিখ্যাত ভাষা জরিপ (Linguistic Survey of India, 1903-1928) থেকে দেখা যায়, ব্রিটিশ ভারতে তখন ভাষার সংখ্যা ছিল ১৭৯টি। আর উপভাষা বা ডায়লেক্টের সংখ্যা ছিল ৫৪৪টি। সে সময়ে ভারতে সবচেয়ে বেশি লোক কথা বলত হিন্দি ভাষায়। হিন্দির পরেই স্থান ছিল বাংলা ভাষার। গ্রিয়ার্সন এই উপমহাদেশের ভাষাগুলোকে প্রধানত চারটি বড় ভাষা পরিবারে বিভক্ত করেন। এরা হলো : দক্ষিণ এশীয় বা অস্ট্রিক (Austric), চীনা-তিব্বতি (Sino-Tibetan), দ্রাবিড় (Dravidian) ও ইন্দো-ইউরোপীয় (Indo-European)। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার খুব বড়। গ্রিয়ার্সন একে এই উপমহাদেশের ক্ষেত্রে তিনটি উপপরিবারে ভাগ করেন। এরা হলো ইরানীয় আর্য (Iranian-Aryan), ভারতীয়-আর্য (Indo-Aryan), দরদ-আর্য (Dardic-Aryan)। তিনি বাংলা ও হিন্দি ভাষাকে স্থাপন করেন ভারতীয়-আর্য পরিবারে। বাংলা ভাষাকে গ্রিয়ার্সন যদিও হিন্দি ভাষার সাথে ভারতীয়-আর্য পরিবারে স্থাপন করেন, কিন্তু হিন্দির সাথে বাংলা ব্যাকরণের অমিল আছে অনেক। যেমন হিন্দিতে ক্রিয়াপদ ছাড়া বাক্য গঠন করা যায় না, কিন্তু বাংলা ভাষায় যায়।
এ দিক থেকে বাংলা ভাষার মিল খুঁজে পাওয়া যায় দ্রাবিড় পরিবারভুক্ত ভাষার সাথে। তামিল ভাষায় ক্রিয়াপদ ছাড়া বাক্য গঠন করা চলে। দ্রাবিড় পরিবারের ভাষার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, জোড়া লেগে নতুন ভাব প্রকাশকারী শব্দ গঠন। এ ক্ষেত্রে শব্দ দু’টি একত্রে মিলে যায় না। অর্থাৎ সন্ধি হয় না। এরকম জোড়ালাগা শব্দ বাংলা ভাষাতেও কিছু কিছু হতে দেখা যায়। যেমন, ছেলে এবং গুলি দু’টি পৃথক শব্দ। কিন্তু আমরা যখন বলি, ছেলেগুলি, তখন তা একটি তৃতীয় ভাবকে বোঝায়। এটাকে তুলনা করা চলে দ্রাবিড় পদ্ধতির সাথে। আমরা বাংলাতে ছেলেগুলি না বলে, বলতে পারি, ছেলেরা। এটা হলো আর্যভাষার পদ্ধতি। দ্রাবিড় ভাষায় থাকতে দেখা যায় ট ধ্বনির প্রাধান্য। বাংলা ভাষাতেও টি টা আমরা যথেষ্ট ব্যবহার করি। বাংলাদেশের পুরনো গ্রাম ও জনপদের নাম দেখে মনে হয়, বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে অতীতে চলত দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের ভাষা। ভাষাতাত্ত্বিক শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এই অভিমত প্রকাশ করেছেন তার বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা নামক বইতে। এমনিতে বস্তুগত সংস্কৃতির দিক থেকেও অনেক মিল আছে দ্রাবিড়ভাষী ও বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে। যেমন, দ্রাবিড়ভাষী মানুষ সিদ্ধ চালের ভাত খান। বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত সিদ্ধ চালের ভাত খেয়ে থাকেন। বাংলাদেশের মানুষ গ্রামে উলুখড়ের ছাওয়া মাটির ঘরে থাকেন। তামিলভাষীরাও থাকেন একই রকম উলুখড়ের ছাওয়া মাটির ঘরে। তামিলরা তরি-তরকারি কোটেন বঁটি দিয়ে। বাংলাদেশেও মানুষ একইভাবে বঁটির ব্যবহার করে। উত্তর ভারতের মানুষের মতো ছুরি দিয়ে তরি-তরকারি কাটেন না।
এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৩৭ সালে প্রথম ভাষা নিয়ে রক্তপাত ঘটেছিল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে। ১৯৩৭ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ-ভারতে ১১টি প্রদেশ ছিল। সে সময় প্রাদেশিক আইনসভার যে নির্বাচন হয়, তাতে ১১টি প্রদেশের মধ্যে আটটিতে কংগ্রেস জয় লাভ করে মন্ত্রিসভা গঠন করে। কংগ্রেস হাইকমান্ডের আদেশ অনুসারে এই আটটি প্রদেশে হিন্দি ভাষা স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়নো বাধ্যতামূলক করা হয়। মাদ্রাজ প্রদেশে তামিলভাষীরা করেন-এর প্রতিবাদ। তিন বছর ধরে চলেছিল প্রতিবাদ বিক্ষোভ। এ সময় একটি প্রতিবাদ-বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। ফলে নিহত হন দু’জন। এটাই এই উপমহাদেশে ভাষার কারণে প্রথম আত্মাহুতি দান। এটা ঘটেছিল ১৯৫২ সালে ঢাকায় গুলি চালাবার প্রায় ১৫ বছর আগে অখণ্ড ভারতে। ১৯৩৯ সালে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা আটটি প্রদেশেই ইস্তফা দেয়। কংগ্রেস ইস্তফা দেয়, কারণ সে চায় না ব্রিটিশ ভারতের সরকারের সাথে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সহযোগী হতে। কংগ্রেস সরকার মাদ্রাজে ইস্তফা দেয়ার পর, মাদ্রাজের গভর্নর জেনারেল Lord Erskine ১৯৪০ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে মাদ্রাজের স্কুলে বাধ্যতামূলকভাবে হিন্দি পড়ানো আইন রদ করেন। মাদ্রাজে যখন বাধ্যতামূলকভাবে হিন্দি পড়ানো শুরু হয়, তখন মাদ্রাজের আইনসভার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন চক্রবর্তী রাজাগোপাল আচারী। গুজব রটে, আচারী যেহেতু ব্রাহ্মণ, তাই তিনি চাচ্ছেন, সংস্কৃতবহুল হিন্দি ভাষা তামিলদের শেখাতে। আর সেই সঙ্গে চাচ্ছেন, তামিলভাষীরা ধীরে ধীরে ত্যাগ করুক তাদের মাতৃভাষাকে। এ সময় মাদ্রাজ প্রদেশে উদ্ভব হয় ব্রাহ্মণবিরোধী দ্রাবিড় মুনাত্রা কাজাগাম নামক দলের, যা পরে মাদ্রাজের রাজনীতিতে হয়ে ওঠে প্রধান রাজনৈতিক দল। এ সময় তামিলভাষী মুসলমানেরা যোগ দিয়েছিলেন হিন্দিবিরোধী আন্দোলনে।
অন্য দিকে, যেসব মুসলিম পরিবারে উর্দু ভাষা চলত, তারা নেন হিন্দি ভাষার পক্ষ। ১৯৬৫ সালে ভারতের কংগ্রেস সরকার চায় হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করতে। এ সময় মাদ্রাজ প্রদেশে (বর্তমান নাম তামিলনাড়–) দেখা দেয় প্রচণ্ড হিন্দিবিরোধ বিক্ষোভ। একটি মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ৬৮ জন। জঙ্গি-জনতা পুলিশকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ চালায়। যার ফলে দু’জন পুলিশের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে। লালবাহাদুর শাস্ত্রী এ সময় ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ঘোষণা করেন, হিন্দিকে এখনোই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হবে না। ইংরেজি অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকবে সহযোগী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। শাস্ত্রী মারা যান ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে। তার মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী হন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৬৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট আইন পাস করে, হিন্দির সাথে ইংরেজি অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারতের সহযোগী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে থাকবে।
বাংলাদেশে অনেকের ধারণা, পাকিস্তান হয়েছিল বলেই সৃষ্টি হতে পারে ভাষা সমস্যার। কিন্তু স্বাধীন ভারতেও দেখা দিয়েছে ভাষার সমস্যা। আরেকটি দৃষ্টান্ত নেয়া যেতে পারে। ব্রিটিশ শাসনামলে পাঞ্জাব ছিল একটা বিরাট প্রদেশ। ১৯৪৭ সালে বাংলার মতো পাঞ্জাব প্রদেশকেও ভাগ করা হয়। পাঞ্জাবের পশ্চিম ভাগ পড়ে পাকিস্তানে আর পূর্বভাগ পড়ে ভারতে। পাঞ্জাবের যে অংশ ভারতে পড়ে, তাতে শিখ পাঞ্জাবিরা চায় পাঞ্জাবিকে প্রদেশের সরকারি ভাষা করতে। কিন্তু হিন্দু পাঞ্জাবিরা তাতে রাজি হয় না। শিখদের এই আন্দোলন ১০ বছর চলার পর ১৯৬৬ সালের ১ নভেম্বর পূর্ব পাঞ্জাবকে বিভক্ত করে দু’টি প্রদেশ করা হয়। উত্তর ভাগ হয় পাঞ্জাবি সুবা আর দক্ষিণ ভাগ হয় হরিয়ানা প্রদেশ। উত্তর ভাগের প্রাদেশিক সরকারের সরকারি ভাষা হয় গুরুমুখী অক্ষরে লেখা পাঞ্জাবি ভাষা। আর হরিয়ানা প্রদেশের সরকারের প্রাদেশিক ভাষা হয় দেবনাগরি অক্ষরে লেখা হিন্দি ভাষা। পরে শিখরা চান স্বাধীন হতে। ইন্দিরা গান্ধী কঠোর হস্তে শিখ স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করেন। এতে শিখরা হয়ে ওঠেন খুবই ক্ষুব্ধ। দু’জন শিখ দেহরক্ষী ইন্দিরা গান্ধীকে তার সরকারি ভবনের প্রাঙ্গণে গুলি করে হত্যা করেন (৩১ অক্টোবর ১৯৮৪)। দিল্লিতে বাধে হিন্দু শিখ দাঙ্গা। দিল্লির শিখরা ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর সাথে জড়িত ছিলেন না। তারা দাঙ্গার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারেন না। এই দাঙ্গায় ভারতের রাজধানী দিল্লিতে মারা যান প্রায় চার হাজার শিখ।
ভারতে ভাষা সমস্যা ছিল এবং আছে। কেউ বলতে পারে না, আবার তা প্রবল হয়ে উঠবে কি না। সাবেক পাকিস্তান ভেঙে গিয়েছে অনেকের মতে ভাষার দ্বন্দ্বের কারণে। কিন্তু সাবেক পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন একটা ব্যর্থ আন্দোলন ছিল না। উর্দুর সাথে বাংলা পেতে পেরেছিল রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি। কিন্তু ভারতে হিন্দির সাথে ইংরেজিকে রাখা হয়েছে সহযোগী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। কোনো ভারতীয় ভাষাকে করা হয়নি কেন্দ্রীয় প্রশাসনের জন্য হিন্দির সাথে সহযোগী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। এখানে থেকে গেছে একটা বড় রকমের ফাঁক।
এসব কথা মনে আসছিল ২১ ফেব্র“য়ারিতে, যা এখন পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বলে কিছু কি কোথাও আছে, না হতে পারে? যেমন কোথাও নেই আন্তর্জাতিক দেশপ্রেমের অস্তিত্ব। আসলে এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বলতে ঠিক কী বুঝতে হবে সে সম্পর্কে ইউনেসকো কিছু বলেনি। ইউনেসকো বলেনি ভারতে ভাষা নিয়ে সঙ্ঘাত ঘটার কথা। সে কেবলই বলেছে পাকিস্তানে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারিতে পুলিশের গুলিতে ভাষার জন্য মানুষের শাহাদত বরণের কথা। যেটা আমার কাছে মনে হয় একদেশদর্শী এবং ইতিহাস না জানার ফল।
আমাদের দেশে আমরা করেছিলাম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। আমাদের আন্দোলন ছিল না মাতৃভাষার আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আর মাতৃভাষা আন্দোলন সমার্থক নয়। কিন্তু এখন যেন সেটাই করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। ১৯৫২ সালের পরিস্থিতি ছিল যথেষ্ট জটিল। উর্দু বনাম বাংলা তখন সরাসরি উচ্চারিত হয়নি। খাজা নাজিমুদ্দিন জন্মেছিলেন ও বেড়ে উঠেছিলেন ঢাকায়। কিন্তু তার পারিবারিক ভাষা ছিল উর্দু। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জন্মেছিলেন ও বেড়ে উঠেছিলেন কলকাতায়, কিন্তু তার মাতৃভাষা বাংলা ছিল না, ছিল উর্দু। ঢাকায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি চলেছিল গুলি। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ২৪ ফেব্র“য়ারি তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে অবস্থিত হায়দ্রাবাদ শহরের এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে উর্দুই হওয়া উচিত একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পূর্ব বাংলায় অনেক মানুষ ছিলেন উর্দুর পক্ষে। তবে অধিকাংশ মানুষই চেয়েছিলেন উর্দুর সাথে বাংলাকে করা হোক অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। তাই আন্দোলনের আওয়াজ ছিল উর্দু বাংলা ভাই ভাই, উর্দুর সাথে বাংলা চাই।
এখন এই ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে। পাঠ্যবইতে যা লেখা হচ্ছে, তাতে মনে হয়, মানুষ যেন হয়ে উঠেছিল উর্দুবিরোধী। সমগ্র পাকিস্তানের মানুষের ওপর পূর্ব বাংলার মানুষ চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল বাংলা ভাষার কর্তৃত্ব। কিন্তু ১৯৫২ সালে এই মনোভাব বিরাজ করছিল না।
ভাষাসৈনিক বলতে ঠিক যা বোঝায়, আমি তা ছিলাম না। তবে এ সময় আমি ছিলাম ছাত্র। ছাত্ররা করেছিল ভাষা আন্দোলন। তাই সে সময়ের মনোভাব সম্পর্কে আমি নিশ্চয় কিছু বলার অধিকার রাখি। যারা ভাষাসৈনিক হিসেবে পরিচিত, তাদের অনেকের সাথে ছিল আমার পরিচয়। যেমন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (শেলী), এস এ বারী এটি, মুহাম্মদ সুলতান, লতিফ চৌধুরী, সাদেক খান প্রমুখ। হাবিবুর রহমান, এটি বারী, সুলতান- এদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম রাজশাহী সরকারি কলেজে। এরা তিনজনই পড়তেন রাজশাহী কলেজে। পরে এরা যান ঢাকায় এমএ পড়তে। লতিফ চৌধুরী এবং সাদেক খান ছিল আমার স্কুলজীবনের সাথী। এদের পিতারা ছিলেন একসময় রাজশাহীতে চাকরি উপলক্ষে। লতিফ চৌধুরীর কথা এখন অনেকেই জানেন না। ইনি ছিলেন খুবই ভালো ছাত্র। ইনি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার প্রভাষক হন। এরপর কোনো মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার চাকরি পেয়ে চলে যান সে দেশে। ইনি বাংলা ভাষা আন্দোলনে জেল খাটেন। লতিফ চৌধুরী ও সাদেক খান উভয়েই ছিলেন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সাদেক খানও ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে ছাড়েন পড়াশোনা। গ্রহণ করেন সাংবাদিকের বৃত্তি।
যেসব ভাষাসৈনিককে চিনতাম, তাদের মধ্যে হাবিবুর রহমানই হলেন সবচেয়ে খ্যাতনামা। ইনিও ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। জীবনের সব পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ইনি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি কেবল ভাষা নিয়ে রাজনীতি করেননি। করেছেন বাংলা ভাষার চর্চা। সঙ্কলন করেছেন বাংলা ভাষার প্রথম ভাব অভিধান, যথাশব্দ । ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঠিক হয়েছিল ছাত্ররা আমতলা থেকে তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের গেট দিয়ে ১০ জন ১০ জন করে স্কয়াড করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবেন। প্রথম স্কয়াডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাবিবুর রহমান শেলী। আমি তখন ঢাকায় না থাকলেও পরে অনেকের কাছেই অনেক কিছু শুনেছিলাম। পুলিশ গুলি চালিয়েছিল, কিন্তু যারা শাহাদত বরণ করেছিলেন, তারা কেউই ছিলেন না ছাত্র মিছিলে। তারা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। গুলি লেগেছিল তাদের গায়ে। তবে তাদের মৃত্যু বৃথা যায়নি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিণত হয় বিরাট গণ-আন্দোলনে। আর এই গণ-আন্দোলন কোনো ভাষাসৈনিকের দ্বারা পরিচালিত হয়নি। আন্দোলন হয়ে উঠেছিল স্বয়ং চালিত। হাজার হাজার মানুষ নেমে এসেছিল সারা দেশে পথে। আমি জীবনে অনেক আন্দোলন দেখেছি। কিন্তু এত বিরাট আন্দোলন আর প্রত্যক্ষ করিনি ইতঃপূর্বে। এই আন্দোলন গৌরব করারই মতো।
কিন্তু সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্র আজ আর নেই। এখন বাংলাদেশ একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলা ভাষার উন্নয়নে আর কোনো রাষ্ট্র প্রতিবন্ধক হতে পারে না। এখন যা প্রয়োজন, তা হলো, কেবল ভাষার প্রকাশ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমাদের নিজের প্রচেষ্টা। আমাদের দেশে আন্তর্জাতিকতাবাদী বুদ্ধিজীবীর অভাব নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে, বর্তমানে আন্তর্জাতিকতাবাদ যেন চাপা পড়ে যেতে চাচ্ছে জাতীয়তাবাদের নিচে। আমরা চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙে যাচ্ছে। ইতঃপূবে আমরা দেখেছি ১৫টি রিপাবলিক নিয়ে গঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে পড়তে। দুনিয়ার সর্বহারারা এক হতে পারল না। প্রতিটি জাতি যেন এখন পৃথক পৃথকভাবে বাঁচতে চাচ্ছে। পৃথক পৃথকভাবে যেন হতে চাচ্ছে সুখী ও সমৃদ্ধ। এই পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমাদেরও হতে হবে স্বাবলম্বী।
এবারের ২১ ফেব্রুয়ারিতে অনেককে অনেক কথা বলতে শুনলাম, যা আমাকে বিস্মিত করেছে। যেমন বলতে শুনলাম, আমাদের উচিত হবে না বিদেশী ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ। অথচ চীনারা তাদের ভাষায় বিদেশী শব্দ প্রচুর গ্রহণ করছেন; তাদের ভাষাকে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভাষা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। ইংরেজি ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে প্রচুর বিদেশী শব্দকে আপন করে নিতে পারার কারণে। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা এ দেশে এসে কথা বলতে শুরু করেন মিশ্র ভাষায়। যাকে বলা হতো Hobson-Jobson। এই হবসন-জবসন ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষায় গৃহীত হয়েছে প্রচুর শব্দ। একটি হিসাব অনুসারে প্রায় ৭০০ এর কাছাকাছি, যা ইংরেজি ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। আমরা যদি ইংরেজি ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করি, তবে বাংলা ভাষার শব্দসম্ভারও বাড়বে। বাড়বে ভাব প্রকাশের শক্তি।
দৈনিক নয়া দিগন্তে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ এ প্রকাশিত।