১২ জানুয়ারি ২০১৯, দৈনিক নয়া দিগন্তে আমার একটা লেখা বেরিয়েছিল। লেখাটির শিরোনাম ছিল, ‘আগে সুগঠিত হও’। কোনো একজন পাঠক (নাম দেননি) আমার এই লেখাটির সমালোচনা করে নয়া দিগন্তে একটি চিঠি লিখেছেন। যা ছাপা হয়েছে ২৬ জানুয়ারি ২০১৯। এই চিঠির উত্তরে বর্তমান লেখাটি।
দেশে অনেক কিছুই ঘটছে। বদলাচ্ছে রাজনীতির প্রেক্ষাপট। দেশের রাজনীতি সম্পর্কে কিছু আন্দাজ করা হয়ে উঠেছে খুবই কঠিন। আমার বক্তব্য তাই হতে পারে কিছুটা অসংলগ্ন। কেননা বাস্তব পরিস্থিতিও হয়ে উঠতে চাচ্ছে যথেষ্ট অগোছালো।
প্রথমে বলতে হয়, গণতান্ত্রিক উপায়ে সেখানেই রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া যায়, যেখানে গণতন্ত্র আছে। যে দেশে গণতন্ত্র নেই, সে দেশে গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া কঠিন। বিলাতের গণতন্ত্রের ইতিহাস জড়িত রক্তক্ষরা অভ্যুত্থানের সাথে। মানুষের ভোটের দাবি সে দেশে সহজভাবে যে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বলা যায় না। বিএনপি বলেছিল, তার কর্মীরা বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র পাহার দেবে; যাতে ভোট ডাকাতি না হতে পারে। কিন্তু কোনো ভোটকেন্দ্রেই বিএনপির কোনো কর্মীকে দেখতে পাওয়া যায়নি। তারা পাহারায় থাকলে এ রকম ভোট ডাকাতি হতে পারত না।
এখন জানা যাচ্ছে, কেবল বিএনপির ভোটাররাই যে ভোট দিতে পারেননি, তা নয়। নৌকায় ভোট দিতে গিয়ে নৌকার অনেক সমর্থক দেখতে পান, তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে। বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রেই ভোটদান শেষ হয় দুপুরের আগেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘দি ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকার ৩১ ডিসেম্বর সংখ্যায় মন্তব্য করা হয়েছে যে, ভোটের এ রকম ফলাফল উত্তর কোরিয়ার মতো কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে হওয়ার কথা ধারণা করা যায়, কিন্তু বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নয়।
আমি বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের চিন্তা-চেতনার সমালোচনা করেছি। কারণ, তিনি আওয়ামী লীগকে বলেছেন একটি ফ্যাসিস্ট দল। কিন্তু আওয়ামী লীগের আচরণ আসলে কোনো ফ্যাসিস্ট দলের মতো নয়। তার আচরণ একটি কমিউনিস্ট দলের মতো। ‘দি ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকা সেই ইঙ্গিতই করেছে। ফ্যাসিস্টরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তারা গণতান্ত্রিক উপায়ে কোনো দেশে ক্ষমতা দখলও করে না।
বিখ্যাত ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিত মুসোলিনি (১৮৮৩-১৯৪৫) ইতালিতে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন না। তিনি ১৯২২ সালে অক্টোবর মাসে তার ৪০ হাজার পার্টি সদস্যকে নিয়ে ইতালির রাজধানী রোম শহরকে ঘিরে করেছিলেন ক্ষমতা দখল। কিন্তু আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ ঠিক একটি ফ্যাসিস্ট দল নয়। যদি তারা তা হতো, তবে তারা ছদ্মভোটের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইত না।
বাংলাদেশে ব্রিটিশ গণতন্ত্রের একটি গভীর প্রভাব পড়েছে ব্রিটিশ শাসনামলে। যার রেশ আজো বজায় আছে। আওয়ামী লীগ তাই অনুভব করছে ছদ্ম নির্বাচনের প্রয়োজন। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সামরিক কায়দায় গঠিত নয়। তাই তার পক্ষে ফ্যাসিস্ট কায়দায় ক্ষমতা দখল সম্ভবপর নয়।
শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ল. ই. ব্রেজনেভের পরামর্শ গ্রহণ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন আর নেই। খোদ রাশিয়ায় কমিউনিস্টরা এখন ক্ষমতাচ্যুত। চীনে কমিউনিস্ট পার্টি এখনো ক্ষমতায় আছে। চীনে চলেছে বিশেষভাবেই এক দলের রাজত্ব। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলছেন, বাংলাদেশ যদি চীনকে আদর্শ করে, তবে সে অল্প সময়ের মধ্যেই লাভ করতে পারবে আর্থিক সচ্ছলতা। বাংলাদেশের জন্য পশ্চিমা গণতন্ত্র সুফল বয়ে আনবে না। চলবে কেবলই দলাদলি।
কিন্তু বাংলাদেশে আর্থিক উন্নয়ন হচ্ছে ব্যক্তিগত মালিকানায়। এতে রাষ্ট্রিক উদ্যোগের স্থান খুবই সামান্য। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অনুসরণ করছে না। চীনের ধারণা তাই সমর্থন করা চলে না। চীনের নীতি অনুসরণ করতে গেলে বাংলাদেশে স্থাপিত হবে রাষ্ট্র-দাসত্ব, যা আমাদের কাম্য হতে পারে না। আজ সারা চীনে তিন কোটি তরুণের জন্য বিয়েযোগ্য নারী নেই। উত্তর মিয়ানমার থেকে নারী পাচার করা হচ্ছে চীনে। যার কাহিনী অনেক ক্ষেত্রেই বলতে হয়, হতে পারছে খুবই অমানবিক।
বাংলাদেশ কখনোই এটাকে আদর্শ বলে মানতে পারে না। অন্য দিকে, আমরা দেখলাম চীনের ঘরের কাছে জাপানের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ হতে। জাপানের এই আর্থিক সমৃদ্ধি এলো গণতন্ত্র ও মিশ্র অর্থনীতিকে নির্ভর করে। জাপানিরা কঠোর শ্রমের মাধ্যমে হতে পারল অর্থনীতির দিক থেকে খুবই উন্নত। বলতে হয় চীনের চেয়েও উন্নত। জাপান কেবল শিল্প-অর্থনীতিতে উন্নতি করেনি। হতে পেরেছে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাপান কেবল বড় আকারের কলকারখানার অর্থনীতি গড়েনি। গড়েছে সমৃদ্ধ কুটির শিল্প। ফলে তার আর্থিক সমৃদ্ধি ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে দেশের সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে। কমেছে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান। আজকের জাপান অনেক সমতাবাদী দেশ। আমার মনে হয়, চীনের চেয়ে জাপানের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের ইতিহাস আমাদের জন্য হতে পারে অনেক বেশি শিক্ষাপ্রদ।
প্রথম আলো পত্রিকায় ২৭ জানুয়ারি ২০১৯ বিএনপির একজন খ্যাতনামা নেতা মাহাবুবুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার পড়লাম। একসময় মাহাবুবুর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে। পরে তিনি যোগ দেন বিএনপিতে। বিএনপি থেকে হন সংসদ সদস্য। তিনি এখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন উল্লেখযোগ্য সদস্য। তিনি বলছেন, বিএনপি একটি জাতীয়তাবাদী দল। তাই তিনি মনে করেন, এমন কোনো দলের সাথে তার জোটবদ্ধ হওয়া উচিত নয়, যারা জাতীয়তাবাদী নয়। তার মতে, বিএনপির উচিত হয়নি জামায়াতে ইসলামীর সাথে ঐক্যজোট গড়া। কারণ জামায়াত একটি জাতীয়তাবাদী দল নয়। কিন্তু মনে হয় তিনি ভুলে গেছেন যে, বিএনপির জাতীয়তাবাদ আর আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদ একই ব্যঞ্জনাবহ নয়। আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে বাঙালি জাতীয়তাবাদে।
কিন্তু বিএনপি বিশ্বাস করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মধ্যে সম্পৃক্ত হয়ে আছে একটা মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধ। জিয়া ক্ষমতায় এসে সংবিধানে যোগ করেছিলেন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। এর সাথে জামায়াতের কোনো বিরোধ নেই। জামায়াত তাই সহজেই জোটবদ্ধ হতে পেরেছে বিএনপির সাথে। মাহাবুবুর রহমান মনে হচ্ছে তার নিজের দলের আদর্শবাদ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন না। কাকে বলব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা আর কাকে বলব জাতীয়তাবাদ, সেটা ঠিক করা সম্ভব নয়। ভারতে এখন শিখরা চাচ্ছেন স্বাধীন হতে। শিখ একটি ধর্ম সম্প্রদায়। কিন্তু শিখদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেউ বলছে না, সাম্প্রদায়িক।
এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক কথাটা যেন কেবল মুসলমানের জন্যই বরাদ্দ হয়ে আছে। আমাদের জাতিসত্তা সম্পর্কে আওয়ামী লীগ যে চিত্র তুলে ধরতে চায়, মনে হয় বিএনপির এক অংশের মধ্যে সে আদর্শ কাজ করছে। ফলে বিএনপিতে সৃষ্টি হতে পারছে আদর্শিক গোলযোগ। যা দুর্বল করছে দলটিকে। বিএনপিতে দেখা দিয়েছে কর্মীর অভাব। যদি দেশে যথাযথ নির্বাচন হয়, তবে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে এনে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করতে প্রয়োজন হবে অনেক কর্মীর। বিএনপি যথেষ্ট কর্মী ধার পেতে পারে জামায়াতের কাছ থেকে। তাদের আছে সুসংগঠিত কর্মিবাহিনী। জামায়াত একটি ক্যাডারভিত্তিক দল। বিএনপি যা নয়। অনেক নির্বাচনী এলাকা আছে, যাতে বিএনপির প্রয়োজন জামায়াতের ভোটের। জামায়াতের ভোট ছাড়া সে হারবে আওয়ামী লীগের কাছে, যদিও বেশি ভোটের ব্যবধানে নয়।
এসব কথা ভেবে বিএনপির একটি বড় অংশ চাচ্ছে না জামায়াতের সঙ্গ পরিত্যাগ করতে। বিএনপি-জামায়াত ঐক্য হচ্ছে প্রয়োজনের ঐক্য; ঠিক আদর্শের ঐক্য নয়। তবে আদর্শিক ঐক্যও যে একেবারেই নেই, তা নয়। এই ঐক্য হলো ইসলামী মূল্যবোধের। ইসলাম একটি পথে ফেলে দেয়ার ধর্ম নয়। ইসলাম বর্তমান বিশ্বে আবার আবির্ভূত হচ্ছে একটি মতাদর্শ হিসেবে। এ কথাও আমাদের উপলব্ধিতে থাকা প্রয়োজন। আমরা ভুলে যাই যে, বাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। মুসলমানেরা এ দেশের একটি ধর্ম সম্প্রদায়মাত্র নয়, তারা এ দেশের অস্তিত্বের ভিত্তি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম করা হয়েছে ইসলাম। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। সম্ভবত ইসলাম ঘোষিত হবে ইন্দোনেশিয়ারও রাষ্ট্রধর্ম। বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া মিলে গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে একটি ইসলামী ব্লক। যেটার কথাও ভাবা দরকার আমাদের। এই অঞ্চলে আবার গঠিত হতে পারে সিয়াটোর মতো সামরিক জোট, যা একসময় গঠিত হতে পেরেছিল।
বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা হাফিজউদ্দিন বলছেন, ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের সাথে জোটবদ্ধ হওয়া বিএনপির উচিত হয়নি। গণফোরাম একটি সাইনবোর্ডসর্বস্ব দল। তার সাথে যুক্ত হয়ে বিএনপি ব্যবহারিক রাজনীতির ক্ষেত্রে কোনোভাবেই লাভবান হতে পারেনি। বরং নিক্ষিপ্ত হয়েছে আদর্শিক জটিলতার মধ্যে। কামাল হোসেন একসময় ছিলেন আওয়ামী লীগে। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে। তার মধ্যে আওয়ামী লীগপ্রবণতা এখনো প্রচ্ছন্নভাবে সক্রিয় আছে বলেই মনে হয়। আশা করি নয়া দিগন্তে যিনি বেনামে চিঠি লিখেছেন, তিনি তার চিঠির উত্তর পেলেন।
লেখাটি প্রকাশিত হয় দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায়, ২০১৯ সালে।