এবনে গোলাম সামাদের চিন্তা-তৎপরতা সংক্রান্ত লেখাটি লিখেছেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ। লেখাটি নেয়া হয়েছে ইসলামী বার্তা নামক অনলাইন পোর্টাল থেকে।
তখনও আমার জানা ছিলো না যে, তিনিই এবনে গোলাম সামাদ। দুখানা বই বগলে। সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে হেঁটে চলে যাচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার পেরিয়ে তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের দিকে। কোনদিকে খেয়াল নেই। ভাবের গভীরে নিবিষ্ট মন। মাঝে মাঝে একা একা ঠোঁট নাড়ছেন। পোশাক-পরিচ্ছদ বেশ সাদামাটা। পথচারী শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রী সালাম দিচ্ছেন। তিনি একটুখানি মাথা ঝুঁকিয়ে ঠোঁট নেড়ে নিঃশব্দে উত্তর দিয়ে নিজের নিশানে এগিয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে এদিক সেদিকে নজর। পাখি, কাঠবিড়ালি কিংবা বৃক্ষের পাতা নড়াচড়ার দৃশ্যের প্রতি সেই দৃষ্টি। সেটাও এক ঝলক। তাঁকে ক্রস করে এসে একজন বললেন, জ্ঞানের জাহাজ যাচ্ছেন। বললাম, কে উনি? তিনি বললেন, চেনেন না? এবনে গোলাম সামাদ স্যার। চমকে উঠলাম। স্যারের একজন ভক্ত আমি। তাঁর লেখা পড়েছি। গল্প শুনেছি অনেক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক তিনি। লিখেছেন নানা বিষয়ে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয় ছাড়াও ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, শিল্পকলা, রাজনীতি, ধর্ম-দর্শন, সমাজ-সংস্কৃতি, সাহিত্য-কাব্যকলা, সমকাল, তথ্যপ্রযুক্তি, মানবিক বিদ্যাসহ বহুবিধ বিষয়ে কলম ধরেছেন তিনি। তাঁর প্রতিটি লেখাই শেকড়কে ছুঁয়েছে। গালগল্প দিয়ে কোনো লেখায় বিশ্বাসী নন তিনি। তথ্য প্রমাণ এবং যুক্তি বিশ্লেষণ দিয়ে তিনি বিষয়কে উপজীব্য করে তোলেন। সেই কিংবদন্তি মানুষটাকে প্রথম চোখে পড়লো।
বগুড়া আজিজুল হক কলেজে ১৯৯০ সালে ভর্তির পর থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আনাগোনা ছিলো। কলেজগুলো তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আলাদা হলেও আমরা সবাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধিত ছাত্র-ছাত্রী ছিলাম। ফলে এক পা কলেজে আর এক পা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে লটকে থাকতো। সেই সুবাদে এবনে গোলাম সামাদ স্যারের সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে বেশ আগে থেকেই। স্যারের পাঠের নিবিষ্ঠতা, নিয়মিত লাইব্রেরি ব্যবহারের ইতিহাস, লাইব্রেরিতে আটকেপড়া নিয়ে নানা মুখরোচক কিংবদন্তি গল্প, বইপ্রেমের কারণে বউপ্রেমে ধ্বস, অবশেষে সংসারে ভাঙন- এসব বিষয়ে অনেক মুখরোচক গল্প তখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের হাওয়ায় ভেসে বেড়াতো। এতো সব বিষয়ের স্মৃতিময় মানুষটি আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, বিষয়টি অন্যরকম ফিলিংসের না? তাই দৌড় দিয়ে স্যারের সামনে এলাম। সালাম দিলাম। তিনি তাঁর চিরাচরিত অভ্যাস মোতাবেক নিঃশব্দে সালামের উত্তর দিয়ে এগিয়ে গেলেন। ভাবলাম, একি কাণ্ডরে বাবা, তিনি আমাকে পাত্তাই দিলেন না! আমার আগ্রহ দেখেও কিছু জিজ্ঞেস করলেন না? দারুণ চরিত্রের মানুষ দেখছি! মনের মধ্যে নানান কথা বুদবুদ করতে লাগলো। বুদ্ধিজীবি মানুষ তো, জ্ঞানের ঘোরের মধ্যেই আছেন হয়তো। আমিও চলে গেলাম আমার গন্তব্যে।
দ্বিতীয় পর্বের দেখায় রীতিমতো ভরকে গিয়েছিলাম। ২০০৩ সাল। গবেষণার কাজে আমি বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে তখন নিয়মিত বসি। মাঝে মাঝে এবনে গোলাম সামাদ স্যার আসেন। আমি সালাম দেই। স্বভাবজাত উত্তর। তিনি তাঁর কাজে মগ্ন। একদিন স্যার লাইব্রেরিতে ঢুকেই সরাসরি আমার টেবিলে চলে এলেন। আমি ধরফর করে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার পরিচয় দিতেই তিনি বলে উঠলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকরা আবার লেখাপড়া করে? তোমরা তো এখন রাজনীতির মাঠকর্মী। হাউস টিউটর, সহকারী প্রক্টর। শিক্ষক সমিতিসহ বিভিন্ন নির্বাচনের মাঠকর্মী তোমরা। তুমি আবার এই সুন্দর সময়ে কি না লাইব্রেরিতে এসেছো। তাও আবার নিয়মিত দেখছি। স্যারের কথায় আমি ভরকে গেলাম। কি বলবো, বুঝতে পারছিলাম না। শুধু আমতা আমতা করছি, আর মাথা নিচু করে বোকার মতো হাসছি। কিছুক্ষণ পরে স্যার বললেন, অনেক বই টেবিলে দেখছি। কি পড়ছো? বললাম, আরাকানের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছি স্যার। স্যার আমার দিকে আরো একটু মনোযোগী হলেন। বললাম, রোহিঙ্গাদের নিয়ে এম.ফিল করার সময় আপনার প্রবন্ধ পড়েছি। ‘ইতিহাসের ধারায় বাংলাদেশ-আরাকান সম্বন্ধ’। খুব সমৃদ্ধ লেখা। স্যার পাশের চেয়ারটা টেনে আমার সামনে বসলেন। আমাকেও বসতে বললেন। অনেক উপদেশ দিলেন আমাকে। আরাকানের অনেক অলিখিত অজানা গল্প শোনালেন। কী অদ্ভুত ব্যাপার! বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়ে ইতিহাসের বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য দেখে সত্যি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। লেখাপড়ার বিষয়ে বেশকছিু গুরুত্বপূর্ণ কথা শোনালেন। সেই প্রেরণার কথাগুলো এখনো আমাকে সামনের পথে হাঁটতে সাহায্য করে।
এবনে গোলাম সামাদকে পাঠ করছি নিয়মিত। বিশেষকরে শিল্পকলা বিষয়ক গ্রন্থসমূহ আমাকে ভীষণভাবে অবাক করেছে। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত শিল্পকলার ইতিকথা, ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত ইসলামী শিল্পকলা, এবং ২০০৬ সালের প্রকাশিত মানুষ ও তার শিল্পকলা। এ গ্রন্থগুলো শুধুমাত্র শিল্পকলার ইতিবৃত্ত নিয়েই রচিত নয়, বরং শিল্পকলার বিবরণের মধ্যদিয়ে তিনি বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের বিষয় দারুণভাবে খোলাসা করেছেন। ধর্ম এবং শিল্পকলাকে একচেতনায় আবদ্ধ করে তিনি পাঠককে আত্মোপলব্ধির দুয়ারে কড়া নেড়েছেন। তিনি এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন- “ধর্ম কাজ করেছে মানুষের সমস্যা-বিক্ষুব্ধ জীবনের সান্তনা হিসেবে। আশার প্রতীক হিসেবে শিল্পেও সে সৃষ্টি করতে চেয়েছে এক অপার্থিব জগৎ, পরম সান্তনার জগৎ। মানুষ অপ্রাপ্তব্যকে পেতে চেয়েছে তার ধর্ম ও শিল্প সাধনার মাধ্যমে। এ কারণে দেখা যায় শিল্পের মধ্যেও বৈচিত্র্য আছে। আছে বিভিন্ন ধারা। এই বিভিন্নতা তৈরি হয়েছে মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রভাবে।” সুতরাং ধর্ম এবং শিল্প-সংস্কৃতির সম্পর্কটা খুব কাছাকাছি হিসেবেই দেখেন এবনে গোলাম সামাদ। সত্যিকার অর্থে বিশ্বাসের প্রভাব শিল্প-সংস্কৃতির দেহে সংক্রমিত হয়। তাইতো ধর্মীয় দৃষ্টিভংগির কারণে অবস্থাভেদে শিল্প-সংস্কৃতিও রূপ বদল করে থাকে।
শিল্প-সংস্কৃতির মতো নৃতাত্ত্বিক বিষয়েও গভীর জ্ঞানের বিচ্ছুরণ ঘটেছে এবনে গোলাম সামাদ এর জীবনে। তাঁর পঠন-পাঠনের বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে নৃতাত্ত্বিক গবেষণা। এবনে গোলাম সামাদ লিখিত নৃতত্ত্ব বিষয়সমূহ পাঠ করার সময় তাঁকে একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবেই মনে হয়। বৃক্ষের নৃতত্ত্ব নয়, মানব সমাজের নৃতাত্ত্বিক বিষয়সমূহকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন সাবলিল ভঙ্গিতে। বাংলাদেশের মানব পরিচয় প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, আমরা বলেছি, মানুষকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। এরা হলো ককেশয়েড, মঙ্গলয়েড, নিগ্রয়েড এবং অস্ট্রালয়েড। ককেশয়েড মানব বিভাগের মাথার চুল হয় মসৃণ, নাক হয় সোজা, উন্নত ও চিকন, ঠোঁট হয় পাতলা, চোখ হয় আয়ত।মঙ্গলয়েড বিভাগের মানুষের মাথার চুল মসৃণ নয়। এদের চুল হয় খড়খড়ে। মাটিতে পড়লে চুল সোজা হয়ে থাকে, কেবল চুলের মাথা সামান্য বাঁকা হয়ে থাকে। মঙ্গলয়েড বিভাগের মানুষের দেহে লোমের পরিমান হয় কম। মুখে দাঁড়ি গোফ হয় না বললেই চলে। এদের চোখের উপর পাতায় বিশেষ ধরনের ভাঁজ থাকে (Epicanthic fold)। যার জন্যে এদের চোখ ছোটো ও বাঁকা দেখায়। এদের গণ্ডের হাড় হয় যথেষ্ট উঁচু। এজন্য এদের মুখমণ্ডল দেখে যথেষ্ট সমতল (Flat) মনে হয়।
নিগ্রয়েড এবং অস্ট্রালয়েড শ্রেণিভুক্ত মানুষের পরিচয়ে তিনি উল্লেখ করেন- নিগ্রয়েড বিভাগভুক্ত মানুষের চুল হলো পশমী। অর্থাৎ ভেড়ার লোমের মতো পাক খাওয়া। এদের ঠোঁট পুরু, কান ছোটো, মুখমণ্ডল হতে দেখা যায় অপ্রসারিত (Prognathic face) এবং গায়ের রং গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ। যাদের ফেলা হয় অস্ট্রালয়েড বিভাগে তাদের চুল মোটা কিন্তু মসৃণ। নিগ্রয়েড বিভাগভুক্ত মানুষের চুলের মতো এদের চুল পশমের মতো পাক খাওয়া নয়। এদের কপালের মধ্যভাগ কিছুটা নীচু। আর ভুরুর হাড় হয় যথেষ্ট উঁচু (High Brow ridge)।
বাংলাদেশের মানবগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বিষয়ে এবনে গোলাম সামাদ উল্লেখ করেন- বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষকেই স্থাপন করা চলে ককেশয়েড বিভাগে। তবে বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের মানুষের উপর বেশ কিছু পরিমাণে মঙ্গলয়েড বিভাগভুক্ত মানুষেরও প্রভাব থাকতে দেখা যায়। বিভিন্ন বিভাগের মানুষের মধ্যে মিলন ঘটলে তাদের সন্তানের মধ্যে পিতা-মাতার দৈহিক বৈশিষ্ট্য বিভিন্নভাবে বর্তাতে দেখা যায়। যখন পশমের মতো পাক খাওয়া চুল-মানুষের সঙ্গে অন্য কেনো প্রকার চুল-মানুষের মিলন ঘটে, তখন তাদের মিলনজাত সন্তানদের চুল হয় পশমের মতো পাক খাওয়া। আমাদের দেশে পশমের মতো পাক খাওয়া চুলওয়ালা মানুষ সাধারণত দেখা যায় না। যখন মসৃণ ও সোজা-চুল মানুষের মিলন ঘটে, তখন তাদের চুল হতে দেখা যায় মসৃণ প্রকৃতির। যখন সাদা ও কালো মানুষের মিলন ঘটে তখন তাদের মিলনজাত সন্তানদের গায়ের রং হতে দেখা যায় কালো ও সাদার মাঝামঝি। অর্থাৎ বাদামী।
নৃতাত্ত্বিক বিষয়ে এগুলো বেশ সাদামাটা আলোচনা হলেও তাঁর গভীর বিশ্লেষণ অনেক বেশি সমৃদ্ধ। নৃতত্ত্বের প্রথম পাঠ বইটি যেমন নৃতাত্ত্বিক বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্যের গণ্ডিবিষয়ে ভাবনার জগতে তোলপাড় করে তেমনি বাংলাদেশের আদিবাসি এবং জাতি ও উপজাতি বইটিও নৃতাত্ত্বিক যুক্তি-বিশ্লেষেণে অন্যরকম এক অনুভ‚তি জাগিয়ে তোলে। আত্মপরিচয়ের সন্ধানে গ্রন্থটিও নৃতাত্ত্বিক ভাবনায় রসদ যোগায় বৈকি। সবমিলিয়ে মনে হয় তিনি হয়তো নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক।
ইতিহাসের পাঠ এবং পুনঃনির্মাণে তিনি ভীষণ সরস এবং নির্মোহ। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্তের ব্যবহার এবং নির্মোহ বিশ্লেষণ তাঁকে একজন ইতিহাস গবেষক হিসেবে প্রমাণ করেছে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও তাঁর ইতিহাস ব্যবচ্ছেদের পাণ্ডিত্য সত্যি বিস্ময়কর। ইসলামের ইতিহাস, রাজনৈতিক দর্শন, সমাজ-সংস্কৃতির ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, শিল্পকলার ইতিহাস, মানবিক বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা, সর্বোপরি মার্কসবাদসহ রাজনৈতিক বিশ্বের তথ্যবহুল বিশ্লেষণ পাঠক মহলে দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাঁর বাংলাদেশে ইসলাম ও ঐতিহ্য, আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা এবং আরাকান সংকট, বায়ান্ন থেকে একাত্তর, বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি, বাংলাদেশ : সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া, শিল্পকলার ইতিকথা, বাংলাদেশের মানুষ ও ঐতিহ্য, বর্তমান বিশ্ব ও মার্কসবাদ গ্রন্থগুলো তাঁর ইতিহাস বিশ্লেষণ, মূল্যায়ণ, পুনঃপাঠ এবং পুনর্নিমাণের কৃতিত্বে ভ‚ষিত করে।
ধর্মীয় বিশ্বাসে দৃঢ়তার পরিচয় দেন এবনে গোলাম সামাদ। ধর্ম-দর্শন, মুসলিম জাতীয়তাবাদ এবং স্বদেশপ্রেমে তাঁর সুদৃঢ় অবস্থান। ইসলামকে তিনি তিনি শুধুমাত্র একটি ধর্ম হিসেবেই দেখেন না। ইসলামকে একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবেই দেখেন তিনি। ইসলামের ধর্ম-দর্শনের পাশাপাশি সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনের সামগ্রিক বিষয়ে ইসলামের সমাধানকে তিনি একান্তভাবে গুরুত্ব দেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন- “অনেকে বলেন, ধর্মের সাথে রাজনীতিকে যুক্ত করা উচিত নয়। কিন্তু ইসলামে বলা হয়েছে এমন রাষ্ট্র গড়তে হবে, যা হবে ন্যায় ও মানবকল্যাণ ভিত্তিক। যাকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ‘ইসতিসলা’। ইসলামে সমাজজীবনে রাষ্ট্রের ভ‚মিকাকে খাটো করে দেখবার চেষ্টা হয়নি। আসলে ইসলামের আরম্ভই হয়েছে মদীনাতে একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে। ইসলামের নবী ছিলেন একজন রণনিপুণ ব্যক্তি ও দক্ষ প্রশাসক। তিনি যেমন আল্লাহর বন্দেগি করেছেন, তেমনি আবার পালন করেছেন সংসার ধর্ম ও একটি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দায়িত্ব। ইসলামে বৈরাগের (তাসাউফের) স্থান নেই। অন্যদিকে মানুষকে নিয়েই গঠিত হয় রাষ্ট্র। মানব চরিত্রের উন্নয়ন ছাড়া উন্নত রাষ্ট্রীয় তথা সমাজজীবন গঠিত হতে পারে না।”
ইসলামের পাশাপাশি প্রচলিত অন্যান্য ধর্ম-দর্শন নিয়ে ব্যাপক পড়ালেখা করেছেন প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ। ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মের নানাবিধ সংস্কারে এগিয়ে আসা মণীষীবৃন্দসহ তাঁদের গৃহীত কর্মপন্থা নিয়েও যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। রাজা রামহোন রায়ের সংস্কার চেতনা বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন- “রামমোহন মনে করতেন মূর্তি পুজা হিন্দু ধর্ম সম্মত নয়। বেদ ও উপনিষদে মূর্তিপুজা নেই। বেদের চাইতে রামমোহন উপনিষদসমূহের উপরই গুরুত্বারোপ করেছেন বেশি। তিনি নিরাকার এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মতে উপনিষদে পাওয়া যায় বিশুদ্ধ এক ঈশ্বরের ধারণা। তিনি হিন্দু সমাজের অনেক কিছুকেই করেছেন সমালোচনা। সে সময় বাংলায় হিন্দু সমাজে, বিশেষ করে উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথা হয়ে উঠেছিল খুব প্রবল। হিন্দু সমাজে উচ্চবর্ণের মধ্যে প্রচলিত ছিল সতীদাহ প্রথা। সতীদাহ বলতে বোঝায়, হিন্দু মেয়েদের স্বামী মারা গেলে তাদের স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারাকে। হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথা ছিল খুবই ভয়াবহ প্রথা। মুঘল বাদশাহদের মধ্যে অনেকেই এ প্রথা তুলে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি।” এমন অনেক সামাজিক অসঙ্গতিকে তিনি উপস্থাপন করেছেন সরলভাবে।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে বলা হয় চলন্ত বিশ্বকোষ। এবনে গোলাম সামাদকে কি উপাধীতে ভ‚ষিত করা যায় তা আমার আওতার বাইরে। তবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবনের এ ক্ষুদ্র সময়ে তাঁর সংস্পর্শে বহুবার যাবার সুযোগ হয়েছে। সুযোগ হয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলার। সেমিনার সেম্পুজিয়াম কিংবা অনেক আলোচনা সভাতে তাঁকে অতিথি করে এনেছি। বক্তৃতা শুনেছি। ব্যক্তিগতভাবে আলাপচারিতা হয়েছে বেহিসেবি। ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি-অর্থনীতি, বিশ্বপরিস্থিতি, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিসহ যখনই যে বিষয় তাঁর সামনে উপস্থাপিত হয়েছে তিনি সাবলিলভাবে দক্ষতার সাথে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মগজটিতে হয়তো বিশ্বের বড় বড় পাঠাগারের গ্রন্থগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সবগুলো কম্পিউটারের সফটকপি। চিন্তার জগতে ক্লিক করলেই চলে আসে।
পরিশেষে বলা যায়, জ্ঞানতাপস প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট সকাল সাড়ে দশটায় রাজশাহী মহানগরীর ফায়ার ব্রিগেড মোড়ের নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৯৪ বছর। তাঁর ইন্তেকালের মধ্যদিয়ে জাতি একজন সমাজচিন্তক, রাষ্ট্রচিন্তক এবং দেশপ্রেমিক দার্শনিককে হারালো। ২০২১ সালের ঈদুল ফিতরের আগে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। তখন তিনি সুস্থ ছিলেন। অবশ্য পরে অসুস্থতার সময় অনেকবার দেখা করেছি। সে সময় দুইজন প্রাজ্ঞরাজনীতিবিদ এবং আইনজীবি ছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন- ইসলামকে সামাজিকভাবে উপস্থাপন করুন। ইসলামের চেয়ে ভালো কোনো সমাজব্যবস্থা পৃথিবীতে নেই। ইসলামকে সামাজিকীকরণ করতে পারলে মুসলিম-অমুসলিম সবাই ইসলামী আদর্শকে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে। আর রাজনৈতিকভাবে আদর্শ চরিত্রে যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ তৈরি করুন, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বাড়ান, সাধারণ মানুষের সাথে একাকার হয়ে যান। সেইসাথে শক্তি অর্জন করুন, যেনো কেউ দুর্বল মনে না করতে পারে। তিনি হেসে হেসে বললেন, কারণ মানুষ শক্তের ভক্ত, নরমের যম। তাহলেই ইসলামী আদর্শের বিজয় আসবে।