এবনে গোলাম সামাদ : কিছু স্মৃতি – মাহমুদ শাহ কোরেশী

Credit: The Daily Star

এবনে গোলাম সামাদ সম্পর্কে লিখবো না কিংবা লিখতে পারবো না স্থিরীকৃত হবার পরও কলম হাতে নিতে হলো। হঠাৎ হাতে এসে পড়লো ‘সমকাল’ পত্রিকার অষ্টাদশ বর্ষ নবপর্যায় : প্রথম সংখ্যা, মাঘ ১৩৮২ তারিখের কপিটি। এতে রয়েছে এবনে গোলাম সামাদের একটি লেখা ‘জাফর ভাই-একটি স্মৃতি চারণা’, পৃষ্ঠা ৩২-৩৪। ছোট লেখাটিতে সিকান্দার আবু জাফরের বহুমুখী প্রতিভার পরিচিতি যেমন উপস্থাপিত, তেমনি ছিল প্রবন্ধকার এবনে গোলাম সামাদের মানস পরিচয়। তড়িঘড়ি আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হলো। এমকি হঠাৎ করে কিছু জমা স্মৃতি যেমন মনে পড়ে গেলো, তেমনি বাংলাদেশের এই অসামান্য বুদ্ধিজীবীর দীপ্ত চেহারাটি আমার স্মৃতিপটে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো ।

একই সময়ে ঢাকায় থাকলেও তার সাথে আমার কখনো সাক্ষাৎ ঘটেনি। ‘সমকাল’ সম্পাদকের সঙ্গেও এবনে গোলাম সামাদের তখন দেখা হয়নি। প্রথম সংখ্যাটি পড়ে সামাদ উদ্বুদ্ধ হলেন এবং একটি প্রবন্ধ লিখে তাঁর (সিকান্দার আবু জাফর) বাসার চিঠির বক্সে ‘ফেলে দিয়ে’ এসেছিলেন। ক’দিন পর দ্বিতীয় সংখ্যায় সেটি প্রথম লেখা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। এতে লেখক ও লেখার কথা মনে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। কয়েক বছর পর, ১৯৬০ সালের হেমস্তে এই লেখকের সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটলো প্যারিসে এবং তাঁকে আমি একটা বড় ব্যাপারে সহায়তা করতে পারলাম।

যেহেতু একবছর আগে আমি প্যারিসে গিয়েছি এবং ফরাসিদের বিচিত্র কর্মপদ্ধতি কিছুটা উপলব্ধি করতে পেরেছি। তার ফলে তাঁকে এই সাহায্য দান সম্ভব হয়েছিল। এবনে গোলাম সামাদকে নিয়ে আমি স্কলারশিপ কমিটির অফিসে গিয়েছিলাম এবং যেহেতু তিনি কী ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করবেন সেটা সিদ্ধান্ত ছিল না। তখন আমি জোর দিয়ে বললাম, ডক্টরেট করবেন। কিন্তু সামাদের তো ‘মাস্টার্স’ ডিগ্রি নেই। তখন আমি তাঁর এর আগে বিলাতে একবছর ‘পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টাডিজের যে সার্টিফিকেট আছে তা দেখিয়ে বললাম, ফরাসি নিয়ম কানুনের মধ্যে মাস্টার্স ডিগ্রি করতে হবে এমন কোন উল্লেখ নাই। অনেক তর্ক বির্তকের পর ওরা আমার কথা মেনে নিলো এবং সামাদ ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রির জন্য ভর্তি হলেন একটি বিশেষ গবেষণাগারের সাথে সংযুক্ত হয়ে ।

এর আবার কিছু পর শিল্পী রশীদ চৌধুরী এলেন এবং তাঁকে ভর্তির ব্যাপারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অনুরোধ ক্রমে আমি একইভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হলাম। সামাদ আর রশীদ দুজনেই আমার ৫/৬ বছরের বড়। কিন্তু বিদেশে থাকার কারণে তাঁদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হলো। তবে রশীদের সঙ্গে প্রথম দিন থেকেই । ‘তুমি-তুমি’ শুরু হলো আর সামাদের সঙ্গে আজীবন ‘আপনি’ রয়ে গেলো ।

তবে মনে পড়ে এ সময় সামাদ প্রায় আমার কাছে আসতেন। দুপুর বেলা আমরা এক সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্তোরাতে খেতে যেতাম। কখনও ফেরার পর আমার ঘরে এক কাপ কফি খেয়ে তিনি ল্যাবে ফিরতেন। একবার তার জন্য কফি তৈরি করতে গিয়ে আমার ঘরে অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল। ভাগ্যিস, অল্পের উপর দিয়ে রেহাই পেলাম। রশীদ সহ আমরা দু-চারবার ‘মোবার’ নামের বিখ্যাত কাফে কুরানি /দোম-এর কোন একটিতে বসে কফি খেতাম আর তাদের দুজনের শিল্প বিষয়ক বিতর্ক উপভোগ করতাম। কোনো রোববার আমরা লুভ্র জাদুঘরে ছবি দেখতে ঢুকতাম। রোববার ছিলো “ফ্রি’।

১৯৬২ সালের শেষ তিনমাস আমি আমেরিকায় ও একমাস লণ্ডনে কাজ শেষে প্যারিসে ফিরলাম। তখন দেখি বন্ধু দুজন ফরাসি দুই তরুণীকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। শুনলাম সামাদ তাঁর ল্যাব প্রধানের কন্যাকে অংক শেখাতে গিয়ে প্রণয়কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। তবে তিনি আমাদের থেকে একটু দূরে সরে থাকলেন। একবার শুনলাম একসময় ডক্টরেট ডিগ্রি সমাপ্ত করে তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন।

আমি আরো অনেক পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি নিলাম। ১৯৭০ সালের শেষদিকে আমার বিয়ের পানচিনি অনুষ্ঠানের সময় সামাদ সন্ত্রীক তাঁর দুইপুত্রসহ চট্টগ্রামে বেড়াতে এলেন। তাঁর এক ভাই এবনে গোলাম নবী চট্টগ্রামে আমার বন্ধু সুচরিত চৌধুরীর সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত ছিলেন। সামাদ সপরিবারে আমার বাসায় দাওয়াত খেতে এলেন এবং আমার পানচিনিতেও গেলেন রশীদ চৌধুরীদের সঙ্গে। তিনি সেসময়ে রাজশাহীতে কর্মরত। কয়েকবছর পর আমিও রাজশাহী চলে গেলাম ইস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজ এর প্রফেসর পদে যোগ দিয়ে, ২ বছরের মাথায়। সেখানে আমি একটি বড় আন্তর্জাতিক সেমিনার করলাম- উপজাতি সংস্কৃতির ওপর।

আমার অনুরোধে একটি প্রবন্ধসহ সামাদও তাতে যোগ দিলেন। সেটা প্রকাশিত হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটেছে। রাজশাহী গিয়ে জানলাম, তাঁর ফরাসি স্ত্রী ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে ২ পুত্রসহ প্যারিসে চলে যান। ১৯৭৩ সালে আমি সন্ত্রীক প্যারিস গেলে তার (সামাদের ফরাসি স্ত্রী) সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং তার কাছ থেকে শুনি, সামাদ প্যারিসে এলে তিনি তার সঙ্গে থাকবেন। কিন্তু বাংলাদেশে ফিরে যাবেন না। আমার দীর্ঘ অবস্থানকালে তিনি ফিরে আসেননি। এক পর্যায়ে শোনা গেল, সামাদ দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।

মধ্যাহ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে সামাদকে নিয়ে সবাই খুব মজা করতো তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা উপভোগ করতো সবাই। আমি এক সন্ধ্যায় বেনারসী শাড়ি পরিহিতা মিসেস সামাদকে দেখি শিক্ষকদের বার্ষিক ডিনারে সামাদকে কাঁধে হাত দিয়ে ‘এসকর্ট’ করে নিয়ে যেতে। দীর্ঘদিন তার সাথে আমার আর যোগাযোগ নেই। তবে রাজশাহীতে ২০ বছর কর্মরত থেকে আমি অবসর নিই। পরে আরো ১৭ বছর গণবিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করি। সেখানে আশরাফ সাহেব নামে এক কর্মকর্তাকে পাই। তিনি সামাদের লেখার ভীষণ ভক্ত। এবনে গোলাম সামাদ প্রতি শনিবার ‘নয়া দিগন্ত’ পত্রিকায় একটি কলাম লেখেন। তার ফটোকপি করে বেশ কয়েকটি কপি আশরাফ সাহেব আমাকে দিতেন।

অবশ্য এর আগে নব্বইয়ের দশকে ‘পালাবদল’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। আমি মাঝে মধ্যে লিখতাম। উল্লেখ্য যে আমি তার লেখার অনুরাগী। অনেক সময় তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হলেও তার তথ্য কিংবা উপস্থাপনের অভিনবত্ব, যুক্তি বিস্তার ও প্রাসঙ্গিকতার জন্য প্রবন্ধাবলি পাঠকের আগ্রহ সৃষ্টি করতো বলে আমার ধারনা। এবনে গোলাম সামাদ শিল্পকলা, ভাষা, রাজনীতি-অনেক বিষয়ে লিখতেন। উল্লেখ্য যে, তাঁর বড় বোনের লেখা একটি চমৎকার উপন্যাস পড়েছি ফজলে লোহানীর ‘অগত্যা’ পত্রিকায়। সে হলো পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকের কথা।

দীর্ঘদিন সামাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। গত বছর এক সংক্ষিপ্ত সফরে রাজশাহী গেলে আমি তাঁর খোঁজ নিতে চেষ্টা করি। কিন্তু সম্ভব হয়নি। কয়েক মাস আগে তাঁর একটি পুরনো চিঠি পেয়ে আমি সেই ঠিকানায় একটি পত্র দিই। কিন্তু কোনো জবাব আসেনি। সিকান্দার আবু জাফর যেমন চিনে ছিলেন এবনে গোলাম সামাদকে তেমনি অন্য অনেকের মতো আমিও ছিলাম তার বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তার বিশেষ ভক্ত। তিনি জান্নাতবাসী হোন।

লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক ও সাবেক মহাপরিচালক; বাংলা একাডেমি। লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, শাহাদাৎ সরকার সম্পাদিত ‘বহুমাত্রিক এবনে গোলাম সামাদ’ এ। 

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ