এবনে গোলাম সামাদ : নির্মোহ পণ্ডিতের প্রতিকৃতি – ড. তারেক ফজল

১৯৯৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রায় সব কিছুই আমাকে নতুন করে জানতে হয়েছে। জেনেছি একজন ব্যতিক্রমী শিক্ষক-পণ্ডিতের কথা। তিনি উদ্ভিদ বিজ্ঞানের প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ। ক্রমে জানতে থাকি, উদ্ভিদ বিজ্ঞানের এই শিক্ষক নৃবিজ্ঞানের ‘পাঠ্য’ বহুদিন থেকে। জ্ঞান-গবেষণার নানা শাখায় তার ব্যাপক স্বচ্ছন্দ বিচরণ। একাডেমিক প্রকাশনায় তিনি ‘গভীরতার’ স্বাক্ষর রাখেন। জনপ্রিয় লেখালেখিতেও তার পাণ্ডিত্য স্বপ্রকাশ। বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতি-প্রতিরক্ষা-বিদেশনীতি বিষয়ে তিনি লিখে চলেন বিরামহীন, ‘শুদ্ধতার কর্তৃত্ব’ নিয়ে। ‘বাংলাদেশ প্রেমের’ এমন আবেগমুক্ত পাণ্ডিত্য সত্যি বিরল।

সেই ১৯৯৫ সালে তিনি অবসরে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে। তার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়নি আমার। বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎ হয়েছে এখানে-সেখানে। দু-তিনবার সময় করে তার বাড়িতে গিয়েছি। মোবাইল ফোনে তার কথা রেকর্ড করেছি। সেগুলো যথেষ্ট পরিকল্পিত ও সুব্যবস্থিত ছিল না। তাই তার একটি বিস্তারিত ও সুব্যবস্থিত সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা ভাবছিলাম। একপর্যায়ে দেশে কোভিড-১৯ হানা দেয়। পিছিয়ে যায় পরিকল্পনা। পরে লন্ডন প্রবাসী এক শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাবিদ-সাংবাদিক ফরিদ আহমদ রেজা ও ইস্তাম্বুল প্রবাসী উদ্যমী গবেষক ও উদ্যোক্তা স্নেহভাজন জোবায়ের আল মাহমুদ সমর্থন জোগালেন একটি ভার্চুয়াল সাক্ষাৎকার গ্রহণ প্রক্রিয়ায়। আমি ঢাকা থেকে যুক্ত হই। প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদের বড় ছেলে, শাহরিয়ার সামাদের সহায়তায় গ্রহণ করি তার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। পাঁচ অধিবেশনের এ সাক্ষাৎকারে এবনে গোলাম সামাদের জীবন-অভিজ্ঞতা, তার প্রজ্ঞা ধারণের চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের সেই উদ্যোগ তার প্রতি শ্রদ্ধার এতটুকু স্মারক হয়ে মহাকালে হাজির থাকুক। গুগল-ইউটিউবের মতো প্রযুক্তি-মাধ্যম এ কাজ করে যাবে।প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদের নানামাত্রিক ভাবনা ও প্রজ্ঞা ছড়িয়ে আছে তার লেখা গ্রন্থ ও কলাম সঙ্কলনে। বর্তমান নিবন্ধে তার ভাবনা ও প্রজ্ঞার আংশিক উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি।

বাঙালি, বাংলাদেশ, জাতিসত্তা ও ধর্ম

এবনে গোলাম সামাদ লিখেছেন- ‘বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষকেই স্থাপন করা চলে ককেশয়েড বিভাগে।’ (আত্মপরিচয়ের সন্ধানে, ২০১৫, পৃষ্ঠা-১৯। অতঃপর ‘২০১৫ : ১৯’ রূপে)। চেহারা বিবেচনায় মানুষকে বুঝতে চারটি বড় ভাগে ভাগ করা হয়Ñ ককেশয়েড, মঙ্গোলয়েড, নিগ্রোয়েড ও অস্ট্রালয়েড। ‘ককেশয়েড মানব বিভাগের মানুষের চুল হয় মসৃণ, নাক হয় আয়ত’। (২০১৫ : ১৮) ‘তবে বাংলাদেশে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের মানুষের ওপর বেশ কিছু পরিমাপে মঙ্গোলয়েড বিভাগভুক্ত মানুষেরও প্রভাব থাকতে দেখা যায়। বিভিন্ন বিভাগের মানুষের মধ্যে মিলন ঘটলে তাদের সন্তানের মধ্যে মা-বাবার দৈহিক বৈশিষ্ট্য বিভিন্নভাবে বর্তাতে দেখা যায়।…বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ হলো মাঝারি আকৃতির মাথাসম্পন্ন। সাধারণত লম্বা ও গোল মাথা মানুষের মধ্যে মিলনজাত সন্তানকে হতে দেখা যায় গোল মাথা। মাথার আকৃতির দিক থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে যথেষ্ট মিশ্র-প্রকৃতির মানুষও চোখে পড়ে।’ (২০১৫ : ১৯) ‘…ইউরোপের এই মানবধারার কথা মনে রাখতে হয়। কেননা, আমাদের দেশে মানবধারা বর্ণনার ক্ষেত্রে অনেকে ইউরোপীয় মানবধারার ধারণাকে অনুসরণ করতে চেয়েছেন। যেটা করা উচিত নয়। তবুও এটা করা হয়েছে। যাতে হয়ে গেছে অর্থ বিভ্রাট। যেমন- যাদের মাথা লম্বা এবং মাথার মধ্যভাগ কিছুটা উঁচু, উত্তর ভারতে এ রকম লোককে বলা হয়েছে নর্ডিক। কিন্তু নর্ডিকদের মাথার চুল সাধারণত হয় সোনালি এবং চোখের তারার রঙ হয় নীল কিন্তু এদের এই বৈশিষ্ট্য নেই। বাংলাদেশের মানুষকে অনেকে বর্ণনা করতে চেয়েছেন আলপাইন হিসেবে। কারণ, এদের অনেকের মাথা আলপাইনদের মতো গোল। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের আরো অনেক বৈশিষ্ট্য আছে। যা ঠিক ইউরোপীয় মানবধারার সাথে মেলে না।’ (২০১৫ : ২০)

‘বঙ্কিমচন্দ্র তার বিখ্যাত ‘বাঙ্গালীর উৎপত্তি’ নামক প্রবন্ধে বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে এক জাতি হিসেবে গণ্য করেননি।…বঙ্কিমচন্দ্রের মতে বাংলা ভাষাভাষীদের চারটি ভাগ লক্ষ্য করা যায়। তাদের মধ্যে একটি ভাগ হলো আর্য হিন্দু, যার বিশেষ দৃষ্টান্ত হলো ব্রাহ্মণ। দ্বিতীয় হলো আর্য-অনার্য মিশ্র হিন্দু, আর তৃতীয়টি হলো অনার্য হিন্দু এবং চতুর্থটি হলো বাংলাভাষী মুসলমান। তিনি বলেন, বাংলাভাষী মুসলমান বাংলাভাষায় কথা বললেও জন্মগতভাবে তারা হলো বিশেষভাবেই একটি পৃথক জাতি। নিকৃষ্ট জাতি। কেননা, তাদের মধ্যে আর্য রক্তের লেশমাত্র নেই।’ (২০১৫ : ২১)
এবনে গোলাম সামাদ লিখেন, ‘বাংলাভাষী মুসলমানদের এক সময় সাধারণত বাঙালি হিসেবে গণ্য করা হতো না। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) তার বহুল পঠিত উপন্যাসের ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পাঠের শুরুতে উল্লেখ করেছেন, বাঙালি ও মুসলমানের ফুটবল খেলার কথা। …বাংলাভাষী মুসলমানকে বাঙালি বলা আরম্ভ হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, তার আগে নয়।’ (২০১৫ : ২৩)

কংগ্রেস (আইএনসি) নেতা পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু (১৮৮৯-১৯৬৪) ১৯২৮ সালে ইংলিশে এক চিঠিতে তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন- ‘আর্য কথাটার মানে ভদ্রলোক, উচ্চ-মার্জিত স্বজন। আর্যরা অত্যন্ত স্বাধীনতাপ্রিয় ছিল। আর আজ! আমরা সেই আর্যদের বংশধর হয়েও পরাধীনতার শৃঙ্খলকে গলায় মালা করে পরে আছি।’ (জওয়াহেরলাল নেহরু, মা-মণিকে বাবা, সম্পাদনায় মজিবর রহমান খোকা, বিদ্যাপ্রকাশ, ঢাকা : ১৯৯২, পৃষ্ঠা-৭৯)। এবনে সামাদ লিখেন- ‘জানি না এ কথা কী করে বলতে পেরেছিলেন। কারণ আর্যরা এই উপমহাদেশে এসেছিল বাইরে থেকেই আর জয় করেছিল এই উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। তারা অনার্যদের ওপর করেছিল রাজ্য বিস্তার। আর চালিয়েছিল বিশেষ অত্যাচার। অনার্যরা ছিল কৃষিজীবী। তাদের ছিল উন্নত সভ্যতা। কিন্তু আর্যরা এতটা উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিল না। তারা যুদ্ধ করে দখল করেছিল বিস্তীর্ণ অঞ্চল। তারা ছিল রণনিপুণ। কিন্তু রণ নিপুণতা সভ্যতার মানদণ্ড হতে পারে না। দক্ষিণ ভারতের বিরাট অঞ্চলজুড়ে বাস করেন দ্রাবিড় পরিবারভুক্ত ভাষায় কথা বলা মানুষ। নৃতত্ত্বের বিচারে এরা আর্য নয়। কিন্তু তাদের ছিল খুবই উন্নত সভ্যতা। ছিল লিখিত সাহিত্য। ছিল নিজেদের অক্ষর (বত্তেলিত্ত)। জওয়াহেরলাল তার চিঠিতে তাদের স্থান দিতে চাননি। তার চিঠি পড়লে মনে হয় ভারত যেন হলো কেবল আর্যদেরই দেশ। আজকের ভারতে উত্তর ভারত আর দক্ষিণ ভারতের মধ্যে জেগে উঠেছে আর্য-অনার্য মনোমালিন্য।’ (২০১৫ : ২৩-২৪)

সামাদ আরো লিখছেন- ‘অনেকের ধারণা বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল তরবারির জোরে। কিন্তু এই ধারণার মূলে কোনো সত্য আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে ব্রিটিশ আমলে প্রথম আদমশুমারি (আদম শুমার) হয় ১৮৭১ সালে। ওই সময় বাংলায় হিন্দুদের সংখ্যা মুসলমানদের চাইতে বেশি ছিল। পরে ১৮৮১ সালে আদমশুমারিতে দেখা গেল হিন্দুদের সংখ্যা কমতে এবং মুসলমানের সংখ্যা বাড়তে। এর পর থেকে বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দুদের জোর করে মুসলমান করার কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। (Herbert Read, The Meaning of Art, Penguin Books, 1956, pp-80-83)। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার নিয়ে এখনো যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। বাংলাদেশের দু’টি যথেষ্ট পুরনো স্থান হলোÑ নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর ও কুমিল্লা জেলার ময়নামতি। এ দু’টি জায়গায় মাটি খুঁড়ে প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। তাই জায়গা দু’টির যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। পাহাড়পুরে খলিফা হারুন-অর-রশিদের একটি স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে। মুদ্রাটি ১৭২ হিজরির (অর্থাৎ ৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দ)। অন্য দিকে ময়নামতিতে পরবর্তীকালের আব্বাসি খলিফাদের দু’টি রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে। এ থেকে অনুমান করা চলে, বাংলাদেশে আরব মুসলমান বণিকদের যাওয়া-আসা ছিল। … বাংলাদেশে মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে আরম্ভ করে এ দেশে তুর্কি মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে। কিন্তু এ দেশে হিন্দুরা নন, বৌদ্ধরাই প্রধানত গ্রহণ করেছিলেন ইসলাম। …দক্ষিণ ভারতে জাফর শরীফ নামে এক ব্যক্তি ‘কানন-ই-ইসলাম’ নামে একটি বই লেখেন। পরে বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন G.A. Herklot। বইটির নাম দেন Islam in India। ১৯২১ সালে বইটিকে ঢেলে সাজান ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিক উইলিয়াম ক্রুক। এই বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদে ক্রুক বলেন, বাংলাদেশে হিন্দুরা মুসলমান হননি, হয়েছিলেন বৌদ্ধরা। তাই বাংলাদেশে (অর্থাৎ তখনকার বাংলা প্রদেশে) মুসলমানের সংখ্যা বেশি। ক্রুকের মতটি গ্রহণ করা হয়েছে History of India বইতে। (তৃতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৮০১)।…১৯৪০-এর দশকে জার্মান গবেষক ম্যাকফারলেন পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলমানের রক্তের গ্রুপ বিশ্লেষণ করে বলেন, তাদের রক্তের গ্রুপের বিভিন্ন হারের সাথে মিলে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের রক্তের বিভিন্ন গ্রুপের হার। তাই ধরে নেয়া যায়, বাংলাভাষী মুসলমানদের উদ্ভব হতে পেরেছে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের থেকে। কিন্তু এই মত এখন আর আদৃত নয়। কেননা, নতুন গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের মুসলমানদের রক্তের গ্রুপের বিভিন্ন হার যত না মিলছে তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সাথে তার চেয়ে অধিক মিলছে তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে।’ (২০১৫ : ২৮-৩০)

এবনে গোলাম সামাদ দাবি করেছেন, ‘বাংলাদেশের জাতিসত্তাকে উপলব্ধি করতে গেলে ইসলামকে বাদ দিয়ে সম্ভবপর হতে পারে না। ইসলাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে এ দেশের জাতিসত্তায়। ইসলামকে বলা চলে এ দেশের জাতি গঠনের বিশেষ উপাদান (Ethno-formative factor)।’ (বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি, রাজশাহী : পরিলেখ, ২০১৬, পৃষ্ঠা-১০৮)। এভাবে এবনে গোলাম সামাদ বাঙালি, বাংলাদেশ ও বাঙালির জাতিসত্তা ও ধর্মের গঠন ও বিবর্তন বিষয়ে প্রচলিত বেশ কিছু ধারণার অশুদ্ধতা চিহ্নিত করেছেন। উপস্থাপন করেছেন এসব বিষয়ের শুদ্ধ ধারণা। কিছু বিষয়ে এখনো অস্পষ্টতা থেকে গেছে। সেসব বিষয়ে তিনি উপযুক্ত গবেষণার তাগিদ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ, বাঙালি, বাংলাভাষা ও বাঙালির ধর্ম প্রসঙ্গের প্রচুর সংখ্যক উপপ্রসঙ্গ ও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিতর্ক-ভিন্নমত রয়েছে। সামাদ কয়েকটি গ্রন্থে ও প্রচুর সংখ্যক কলাম রচনায় সেসব প্রসঙ্গ-উপপ্রসঙ্গ ও তথ্য-উপাত্ত বিষয়ে পাঠককে প্রাপ্ত সর্বশেষ জ্ঞান বিলিয়েছেন। এসব বিষয়ে তিনি লিখেছেন ‘বাংলাদেশে ইসলাম’, ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’, ‘বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি’, ‘আমার স্বদেশ ভাবনা’, ‘বাংলাদেশে ইসলাম ও ঐতিহ্য’, ‘বাংলাদেশের মানুষ ও ঐতিহ্য’, ‘বাংলাদেশ : সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’, ‘বায়ান্ন থেকে একাত্তর’, ‘আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা এবং আরাকান সঙ্কট’, ‘আত্মপক্ষ’ প্রভৃতি গ্রন্থ। এর বাইরে লিখেছেন ‘নৃতত্ত্বের প্রথম পাঠ’, ‘প্রাথমিক জীবাণুতত্ত্ব’, ‘ইসলামী শিল্পকলা’, ‘শিল্পকলার ইতিকথা’, ‘উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব’, ‘জীবাণুতত্ত্ব’, ‘উদ্ভিদ সমীক্ষা’, ‘মানুষ ও তার শিল্পকলা’, ‘বর্তমান বিশ্বে মার্কসবাদ’ প্রভৃতি গ্রন্থ। এসব গ্রন্থের বাইরে তার কলামসমূহের দু’টি বৃহদাকার সঙ্কলন প্রকাশ করেছে ঢাকার প্রকাশক ‘বুকমাস্টার’।

বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিকাশ বিষয়ে তিনি যেসব যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছেন, পাঠককে তা অনেক দ্বিধা ও অস্পষ্টতা থেকে মুক্ত করে। ব্রাহ্মণ হিন্দুর আর্যত্ব ও অন্য মানুষের প্রতি তাদের অমানবিকতা বিষয়ে সামাদ বিস্তারিত ধারণা দিয়েছেন। সব মানুষই যে ‘মানুষ’ হিসেবে সমান সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে জীবন যাপনের অধিকার রাখে, ব্রাহ্মণ্যবাদ তা স্বীকার করে না। ব্রাহ্মণদের ক্ষতিকর এই সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে কথিত শিক্ষিতজনদের বিকারহীনতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।

বাংলাদেশের আদিবাসী বিষয়ক বিতর্কে এবনে সামাদ সম্ভবত যে কারো চেয়ে নির্দিষ্ট ও দৃঢ়ভাবে যুক্তি দিয়েছেন। বলেছেন, কৃষিজীবী বাঙালি জনগোষ্ঠীই বাংলাদেশের প্রকৃত ও যথার্থ আদিবাসী। অন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বাস করতে শুরু করেছে মাত্র তিন-চার শতাব্দী আগে। কৃষিজীবী ও সমতলবাসী বাঙালিরা বাস করছে খ্রিষ্টপূর্ব কাল থেকে। তাই তারাই এ দেশের-ভূখণ্ডের অবিসংবাদিত আদিবাসী। বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বর্তমান রাজনৈতিক অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা তিনি তুলে ধরেছেন। এর সাথে সম্পর্কিত রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় বিষয়াদির বিতর্কিত প্রশ্নের সমাধান দিয়েছেন।

নিজের প্রেরণা বিষয়ে তিনি বলছেন- ‘অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তির দ্বারা আমি হয়েছি প্রভাবিত। যেসব কালজয়ী প্রতিভাবান ব্যক্তি আমাকে প্রভাবিত করেছেন তাদের মধ্যে একজন কার্ল ফন লিনে (১৭০৭-১৭৭৮)। ইনি ছিলেন সুইডিস। কিন্তু সুইডিস ভাষায় বই না লিখে, তার সময়ের পণ্ডিতদের মতো বই লিখেছেন লাতিন ভাষায়। লিনে (Linne) নামটা লাতিন ভাষায় হয়েছে Linnaeus। …লিনিয়াস তার বিখ্যাত Systema naturae (1758) নামক গ্রন্থে মানুষকে স্থাপন করেছেন প্রাইমেটস (Primates) বর্গে। আর মানুষের নাম রেখেছেন Homo sapiens. লাতিন ভাষায় ‘হোম’ মানে হলো মানুষ। আর ‘সেপিয়েন্স’ মানে হলো জ্ঞানী।’ (২০১৬ : ১১১)

নিজের অস্তিত্ব বিষয়ে সামাদ লিখেন- ‘আমি ছিলাম, ঐ যাকে সাধারণভাবে বলে অভিজ্ঞতাবাদী। সব কিছু যুক্তি দিয়ে প্রমাণিত হয় না। কেউ যদি বলে, রাজশাহী শহরে ১৪০ রকম আম বিক্রি হয়, তবে তার কথাটা সত্য কি না, সেটা জানার জন্য যেতে হবে রাজশাহীর বাজারে। বিশুদ্ধ যুক্তি দিয়ে এটার সত্য-মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে না।’ (২০১৬ : ১২৫)

এবনে গোলাম সামাদের প্রতিটি লেখা-কলামে পাঠক সমৃদ্ধ হন। পান নতুন অজানা জ্ঞানের সন্ধান। তার সহজ-সরল শব্দ চয়নে থাকে নির্মোহ সত্যের স্বাদ। তার আবেগমুক্ত পাণ্ডিত্যে পাঠক পেয়ে চলেছেন ভবিষ্যতে এগিয়ে চলার নির্দেশনা। নবোতিপর এই অভিজ্ঞতাবাদীর জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করুক পাঠকদের। অব্যাহত থাকুক এই জ্ঞানযাত্রা।

লেখক : ড. তারেক ফজল, রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক নয়া দিগন্তে, ০৮ জুলাই ২০২১। 

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ