রুশ বিপ্লবী ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ভ্লাদিমির লেনিন ১৯০৫ সালে একবার রুশ সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চান; কিন্তু সেবার তিনি তাতে কৃতকার্য হন না। তিনি কৃতকার্য হন ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর দ্বিতীয় প্রচেষ্টায়। প্রধানত জার্মানির বিশেষ সহায়তায়। এ সময় চলছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। রাশিয়া এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল ফ্রান্সের পক্ষে, জার্মানি ও অস্ট্র-হাঙ্গেরীর বিপক্ষে। লেনিন ছিলেন এ সময় সুইজারল্যান্ডে। জার্মানি চেয়েছিল লেনিনকে দিয়ে রাশিয়ায় বিপ্লব ঘটাতে। কারণ সে ভেবেছিল রাশিয়ায় বিপ্লব হলে রাশিয়া আর যুদ্ধ করতে পারবে না। জার্মানি তার সৈন্য সব সরিয়ে এনে যুদ্ধ করতে পারবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেন জার্মানির পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ করছিল। ব্রিটেন ফ্রান্সকে সাহায্য করছিল তার আপন স্বার্থে এবং জার্মানিকে ইউরোপের সর্ব বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে না দেয়ার জন্য। ব্রিটেনের এই নীতিকে উল্লেখ করা হয় শক্তির ভারসাম্য নীতি হিসেবে। ব্রিটেন চেয়েছে ইউরোপে ফ্রান্সকে দিয়ে জার্মানিকে কাবু করতে।
রুশ বিপ্লব ঘটেছিল একটি বিশেষ অবস্থায়। কেবলই লেনিনের বিপ্লবী নীতিচেতনার জন্য নয়; যেমন বাংলাদেশের কিছু বুদ্ধিজীবী আমাদের বোঝাতে চাচ্ছেন। রাশিয়ায় সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ১৯০৩ সালে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এ ভাগকে বলা হতে থাকে বলসেভিক, আরেকভাগকে বলা হয় মেনসেভিক। বলসেভিক শব্দের অর্থ হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ। মেনসেভিক অর্থ হলো, সংখ্যালঘিষ্ঠ। ১৯০৩ সালে লন্ডনে রুশ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে ভোট হয়। এই ভোটে লেনিনের অনুসারীরা পান অধিকসংখ্যক ভোট। তাই তারা পরিচিত হন বলসেভিক হিসেবে। বলসেভিকরা বলেন, বল প্রয়োগ করে রুশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতা দখল করে পরিকল্পনা অনুসারে রাশিয়ায় গড়তে হবে সমাজতন্ত্র। অন্য দিকে মেনসেভিকরা বলেন, প্রথমে রুশ সাম্রাজ্যকে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আইন করে ধাপে ধাপে রাশিয়াতে গড়তে হবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি।
এই দুই দলই ছিল কার্ল মার্কসের ভাবধারা অনুপ্রাণিত। কিন্তু মেনসেভিকরা বিশ্বাস করতেন উদার গণতন্ত্রে। বলসেভিকরা তা বিশ্বাস করতেন না। তারা বিশ্বাস করতেন বিপ্লব করবে এমন একটি দল, যারা ক্ষমতায় গেলে বিপ্লবী পরিকল্পনানুসারে সামজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তুলবে। এরা বিশ্বাস করতেন একদলের রাজত্বে। কিন্তু মেনসেভিকরা তা করতেন না। মেনসেভিকরা মনে করতেন একদলের রাজত্বে স্বেচ্ছাচারিতা প্রশ্রয় পাবে। কেননা, জনগণের থাকবে না সরকারকে সমালোচনা করার অধিকার। বলসেভিকরা কার্ল মার্কসের সর্বহারা একনায়কত্বের ধারণার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। কিন্তু লেনিন সর্বহারা ছিলেন না। তার দলের অধিকাংশ সদস্যকেই বলা যেত না সর্বহারা। তারা প্রায় সবাই ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। লেনিন আইন পড়েছিলেন কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে। পেশায় তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। লেনিনের পিতা ছিলেন রাশিয়ার একটি উচ্চ বিদ্যানিকেতনের অধ্যাপক। কিন্তু বলসেভিক পার্টির সবারই দাবি ছিল, তারা আর মধ্যবিত্ত নন, সবাই হয়ে পড়েছেন সর্বহারা। সর্বহারা শ্রেণীর নামে তারা রুশ সাম্রাজ্যকে একক দল হিসেবে শাসন করতে এবং রাষ্ট্রিক পরিকল্পনা অনুসারে তার অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে চান। যার ফলে গোটা রুশ সাম্রাজ্যে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বৈরাচার।
লেনিন রুশ সাম্রাজ্যকে পরিণত করেন সোভিয়েত ইউনিয়নে, যা গঠিত হয় ১৫টি রিপাবলিকের একটা ফেডারেশনে। লেনিনের মৃত্যুর পর জোসেফ স্টালিন একটানা ত্রিশ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নকে শাসন করেন। তিনি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করতে সক্ষম হন; কিন্তু তিনি ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রচুর লোককে খুন করেন। যা হয়ে আছে একটি ভয়াবহ ঐতিহাসিক অধ্যায়। স্টালিনের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন শ্রেণীহীন সমাজে পরিণত হয়নি। বরং সোভিয়েত ইউনিয়নে দেখা দেয় দু’টি শাসক ও শোষক শ্রেণী। এর একটি হলো নতুন আমলাতন্ত্র, আরেকটি হলো কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা। বলসেভিক পার্টি একপর্যায়ে নিজের নামকরণ করে কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে। সাধারণভাবে সারাবিশ্বে যারা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান ধাপে ধাপে নিয়মতান্ত্রিকভাবে, তাদের বলা হতে থাকে সমাজতন্ত্রী। আর যারা বল প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রিক পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুসারে সামজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়তে চান, তাদের উল্লেখ করা হতে থাকে কমিউনিস্ট হিসেবে।
কমিউনিস্টরা দাবি করেন, তারা হলেন খাঁটি মার্কসবাদী। তাদের প্রতিপক্ষরা তা নয়। তারা চাচ্ছে ধনতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু মার্কসবাদ ও লেনিনবাদকে সমার্থক বলা যায় না। কেননা, মার্কস জনগণের মুক্ত ভোটাধিকারের দাবিকেও একপর্যায়ে দিয়েছিলেন সমর্থন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বিলাতে আরম্ভ হয় চার্টিস্ট আন্দোলন (CHARTIST MOVEMENT)। চার্টিস্টদের দাবি ছিল সাবালক পুরুষদের সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার জন্য দাঁড়াবার অধিকার। আগে আইন ছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হতে গেলে তার থাকতে হবে একটি ন্যূনতম নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তি। কিন্তু চার্টিস্টরা চান এই আইনের অবসান। চার্টিস্টরা দাবি করেন গোপনে ভোটদানের ব্যবস্থা এবং পার্লামেন্টের সদস্যদের নির্দিষ্ট বেতন দেয়ার বিধান। প্রতি বছর কমপক্ষে একবার করে পার্লামেন্টের অধিবেশন।
কার্ল মার্কস চার্টিস্টদের এসব দাবি সমর্থন করেন। তিনি তার এক বক্তৃতায় বলেন, বিলাতে ভোটের মাধ্যমে আইন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে। চার্টিস্টদের পত্রিকার নাম ছিল Northern Star। এই পত্রিকার ১৮৪৭ সালের ৪ ডিসেম্বর সংখ্যায় মার্কসের বক্তৃতার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। তাই বলা যায় না কার্ল মার্কস ছিলেন উদার গণতন্ত্রবিরোধী। যে রকম বলে থাকেন লেনিনবাদীরা। লেনিনবাদীদের মার্কসবাদ, মার্কসবাদের একমাত্র ব্যাখ্যা বলে গ্রহণ করা যায় না।
মার্কসের Critique of Political Economy (1859) নামে একটি বই আছে। যাতে তিনি বলেছেন, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পর আসবে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। কেননা, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক দ্রব্য উৎপাদন এতটা বাড়বে যে, উৎপাদিত দ্রব্য সবাইকে দিয়ে দারিদ্র্য ঘোচানো সম্ভবপর হবে। অর্থনীতির আছে দু’টি দিক। একটি দিক হলো অর্থনৈতিক দ্রব্য উৎপাদনের, আরেকটি উৎপাদিত দ্রব্য মানুষের মধ্যে বিতরণের। অর্থনৈতিক দ্রব্য যথেষ্ট উৎপাদিত না হলে, তা বিতরণ করে মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হতে পারে না। সমাজতন্ত্র গড়তে হলে করতে হবে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক দ্রব্য উৎপাদন বৃদ্ধি। কার্ল মার্কস ধনতন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে অর্থনৈতিক দ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় জটিল যন্ত্র, যেমন স্টিম ইঞ্জিন। আর এই দ্রব্য উৎপাদনের কারখানায় ব্যবহার করা হয় বহুসংখ্যক দিনমজুরকে।
মার্কস সমাজতন্ত্র বলতে বুঝিয়েছেন এমন উৎপাদন ব্যবস্থা, যেখানে জটিল যন্ত্রের ওপর থাকবে না কোনো ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ। জটিল যন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদনব্যবস্থা পরিচালিত হবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণে। সমাজতন্ত্রের গোড়ার কথা হলো, এই সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রবর্তন। লেনিন যখন রুশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতা দখল করেন, তখন ওই সাম্রাজ্যে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি ছিল না। ছিল প্রধানত কৃষি অর্থনীতি। এই কৃষি অর্থনীতিতে ছিল না জটিল যন্ত্রের প্রয়োগ। ট্রাক্টর দিয়ে লাঙল টানা হলো না। কৃষিকাজ নিষ্পন্ন হতো ঘোড়ায় টানা লাঙলের মাধ্যমে। অর্থাৎ কৃষি ছিল মূলত পশুশক্তি নির্ভর। জোসেফ স্টালিন রাশিয়ায় গড়তে পারেন কলকারখানার অর্থনীতি। আর কৃষিতে প্রবর্তন করতে পারেন কলে-টানা লাঙলের। রাশিয়া এসে পৌঁছায় শিল্প অর্থনীতির যুগে; সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পর্যায়ে নয়। সমাজতন্ত্রে যন্ত্র পরিচালিত হতে হয় জনগণের ইচ্ছায়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে পরিচালিত হতে থাকে আমলাতন্ত্র ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের ইচ্ছায়। যারা লিপ্ত হন আপন ভোগবাসনার পরিতৃপ্তিতে। বাংলাদেশে যারা সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক বিকাশ নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন, তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের জটিল আমলাতন্ত্র ও কমিউনিস্টদের শাসন ও শোষণের চিত্রকে।
আমরা বলেছি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ১৫টি রিপাবলিক নিয়ে গঠিত। এই ১৫টি রিপাবলিকের মানুষের ভাষা এক ছিল না। এদের মধ্যে ছিল ভাষাগত পার্থক্য এবং তাকে নির্ভর করে জাতীয়ভাবের (Nationalism) পার্থক্য। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে। এই ভেঙে পড়ার কারণ বাইলোরাশিয়া এবং ইউক্রেনের সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গিয়ে পৃথক স্বাধীন রিপাবলিক হওয়ার ইচ্ছা। আমাদের দেশের একদল বুদ্ধিজীবী বলছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার কারণ নাকি মার্কিন চক্রান্ত; কিন্তু আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রুশভাষী রাশিয়া হয়ে উঠেছে খুবই উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদী। রুশ সরকার তার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করছে কেবলই তার আপন স্বার্থের কথা বিবেচনা করে। ন্যায় অন্যায়ের কোনো নৈতিকতার তোয়াক্কা করে নয়। তাই আমরা দেখছি যে, রোহিঙ্গা সমস্যায় রাশিয়া নিচ্ছে মিয়ানমারের পক্ষ। আমরা বলেছি, প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ১৫টি রিপাবলিক নিয়ে গঠিত। এই ১৫টি রিপাবলিকের মধ্যে ছয়টি ছিল মুসলিম অধ্যুষিত। এই মুসলিম অধ্যুষিত রিপাবলিকগুলো রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সমর্থন করছে বাংলাদেশের দাবি। অর্থাৎ এই ছয়টি রিপাবলিকে দেখা দিয়েছে একটা বিশেষ মুসলিম চেতনা।
পত্রিকার খবরে দেখলাম (প্রথম আলো, ২৯ নভেম্বর ২০১৭) রাশিয়া আবার মহাকাশে রকেট উৎক্ষেপণ শুরু করেছে। এর আগে রাশিয়া সাধারণত রকেট উৎক্ষেপণ করত কাজাখস্তান থেকে। কিন্তু এবার সে রকেট উৎক্ষেপণ করছে রাশিয়ার পূর্ব প্রান্তের ভসৎচনি কসমোড্রম থেকে। এর একটা কারণ, রাশিয়া কাজাখদের ওপর আর আগের মতো আস্থা রাখতে পারছে না এবং আরেকটি কারণ হলো, যে জায়গা থেকে সে এখন রকেট উৎক্ষেপণ করছে, তা উত্তর কোরিয়া থেকে বহু দূরে অবস্থিত নয়। এর লক্ষ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও যেন কিছুটা ভয় পাইয়ে দেয়া। ভাবা গিয়েছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগ আর থাকবে না। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়ার ঠাণ্ডা লড়াই যেন শেষ হয়েও শেষ হতে চাচ্ছে না। আর আমাদের একদল বুদ্ধিজীবী করছেন ভøাদিমির পুতিনের রাশিয়ার বিশেষ প্রশংসা।
দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশ, ০২ ডিসেম্বর ২০১৭।