কবিতার সত্তা

এবনে গোলাম সামাদ এখনো সচল তাঁর জ্ঞান-তারুণ্যে, বলছেন লিখছেন শিল্প-সাহিত্য-দর্শন আর সমকালীন রাজনীতির বিষয়আশয় নিয়ে। দেশভাগের দগদগে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন এখনো। চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করেছেন বৃটিশ, পাক আর স্বাধীন বাংলার প্রায় শতবছর। হালে ভ‚-রাজনীতি ও নৃ-তত্ত¡ নিয়ে লিখলেও শিল্প সাহিত্য চিত্রকলা সবসময় তার অন্যতম পছন্দের সাবজেক্ট ছিলো। তারুণ্যে লিখতেন খ্যাতনামা সাহিত্য সাময়িকীগুলোতে। সম্প্রতি তাঁর সাথে আলাপচারিতায় কবিতার কথা উঠলে স্মিতহাস্যে জবাব দেন ‘ঐ রোগ ছিলো না’, অথচ সমকালীন এবং বিশ্বকবিতা নিয়ে অনয়াসেই বললেন প্রায় ঘন্টাখানিক। সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকার অগ্রহাছু ১৩৬৫ সংখ্যায় ‘কবিতার সত্তা’ শিরোনামে তার একটি কাব্যালোচনার সন্ধান দেন গল্পকার মঈন শেখ। আলোচনাটি ক্ল্যাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় নোঙর পাঠকদের উদ্দেশ্যে তা পুনর্মুদ্রণ করা হলো। নোঙর সম্পাদনা পরিষদ।


কবি কবিতা লেখেন শব্দ দিয়ে। শব্দের দুটো দিক; একটি তার ধ্বনি ব্যঞ্জনার, অন্যটি তার অর্থ সম্পদের। যখন ধ্বনি সম্পদের দিকে কবি বিশেষভাবে ঝুঁকে পড়েন তখন তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন সঙ্গীতের দিকে। আবার যখন অর্থের মোহ তাকে বিশেষ করে পেয়ে বসে, তখন তিনি এগিয়ে যান গদ্যের দিকে। সঙ্গীত ও গদ্য সাহিত্যের মাঝামাঝি পর্যায়ের সাহিত্য-বাস্তবতা হিসেবে ধরা চলে কবিতাকে। কবিতা যেন এক সংকর (যুনৎরফ) সত্তা।
সব সাহিত্যই একদিক থেকে দেখতে গেলে বলতে হয় ধ্বনি ও অর্থের সমন্বয়। কারণ, শব্দই সব সাহিত্যিকের সাহিত্য রচনার পুঁজি। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে এটা বিশেষ অর্থে সত্য। কবিতার বিশেষত্ব হচ্ছে তার গতিশীলতা। সে শেষ হয়েও শেষ হয় না। গদ্যে যখন বলি, ‘একদিন শ্রাবণ রাত্রে বৃষ্টি হয়েছিল’ তখন এই বলার মধ্যে খবরটি ফুরিয়ে যায়। কিন্তু কবি যখন বলেনÑ
রজনী শাওন ঘন ঘন দেয়া গরজন
রিম ঝিম শব্দে বরিষে…
তখন কথা থেমে গেলেও বলা থামে না। এ যেন চিরকালের বৃষ্টি, পঞ্জিকা-আশ্রিত কোন ক্ষণের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে এ বৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে যায়নি। …ভাবকে কথাকে ছন্দের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পারলেই তা কবিতা হয়। সেই ছন্দ থেকে ছাড়িয়ে নিলেই সে হয় সংবাদ- সে সংবাদের প্রাণ নেই, নিত্যতা নেই। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার পরিচয়)।
ভাবকে, কথাকে ছন্দের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হলে বিশেষভাবে সচেতন হতে হয় শব্দের ধ্বনিব্যঞ্জনা সম্বন্ধে। ছন্দের দোলা সৃষ্টির ব্যাপারে শব্দের ধ্বনি-সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। সমিল ধ্বনি হোক অমিল ধ্বনি হোক কবিতায় ছন্দের স্পন্দন থাকে বলেই তার একটা বিশেষ আকর্ষণ বয়ে আনে আমাদের কাছে। যখন পড়ি;

এখানে নামল সন্ধ্যা
সূর্যদেব কোন দেশে কোন সমুদ্র পারে তোমার প্রভাত হলো?
অন্ধকারে এখানে কেঁপে উঠছে রজনীগন্ধা
বাসর ঘরের দ্বারের কাছে অবগুণ্ঠিতা নব-বধুর মতো;
কোনখানে ফুটলো ভোর বেলাকার কনক চাঁপা?
জাগল কে?
নিভিয়ে দিল সন্ধ্যায় জ্বালানো দীপ
ফেলে দিল রাত্রে গাঁথা শিউলি ফুলের মালা

এখানে ছন্দের বন্ধন খুব আলগা। কিন্তু তবু ছন্দ আছে। আছে ধ্বনির সম্মোহন। তাই ঢালা গদ্যে যে রসের স্বাদ পাওয়া যায় না, এখানে তা পাওয়া যায়। এইখানেই কবিতার এক বিশেষ আবেদন।

ভাবকে, কথাকে, ছন্দের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পারলেই কবিতা হয়। কিন্তু এইটুকু বললেই সব বলা হয় না। কবিতার ভাষাগত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করবার মত। কবিতার ভাষা মূলতঃ আবেগের ভাষা। কবিতার ভাষায় আমরা পরিচয় পাই এক আদিম মনের। যে মন সব কিছুকেই ভাবত প্রাণবান – মানবিক সত্তা সম্পন্ন বলে। যে মন সব কিছুর সাথে যোগ করতে চাইতো আমাদের মানবিক কামনা ভাবনাকে। মানুষ একদিন ফসল বপনের আগে শেষ সময়ে মাটিকে মনে করেছে সত্যিই ঋতুমতি বলে। ঝড়, বস্ত্র, বৃষ্টি – সব কিছুর অন্তরে দেখতে পেয়েছে নিজেরই অনুরূপ শক্তির বৃহত্তর প্রকাশকে। সারা বিশ্বই মানুষের কাছে একদিন ছিল সজীব আর তারই মত মনোভাবাপন্ন রূপে। আমরা সাধারণভাবে আমাদের মনের এই অজ্ঞতাকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। বিজ্ঞানের বাস্তব আবিষ্কার, আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও মনন প্রসারতা আমাদের মানব ইতিহাসের আদিপর্বের বহু ভ্রান্তির নিরসন ঘটিয়েছে। তথাপি আমাদের আদিম প্রবণতা আজো বিদায় নেয়নি। হয়তো বা কোনদিন নেবে না। আমরা আজো প্রকৃতির সব কিছুর সাথে আমাদের চেতনার সাদৃশ্য দেখতে চাই। কবিতার ভাষা বিশেষভাবেই বহন করে এই প্রবণতার ছাপ। কবিতায় আমরা যে ভাষা ব্যবহার করি তাকে বলা চলে নরত্ববোধি (ধহঃযৎড়ঢ়ড়সড়ৎঢ়যরপ) ভাষা। আমাদের মনের অতলে সেই আদিম চেতনা আজো কাজ করে চলে বলেই আমরা যখন কোন কিছুর সাথে নিজেদের বিভিন্ন অনুভ‚তিকে জড়িত করি, তা তখন অনেক আপন হয়ে ওঠে আমাদের চেতনায়। তা অনেক সহজে স্বীকৃতি পায় আমাদের কাছে। আমরা জানি ঝরাপাতা ঝরা পাতা-ই। প্রাণহীন তার ঝরে পড়ার পিছনে নেই কোন উদ্দেশ্য। প্রকৃতির সহজ নিয়মেই ঝরে পড়ে সে। কিন্তু তবু পড়তে ভাল লাগে,

ঝরা পাতা গো আমি তোমারই দলে
অনেক হাসি অনেক অশ্রু জলে

এই বলার মধ্যে সুপ্ত হয়ে রয়েছে আমাদের মনের সেই আদিম বৃত্তি- যা সব কিছুর মধ্যে দেখতে চায় নিজেরই ছায়া। ঝরা পাতার সাথে আমাদের মনের সুখ-দুঃখের বোধকে যুক্ত করার সাথে সাথে আমাদের মন মুক্তি পায় এখানে বিরাট প্রকতিলোকে। তাকে আপন মনে হয় অনেক। নিষ্প্রাণ ঝরাপাতা হয়ে ওঠে এক রসময় বাস্তবতা। ঝরে পড়া পাতার মধ্যে আমরা দেখতে পাই আমাদের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলিকে। আমরা যাকে সাধারণতঃ বলি কবি-কল্পনা, তারা প্রায় এই জাতীয়। কবি সব কিছুর সাথে যুক্ত করতে চান মানবিক আশা, আকাক্সক্ষাকে। বিজ্ঞানী বলেন, “দুয়ে দুয়ে চার”, আর কবি বলেন, “দুয়ের যুগল মিলনে চার”। আমাদের কাব্য বোধ একদিক থেকে দেখলে বলতে হয় আমাদের নরত্ববোধের এক (anthropomorphic) বিশেষ প্রকাশ মাত্র।

কবিতা আমাদের মনের কল্পনাকে জাগিয়ে দেয় আরো নানানভাবে। কবিতা আমাদের ভাল লাগে, কারণ, কবিতা আমাদের মনে পড়িয়ে দেয় অনেক স্মৃতি, অনেক ভুলে যাওয়া কথা। যখন পড়ি- “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা”- তখন আমাদের মন কেবলমাত্র যে ইতিহাসের বিদিশা নগরীর কথা মনে করিয়ে দেয় তা নয়। বিদিশা আর বিদর্ভকে ছাড়িয়ে, শ্রাবস্তির কারুকার্যের মোহ কাটিয়ে, আমাদের কল্পনা পাখা মেলে। মনে পড়ে যায় বাস্তব জীবনে দেখা, মনে দোলা দেওয়া অনেক অলক গুচ্ছের কথা। সেই কবিতাই আমাদের কাছে বিশেষ ভাল লাগে, যাতে বলা কথার চাইতে অনুক্ত কথা অনেক। যাকে কেন্দ্র করে আমাদের মন মুক্তি পেতে পারে নূতন কল্পলোকে। যে কবিতার সাথে কথা বলে চলতে পারে আমাদের মন। যার সাহচর্যে এসে আমাদের ঘুমন্ত কবি-চিত্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। একটি ভাল কবিতা অনেকের কাছে অনেক কারণে ভাল লাগে। একই কবিতার অর্থ হয় অনেক। এর কারণ আর কিছুই নয়, ভাল কবিতার ব্যাপক আবেদন ব্যক্তি মনে জাগিয়ে দেয় নানা ভাবের দোলা। যেমন একই বিশ্ব প্রকৃতি নানা শিল্পীকে নানান ভাবে উদ্বুদ্ধ করে শিল্প-সৃষ্টিতে।
কবিতা কোন সত্যের, কোন মতবাদের পক্ষে বিপক্ষে তর্ক করে না। কবিতার বিশ্লেষণ করা চলে না। কবিতা বিশ্লেষণধর্মী। অধিকাংশ কবিতাই আমাদের কাছে জীবনের কোন না কোন সত্যকে ধরে দিতে চায়। কিন্তু কবিতায় এই প্রয়াস সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। কবিতার আবেদন মূলত আমাদের বুদ্ধির কাছে নয়- বোধির কাছে। কবিতার বক্তব্যকে আমরা হৃদয় দিয়ে বুঝি। কবি বিনা তর্কে, বিনা যুক্তিতে, কোন আলোচনার সূত্রপাত না করেই অনেক দুরূহ দার্শনিক সমস্যার কথা তুলে ধরেন আমাদের কাছে। কিন্তু কবি এটা করেন তার নিজস্ব ধারায়। কাব্যে দর্শন ধরা দেয় কাব্যময় রূপে। কবিতায় আমরা শুধু কবির জীবন দৃষ্টির পরিচয় পাই না, পাই সেই জীবনদৃষ্টির উপলব্ধিগত কবিমনের আনন্দ-চেতনাকেও। বিসপ বার্কলি-র “সাবজেকটিভ আইডিয়ালিজম” -এর কথা পড়তে হয়তো মাথা ধরে। কিন্তু কবিতার অনুরূপ দর্শনের অভিব্যক্তি আমাদের মনকে, চেতনাকে ক্লান্ত করে না;

আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশেÑ
জ্বলে উঠল আলো।
পূর্বে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বলল, সুন্দরÑ
সুন্দর হল সে।

কবির সাথে মতের অমিল হলেও কবিতাটি পড়তে খারাপ লাগে না। এই খারাপ না লাগার মূলে যা আছে তা-ই কাব্য।

কবিতা কোন কিছুর প্রমাণ করে না। কিন্তু প্রামাণ্য কিছু লিখতে গেলে অথবা বলতে হলে আমরা অনেক সময় কবিতার উদ্ধৃতি দিই। এ থেকেই প্রমাণিত হয় কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্যেরÑ তার সম্মোহন শক্তির। অনেকে বলেন, কবিতার জন্ম হয়েছিল, শ্রæতি-সুন্দর ছন্দবদ্ধ শব্দ সমষ্টি দিয়ে দেবতাকে তুষ্ট করবার আশায়। কারণ, আদি কবিতার যে পরিচয় আমরা পাই তার অধিকাংশই স্তোত্র জাতীয়। এবং তারা বিশেষভাবে মানুষের ধর্ম সাধনারই অঙ্গীভ‚ত। বলা বাহুল্য, কবিতায় দেবতা বশীভ‚ত হয়নি। কারণ, তিনি যে নাই, কিন্তু আছে মানুষের মন। সে মনে দোলা দিয়েছে এবং আজো দেয় কবিতা। কিন্তু কবিতা মানুষের মনে দোলা দিয়েছে এবং আজো দেয়। মানুষ নিজেই আটকা পড়েছে যেন কবিতার যাদুতে। ছন্দ রয়েছে মানুষের রক্তপ্রর্বাহে। ছন্দ রয়েছে তার জীবন সূত্রের গোড়ায়। তাই মানুষ তার জীবন দেবতাকে পাবার আশায় ছন্দের দোলায় রূপ দিতে চেয়েছে তার অন্তরের অন্তরতম কামনাকে।

কবিতা মানুষের কোন কাজে লাগে না। কবিতা স্বপ্নবিলাস মাত্র। দার্শনিক প্লেটো রায় দিয়েছেন, কবিরা কল্পনা-প্রবণ তথা সত্যহন্তা বলে। কিন্তু সত্য বলতে কী বোঝায়? স্বপ্ন কি স্বপ্ন হিসাবে চরম সত্য নয় মানুষের জীবনে? এদিক থেকে দেখতে গেলে বলতে হয়; মানুষের ইতিহাস তার স্বপ্ন কল্পনার ইতিহাস। আর কবিরা মানুষের এই হৃদয়বৃত্তিরই প্রতিধ্বনি করেছেন নানাভাবে তাঁদের বিশিষ্ট বাক্ ভঙ্গিমায়। অভিধানে আমরা শব্দের যে অর্থ পাই তা শব্দের সাধারণ অর্থ। কিন্তু কেবলমাত্র এই অর্থ দিয়ে কাজ করা চলে না কবির। কারণ, কবির কারবার মনের সূ² অনুভ‚তি নিয়ে। এই অনুভ‚তিকে ধরে দিতে যেয়ে তাকে সাধারণ শব্দকেই নানাভাবে সাজাতে হয়; অসাধারণ অর্থময় করে তুলতে হয়। কিন্তু এ থেকে প্রমাণিত হয় না, কবিরা সত্য-বিদ্বেষী। কবিতায় জীবন-সত্য রূপ পায় কবিতার মত করে। সূ²বোধের রসে জারিত হয়ে। কবিতার ভাষা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :- ভাল লাগা বোঝাতে কবি বলেন “পাষাণ মিলায়ে যায় গায়ের বাতাসে।’ বলেন ‘ঢল ঢল কাচা অঙ্গের লাবণি অবনি বহিয়া যায়।’ এখানে কথাগুলোর ঠিক মানে নিলে পাগলামি হয়ে দাঁড়াবে। কথাগুলো যদি বিজ্ঞানের বইয়ে থাকতো তাহলে বুঝতুম, বিজ্ঞানী নতুন আবিষ্কার করেছেন এমন একটি দৈহিক হাওয়া যার রাসায়নিক ক্রিয়ায় পাথর কঠিন থাকতে পারে না। গ্যাসরূপে হয় অদৃশ্য। কিংবা কোন একটা মানুষের শরীর থেকে এমন একটি রশ্মি পাওয়া গেছে যার নাম দেওয়া হয়েছে লাবণি। পৃথিবীর টানে যার বিকিরণ মাটির ওপর দিয়ে ছড়িয়ে যেতে থাকে। শব্দের অর্থকে একান্তভাবে বিশ্বাস করলে এ রকম মানে করা ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু এ তো প্রকৃত ঘটনার কথা নয়, এ যে মনে হয়, যেনর কথা। “…..ঠিক যেন কি-র ভাষা অভিধানে বেঁধে দেওয়া নেই। তাই সাধারণ ভাষা দিয়েই কবিকে কাজ চালাতে হয়। তাকেই বলা যায় কবিত্ব” (রবীন্দ্রনাথÑবাংলা ভাষার পরিচয়)।

ব্যক্তি জীবনে সংকট কম বেশি সবার আসে। জীবনের এই সব মুহুর্তে অনেক সময় নিজেকে মনে হয় অনিকেত বলে। মনে হয় জীবনের কোন অর্থ নেই- জীবন নিঃসঙ্গতার উদ্দেশ্যে এক নিরুদ্দেশ যাত্রা। জীবনের এই সব মুহূর্তে কবিতা আসে বন্ধুর মত। পড়তে ভাল লাগে এই ধরনের ছত্র :

প্রতি দিবসের যত ক্ষতি যত লাভ
পশ্চাতে ফেলি প্রকাশে সহসা পরম আবির্ভাব
ভাসিয়া চলে সে কোথায় কেহ না জানে
আঁধার হইতে সহসা আলোর পানে।

কবিতা কোন কিছু প্রমাণ করে না। কবিতায় কোন বিষয়ে তর্ক করা যায় না। কারণ, কবিতা বিশ্লেষণধর্মী নয়। মানুষের চিন্তার যুক্তিময় অভিব্যক্তির জন্য গদ্যই উপযুক্ত হন। কিন্তু কবিতা বহু কথাকেই আমাদের মনে গেঁথে দেয়- গেঁথে দেয় সুনিপুনভাবে। কবিতা মাত্র অল্প কয়েকটি কথার মাধ্যমে আমাদের জীবনের কোন বিশেষ মুহূর্তের প্রয়োজনীয় সমগ্র জীবনচেতনাকে সুচারুরূপে ধরে দিতে পারে। কবিতার সত্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল এই অল্প কয়েকটি কথার একটি ব্যাপক সত্যের অনুভ‚তিকে আমাদের চেতনায় সঞ্চারিত করে দিতে পারা। আমরা কবিতা পড়ি, আমাদের মনের পালে আশার বাতাস পাবার জন্য; জীবনের যে অর্থ আমরা খুঁজে চলি তার সরস উত্তর পাবার জন্য; আমাদের আনন্দময় অনুভ‚তিকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করবার জন্য;Ñ সবার উপরে আমাদের মনে একটি প্রগাঢ় সৌন্দর্য চেতনাকে জাগিয়ে দেবার জন্য। গতিয়ে-র মতে, আমাদের মনে একটা নিবিড় সৌন্দর্যানুভ‚তি সৃষ্টিতেই কবিতার সকল সার্থকতা।

অনেকের মুখে শুনতে পাই; কবিতার দিন শেষ হয়ে আসছে। গল্প, উপন্যাস, যত লোকে পড়ে কবিতা আর তত লোকে পড়ে না। শিল্পকর্ম হিসাবে কবিতার আবেদন ক্রমশঃ নিষ্প্রভ হয়ে পড়বে। কিন্তু কবিতার যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করলে এতটা নিরাশাবাদী বোধ হয় হওয়া যায় না। কারণ, গল্প, উপন্যাস আর কবিতার আকর্ষণ কেন্দ্র এক নয়। কবিতার কাজ গল্প বলা নয়; মানব চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখানো নয়, বাস্তব জীবনের বিচিত্র ঘটনা প্রবাহের চিত্র নয়। মহাকাব্যের যুগে কবিতা গল্প, উপন্যাস সব ছিল একসাথে মিশে। কিন্তু আজ গল্প, কবিতা, উপন্যাসের ক্ষেত্র স্বতন্ত্র হয়ে পড়েছে। আজকের কবিতা মূলতঃ কবি মানসের একটি বিশেষ উপলব্ধি ও সেই উপলব্ধিগত তৃপ্তির অভিব্যক্তি মাত্র। দীর্ঘ কবিতা লেখার রেওয়াজও ক্রমেই কমে আসছে। কবিতা হয়ে ওঠছে কবির বিশেষ সময়ের একটি মুডের (সড়ড়ফ) পরিচয় মাত্র। এই হিসাবেই আজকের কবিতার মূল্য। আর এই হিসাবে তা আপন সত্তার অস্তিত্ব রক্ষার দাবী। আমাদের মনে কোন একটি বিষয়ে একটি আবেগঘন গভীর চৈতন্য জাগিয়ে দিতে পারাতেই তার চরম সফলতা।

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ