কতগুলো ব্যাপারে পাখিদের সঙ্গে আমাদের বেশ মিল আছে। অন্য প্রাণীদের সঙ্গে যা নেই। যেমন পাখিদের গায়ের রক্ত আমাদেরই মতো গরম। অর্থাত্ পাখিদের দেহের তাপমাত্রা পরিবেশের তাপমাত্রা দ্বারা প্রভাবিত হয় না। আমাদের শরীরের মতোই পাখিদের শরীরের ভেতর আছে বিশেষ তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। পাখিদের হৃৎপণ্ড আমাদেরই মতো।
তবে পাখিদের ডানা আছে, যা দিয়ে তারা পারে উড়তে। পাখিদের ক্ষেত্রে হাত রূপান্তরিত হয়েছে ডানায়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। পাখিদের গায়ে থাকে পালক, যা আমাদের গায়ে থাকে না। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, মানুষ হলো দু’পায়ে হাঁটা পালকবিহীন পাখি। কিন্তু এরকম মন্তব্য যথাযথ নয়। পাখি আর মানুষের সঙ্গে বহু ব্যাপারেই রয়েছে বড় ধরনের পার্থক্য। প্রাণী বিজ্ঞানীরা তাই মানুষ ও পাখিকে এক শ্রেণীতে শ্রেণীবদ্ধ করেননি। আমার অবসর সময় কাটে বই পড়ে। পাখিদের কথা পড়ছিলাম, আর ভাবছিলাম পাখিদের সম্বন্ধে।
কিছুক্ষণ আগে আমার ঘরের পুবের খোলা জানালা দিয়ে শুনছিলাম রাস্তার ওধারে বিদ্যুতের তারে বসে থাকা কাকের ডাক। ওরা হলো, যাদের বলে পাতিকাক। এদের গায়ের পালক কালো। কিন্তু গলায় কাছের পালক হল ধূসর। এরা দল বেঁধে চলে, দল বেঁধে বাস করে রাতে এক গাছে। ওদের আছে একটা সমাজ জীবন। ওরা একে অপরের ওপর হলো খুবই সহানুভূতিশীল। পড়ছিলাম, ওদের সমাজ জীবনের কথা। সেসব কাক এক গাছে থাকে, তাদের মধ্যে কেউ বৃদ্ধ বয়সে অন্ধ হয়ে গেলে তাকে মরতে হয় না অনাহারে। কারণ, ওই গাছে বসবাসকারী তরুণ কাকরা তাদের খাওয়ায়, খাদ্য এনে দেয়।
আমরা মানুষ, প্রাণী জগতে দাবি করি শ্রেষ্ঠ বলে। কিন্তু কাকদের মধ্যে যে ধরনের সামাজিকতা পরিলক্ষিত হয়, আমাদের কি তা আছে? কাক কাককে খুন করে না। কিন্তু মানুষ মানুষকে খুন করে। কাকেরা চলেছে তাদের সহজাত ধর্ম অনুসরণ করে। আর আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রিক আইন। জনহিতকর কাজের জন্য এগিয়ে আসতে হয় সরকারকে। কিন্তু কাকদের কোন রাষ্ট্র নেই। অন্ধ কাককে খাওয়াবার জন্য অন্য কাক এগিয়ে আসে স্বপ্রণোদিত হয়ে। প্রাণী হিসাবে কারা ভালো; আমরা না কাক? প্রশ্নটা জাগছিল আমার মনে।
ক’দিন আগের ঘটনা, বিদ্যুতের দুটি তারে একটি কাকের ডানার ছোঁয়া লাগল। তড়িত্ প্রবাহে ঘটল তার মৃত্যু। সে গিয়ে পড়ল মাটিতে। অন্য কাকরা উড়ে গিয়ে তার মৃতদেহকে প্রদক্ষিণ করতে থাকল। ডাকতে শুরু করল করুণ সুরে। আমার চোখে ফুটে উঠল কাকদের সমাজ জীবনের আর এক চিত্র। কাকরা কত সহানুভূতিশীল একে অপরের প্রতি। আর ভাবলাম মানুষের সমাজটা যদি হতো কাকদের মতো, তবে হয়তো আমরা অনেক সুখী হতে পারতাম।
আমরা সাধারণত ভাবি, পাখিদের মধ্যে কাক হল সবচেয়ে বুদ্ধিমান। জানি না, এ ধারণা সৃষ্টি হতে পেরেছে কেন। আমাদের দেশে কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। আর কাক সেটা না বুঝে কোকিলের ডিমে তা দেয়। কাকের বাসায় ডিম ফুটে হয় কোকিলের বাচ্চার জন্ম। কাক প্রথমে কোকিলের বাচ্চাকে চিনতে পারে না। কোকিলের বাচ্চাদের আহার যোগায় নিজের বাচ্চা ভেবে। বাচ্চা বড় হলে কাক বুঝতে পেরে তাদের ঠেলে ফেলে দেয় বাসা থেকে, কিন্তু এর আগে নয়। দুটি করে কাক এক সঙ্গে থাকে স্বামী-স্ত্রীর মতো। স্ত্রী কাক ও পুরুষ কাকে ডিমে তা দেয় পালা করে। বাচ্চাদের স্ত্রী কাক ও পুরুষ কাক উভয়েই আহার এনে খাওয়ায়। উভয়েই পালন করে শাবক পালনের দায়িত্ব। এটাও তারা করে তাদের সহজাত ধর্মকে অনুসরণ করে। ওদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন কোন আইনের বন্ধন নয়। একটা সহজাত জৈবিক বন্ধন মাত্র।
কোকিল কেন অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে এর বিবর্তনিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে চার্লস ডারউইন পড়েছিলেন বেশ বিপাকে। ডারউইনের মতে, কোকিল আগে অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ত না। উত্তর আমেরিকার কোকিল অন্য পাখির বাসায় সাধারণত ডিম পাড়তে যায় না। কিন্তু দু’এক সময় তাকে দেখা যায় কাক পরিবারভুক্ত নীল-জে (ঔধু) পাখির বাসায় ডিম পাড়তে। আর জে-পাখির বাসায় জে-পাখি ও কোকিল একত্রে বসে তা দিয়ে ডিম ফোটায়। এক্ষেত্রে ডারউইনের মতে, আগে ইউরোপের কোকিলও মাঝে মাঝে অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ত। কিন্তু সেটা ছিল ব্যতিক্রম, নিয়ম নয়। তবে পরে অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়া ইউরোপীয় কোকিলের হয়ে পড়ে সহজাত ধর্ম। সহজাত ধর্ম কথাটা বেশ গোলমেলে। কী করে কোনো অর্জিত অভ্যাস সহজাত ধর্মে পরিণত হতে পারে তার ব্যাখ্যা এখনও দেয়া যায়নি। অন্য পাখির বাসায় ডিম দেয়া এখন কোকিলরা পায় জন্মসূত্রে। অর্থাত্ এক্ষেত্রে অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়াটা হয়ে পড়েছে একটা বংশগত গুণ।
আমরা অনেক পাখির মাংস খাই। কিন্তু কাকের মাংস খাই না। যদি খেতাম, তবে কাককে আমাদের চার পাশে এত সংখ্যায় দেখতে পেতাম বলে মনে হয় না। আমাদের দেশে অনেক পাখি এখন বিরল হয়ে পড়েছে। যেমন ঘুঘু। এর একটা কারণ হল ঘুঘু পাখি শিকার করে খাওয়া। অনেক পাখির মাংস আমরা আহার করি না। কিন্তু তারাও হয়ে পড়েছে বিরল। যেমন—চিল ও শকুন। চিল ও শকুন বিরল হয়ে পড়ার একটা কারণ হলো উঁচু গাছের অভাব। উঁচু গাছে চিল ও শকুন বাসা বেঁধে পাড়ত ডিম।
অনেক দেশে অনেক পাখি মরেছে উউঞ্থর মতো কীটনাশক ব্যবহারের জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিমান থেকে এক সময় ছড়ানো হয়েছে উউঞ, ক্ষেতে-খামারে কীট-পতঙ্গ নাশের জন্য। এই উউঞ্থর প্রভাব গিয়ে পড়েছে পাখিদের ওপর। পাখিদের শরীরের রক্তে উউঞ মিশলে তাদের ডিমের খোলা পুষ্ট হয় না। অপুষ্ট খোলাযুক্ত ডিম থেকে হয় না বাচ্চা। ফলে বিলুপ্ত হতে চায় বিহঙ্গ। বিষয়টি নিয়ে প্রথম বিশেষভাবে আলোচনা করেন জধপযবষ ঈধত্ংড়হ তার লেখা ঝরষবহঃ ঝঢ়ধত্রহম বইতে। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে।
বইটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পায় বিশেষ খ্যাতি। শুরু হয় পরিবেশবাদী আন্দোলন। এ বইয়ের প্রভাবে ১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কীটনাশক হিসেবে উউঞ্থর ব্যবহার করা হয় নিষিদ্ধ। কিন্তু সবদেশে উউঞ্থর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়নি। ম্যালেরিয়ার জীবণুবাহী মশক নিবারণে উউঞ্থর ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে ম্যালেরিয়া রোগ আসতে পেরেছে নিয়ন্ত্রণে। আমাদের মতো দেশে ম্যালেরিয়া ছিল একটা মারাত্মক ব্যাধি। কিন্তু ম্যালেরিয়া এখন আর আগের মতো কোনো মারাত্মক ব্যাধি হয়ে নেই। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে আসার ফলে এদেশের মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। কৃষকদের বেড়েছে কর্মক্ষমতা। উত্পাদন বেড়েছে ফসলের। এদেশে কৃষি উন্নয়নের পেছনে ম্যালেরিয়া নিবারণ হলো উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
সেদিন পত্রিকায় দেখছিলাম ঢাকায় পরিবেশবাদী মহিলারা সভা ও সমাবেশ করেছেন। দাবি তুলেছেন, সব ধরনের রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করার। কিন্তু উউঞ্থর ব্যবহার আমাদের জন্য হতে পেরেছে বিশেষ উপকারী। নির্বিচারে সব ধরনের কীটনাশক ও বালাই নিবারক রাসায়নিক বস্তুর ব্যবহার বন্ধ কোনোভাবেই উচিত হবে না। আমাদের দেশে উউঞ্থর ব্যবহারের কারণে এ যাবত্ কী পরিমাণ পাখি মারা গেছে তার খবর আমরা জানি না। উউঞ্থর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করেছে এনড্রিনের মতো অতি বিষাক্ত পতঙ্গবারক। মৃত্যু ঘটিয়েছে পাখিদের। মৃত্যু ঘটিয়েছে খাল-বিলের মাছের। অনেক মানুষ আত্মহত্যা করেছে এনড্রিন পান করে। বিশেষ করে পাখি কমে যাওয়ার একটা কারণ হলো গাছপালা কেটে ফেলে জনবসতি হওয়া। আমাদের দেশে অনেক জলচর পাখি এখন আর চোখে পড়ে না। কারণ দেশে আর আগের মতো খালবিল নেই।
পরিবেশবাদীরা পাখির অভাবে দুঃখ করতে পারেন, কিন্তু মানুষকে বাঁচতে হবে খেয়ে-পরে। বাঁচতে হবে নতুন জনপদ গড়ে। এজন্য কাটা পড়বে বন, ভরাট হবে জলাভূমি। পাখিদের চেয়ে মানুষের জীবন মানুষের কাছে অনেক মূল্যবান। পাখিদের গান বন্ধ হলে দুঃখ করার কিছু নেই। বসন্ত এখন আগের তুলনায় নীরব হতেই পারে। কাকের বংশ কিন্তু বিলুপ্ত হচ্ছে না। এখন আমরা গ্রামগঞ্জে এবং শহরে দেখতে পাচ্ছি অনেক কাক। কাকরা লুপ্ত হচ্ছে না, কারণ তারা বহু কিছু খেয়ে বাঁচে। আর তারা লুপ্ত হচ্ছে না, তাদের সুশৃঙ্খল সমাজ জীবনের জন্য। পরস্পরের প্রতি সহানুভূতির কারণে।
আমাদের দেশে আর এক ধরনের কাক আছে, যাদের দাঁড়কাক বলে। দাঁড়কাকরা পাতি কাকের তুলনায় আকারে অনেক বড়। এরা দেখতে খুব কালো। এদের গলার কাছে কোন ধূসর পালক থাকে না। এরা সাধারণত থাকে একা। কখনও কখনও থাকে জোড়ায় জোড়ায়। দু’একসময় এদের দেখা যায় অনেকে মিলে একসঙ্গে চলতে। তবে এটা তুলনামূলকভাবে এদের ক্ষেত্রে হলো বিরল ব্যাপার। আমাদের দেশে দাঁড়কাকের সংখ্যা খুব কমে এসেছে। মনে হয় এরা চলেছে বিলুপ্তিরই পথে। কাক দেখে আমার সময় কাটে। ভোরে ঘুম ভাঙে কাকের ডাকে। মনে হয় এদেশ থেকে পাতিকাক বিলুপ্ত হবে না। যাদের বলা হয় কাক, তারা ৪৩টি প্রজাতিতে বিভক্ত। দক্ষিণ আমেরিকা ছাড়া আর সব মহাদেশেই কাককে ডাকতে দেখা যায়। কাক ডাকে কা কা। তাদের ডাক শুনে কাক বলে চিনতে অসুবিধা হয় না। পাতিকাক ও দাঁড়কাক অনেক দেশে বাস করে। শুধু বাংলাদেশে নয়। এরা বাস করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এবং মিয়ানমারে। আর একইভাবে বাস করা পাতিকাকের সংখ্যা কমছে না, তবে কমছে দাঁড়কাকের সংখ্যা।