বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ড. কামাল হোসেন ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নেতৃত্ব দিতে চলেছেন। তার নেতৃত্ব বিএনপির মতো দল মেনে নিচ্ছে। অবশ্য কামাল হোসেন কোনো দিন জননেতা ছিলেন না। কামাল হোসেন একজন খ্যাতনামা আইনজীবী। অনেক খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ পেশায় ছিলেন উকিল। কিন্তু রাজনীতি আর ওকালতি আসলে একসূত্রে গাঁথা নয়। রাজনীতিতে বিশেষভাবে প্রয়োজন হয় জনসমর্থনের।
একটি দেশে গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে সে দেশের জনমত, রাজনৈতিক দল এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারার ওপর। ড. কামাল চাচ্ছেন, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন। কিন্তু তার নেই কোনো সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল। নেই কোনো দক্ষ কর্মীবাহিনী। তার অবস্থা অনেকটা ‘সৈন্যবিহীন সেনাপতি’র মতো। তার নেতৃত্বে দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ কতটা সৃষ্টি হতে পারবে, তাই দেখা দিচ্ছে সংশয়।
কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঢাকায় এক জনসভায় বলেছেন, তার আশঙ্কা হচ্ছে- জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত না-ও হতে পারে। কেন তিনি এ রকম আশঙ্কা করছেন, তার ব্যাখ্যা করেননি। তবে বাতাসে ভাসছে কথাটা। তিনি ছাড়া আরো অনেক ছোটখাটো নেতার মনেও জাগছে একই রকম শঙ্কা।
চীনের সীমান্তে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান। নেপাল ও ভুটান একসময় ছিল ব্রিটিশ ভারতের আশ্রিত রাজ্য। পরে ইংরেজ চলে গেলে তা আসে নেহরু শাসিত ভারতের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু নেপাল এখন আর ভারত নিয়ন্ত্রিত নয়। দেশটি এখন পরিণত হয়েছে একটি পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্রে। আর পরিণত হয়েছে চীনবান্ধবে। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে চীনের রাজধানী বেইজিং পর্যন্ত পর্বত ভেদ করে নির্মিত হয়েছে পাকা সড়ক। ভুটানকে নিয়ন্ত্রণ করছিল ভারত সরকার। ভুটানের নির্বাচনে যে দল এবার ক্ষমতায় এলো, তারা চীনকে ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে দূতাবাস খুলতে অনুমতি দিয়েছে। চীনের সাথে ভুটানের প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সুসম্পর্ক। বাংলাদেশে বর্তমানে বিরাজ করছে বেশ ভারতবান্ধব সরকার।
নির্বাচনের ফলে যদি এই সরকারের পরিবর্তন ঘটে, তবে সেটা ভারতের কাম্য হতে পারে না। ভারতঘেরা বাংলাদেশে ভারত তাই চাইতে পারে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে। তবে এটা একটা আশঙ্কামাত্র। ভারত যে এটা করবে অথবা করার ক্ষমতা রাখে, সেটা ধরে নেয়া যথাযথ না-ও হতে পারে।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রও চাচ্ছে নিজ প্রভাব বজায় রাখতে। বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর চাপে বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন স্থগিত হাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করে দেয়া যায় না। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, বিদেশী বৃহৎ শক্তির প্রভাব এখানে পড়া অনেক সহজ ও সম্ভব। আমাদের নির্বাচন নিয়ে তাই আসছে বিদেশী শক্তির চাপের প্রসঙ্গ।
ড. কামাল হোসেনের জীবনী যথেষ্ট আলোচিত নয়। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন বরিশালের একটি জমিদার পরিবার। তার বাবা ছিলেন একজন এমবিবিএস ডাক্তার। তিনি ডাক্তারি করতেন কলকাতায়। মোটামুটি অর্থবিত্ত ছিল তার। কামাল হোসেন জন্মেছিলেন কলকাতায় (১৯৩৭)। পাকিস্তান হাওয়ার পরে কামাল হোসেনের পরিবার আসে ঢাকায়। ঢাকাতে তিনি ভর্তি হন সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুলে। এখানে তার সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন আনিসুজ্জামান। অর্থাৎ ঘটনাচক্রে যিনি (আনিসুজ্জামান) তার (কামাল হোসেনের) মুসাবিদা করা বাংলাদেশের সংবিধানের ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষ্য রচনা করেছেন। আর তিনিও হয়েছেন একজন খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ও সেই সাথে বেশ কিছুটা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কেবল তাই নয়, ভারত সরকারের কাছ থেকে আনিসুজ্জামান পেয়েছেন ‘পদ্মভূষণ’ খেতাব। ড. কামাল বিশ্বের কাছ থেকে এ রকম কোনো খেতাব পাননি অথবা নিতেও চাননি।
সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ছাত্র অবস্থায় কামাল হোসেন যান বৃত্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়তে। তার পাঠ্য বিষয় ছিল অর্থনীতি। এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। এরপরে তিনি মিসিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসেন ইংল্যান্ডে।
সেখানে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেসামরিক আইনে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি বিলাতে লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে বিলাতেই ব্যারিস্টারি শুরু করেন। একই সাথে তিনি আরম্ভ করেন ঢাকা হাইকোর্টেও আইন ব্যবসায়। ১৯৬৪ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট লাভ করেছিলেন। তার অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং জাতিসঙ্ঘ সনদ (State Sovereignty and the United Nations Charter)। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এত উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি আর কেউ আছেন বলে আমাদের জানা নেই। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ও গণ-আন্দোলনকারী রাজনীতিবিদ হওয়ার যোগ্যতা এক নয়। তিনি বিদ্বান ব্যক্তি হলেও জনগণ তার দ্বারা হতে চান না আকৃষ্ট। তিনি জননেতা নন। তাই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা কতটা সফলতা পাবে, সেটা অনুমান করা যাচ্ছে না।
ড. কামাল হোসেন হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আত্মীয়। সোহরাওয়ার্দীর মাধ্যমে তার পরিচয় হয় শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে। আর তিনি যোগ দেন আওয়ামী লীগে। কিন্তু আওয়ামী লীগে তিনি একজন খুব আদৃত নেতা ছিলেন না। মুজিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে প্রথমে করেন আইনমন্ত্রী (১৯৭২-৭৩)। পরে করে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৭৩-৭৫)। এরপর করেন জ্বালানিমন্ত্রী। যখন তিনি আইনমন্ত্রী ছিলেন, তখন করেছিলেন বাংলাদেশের সংবিধানের মুসাবিদা। তিনি এটা করেছিলেন ইংরেজি ভাষায়। এর বাংলা ভাষ্য করেছেন তার এককালের স্কুলের সতীর্থ আনিসুজ্জামান। ড. কামাল হোসেন পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রকে বাংলাদেশের জন্য আদর্শ হিসেবে মনে করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব যখন বাকশাল করার উদ্যোগ নেন, তিনি তার বিরোধিতা বা সমর্থন, কোনোটা করেননি। তিনি চলে যান তখনকার যুগোস্লাভিয়া সফরে। ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর দেশে ফিরে না এসে বিলাতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রহণ করেন শিক্ষকতার চাকরি।
তাকে কখনো বাকশাল ব্যবস্থার বিপক্ষে কিছু বলতে শোনা যায়নি। তিনি ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। কিন্তু হেরে যান তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের কাছে, যিনি ছিলেন বিএনপির প্রার্থী। এরপর কামাল ১৯৯২ সালে ছাড়েন আওয়ামী লীগ এবং গঠন করেন নিজস্ব দল ‘গণফোরাম’; যাকে কার্যত বলা চলে একটি সুন্দর সাইনবোর্ড সর্বস্ব দল। তিনি দল গড়ার সাংগঠনিক দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হননি।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে কামাল হোসেন এমপি হতে পারেননি। যত দূর মনে পড়ছে তার জামানত জব্দ হয়েছিল। ড. কামাল হোসেনের চালচলন এমন যে, সর্বসাধারণ তার কাছে যেতে ভয় পায়। এ রকম নেতার পক্ষে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া মনোস্তাত্ত্বিক কারণে কতটা সম্ভব, তা নিয়ে থাকছে প্রশ্ন।
আওয়ামী লীগে কামাল হোসেন আগাগোড়াই ছিলেন ব্যাপকভাবে বিতর্কিত। জানা যায়, প্রধানত তার পরামর্শেই শেখ মুজিব যেতে চাননি ভারতে। তিনিও ১৯৭১-এ ভারতে যাননি। চলে গিয়েছিলেন তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিম ভাগে। বলতে হয়, তা কতকটা নিজ উদ্যোগে। জানা যায়, ১৯৭১-এ পাকিস্তানে থাকার সময় ১০ জুলাই তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব ড. হেনরি কিসিঞ্জারের সাথে বৈঠক করেন। এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় নাথিয়াগলি নামক জায়গায়, যা রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
ড. কামাল হোসেন এ বৈঠকের পর কলকাতাস্থ মার্কিন কন্স্যুলেটের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদকে বলে পাঠান, কলকাতায় আওয়ামী লীগের যেসব এমএনএ আছেন, তাদের নিয়ে ঢাকায় যেতে এবং পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় বসে আলোচনার মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উদ্ভূত পরিস্থিতির একটি সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে। কিন্তু ভারত সরকার খন্দকার মোশতাক আহমদকে গৃহবন্দী করেন। তার পক্ষে সম্ভব হয়নি কলকাতা থেকে এমএনএদের নিয়ে ঢাকায় আসাতে।
এ সময় বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রচার করা হয়, ড. কামাল হোসেন আর আওয়ামী লীগের লোক নন এবং তিনি হলেন পাকিস্তান সরকারের লোক। বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রকে বলা হতো ‘মুজিব নগরে’ অবস্থিত। আসলে তা ছিল কলকাতার ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। আর পরিচালিত হতো ভারতীয় তত্ত্বাবধায়নে। এর কোনো নিজস্ব ট্রান্সমিটার ছিল না। অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো আকাশবাণী কলকাতা থেকে একটা পৃথক মিটার ব্র্যান্ডে।
তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন কামাল হোসেনের ঘোর বিরোধী। পরে মুজিব ও তাজউদ্দীনের মধ্যে গুরুতর মতবিরোধ দেখা দেয়। শেখ মুজিব বাধ্য হন তাজউদ্দীনকে তার মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দিতে।
প্রকাশিত হয়েহচিল দৈনিক নয়া দিগন্তে, ২০১৯ সালে।