“জীবনে এমন কিছুই করিনি, যা নিয়ে গৌরব করে বলবার কিছু আছে”

ছবি: আবু তোহা

প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ দেশের একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। যথার্থই এক সাধক তিনি, জ্ঞানের সাধক। পেশাগত দায়িত্বপালনের বাইরে তার প্রায় পুরো সময়টাই কাটে লাইব্রেরিতে অথবা পড়ার টেবিলে, এই বাষট্টি বছর বয়সেও। দীর্ঘদেহী একহারা গড়নের শ্মাশ্রুমন্ডিত মানুষটি যখন অগোছালো পোশাকে রাস্তায় হাঁটেন বিনীত ভঙ্গীতে তখন তাকে দার্শনিকের মতই মনে হয়। কিন্তু দার্শনিক তিনি নন, একেবারেই সাধারণ একজন মানুষ, চালচলনে, হাসি-গল্পে। কিন্তু তার মধ্যেই, তার বিন্ম্র স্বরে, তার অসাধারণত্বটুকু ফুটে ওঠে স্বমহিমায়, স্বতঃস্ফ’র্তভাবে। যে কেউ তা বুঝতে পারে।

মূলত শিক্ষক হলেও লেখক পরিচিত তার পেশাগত পরিচয়কে অতিক্রম করে গিয়েছে। রাজনীতি ও ইতিহাসের ব্যাখ্যাকার এবং দিগদর্শনদানকারী হিসেবেই এখন জাতি তাকে বিশেষভাবে চেনে। তার সম্পর্কে পাঠকের অফুরন্ত কৌত‚হল। সেই কৌতুহল মেটাতেই আমরা গিয়েছিলাম তার কাছে কিন্তু চিরদিন যিনি নীরবে-নিভৃতে জ্ঞানের সাধনা করেছেন, প্রচারণার ঢাক-ঢোলকে সচেতনভাবেই এড়িয়ে, তিনি সাক্ষাৎকার দিতে সহজে রাজি হবেন না, তা ছিল জানা। তবে  স্নেহের অধিকারের কাছে তিনি শেষ পর্যন্ত হার মেনেছেন, যদিও তার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ কিছু শর্তও আমাদের মেনে নিতে হয়েছে।

ব্যক্তি হিসাবে তিনি বড় নন, তার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ সাধারণকে জানার আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই। এই ছিল তার যুক্তি। ‘আমিতো স্টার নই যে জনগণ আমার সম্পর্কে জানতে চাইবে। এর বাইরে যেটুকু জানবার তা তো আমার লেখাতেই প্রকাশ পায়’-বলছিলেন তিনি। তাছাড়া তার বক্তব্য হলো, কোনও আনুষকে ভালবাসা বা শ্রদ্ধা করার সর্বোত্তম উপায় হলো তার জ্ঞান ও আদর্শকে জানা ও সম্ভব হলো মানা। ব্যক্তিগত জানা-শোনার কোনও দরকার নেই। সুতরাং আমাদের আলাপ সে পথেই এগিয়েছে।- সম্পাদক

এবনে গোলাম সামাদ : আপনি আমার সাক্ষাৎকার নিতে চান কেন? আমি তো ঠিক সেই ধরনের ব্যক্তিত্ব নই।

নাজিব ওয়াদুদ : পত্র পত্রিকায় আপনার লেখা পড়ে উৎসাহিত হয়ে আপনার সম্পর্কে এবং আপনার মতামত সম্পর্কে জানতে এসেছি।

এবনে গোলাম সামাদ : বেশ কি জানতে চান বলুন?

প্রশ্ন : আপনি উদ্ভিদ বিদ্যার অধ্যাপক। কিন্তু লিখেছেন ধর্ম, নৃতত্ত¡, ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্পকলা, রাজনীতি নানা বিষয়ে। কর্মজীবনের সঙ্গে আপনার চিন্তাধারার সংযোগ রক্ষা করেন কিভাবে?

উত্তর : আমি উদ্ভিদ বিদ্যার উপরই বেশি বই লিখেছি। ছাত্ররা, সেগুলো পড়েও থাকে। তবে নানা বিষয়ে আমার কৌত‚হল আছে তাই সেসব বিষয়েও আমি কিছু কিছু লিখে থাকি। সাধারণ পত্র-পত্রিকায় উদ্ভিদ বিজ্ঞান সম্পর্কে লিখলে সেটা সাধারণ পাঠকের কাছে সে রকম আবেদনবহ হওয়া সম্ভব নয়। তাই লিখি না।

প্রশ্ন : তাছাড়া একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে।

উত্তর : হ্যাঁ, সামাজিক একটা কর্তব্যবোধ আমি অনুভব করে থাকি। যে সময়ে জন্মেছি সেই সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি আমাকে নাড়া দেয়। আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৩৫০ এর মন্বন্তর, ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের জন্ম বহু কিছু প্রত্যক্ষ করেছি। অথবা এদের সম্পর্কে অনেক কিছু পড়েছি। তাই নানা ভাবে এ সম্পর্কে আমার মনে অনেক প্রতিক্রিয়া জেগেছে এবং এখনো জাগে। আমি লেখার মাধ্যমে এদের প্রকাশ করি, কারণ আমি মনে করি আমার প্রতিক্রিয়া জনমত গঠনে কিছুটা সাহায্য করলেও করতে পারে।

প্রশ্ন : আপনি তো এক সময় ইউরোপে ছিলেন।

উত্তর :  এক সময় ফরাসি দেশের ছাত্র ছিলাম। সে দেশের অধ্যাপকের দৈনিক পত্রিকায় নানা বিষয়ে মন্তব্য, প্রবন্ধ লিখে থাকেন। হতে পারে  এর একটা প্রভঅব আমার উপর কাজ করে চলেছে।

প্রশ্ন : আমরা আলোচনা করছিলাম আপনার কর্মজীবন ও চিন্তাধারা সম্পর্কে।

উত্তর : আমার পেশা শিক্ষকতা। হতে পারে; আমি অনুভব করি দেশবাসীকে সাধারণভাবে শিক্ষিত হতে সাহায্য করা আমার কর্তব্যের অঙ্গ। তাছাড়া আমার জন্ম মুসলিম পরিবারে। ইসলামি সংস্কৃতির ইতিহাস পড়লে দেখা যায় ইবনে সিনার মত লোক একদিকে বই লিখেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর। আবার বই লিখছেন সঙ্গীত শাস্ত্রের উপরও। হতে পারে এই ঐতিহ্য আমার মধ্যে সক্রিয় সংযোগ রক্ষা করেন রয়েছে। কোনও একটি বিষয়ে আলোচনা করে, অনুশীলন করে আমার মন তৃপ্তি পেতে পারেনি।

প্রশ্ন : তাহলে আমরা নানান বিষয়েই আলোচনা করতে পারি।

উত্তর : (স্মিত হাসি) তা করা যায়।

প্রশ্ন : যেমন ধরুন ধর্ম? খুবই স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

উত্তর : যদি তার সঙ্গে রাজনীতি এসে ।

প্রশ্ন : হ্যাঁ, এই প্রশ্নটাই আমি করতে চাই।  ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে সারা বিশ্বেই এখন বিস্তর চিন্তাভাবনা চলছে। আপিন তো একসময়ে তুলনামূলক ধর্মতত্ত¡ নিয়ে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্মের রাজনীতির সম্পর্ক আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করেন?

উত্তর : ধর্ম ও রাজনীতিকে পরস্পরের বৈরী ভাববার কোনও কারণ তো দেখি না। ধর্ম আমাদের কতকগুলি মূল্যবোধ প্রদান করে। এইসব মূল্যবোধের ভিত্তিতে আমরা চাই জীবনকে পরিচালিত করতে। রাজনীতির লক্ষ্য যদি হয় উন্নত সমাজ জীবন গড়া তবে ধর্মের মল্যবোধগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ কারণেই ধর্ম রাজনীতিকে যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে। যে বিলাতের কাছ থেকে আমরা আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণা দাঁড় করেছি সে দেশের রাজনীতিও ধর্মীয় মূল্যবোধকে অস্বীকার করতে পারেনি।

প্রশ্ন : একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?

উত্তর : এক সময় বিলাতের সাধারণ মানুষ বলেছে- When Adam delved and Eve span who was then Gentleman? অর্থাৎ আদম যবে চষিতেন জমি ঈভ কাটিতেন সুতা, তখন কে ছিল ধনী? কে ছিল নিধন-এসব কিছুই তো ছুতা। বিলাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে বাইবেলের যুক্তি টানা হয়েছে। তারা বলেছে-আমরা সকলেই আদম সন্তান, মানুষে মানুষে ব্যবধান তাই থাকতে পারে না। সকলের থাকতে হবে গণতান্ত্রিক অধিকার। ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম এই ধর্ম তিনটিরই জন্ম হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে মরুভ‚মিময় দেশে। এরা সকলেই একেশ্বরবাদী ধর্ম। এদের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এদের মূল বক্তব্য প্রায় একই। আল্লাহ এমন এক শক্তি-যিনি অত্যাচারীকে শাস্তি দেন, সৎ কে করেন পুরস্কৃত। এই তিনটি ধর্মেরই লক্ষ্য হলো এমন একটি নৈতিক রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া যেখানে মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে বাস করতে পারবে। রাজনীতির গোড়ার কথাও একদিক থেকে হল তাই। ধর্ম আর রাজনীতিকে সে জন্যে আদর্শিক দিক থেকে পৃথক করে দেখা যায় না।

প্রশ্ন : কিন্তু ইহুদিবাদী ইজরায়েল ছাড়া ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে তো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলন তেমন একটা দেখা যায়। এটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

উত্তর : আজকের ইজরায়েল জিওনিজম-এর উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু হযরত মুসার (আ.) ইহুদি রাষ্ট্র জিওনিজম-এর উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তিনি তার রাষ্ট্রকে আল্লাহর আইনের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। আমি যখন ইহুদি ধর্মের কথা বলছি তখন হযরত মুসার (আ.) সেই আদি ধর্মের কথাই বোঝাতে চাচ্ছি। আজকের ইহুদিবাদকে নয়। আদি ইহুদি ধর্মের সঙ্গে ইসলামের কোনও সংঘাত নেই।

খ্রিষ্ট ধর্ম সম্পর্কেও একই কথা। যদিও হযরত ঈসা (আ.) কোনও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হননি, কিন্তু তারও লক্ষ্য ছিল মর্ত্যে আল্লাহর আইনকে প্রতিষ্ঠিত দেখা। সৈয়দ আমির আলীর মতে, খ্রিষ্টান ধর্মে মানবতা হলো বিমূর্ত, আর ইসলাম ধর্মে সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে মানবতাকে মূর্ত রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। ঠিক একই ধরনের কথা বলতে চেয়েছেন কবি আল্লামা ইকবাল।

প্রশ্ন : আমরা আবার আগের আলোচনায় ফিরে যেতে পারি। আপনি বলছিলেন ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করে দেখা যায় না। ইসলাম তো আরো বেশি রকম রাজনৈতিক ধর্ম।

উত্তর : হ্যাঁ। ইসলামের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও ধর্ম উভয়েই আরো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইসলাম মদীনায় একটি রাষ্ট্রীয় আদর্শরূপেই আত্মপ্রকাশ করে। ইসলামে বিশ্বাসীরা রাষ্ট্র আর ধর্মের সমস্যাকে পৃথক করে দেখতে ইচ্ছুক নয়। তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে ক্ষমতার লড়াই একটা সত্য। ক্ষমতার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধ সেভাবে কার্যকর থাকে না। অনেক অঘটন ঘটে। মানুষের অনেক হীন প্রবৃত্তি আত্মপ্রকাশ করতে পারে রাজনৈতিক সংঘাতের মাধ্যমে। ইসলামে শয়তানের অস্তিত্বকেও স্বীকার করা হয়। এবং বলা হয় শয়তানকে পরাজিত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবার কথা। ইসলামে গোড়া থেকেই আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। ইসলামের মধ্যে তাই সংগুপ্ত রয়েছে গণতন্ত্রের বীজ। আধুনিক রাষ্ট্রে মানবকল্যাণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ইসলামেও মানব কল্যাণের উপর খুব গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আধুনিক কল্যাব্রতী রাষ্ট্রের ধারণা তাই ইসলামের পরিপন্থী নয়। সব দিক থেকে বিচার করলে বলতেই হয়। ধর্ম বাদ দিয়ে রাজনীতি হতে পারে না।

প্রশ্ন: আপনি তো বললেন ইসলামের উদ্ভব হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের মরুময় অঞ্চলে। মদীনায় এর রাষ্ট্রিক বিকাশ। বাংলাদেশে কি এর প্রয়োগ সম্ভব?

উত্তর : ইসলাম একটি প্রচারশীল ধর্ম। যদিও এর উদ্ভব হয়েছিল মরুময় অঞ্চলে কিন্তু তা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা অঞ্চলে, এমনকি ইন্দোনেশিয়ার গহীন জঙ্গলেও। মানুষের জীবনের মূল সমস্যাগুলির মধ্যে আছে বিশেষ ধরনের ঐক্য। তাই মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধানের ক্ষেত্রে ইসলামের মূল্যবোধ বিভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে অবাধে কার্যকর হতে পারে।

প্রশ্ন : কেউ কেউ বলে থাকেন বাংলাদেশের মানুষ ইসলামের উদারনৈতিক মানবিকতাকে গ্রহণ করেছে, কিন্তু ইসলামের রাজনৈতিক ও সামরিক দিক তাদের মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায় না। সে জন্যে এ দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চলবে না। ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ কি তাই বলে?

উত্তর : বাংলাদেশে ইংরেজরা আসার আগে দেশে ছিল মুসলিম শাসন। এদের সব আচার-আচরণ যে সব দিক থেকে ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধের অনুক‚ল ছিল তা নয়, কিন্তু রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে ইসলাম ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। এবং দীন-দুঃখীর দয়া করা, ইসলামি আইন অনুযায়ী বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করা ছিল রাষ্ট্রীয় আদর্শ। এই আদর্শ কতটা মেনে চলা হতো সেটা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু কোনও আদর্শ ছিল না তা নয়। যেটাকে বলা হয় বাংলাদেশের স্বাধীন সুলতানী আমল সে সময় অনেক সুলতান তাদের মুদ্রায় বাগদাদের খলিফার নাম উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ এইসব সুলতানরা নিজেদের ভেবেছেন ইসলামি সাম্রাজ্যের প্রতিভ‚ হিসেবে। খলিফার প্রতি একটা আনুগত্য তাদের ছিলই। তাই ইসলামি চেতনা একেবারেই ছিল না এ রকম ভাববার কোনও কারণ নেই।

প্রশ্ন : অর্থাৎ আপনি বলতে চাচ্ছেন বিশ্ব ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধ এবং মুসলিম হিসেবে স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনা গোড়া থেকেই বাঙালি মুসলমানের মনে কাজ করে চলেছে?

উত্তর : খুব সংগঠিতভাবে না হলেও চেতনা যে একটা ছিল তা অস্বীকার করা যায় না। ধর্মের পরেই এই উপমহাদেশে মুসলিম মানসকে যা ঐক্য দিয়েছে তা হলো ফারসি ভাষা-সাহিত্য। কথিত আছে বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দীন পারস্যের কবি হাফিজকে সভাকবি হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই মুসলিম জগৎ ও সভ্যতার প্রতি একটা বিশেষ আকর্ষণ এ দেশের সুলতানদের মধ্যে ছিল। ফারসি ছিল মধ্যযুগীয় দরবারের ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের কথ্যভাষা। যাকে বলা হয় মুসলমানি বাংলা তা ফারসি ও ফারসির মাধ্যমে প্রাপ্ত আরবি শব্দে ভরপুর। এই ভাষায় কথা বলতেন বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মুসলিম জনসমাজ। এর একটি স্বতন্ত্র লিখিত সাহিত্য ছিল। এই ভাষায় ছাপানো গ্রন্থের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, আরবি-ফারসির অনুকরণে তার শেষ পাতা হতো প্রথম পাতা। এই ভাষায় লিখিত সাহিত্যকেই বলা হয় পুথি সাহিত্য। ভাষাতাত্তি¡ক শহীদুল্লাহর মতে, ইংরেজরা এ দেশে না আসলে এই ভাষাই হতে পারত আমাদের বাংলা ভাষা। কবি ভারতচন্দ্র লিখেছেন-“না রবে প্রসাদ গুণ না হবে রসাল, অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল।” যবন বলতে হিন্দুরা সাধারণভাবে মুসলমানদের বুঝাতেন। যদিও একসময় যবন বলতে বোঝাতে গ্রীকদের।

প্রশ্ন : অর্থাৎ এ দেশে ইসলামি চেতনার শেকড় বেশ গভীরে গ্রোথিত?

উত্তর : বাংলাদেশে মুসলিম হাকিম বা চিকিৎসকরা তাদের নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। বাংলাদেশের ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছেলেরা শেখ সাদীর কবিতা পড়েছে, বাংলাদেশের মুসলিম কবিরা ফারসি ভাষা-সাহিত্য থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেছেন। হিন্দু সাহিত্যিকরা যেখানে দেবদেবীর মাহাত্ম্য নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। সেখানে মুসলমান সাহিত্যিকরা সাহিত্য করেছেন মাটির মানুষের ভালোবাসা ও জীবন নিয়ে। বাংলার মসজিদে যে কারুকার্য দেখা যায় তা ইসলামি নকসা কলার দ্বারা প্রভাবিত। এসব কিছুর মধ্যেই একটা ইসলামি মেজাজ প্রত্যক্ষ করা চলে। তাই হঠাৎ করে বাংলাদেশে আজ ইসলামি সংস্কৃতির হুজুগ উঠেছে এটা বলা যায় না। মুসলিম শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ পরিচয় হলো স্থাপত্যে। বাংলাদেশে সুলতানী আমলে একটি নিজস্ব স্থাপত্য ধারার উদ্ভব হয়েছিল। ছোট সোনা মসজিদ তার একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। বাংলা লোকসঙ্গীতে আছে আরবি, ফারসি ও তুর্কি লোকসঙ্গীতের প্রভাব। হিন্দু বিবাহের সময় হিন্দু মহিলারা কোনও গান করেন না। কিন্তু মুসলমান বিবাহে গ্রামদেশে এখনো বিবাহগীত অপরিহার্য। এসব কিছুই মুসলিম সংস্কৃতির স্বাতন্ত্রের পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশে ইসলাম প্রায় হাজার বছর ধরে তার প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এটা ঐতিহাসিক সত্য। একথা অস্বীকার কার যাবে না। আজকের বাংলাদেশ বাঙালি মুসলমানেরই সংগ্রামের ফল। এটাই বাস্তবতা, এটাই ইতিহাস।

প্রশ্ন : আজকের বাংলাদেশ বাঙালি মুসলমানেরই সংগ্রামের ফসল একথা বোধ হয় অনেকেই মেনে নেবে না। আপনি তো, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন সংগঠক ছিলেন। কোন চেতনা বা আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আপনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন?

উত্তর : মুক্তিযুদ্ধ শব্দটা একেকজন একেক অর্থে ব্যবহার করছেন। যাকে বলা হচ্ছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তার ছিল দুটি রূপ। বাংলাদেশের মানুষ চাচ্ছিল একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে। আর ভারত চাচ্ছিল সাবেক পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশকে তার একটি অঙ্গরাজ্যে অথবা Protectorate-এ পরিণত করতে।

প্রশ্ন : তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন গোড়া থেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা এই দুটি ধারায় বিভক্ত ছিল? এদের কি সংগঠিত রূপ বা কোনও কাঠামো ছিল?

উত্তর : সাংগঠনিকভাবেও এ দুটি ধারা সক্রিয় ছিল। একটি ধারার নেতৃত্ব দিতেন মরহুম তাজউদ্দিন, অপর ধারাটি নেতৃত্ব পেতে চাইত খন্দকার মোশতাকের কাছ থেকে। যা হোক ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধকে প্রথম অর্থেই অর্থাৎ স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার অর্থেই গ্রহণ করেছিলাম। আমার সঙ্গে ভারতপ্রেমীদের কোনও যোগাযোগ ছিল না।

প্রশ্ন : কিন্তু আপনি তো ভারতে গিয়েছিলেন। আকাশবাণী দিল্লি কেন্দ্র থেকে আপনার বিবৃতিও প্রচারিত হয়েছে।

উত্তর : তা ঠিক। কিন্তু এই বিবৃতিতে আমি ভারতের পক্ষ হয়ে কিছু বলিনি। আমার বক্তব্য ছিল আমরা চাচ্ছি স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রপ্রেমিক বিশ্ববাসীর তাই উচিত হবে আমাদের সমর্থন দেওয়া। আমার আবেদনটা ছিল আন্তর্জাতিক জনমতের কাছে। ঠিক ভারত সরকারের কাছে নয়। এ ক্ষেত্রে আকাশবাণীকে আমি প্রচার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম মাত্র। অবশ্য আমি অনেকের মত খুব বেশি বিবৃতি দিইনি। আমি মনে করতাম ভারতের উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে। তাই আপাততঃ কৌশলগত কারণে ভারতের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল কেবলই একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়বার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। আমরা কোনও ধর্মবিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করবার অথবা বাদ দেবার জন্যে লড়াই করিনি। মানুষ নিয়ে দেশ। মানুষের মনে ধর্মবিশ্বাস নানাভাবেই কাজ করে চলে। আমাদের মধ্যেও তা কাজ করেছে-নিশ্চয়ই প্রচ্ছন্নভাবে।

১৯৭১-এ ভারতের হিসেব মতে প্রায় ৯০ লাখ লোক তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর মধ্যে ২০ লক্ষ ছিলেন মুসলমান, আর ৭০ লক্ষ ছিলেন হিন্দু। একটি হিসাব অনুসারে, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে মাত্র ২০০ জন ছিলেন অমুসলমান। অর্থাৎ বাংলাভাষী মুসলমান যেভাবে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন অন্যরা সেভাবে নেননি। যাকে অনেকে বলতে চাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সেটা সক্রিয় ছিল মূলতঃ বাংলা ভাষী মুসলিম তরুণদের মধ্যেই সীমিত। যে বাঙালি মুসলিম উনবিংশ শতাব্দীতে তিতুমীর ও দুদু মিয়ার নেতত্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছে, জমিদার ও নীলকুঠির সাহেবদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে, তাদেরই বংশধররা করেছিল ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ।

প্রশ্ন : তার মানে তো এই দাঁড়াচ্ছে যে বাঙালি মুসলিম মানসে যে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ও ঐতিহ্যচেতনা ক্রিয়াশীল ছিল তার প্রভাব এখানেও পড়েছে?

উত্তর : অন্যায়-জুলুমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হলো জিহাদ। হতে পারে বাংলাভাষী মুসলমান তরুণ মনে এই জেহাদী অনুপ্রেরণাই সক্রিয় হয়ে উঠেছিল সেদিন।

প্রশ্ন : কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এখন তো কেউ কেউ ধর্ম ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিপক্ষে দাঁড় করাতে চাচ্ছেন!

উত্তর : আজ যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির কথা বলছেন তারা একটা বিশেষ রাজনৈতিক মতলবেই তা বলছেন। আমি এদের এই বক্তব্য সমর্থন করতে পারি না। ১৯৭১-এ সমস্যা ছিল স্বাধীনতা অর্জনের, আর আজ সমস্যা হলো স্বাধীনতা রক্ষার। আমি মনে করি আমাদের স্বাধীনতা কেবলমাত্র একটি দেশই বিপন্ন করে তুলতে পারে। সে হলো ভারত। আমি তাই আমাদের দেশের সমস্ত ভারতবিরোধী দলকে এখন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসাবে গণ্য করতে চাই। কারণ ভারতবিরোধী শক্তির একতাই কেবল আমাদের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করতে পারে।

প্রশ্ন : একাত্তর কিংবা পঁচাত্তরে কার কী  ভূমিকা ছিল সে প্রশ্ন না তুলেই কি এই ঐক্য গড়বার কথা আপনি বলছেন?

উত্তর : হ্যাঁ। তাই বলছি। একাত্তরের পরিস্থিতি আর আজকের পরিস্থিতি এক নয়। ১৯৭১-এ যারা ছিলেন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের সমর্থক, আজ তারা একই যুক্তিতে হতে পারেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সমর্থক। কারণ, আর যাই হোক, এরা কেউই অখÐ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমর্থক নন। আমি মনে করি সেদিনের পাকিস্তানপন্থী মনোভাব আজকের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অনুক‚ল শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। এই উপমহাদেশের ইতিহাস আমাদের এই সিদ্ধান্তেই আসতে নির্দেশ দেয়। মুসলিম চেতনাকে অগ্রাহ্য করে আমাদের জাতীয়তাবাদ টিকে থাকতে পারে না।

প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয় যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির দাবিদারগণ একটা অন্ধ ভাবাবেগপূর্ণ অচলায়তনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে? তাদের এখন কী করা উচিত?

উত্তর : আগেই বলেছি ১৯৭১-এর পরিস্থিতি আর আজকের পরিস্থিতি এক নয়। পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। আর তাকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করেই গ্রহণ করতে হবে সিদ্ধান্ত। জাতীয় স্বার্থকে বাদ দিয়ে জাতীয় রাজনীতি হতে পারে না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মত পার্থক্য থাকতে পারে, থাকতে পারে ব্যক্তিত্বের সংঘাত। কিন্তু তাই বলে জাতীয় স্বার্থকে অস্বীকার করে রাজনীতি করতে গেলে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে থাকবে।

প্রশ্ন : পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে একথা কম বেশি সকলেই স্বীকার করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির দাবিদাররা, যারা ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত, তারা বলছেন এই পরিবর্তন নেতিবাচক, পশ্চাৎমুখী এবং স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ। আপনি কি মনে করেন?

উত্তর : আমি তা মনে করি না। কারণ প্রত্যেকটি জাতি গড়ে ওঠে তার ইতিহাসের ধারায়। আমরা যদি আমাদের ইতিহাসকে অস্বীকার করতে চাই তবে তা হবে আত্মঘাতী। আজকের বাংলাদেশ ভারত বিভক্ত হয়ে হয়নি, হয়েছে সাবেক পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে। বাংলাভাষা আন্দোলন হয়েছিল সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে। ভারতে এ ধরনের কোনও আন্দোলন হয়নি। আমাদের ইতিহাসের এই বিশেষত্বকে আমরা তাই অস্বীকার করতে পারি না। অস্বীকার করতে গেলে সেটাই হবে পশ্চাৎগামিতা।

প্রশ্ন : ভারতে তামিলরা তো ভাষা নিয়ে আন্দোলন করেছে?

উত্তর : হ্যাঁ করেছে। কিন্তু তা আমাদের মত এত প্রচÐ ছিল না।

প্রশ্ন : এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী?

উত্তর : বিগত বিশ্বযুদ্ধের সময় বিলাতে রক্ষণশীল দল ও শ্রমিক দল একত্রিত হয়ে সরকার গঠন করেছিল। বিলাতে তখন বিরোধী দল বলে কিছু ছিল না। প্রয়োজনে আমাদেরও অনুরূপ ঐক্য গড়তে হবে।

প্রশ্ন : সে রকম চরম পরিস্থিতি কি এখন বিরাজ করছে, অথবা আসন্ন প্রায়?

উত্তর : সে রকম চরম পরিস্থিতি এখনো আসেনি। তবে আসবার সম্ভাবনাকে মনে রেখেই আমাদের রাজনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে।

প্রশ্ন : আপনি তো রাজনীতিতে খুবই আগ্রহী। শুনেছি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক-মুহূর্তে এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে আপনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

উত্তর : না, যাকে বলে ফলিত রাজনীতি আমি তা কখনো করিনি। তবে রাজনৈতিক সমস্যা আমাকে চিরদিনই ভাবিত করছে। রাজনীতি বিষয়ে তাই পড়াশোনাও করেছি অবসর সময়ে। তাছাড়া জন্মেছিলাম রাজনৈতিক আলোড়নের যুগে। নানা রাজনৈতিক ভাবনা-ধারণা জীবনের একেক পর্যায়ে আমাকে কিছু না কিছু প্রভাবিত করেছে। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেছি, আবার সেই সঙ্গে চেয়েছি অর্থনৈতিক সমতা। সাম্যবাদী না হলে ও মনে করেছি একজন মানুষের খেয়ে-পরে বাঁচবার অধিকার থাকতে হবে সুস্থ সমাজে। এই উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমানের বিরোধ একটা ঐতিহাসিক সত্য! আমি এর সমাধান চেয়েছি বিরোধকে মেনে নিয়েই। তবে তাকে বাড়িয়ে রাজনীতি করার চেষ্টাকে সমর্থন জানাইনি। আজও জানাই না। কিন্তু প্রগতিশীল হতে হলে ইসলামের সমালোচনা করতেই হবে এরকম মতবাদে আমি বিশ্বাসী নই। আমি মনে করি ইসলামে অনেক উপাদান আছে যাকে অনুসরণ করেই কেবল মানব প্রগতি সম্ভব। তবে গোঁড়ামির পক্ষে নই।

প্রশ্ন : ইসলামে গোঁড়ামি আর উদারতার ব্যাপারটা কী রকম?

উত্তর : ইসলামি চিন্তাধারায় ইজমা বলে একটা কথা আছে। ইজমার সাধারণ অর্থ হলো মুসলমানদের সাধারণ সম্মতির মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করে সমাজ পরিচালনা। যারা গোঁড়া মুসলমান তারা মনে করেন যে, অতীতে ইসলামি আইনবিশারদরা ইসলামি আইনের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেই ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। এখন আর ইজমার কোনও সুযোগ নেই। কিন্তু যারা প্রগতিশীল মুসলমান তারা মনে করেন ইজমার দরোজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়নি। নতুন পরিস্থিতিতে সাধারণ সম্মতির মাধ্যমে নতুন আইন প্রবর্তনের অথবা পুরাতন আইনের নতুন ব্যাখ্যা দেবার প্রয়োজন হতে পারে। যদি ইজমার দরোজা বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের পক্ষে পরিবর্তিত অবস্থায় নিজেদের খাপ খাওয়ানো কঠিন হয়ে উঠবে। মহাকবি আল্লামা ইকবাল তাই মুসলিম সমাজের ইজমার অধিকার পুনরুজ্জীবিত করতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।

প্রশ্ন : বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে, আপনি কি মনে করেন, ইজমার ধারণা কোনও অবদান রাখতে পারে?

উত্তর : রাখতে পারে বৈ কি। ইসলামের সূচনা হয়েছিল মদীনার মতো শহরকে নির্ভর করে। সেখানে যে গণতন্ত্র ছিল তা কতকটা গ্রীক নগর-গণতন্ত্রের মতই। এই গণতন্ত্রে ঠিক বিরোধী দল বলে কিছু ছিল না। বিরোধী দলের ধারণা হল আধুনিক গণতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু গণতন্ত্রের ব্যর্থতা অনেক ক্ষেত্রেই এসেছে সরকারি দল ও বিরোধী দলের তীব্র দ্বন্দ্বের ফলে। ইজমা হলো সাধারণ সম্মতি। দুইটি দলের মধ্যেকার সম্মতি নয়। দলাদলি কমাতে হলে ইজমা বলতে যে ধরনের মনোভাবকে বোঝানো হয়ে থাকে তার প্রয়োজনীয়তা আমাদের দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে অবশ্যই আছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে দলীয় কোন্দল অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে। আর সে ক্ষেত্রে ইসলামি ইজমা বা সাধারণ সম্মতির নীতি আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। ব্যক্তিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তার ব্যক্তি বিবেকের সিদ্ধান্তের নির্দেশে, দলবাদী মনোভাবের ভিত্তিতে নয়। দলবাজি আর মানুষের কল্যাণের গণতন্ত্র সমার্থক হতে পারে না।

প্রশ্ন : একটু আগে আপনি বলছিলেন ‘হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ঐতিহাসিক সত্য’-এখন আপনি এ সমস্যাকে কিভাবে দেখেন?

উত্তর : কথাটাকে আমি একটু ভিন্ন প্রেক্ষিতে বিচার করতে চাই। বিলাত একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। বিলাতে রাষ্ট্রধর্ম অ্যাংলিক্যান খ্রিস্টান ধর্ম। আমাদের একটি রাষ্ট্রধর্ম আছে। এ দেশের যারা নাগরিক সকলেই তারা ভোগ করবে সমান সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু রাষ্ট্র প্রধানকে হতে হবে বিশ্বাসের রক্ষক, অর্থাৎ রাষ্ট্র ধর্মের রক্ষক। তাই তাকে হতে হবে মুসলিম। সবদেশেই রাষ্ট্রপ্রধান হবার ক্ষেত্রে কিছু না কিছু বিধিনিষেধ থাকতে দেখা যায়। কোনও ক্যাথলিক এখনো বিলাতের রাজা হতে পারেন না। সুইডেনে রাজা হতে হলে তাকে হতে হবে লুথেরান খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী। নরওয়েতেও তাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাউকে প্রেসিডেন্ট হতে হলে তাকে হতে হয় জন্মগতভাবে মার্কিন নাগরিক। একজন মার্কিন নাগরিক যদি জন্মগতভাবে মার্কিন নাগরিক না হন তবে আর সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারলেও প্রেসিডেন্ট হবার অধিকার তার থাকে না। ঐতিহাসিক কারণেই আমি মনে করি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব থাকতে হবে একজন প্রকত মুসলিম শাসকেরই হাতে। যদিও তিনি নির্বাচিত হবেন গণতান্ত্রিক উপায়ে। সব ধর্মের নাগরিকেরাই এখানে পাবেন সমান অধিকার। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কারণে শেষ কর্তৃত্ব হতে হবে মুসলিম কেন্দ্রিক। ভবিষ্যতে হয়তো এর প্রয়োজন হবে না। তবে বর্তমানে এর প্রয়োজন আছে। কারণ ইসলাম হল উপমহাদেশীয় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমাদের স্বাধীনতা রক্ষার আধ্যাত্মিক হাতিয়ার।

প্রশ্ন : এই মতের ব্যাপারে আপনার কোনও সমর্থন আছে কি?

উত্তর : সম্ভবতঃ আমি একাই এই মতের প্রবক্তা নই। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহমদ তার স্মৃতিকথায় অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেছেন। তবে আমার মনোভাব গড়ে উঠেছে আমার নিজস্ব চিন্তা পদ্ধতিকে অনুসরণ করেই। এম এন রায়ও মনে করতেন হিন্দু-মুসলমান সমস্যা একটি ঐতিহাসিক সমস্যা এবং তাকে রাজনীতির ক্ষেত্রে গ্রহণ করতে হবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। রায় মুসলিম সভ্যতাকে বুঝবার যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। আর এই কারণেই তিনি ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান নিয়ে একটা বইও লিখেছিলেন। আর কোনও নেতা তা করেননি। এ ক্ষেত্রে তিনি অনন্য।

প্রশ্ন : আমাদের আলোচনায় ধর্ম, মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতি খুব প্রাধান্য পেয়ে গেল।

উত্তর : হ্যাঁ। প্রশ্নোত্তরের ক্ষেত্রে ধর্ম প্রসঙ্গে অনেক কথাই বলতে হল। কিন্তু মানুষের জীবন কেবল যে ধর্ম দিয়েই চলে আমি তা মনে করি না। জীবনের নানা দিক আছে যাকে স্বীকার করেই বাঁচতে হয় মানুষকে। মুক্তিযুদ্ধের কথাও বলতে হল। ১৯৭১-এ কোনও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু ঘটনাচক্রে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলাম। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথাও আসলো কথার প্রসঙ্গে।

প্রশ্ন : এবার আমরা ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে কিছু আলাপ করতে পারি?

উত্তর : বলুন কি জানতে চান?

প্রশ্ন : আমাদের ছাত্ররা খুব বেশি রাজনীতি প্রবণ এমন কথা শোনা যায়।

উত্তর : তা ঠিক। আমাদের দেশে ছাত্ররা রাজনীতি নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়; জীবনের অন্য দিক নিয়ে নয়। অন্য দেশের ছাত্ররা যেভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করছে। আমাদের ছাত্ররা সেভাবে করছে না।

প্রশ্ন : এ জন্যে কি শুধুই ছাত্ররা দায়ী?

উত্তর : এর জন্য আমরা শিক্ষকরাও বহুলাংশে দায়ী। আমরা যেভাবে শিক্ষকতা করছি তা ছাত্রদের বুদ্ধিবৃত্তি জাগরণের অনুক‚ল নয়। পেশা হিসাবে শিক্ষকতাকে যেভাবে গ্রহণ করা উচিত আমরা সেভাবে গ্রহণ করছি না। অনেক শিক্ষকের বিদ্যার পরিধি আমাকে পীড়িত করে। তাই আমার মনে হয় শিক্ষার মান বাড়াতে হলে শিক্ষকতার মানকেও অবশ্যই বাড়াতে হবে। অনেক ছাত্র উষ্মা প্রকাশ করে বলে-এত জেনে কী হবে? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কেবলই হয়ে দাঁড়িয়েছে কম জেনে পরীক্ষায় ভাল ফল করে ভাল চাকরি পাওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত। এ সমস্যার সুরাহা না হলে দেশের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে না। কারণ এ যুগের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনিতে হলে প্রয়োজন বিজ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ। আর এ বিজ্ঞান এখন যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তাকে গ্রহণ করতে গেলে আমরা এখন যে পরিমাণ পরিশ্রম করছি তার চাইতে অধিক শ্রম দিতে হবে। অর্থনৈতিক মুক্তির কথাটা যেভাবে বলা হচ্ছে সেভাবে কোনওদিনই কোনও সমাজে সম্ভব নয়। জ্ঞান-বুদ্ধির প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের সভ্যতা এগিয়ে চলেছে। এর জন্যে প্রয়োজন হয় যথেষ্ট শ্রমেরও।

প্রশ্ন : এর জন্যে রাজনীতি করাও  তো দায়ী-কী বলেন?

উত্তর : অবশ্যই। আমাদের রাজনীতির বড় দুর্বলতা এই যে তা ছাত্র-নির্ভর। অন্য দেশের মত তা সমগ্র জন নির্ভর নয়। জনসচেতনতা বাড়িয়েই কেবল এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, অন্যভাবে নয়।

প্রশ্ন : আপনি কি ছাত্রদের আপনার চিন্তাধারায় উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন?

উত্তর : আমার সুদীর্ঘ জীবন কেটেছে অধ্যাপনা করে। কিন্তু ছাত্র নিয়ে আমি কোনও রাজনীতি করতে চাইনি। আমার মতামত আমি পত্র-পত্রিকায় লিখেই প্রকাশ করেছি। কোনও ছাত্র যদি তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে তবে সেটা হয়েছে পরোক্ষভাবে, প্রত্যক্ষভাবে নয়।

প্রশ্ন : ষাট-এর দশকে আপনি সমকালে লিখতেন। সমকাল গোষ্ঠীকে বাম ঘেঁষা বলে মনে করা হতো। আপনি কি তখন বামপন্থী ছিলেন?

উত্তর : সমকাল পত্রিকার সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না। লেখার মাধ্যমেই তার সাথে পরিচয় ঘটে। সিকান্দার আবু জাফরের মন আধুনিক ছিল, কিন্তু প্রচলিত অর্থে বাম বলতে যা বোঝায় তা ছিল না। সমকালে নানা ধরনের লোকই লিখতেন। তাদের মধ্যে পরবর্তীকালে আল মাহমুদ কবি খ্যাতির শীর্ষে ওঠেন। আল মাহমুদের সঙ্গে সমকাল পত্রিকার মাধ্যমে আমার গভীর পরিচয় ঘটে। তার কবিতা আমার ভাল লাগত। আমি সমকালে লিখতাম অনেক সময়ই পৃষ্ঠাপূরণের জন্যে। সে সময় ঢাকায় লেখকের সংখ্যা ছিল সীমিত। আমি ঠিক সাহিত্যিকদের দলেও ছিলাম না। লিখতাম এই মাত্র। সিকান্দার আবু জাফর আমার প্রথম বই ‘শিল্পকলার ইতিকথা প্রকাশ করেন।

প্রশ্ন : ১৯৭১-এ কলকাতায় আপনি প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সিকান্দার আবু জাফরও একটি কাগজ বের করেছিলেন। তখনও কি একসঙ্গে কাজ করেছেন?

উত্তর : সিকান্দার আবু জাফর ১৯৭১-এ কলকাতায় যান এবং খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে ‘অভিযান’ বলে একটি সাপ্তাহিক কাগজ প্রকাশ করেন। সিকান্দার আবু জাফর তার পত্রিকায় আমাকে লিখতে বলেন। তবে সময়াভাবে তা পেরে উঠিনি। পত্রিকাটি দু’তিন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। তারপরই যুদ্ধ শেষ হয়।

প্রশ্ন : আপনি  তো ৭১-এ কলকাতায় আওয়ামী লীগের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ প্রকাশ করতেন ।

উত্তর : হ্যাঁ! জয়বাংলা সম্পাদনার সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। বেশ কিছু প্রচার-পুস্তিকাও প্রণয়ন করি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে আমি কখনো আওয়ামী লীগ পন্থী ছিলাম না।

প্রশ্ন : আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কি কিছুই বলবেন না?

উত্তর : নিজের কথা বলবার আমার বিশেষ কিছুই নেই। আমি জীবনে এমন কিছু করিনি, যা নিয়ে গৌরব করে বলবার কিছু আছে। আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ফেলে আসা দিনগুলির কথা যখন দু’একবার মনে করি তখন নিজেকে মনে হয় ভবঘুরের মত, যে দেশ-বিদেশ ঘুরে দেখতে চায়, দেখে আনন্দ পায়, পথ চলার আনন্দটাই যার কাছে বড় পাওয়া। নানা বিষয়ে পড়াশোনা করে আনন্দ পেয়েছি। এই জানা ঠিক পন্ডিত হবার জানা নয়, ভবঘুরের দৃষ্টি নিয়ে সবকিছুকে দেখা, দেখে আনন্দ পাওয়া। আমার নিজের বাড়িঘর নেই, কিন্তু অন্যের বাড়িঘর দেখে পেয়েছি আনন্দ। পড়েছি স্থাপত্যের ইতিহাস। বস্তু নয়, বস্তুর রূপই আমাকে আকৃষ্ট করেছে। বেশি।

প্রশ্ন : এখন বিশেষ কোনও কাজ করছেন কি?

উত্তর : পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি ছাড়াও বর্তমানে আমি মিউজিকোলাজ বা সঙ্গীত তত্তে¡র উপর একটা বই লেখার কাজে ব্যাপৃত আছি।

প্রশ্ন : এটা কি ফরমায়েসী লেখা।

উত্তর : না। মনের তাগিদেই লিখছি।

প্রশ্ন : ছোট্ট একটা প্রশ্ন।

উত্তর : (হাসলেন তিনি) বলুন ।

প্রশ্ন : আমরা দেখি বয়স্কদের তুলনায় তরুণদের সঙ্গে আপনি মেশেন বেশি…!

উত্তর : (স্মিত হাসি) তরুণ মন চিরকালই সক্রিয়। তারা হলেন ভবিষ্যতের প্রতীক। আশাবাদী বলেই হয় তো তাদের প্রতি আমার এই পক্ষপাত। এটা চিরদিনের, বলতে পারেন আজন্ম পক্ষপাত। (ভুরু উঁচিয়ে হাসলেন তিনি। বরাবরের মত তীক্ষè চোখে তারুণ্যের উচ্ছলতা।)

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : নাজিব ওয়াদুদ

তথ্যসূত্র : আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ (সম্পাদিত) অঙ্গীকার ডাইজেস্ট, তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, মে ১৯৯৪।

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ