তাজমহলের স্থাপত্যশৈলী

Photo: Alamy

উত্তর ভারতে হিন্দুত্ববাদ প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করানোর চেষ্টা চলছে হিন্দুত্ববাদকে। ১৯৯২ সালে হিন্দুত্ববাদের একটা উৎকট অভিব্যক্তি আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রক্রিয়ায়। যাতে অংশ নিয়েছিল তিন লাখের মতো হিন্দু করসেবক বা ধর্মীয় স্বেচ্ছাসেবী। প্রচার করা হয়, ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রাম সেখানে জন্মেছিলেন। ১৫২১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমানরা অযোধ্যায় রামমন্দির ভেঙে ফেলে অথবা রূপান্তরিত করে বানায় বাবরি মসজিদ। বাবরি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন মীর বাকি নামক সম্রাট বাবরের সাথে আসা একজন সম্ভ্রান্ত অমাত্য।

ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা এখন বিশেষভাবে বলতে শুরু করেছেন, তাজমহলও নাকি ছিল একসময় হিন্দু-মন্দির। তারা এটাকে ভেঙে ফেলার কথা ভাবছেন, না ভাবছেন হিন্দু মন্দিরে পরিণত করার কথা, সেটা আমাদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। তাই তাজমহল নিয়ে বর্তমানের এই আলোচনা। আমাদের কাছে এবং বিশ্বের কাছে তাজমহল হলো ইসলামি শিল্পকলার একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন এবং তা হয়ে আছে জগৎখ্যাত। যেসব স্থাপত্যবস্তুকে চিহ্নিত করা হয় ইসলামি বিশেষণে, তাদের বৈশিষ্ট্য হলো গম্বুজ, খিলান ও মিনার।

দক্ষিণ এশিয়াতে যাকে বলা হয় মুসলিম বা ইসলামি স্থাপত্য, তার বিশ্লেষণেও এই তিনটি উপকরণ বিশেষভাবে বিচার্য। তাজমহলের গম্বুজ কতকটা পিয়াজাকৃতির মতো, উল্টানো গোল বাটির মতো নয়। এ ধরনের গম্বুজের উদ্ভব হয় ইরানে ইলখান্দের রাজত্বের সময়। পরে তা এসে পৌঁছে উত্তর-ভারতে মুঘল আমলে ইরান থেকে; বিশেষভাবে ইরানের সাফাভির বাদশাহদের শাসনপর্বে (১৫০২-১৭৩৬ খ্রি.)। মুঘল বাদশাহরা শিয়া ছিলেন না। কিন্তু তারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন ইরানের শিয়া মুসলিম শিল্প-সংস্কৃতির দ্বারা। মুঘল বাদশাহরা মানবধারার দিক থেকে ছিলেন মূলত তুর্কি। ঐতিহাসিকদের মতে বারলা তুর্কি। সম্রাট বাবর তার আত্মজীবনী লিখেছেন বারলা-তুর্কি ভাষায়। কিন্তু মুঘলরা এই উপমহাদেশে রাজকার্য পরিচালনা করেছেন ফারসি ভাষায়।

ধর্মের ভাষা ছিল আরবি; কিন্তু এ ক্ষেত্রেও পড়েছে ফারসি ভাষার প্রভাব। যেমন বেহেস্ত, দোজখ, নামাজ, পয়গম্বর। এসব শব্দ আরবি ভাষার নয়, ফারসি ভাষার। মুসলিম শব্দটি আরবি। কিন্তু মুসলমান শব্দটি হলো ফারসি। ইসলাম শব্দটি অনেকের মতে এসেছে হিব্রু (!) ভাষা থেকে। হিব্রুতে ‘সালম’ মানে হলো শান্তি। তা থেকে আরবিতে সৃষ্টি হয়েছে ইসলাম শব্দটি। ইসলামের বিশেষণ, আরবিতে মুসলিম। কিন্তু ফারসিতে মুসলিম দাঁড়িয়েছে মুসলমান শব্দে। মসজিদ শব্দটা আরবি, ফারসি ভাষায় তা গৃহীত হয়েছে। মসজিদ বলতে বোঝায় সেজদা করার বা প্রণত হওয়ার জায়গা।

তাজমহলের গড়ন মসজিদের মতো। কিন্তু তাজমহল মসজিদ নয়, স্মৃতিসৌধ। যদিও গড়া হয়েছে মসজিদের শৈলীতে। সাধারণত বলা হয়, তাজমহল হলো মমতাজ বেগমের স্মৃতিসৌধ। কিন্তু এভাবে তাজমহলকে কেবল মমতাজ বেগমের স্মৃতিসৌধ বলে উল্লেখ করা যথাযথ নয়। কারণ তাজমহলে রয়েছে সম্রাট শাহজাহানেরও কবর। তাজমহল কেবল মমতাজ বেগমের কবর ধারণ করে নেই, ধারণ করে আছে বাদশা শাহজাহানেরও কবর। তবে মমতাজ মারা যান সন্তান প্রসবের সময়। তার মৃত্যুর অনেক পরে মারা যান সম্রাট শাহজাহান। এ ছাড়া বাদশা শাহজাহানের ছিল তিনজন স্ত্রী। মমতাজ বেগমের আসল নাম হলো আরজুমান্দ বেগম। তাজমহল নামের শব্দগত অর্থ হলো, রাজপ্রাসাদের মুকুট। রবীন্দ্রনাথ শাহজাহানকে তার কবিতায় যেভাবে রূপদান করেছেন, বাস্তব ইতিহাস কিন্তু মোটেও তার অনুরূপ নয়। শাহজাহান চিরদিন তার এক স্ত্রীর ভালোবাসাতেই যে আবদ্ধ ছিলেন, তা কিন্তু ইতিহাস বলে না।

আরজুমান্দের গর্ভজাত চার পুত্রের মধ্যে হয়েছে শাহজাহানের উত্তরাধিকার নিয়ে যুদ্ধ। দারাশিকো, সুজা, আরোঙ্গজেব ও মুরাদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে হয়েছে যুদ্ধ। কিন্তু শাহজাহানের অন্য স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তাদের ইতিহাস সেভাবে কিছু জানা যায় না। রবীন্দ্রনাথের মতে, শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন স্মরণের আবরণে মরণকে ঢেকে রাখার ইচ্ছায়। কিন্তু তাজমহল তৈরি শেষ হওয়ার আগে শাহজাহানকে রাজপ্রাসাদে বন্দী করে রেখেছিলেন আরোঙ্গজেব। তিনি চেয়েছিলেন তার পিতার স্মৃতিসৌধ যথাযথভাবে নির্মিত হোক। তাজমহল কেবলই সম্রাট শাহজাহানের কীর্তিগাথা নয়। তবে আরোঙ্গজেব ছিলেন গোঁড়া সুন্নি মুসলমান। তিনি জাকজমক পছন্দ করতেন না। তিনি সংস্কৃতি চর্চার নামে রাষ্ট্রের বিরাট অর্থ ব্যয়ের ছিলেন ঘোর বিরোধী। তিনি মনে করতেন, ধর্ম মানুষের অন্তরের জিনিস। মার্বেল পাথরের মসজিদ বানিয়ে মানুষকে ধার্মিক করা যায় না; যদিও দেখানো যায় জাকজমক।

হিন্দুত্ববাদীরা দাবি করছেন, তাজমহল নাকি একসময় ছিল হিন্দু মন্দির। কিন্তু হিন্দু মন্দিরের ধারণা আর মসজিদের ধারণা এক নয়। হিন্দু মন্দিরে সাধারণত দেব-মূর্তি থাকে একটি ছোট কুঠরিতে বা গর্ভগৃহে। সেখানে পুরোহিত করেন পূজা। কিন্তু মুসলমানদের মসজিদে প্রার্থনা করেন সমবেতভাবে, একজন ইমামের পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। আল কুরআনে বলা হয়েছে- একাকি প্রার্থনা করার চেয়ে আল্লাহর কাছে সমবেতভাবে প্রার্থনা করা ভালো (সূরা বাকা : আয়াত-৪০)। কিন্তু হিন্দু-মন্দিরে এভাবে কোনো প্রার্থনা করার রীতি নেই। বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে চৈত্যতে সমবেতভাবে প্রার্থনা করার বিধান আছে। কিন্তু হিন্দু ধর্মে নেই। হিন্দু মন্দির আর বৌদ্ধ চৈত্য গঠন এক নয়। বৌদ্ধ চৈত্যকে কিছুটা তুলনা করা চলে মুসলিম মসজিদের সাথে, কিন্তু হিন্দু মন্দিরকে নয়। হিন্দু আমলে মন্দির গড়া হয়েছে পাথর কেটে সাজিয়ে। মন্দির যাতে ভেঙে না পড়ে সে জন্য লোহার পাত অথবা সিসার পাত দিয়ে পাথরকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু মুসলমান আমলে পাথরকে ইটের মতো কেটে সিমেন্টের মতো জিনিস ব্যবহার করে একের পর এক উপযুক্ত আকারের পাথর গেঁথে বানানো হয়েছে মসজিদ, দুর্গ, রাজপ্রাসাদ। অর্থাৎ মন্দির স্থাপত্য আর মসজিদ স্থাপত্য নির্মাণগত দিক থেকেও তুলনীয় নয়। তাজমহল নির্মাণে কোথাও মন্দিরের মতো ইস্পাত ও লোহার পাত ব্যবহৃত হয়নি। কোনো মন্দিরেই মিনার থাকতে দেখা যায় না। মসজিদে মিনার থাকে। কেননা, মসজিদের মিনার থেকে আজান দেয়া হয়। মসজিদে থাকতে হয় পানির বিশেষ ব্যবস্থা। কেননা, মুসলমানরা পানি দিয়ে ওজুু করার পর নামাজ আদায় করেন। তাই ফোয়ারা হয়েছে মসজিদ স্থাপত্যের বিশেষ অংশ।

মসজিদের কাছে করা হয়েছে কৃত্রিম সরোবর। তাজমহলের চার কোণে চারটি মিনার আছে। যেমন আছে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত সেন্ট সোফিয়া মসজিদের চার কোণে চারটি। সেন্ট সোফিয়া মসজিদ অবশ্য একসময় ছিল গ্রিক-খ্রিষ্টান গির্জা। পরে তুর্কি মুসলমানরা সেটাকে পরিণত করেন মসজিদে। তাজমহলের মাঝখানে আছে একটি বড় পিয়াজাকৃতির গম্বুজ। যার উঁচু চূড়া ধরে উচ্চতা হলো প্রায় ৭৩ মিটার। এই বড় গম্বুজের চারধারে রয়েছে চারটি ছোট গম্বুজ। এরা পিয়াজাকৃতির নয়। কতকটা বাটির মতো গোল। তাজমহলের চারটি পাশ অবিকল একই রকম দেখতে। অর্থাৎ তাজমহলকে চারপাশ থেকে দেখতে একই রকম দেখায়। তাজমহলে ব্যবহার করা হয়েছে সুচালো খিলান (Pointed Arch), যা হিন্দু স্থাপত্যে ছিল না। হিন্দু স্থাপত্যে গোল খিলানও ছিল না। হিন্দু-স্থাপত্যে প্রকৃত খিলানের ব্যবস্থা নেই। আছে, যাকে বলে কর্বেল আর্চ। যা করা হয় পাথরকে একটু একটু করে দেয়ালের ওপর সামনের দিকে একের পর এক এগিয়ে দিয়ে। কিন্তু কর্বেল আর্চ তেমন ভারবহ হয় না। যেমন হয় প্রকৃত খিলান। মুঘলরা সুন্দর হর্ম্য নির্মাণের সময় তার চারধারে গড়তেন উদ্যান ও সরোবর।

যার মধ্যে হর্ম্যরে প্রতিবিম্ব পড়ে, তাকে একত্রে অনেক সুন্দর দেখায়। তাজমহলের চারধারে আছে অনুপম উদ্যান, আছে ফোয়ারার সারি আর আছে কৃত্রিম সরোবর। এদের সব কিছুকে একত্রে চোখে পড়ে। তাজমহলের দুই পাশে (উত্তরে ও দক্ষিণে) আছে লাল বেলেপাথরের তৈরী দুটি মসজিদ।
যারা একই রকম দেখতে এবং একে অপরের ভারসাম্যমূলক। ইসলামি স্থাপত্যে ভারসাম্য ও প্রতিসাম্যের নীতিকে বিশেষভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। এই দুটি মসজিদকে সাধারণভাবে বলা হয় একে অপরের জওয়াব। তাজমহলকে ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো ঘোষণা করেছিল বিশ্ব সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে। সাধারণত মনে করা হয়, তাজমহল হলো ভারতের সবচেয়ে সুন্দর হর্ম্য। এই হর্ম্যটিকে এখন প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে, ছিল, হিন্দু-মন্দির। তাজমহলের শূল গম্বুজের গোড়ায় আছে পদ্মের পাঁপড়ি দিয়ে করা নকশা। এ রকম নকশা একাধিক মুসলিম মসজিদে করা হয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় না যে, তাজমহল ছিল একসময় হিন্দু-মন্দির।

আমরা জানি জাহাঙ্গীরের মা ছিলেন হিন্দু রাজপুত মহিলা। শাজাহানের মা-ও ছিলেন হিন্দু রাজপুত বংশোদ্ভূত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে প্রাচীন রাজপুত মন্দিরশৈলীর দ্বারা এরা দু’জনের কেউই প্রভাবিত হননি। তাজমহলের প্রকৃত স্থপতি কে, সে বিষয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে। তবে সাধারণভাবে মনে করা হয়, তাজমহলের স্থপতি হলেন ওস্তাদ আহমাদ লাহুরি। তার নাম লাহুরি হয়েছে, কারণ তিনি জন্মেছিলেন লাহোর শহরে। কিন্তু তার পূর্বপুরুষ এসেছিলেন ইরান থেকে। তাজমহল নির্মাণে নানা দেশের শ্রমিক ও কারিগররা অংশ নিয়েছিলেন। এরা এসেছিলেন ইরান, তুরস্ক, মধ্যএশিয়া এমনকি তখনকার ইটালি থেকেও। তাজমহল তৈরি করতে লেগেছিল প্রায় ২০ বছর। এতে অংশ নিয়েছিল প্রায় ২০ হাজার লোক।

দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১০ নভেম্বর ২০১৭। 

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ