“আমরা বেঁচে থাকি আগে আর চিন্তা করি পরে” বলেছেন বিখ্যাত দিনেমার দার্শনিক ‘কের কাগর’ (Kier Kegaard)। ধর্ম সম্বন্ধেও কথাটা বোধ হয় অনেক পরিমাণে খাটে। ধর্মের অস্তিত্ব আগে, ধর্ম নিয়ে চিন্তা তার অনেক পরের ব্যাপার। আসলে ধর্ম সম্বন্ধে আমরা যা আলোচনা করবো তা খুবই আধুনিক চিন্তার ফল। ধর্মের বয়সের তুলনায় এই নূতন চিন্তা ধরার বয়সকে নিমেষ মাত্রও বলা যায় না। কিন্তু ইতিমধ্যেই আমরা অনুসন্ধানের ফলে এমন অনেক কথা জানতে পেরেছি যা আমাদের ধর্ম সম্বন্ধে ধারণাকে দিয়েছে বিরাটভাবে বদলে।
ধর্মকে আজ নূতন করে বুঝে দেখবার চেষ্টা হচ্ছে। একাধিক কারণ রয়েছে এই প্রচেষ্টার মূলে। ধর্ম মানুষের প্রথম আত্মচেতনার ফল। ধর্ম-চিন্তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা খুজে পাই আমাদের অনেক জটিল চিন্তার প্রাথমিক উৎস। ধর্মের ভিত্তিতে আমরা আমাদের আচার-আচরণের অনেক কিছুর ব্যাখ্যা পেতে পারি। মানুষের ইতিহাসকে, ইতিহাসের ধারাকে, বুঝাবার কাজে ধর্ম নানাভাবে সাহায্য করে। মানুষ ধর্ম গড়েছে। ধর্ম আবার নানা ভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছে মানুষের জীবন। ধর্মীয় ধারণাকে কেন্দ্র করে সুসংগঠিত হয়েছে মানুষের সমাজজীবন। মানুষ সব সময় তার জীবনে কোন না কোন একটা আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চেয়েছে, আর তার এই আদর্শের ভিত্তি যুগিয়েছে বিশেষভাবে ধর্মচেতনা ও ধর্মীয় মনোভাব। মানুষের ইতিহাস বহুল পরিমাণেই তার চেতনার বিকাশের ইতিহাস। ইতিহাস ও দর্শনের সম্বন্ধ নিবিড়। আর ধর্মকে বলা যায় মানুষের প্রাথমিক দর্শন। কারণ সব ধর্মের মধ্যেই আমরা খুঁজে পাই জগত ও জীবন সম্বন্ধে কিছু না কিছু ধারণা। কিভাবে জীবন যাপন করব এবং কেন সেভাবে জীবন যাপন করব তার নির্দেশ। ধর্ম কেবল মাত্র বিশ্বাসের বিষয় (matter of believing) নয়, ধর্ম মানুষকে দেয় একটা জীবন যাপন পদ্ধতি (way of living)।
আমাদের ভাষায় ধর্ম কথাটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। দুটি শব্দের যোগে হয়েছে এর উদ্ভব : ধৃ+মন্ = ধর্ম। শব্দগত অর্থ করলে দাঁড়ায় ধারণ করা। শব্দগত অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘ধারণ করা’। অর্থাৎ যা মানব জীবনকে ধারণ করে বা ধরে রাখে তাই ধর্ম। অন্যদিকে ইংরাজী ‘রেলিজিয়ন’ (ৎবষরমরড়হ) কথাটা এসেছে অনেকের মতে ল্যাটিন রেলিগার (ৎবষরমধৎ) শব্দটি থেকে। রেলিগার শব্দটার মানে হল বাঁধা বা বন্ধন করা (to bind)। অর্থাৎ ধর্ম এমন এক চেতনা যা মানুষের সাথে মানুষকে বিশেষ বন্ধনে আবদ্ধ করে, ধরে রাখে। ধর্মের মাধ্যমে মানুষ সবক্ষেত্রেই বন্ধন বা সমাজ-সম্বন্ধ রচনা করতে চেয়েছে। মানুষে মানুষে সহযোগিতার জন্যে বন্ধন প্রয়োজন। বন্ধন প্রয়োজন সামাজিক নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে। বন্ধন প্রয়োজন জীবনের বাঞ্ছিত শান্তি আর নিরাপত্তার জন্য। মানুষ ভালভাবে শান্তিতে বেঁচে থাকবার জন্যেই ধর্মের সৃষ্টি করেছে। ধর্মের মূলে আছে মানুষের ভাল ভাবে বেঁচে থাকবার, আপনি অস্তিত্বকে নিরাপদ করবার এক আদ্য তাগিদ। ধর্ম মানুষের জিজীবিষার অভিব্যক্তি।
আদিম উপজাতির (Premitive People) মধ্যে দেখা যায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংঘবদ্ধ উৎসব মাত্র। উন্নত ধর্মের ক্ষেত্রেও সংবদ্ধভাবে প্রার্থনা করা হয়। অনেকে তাই বলতে চান, ধর্মের মূলে আছে মানুষের সংঘচেতনা, আর এই সংঘচেতনাকে বাড়াবার প্রেরণা। ফরাসী সমাজতাত্তিক ডুরকেইম (Durkheim)-এর মতে : ধর্ম ও ধর্মসংঘ (Church) অভেদার্থক। স্রষ্টা হচ্ছেন সমাজ সত্তার দেব-রূপ (society deified)। সমাজের যৌথ চেতনা কেন্দ্র করেই দেখা দিয়েছে এক সর্বাত্মক চিৎ শক্তির ধারণাÑযাকে কেন্দ্র করে জগত ও জীবন।
বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ধর্মের তিনটি অঙ্গ। সব ধর্মের গোড়ায় আছে ভালভাবে বাঁচবার তাগিদ, নিরাপত্তার তাগিদ। এটাকে বলা যায় ধর্মের লক্ষ্য বা আদর্শ (Ideal)। এই লক্ষ্য হল ধর্মের প্রথম অঙ্গ। সকলেই এই লক্ষ্যে পৌছবার জন্যে, জীবন থেকে অনিশ্চয়তা দূর করে সুখী হবার জন্যে, অনেক রকম ক্রিয়াকাÐ করে থাকে। এই ক্রিয়াকান্ড বা কর্মকান্ডকে (Cult) বলা যায় ধর্মের দ্বিতীয় অঙ্গ। ধর্মের তৃতীয় অঙ্গ হচ্ছে তার জ্ঞানকাÐ বা তত্ত¡গত দিক। সব ধর্মই বলতে চায় জগত ও জীবন সম্বন্ধে অনেক কথা। আত্মা পরকাল ইত্যাদির ধারণা সব ধর্মেই নানাভাবে দেখতে পাওয়া যায়। ধর্মের এই জ্ঞানকান্ড বা তত্ত্বগত দিকের (Theology) সাথে দর্শনের যোগাযোগ নিকট। ধর্মের জ্ঞানকান্ডের প্রশ্ন অর দর্শনের প্রশ্ন একই।
ধর্মীয় ধারণায় আত্মা (Soul) একটা বড় কথা। আত্মার ধারণা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসছে। বস্তুবিহীন সচেতন সত্তা বা আত্মার অস্তিত্বের মাধ্যমে ধর্মে বহু কিছুর ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করা হয়েছে। বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী টেলর (Tylor) তাই আত্মার বিশ্বাসকেই ধর্মের ন্যূনতম সংজ্ঞা নির্দেশের পক্ষে যথেষ্ট বলে অভিমত প্রকাশ করেন। তাঁর ও তাঁর অনুগামীদের মতে আত্মাবাদ বা এনিমিজম থেকে হয়েছে সর্বপ্রকার ধর্মের উদ্ভব। ধর্মের মূলে আমরা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই আছে এক ভক্তি প্রযুক্ত ভয় (awe) ও পবিত্রতাবোধ। একে বলা যায় ধর্মীয় মেজাজ। এই মেজাজের সাথে আবার অদৃশ্য অধরা আত্মার অস্তিত্বের ধারণা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আমাদের আলোচনার আরম্ভে আমরা টেলরের সংজ্ঞাটিকেই গ্রহণ করব। আত্মার কথা ধর্মের ক্ষেত্রে এমন এক বাস্তবতা যাকে বাদ দিয়ে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ধর্মের বিচার-বিশ্লেষণ করা সত্যিই যায় না। আমরা আমাদের এই আলোচনায় ধর্মকে প্রথম দেখবো নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে। তারপর দেখব প্রত্মতত্ত্ব ও ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে। তারপরে আমরা আলোচনা করব ধর্ম সম্বন্ধে কয়েকটি বিশেষ দার্শনিক মতের কথা। সব সময় যতদূর সম্ভব আমরা ধর্মতত্তে¡র জটিল বিতর্কমূলক বিষয়গুলি থেকে সরে থাকব। কারণ ধর্মকে একটা অখÐ ক্রমপরিণতিলব্ধ মানব-বাস্তবতা হিসাবে বুঝে দেখাই হবে আমাদের প্রথম লক্ষ্য। আমাদের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হবে মানব জীবন ও ইতিহাসে ধর্মের ভ‚মিকাকে বুঝে দেখা। অর্থাৎ ধর্মকে দেখব আমরা ইতিহাসের ধারায় ব্যাপক অর্থে এবং মানব ইতিহাসকে আবার বিচার করব ধর্মচেতনার ভিত্তিতে। যার ফলে, আশা করা যায়, সমগ্র ভাবে মানুষ সম্বন্ধেই একটা বিশিষ্ট ধারণা গড়ে ওঠা সম্ভব হবে আমাদের মনে। মানুষই একমাত্র প্রাণী, যার ক্ষেত্রে আমরা পরিচয় পাই ধর্মচেতনার-ধর্মের কথা তাই বিশেষ ভাবে মানুষেরই পরিচয়-কথা ।
প্রথম ধার্মিক মানুষ
ধর্মের জন্ম মূল নিহিত রয়েছে সুদূর অতীতের গর্ভে; যার বহু কথাই আমরা জানি না। ধর্মের জন্ম মূল প্রাগৈতিহাসিক মানুষের সাথে যুক্ত। নানা জায়গায় মাটি খুঁড়ে একাধিক প্রাচীন মানব-কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে। এরা ঠিক আমাদের মত মানুষ নয়। অনেক দিক থেকেই এদের চেহারা ছিল আমাদের থেকে আলাদা। আমরা আজ যদি এ-ধরনের কোন প্রাণীকে হঠাৎ দেখতে পাই তবে তাকে মানুষ না ভেবে বন মানুষ (ape) বলেই ধরে নেব। তবু বিজ্ঞানীরা এসব প্রাণীকে মানুষের দলে ফেলেন। কারণ, এর কথা বলতে পারত। পাথরের অস্ত্র বানাতে পারত। অনেকে আবার আগুনের ব্যবহারও জানত। মনোভাব ব্যক্ত করতে পারা, হাতিয়ার বানাতে পারা, প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগাতে পারা প্রাথমিক মানব-ধর্ম। তাই এদের ও আমাদের এক পরিবারভুক্ত প্রাণী বলে মনে করেন। এই পরিবারের (ভধসরষু) নাম তারা রেখেছেন ‘মানব’ বা হোমোনিডি (Hominidae)। হোমোনিডদের মধ্যে আবার দুটো বড় ভাগ করা হয়। একদলকে বলা হয় পিথেক্যানথ্রপাস (Pithecanthropus) অন্য দলকে বলা হয় হোমো। এই হোমে দলের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে বেঁচে আছি আমরা। পিথেক্যানথ্রপাস দলের কোন প্রাণী আজ আর বেঁচে নেই। তাদের সাক্ষ্যবাহী কঙ্কাল যবদ্বীপ ও চীনের পিকিং-এর কাছে পাওয়া গিয়েছে মাত্র। এদের প্রস্তরীভ‚ত কঙ্কাল থেকে এদের সম্বন্ধে আমরা অনেক কথা জানতে পেরেছি। অনুমান করা চলে, জীব-বিবর্তনের ধারায় নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে এদের মত প্রাণীদের থেকেই হয়েছে হোমো দলে (মবহঁং) মানবের উদ্ভব। এই হোমোদের মধ্যে এ পর্যন্ত যতদূর জানা গেছে, ঘটে প্রথম ধর্ম চেতনার উন্মেষ। হাজার পঞ্চাশেক বছর আগে যে মানব কঙ্কাল ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের মাটি খুঁড়ে একাধিক পাওয়া গিয়েছে, বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন হোমোনিয়ানডেরথালেন্সিস্ (Homo-neanderthalensis)। সংক্ষেপে একে বলা হয় নিয়নডেরথাল মানুষ। এরাও দেখতে ছিল কতকট গরিলা জাতীয়। এদের চোয়ালের হাড় ছিল আমাদের চাইতে অনেক ভারি। থুতনি (chin) ছিল অনেক সমতল। কপাল ছিল চাপাÑকতকটা গরিলার মত। এদের পায়ের হাড় ছিল বাঁকা। তাই এদের হাঁটতে হত সামনের দিকে ঝুঁকে। এদের মাথায় মগজের পরিমাণ ছিল আমাদের চাইতে বেশী। কিন্তু মগজের যে অংশকে আমাদের ধীশক্তির আশ্রয় বলা হয়, তা এদের ক্ষেত্রে ছিল কম। কিন্তু ক্রিয়া কর্মে এরা নানা ভাবে ছিল আমাদের মত। এরা আগুন জ্বালাতে পারত। পাথরের অস্ত্র দিয়ে শিকার করত। থাকত পাহাড়ের গুহায়। এরা কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করত। যূথবদ্ধ ভাবে থাকতে ভালবাসত। ধর্মের ইতিহাসের ক্ষেত্রে এদের স্থান দিতে হয় প্রথমে। কারণ, এরা মৃতদেহ কবর দিত। মৃতদেহকে কবরে শায়িত করত বিশেষ যত্ন করে ও সুনির্দিষ্ট প্রথা অনুসারে। কবরে মৃত দেহের সাথে এরা দিল পাথরের অস্ত্রপাতি, পান পাত্র ও আহার্য-প্রাণী। এসব কবর খুঁড়ে নিয়নডেরথাল মানুষের কঙ্কালের সাথে এসব পথরের অস্ত্রপাতি, আহার্য জীবজন্তুর হাড়, পান-পাত্র ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এ থেকে মনে করা যায়, এদের ধারণা ছির কবরের মধ্যে মানুষ আবার প্রাণ পায়। আর সেই মানুষের জন্যে প য়োজন হয় এ সমস্ত জিনিসের। আত্মার বিশ্বাস ধর্মের অন্যতম গোড়ার কথা। তাই এ সব মানুষকে বলা যায় প্রথম ধার্মিক মানুষ।
মানুষের মধ্যে আত্মার ধারণা প্রথম কি ভাবে দেখা দেয় সে সম্বন্ধে অনেক মত প্রচলিত আছে। নৃবিজ্ঞানী টেলর-এর মতে : আদিম মানুষ লক্ষ্য করেছে, মানুষ মরে গেলে তার শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। তাই সে বাতাসকে ভেবেছে জীবন। বাতাসকে চোখে দেখা যায় না। তাকে অনুভব করা যায়। তাই সে আত্মাকে ভেবেছে অশরীরী একটা কিছু। শেষ নিঃশ্বাসকে ভেবেছে আত্মার দেহ থেকে চলে যাওয়াও। যে সব উপজাতির মানুষ আজো আদিম পর্যায়ে পড়ে আছে, যেমন অস্ট্রেলিয়ার আদিম উপজাতির লোকেরা, তাদের ভাষায় নিঃশ্বাস, প্রাণ ও আত্মা একই শব্দ দিয়ে বোঝানো হয়। আমরাও বাংলায়, চলিত কথায় মারা যাওয়াকে অনেক সময় ‘দম বেরিয়ে যাওয়া’ বলি। সংস্কৃত ‘আত্মান’ বা আত্মা জার্মান ‘এ্যাটমেন’ ও গ্রীক ‘এ্যাটমস’ শব্দের সাথে নিকট সম্বন্ধীয়। এ্যাটমেন ও গ্রীক এ্যাটমস শব্দের অর্থ শ্বাস নেওয়া ও শ্বাস ফেলা। ইংরাজি ঘোষ্ট (ghost) কথাটার আদি অর্থও শ্বাস।
মানুষ প্রথমে ঘুম আর মৃত্যুর সাথে তফাৎ করতে পারেনি। ভেবেছে মৃত্যু সুদীর্ঘ ঘুম মাত্র। মানুষ অজ্ঞান হয়ে গেলেও আবার ফিরে পায়। কি করে পায়? স্বপ্নে মানুষ তার মৃত পূর্বপুরুষকে দেখেছে-স্বপ্নের এই সব ছায়ামূর্তিরা কোথা থেকে আস্তে ? নিশ্চয়ই ভাই মৃত্যুই জীবনের শেষ কথা নয়। মৃত্যু একটি শোচনীয় দুর্ঘটনা। কিন্তু মৃত্যুর পরেও আত্মা থেকে যায়। স্বপ্নে দেখা ছায়ামূর্তিরা হল অশরীরী আত্মা। মানুষ যেহেতু প্রথমে মৃত্যুকে সুদীর্ঘ ঘুম মনে করেছে, তাই কবরে মৃত ব্যক্তির সাথে দিয়েছে বিভিন্ন জিনিস। ভেবেছে, এক সময়, কবে কেউ জানে না, আবার মৃতদেহে ফিরে আসবে আত্মা। মৃত ফিরে পাবে তার সজীবতা। তখন শিকার করে খাবার জন্যে আবার প্রয়োজন হবে পাথরের অস্ত্রপাতি।
গ্রীক কাব্যের যুগেও আত্মার দেহে ফিরে আসার অতি প্রাচীন ধারণার নিদর্শন মেলে, গ্রীক কাহিনীর হোরমোটিমোস (Hormotimos)। দেহ ছেড়ে চলে যেতেন। আবার ফিরে আসতেন। কিন্তু তার স্ত্রী একবার মৃত ভেবে তার দেহকে পুড়িয়ে ফেলেন। ফলে তাঁর আর দেহে ফিরে আসা সম্ভব হয় না। হোরমোটিমোস পরিণত হয় দেহহীন প্রেতআত্মায়। ঘুম আর মৃত্যুর মধ্যে তুলনা করেছেন বিভিন্ন কবি বিভিন্ন ভাবে। ঘুম, মৃত্যু, আত্মাÑধর্মচেতনার আদি কথা। মানুষ মৃত্যুকে ভয় পেয়েছে। আপন অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা, তাকে ব্যথিত করেছে, তাই সে ভেবেছে অমর আত্মার কথা। আর আত্মার ধারণাকে কেন্দ্র করে দেখা দিয়েছে জটিল ধর্মীয় ধ্যান ধারণা, ক্রিয়াকান্ড।
সব প্রাণীই মরে। মৃত্যুর গন্ডীঘেরা জীবনের বাস্তবতা। কিন্তু অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে ধমের উদ্ভব হয়নি। কারণ, মৃত্যু আর জীবনের অর্থ নিয়ে ভাববার মত মননশক্তি তাদের নেই। মৃত্যু সম্বন্ধে তারা সচেতন নয়। কিন্তু মানুষ সচেতন। তার এই চেতনাই তাকে ভাবিয়েছে। এই ভাবনা থেকে লন্ধ বিভিন্ন উত্তরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মানুষের প্রথম আত্মসচেতনতার ফল ধর্ম। ধর্মের কথা যে কেবল মাত্র আমাদের মত মানুষ ভেবেছে তা নয়। আমাদের থেকে স্বতন্ত্র দলের মানুষের মধ্যেই প্রথমিক ধর্মচিন্তার অভিব্যক্তি ঘটে। সে প্রায় হাজার পঞ্চাশেক বৎসর আগের কথা।
ধর্মের ইতিহাস, সুদীর্ঘ বৈচিত্রময়। একেদিনে তা গড়ে ওঠেনি। গড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে।
ধর্মের মাধ্যমে মানুষ পেয়েছে এক নির্ভরতা, মৃত্যুর করুণ বাস্তবতাকে ভুলে গিয়ে অনন্ত জীবনের ধারণা যা তাকে মৃত্যুর আপাতÑপরিপন্থি তাকে জয় করে জীবন সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।*
*লেখকের প্রকাশিতব্য ‘ধর্মের কথা’ পুস্তকের প্রথম অধ্যায় এই প্রবন্ধটি- সম্পাদক , সমকাল
প্রথম প্রকাশ: সমকাল, ৩য় বর্ষ, একাদশ সংখ্যা, আষাঢ়, ১৩৬৬।