নিকটতম ছাত্রের দৃষ্টিতে এবনে গোলাম সামাদঃ আশরাফ আহমেদ

গত দুই দিনে আমাদের বোটানি ডিপার্টমেন্টের দুইজন শিক্ষক চলে গেলেন অনন্তলোকে। প্রথমে চলে গেলেন প্রফেসর গাউসুজ্জামান। উনি গত হলেন ৮৭ বছর বয়সে। আজকে প্রয়াত হলেন প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদ। উনার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর ।দুজ্নের সংগেই আমার ব্যক্তিগত পরিচয ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। তার কারণ হচ্ছে প্রফেসর গাউছসূজামান সম্পর্কে আমার খালু। প্রফেসর এবনে গোলাম সামা্দের আমি ঘনিষ্ঠ ছায়াসঙ্গী ছিলাম দুই বছর ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ যখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি।

আমি আজকে কিছু কথা বলব প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদ সাহেব কে নিয়ে। তাঁকে আমার খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে।আমরা দুজনেই রাজশাহী শহরের বাসিন্দা। আমার পৈত্রিক বাড়ি কাজিহাটায় আর উনি থাকতেন উনার পৈতৃক বাড়ি ফায়ার ব্রিগেড মোড়ে নসিরন ভিলায়।নসিরন উনার মায়ের নাম ছিল। উনার বাবা রাজশাহি রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টার ছিলেন। সামাদ স্যারের জন্ম ১৯২৯ সালে। তেজগাঁও কৃষি ইনিস্টিটিউট থেকে কৃষিবিদ্যায় স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি বিদেশে পাড়ি জমান উদ্ভিদ রোগতত্ত্বের ওপরে গবেষণা করতে। ফ্রান্সে ৪ বছর গবেষণা করেন প্ল্যান্ট ভাইরাসের ওপরে। ১৯৬৩ সালে দেশে ফিরে ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। উনি উনি ফ্রান্সে থাকাকালীন একজন ফরাসি মহিলাকে বিয়ে করেন তাদের দুটি ফুটফুটে সন্তান জন্মগ্রহণ করে তাদেরকে আমি ১৯৭১ এর আগে দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় সামাদ স্যার ভারতে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অনেক ভাষণ দিয়েছেন বিভিন্ন সেমিনারে।এক বিশাল বড় অবদান ছিল সেই সময়ে। মুক্তিযুদ্ধের পরে দেশে ফিরে আসার পরে আমার সঙ্গে উনার প্রথম পরিচয় হয় ।এর আগে দূর থেকে দেখেছি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে কিন্তু কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। কিভাবে পরিচয় হয় কিভাবে কাছে গেলাম সেটা আমার মনে নাই।অনেক আগের কথা। এরপরে যে কথা আগেই বলেছি। যে আমি ওনার খুব কাছের মানুষ হয়ে গেলাম। আমার মনে হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার মত এত ঘনিস্ট কেউ ছিলনা ।উনার ফ্রান্স থেকে আনা Citron গাড়িটিতেই বিশ্ববিদ্যালয় আসা-যাওয়া করেছি। খুব কাছ থেকে এই বিস্ময়কর মানুষটিকে আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। এরকম গুণী মানুষকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে আমি ব্যাক্তিগতভাবে সমৃদ্ধ হয়েছি।

আমার মনে আছে ১৯৭২-১৯৭৩ সালের দিকে রাজশাহীতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখবার জন্য একটা মুর‍্যাল করা হয়। যেটি করেছিলেন খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী মুর্তজা বশীর ।একসময় মুর্তজা বশীর, বাংলার সেই সময়ের অধ্যাপক শেখ আতাউর রহমান, বাংলাদেশ বেতারের রেডিও নিউজ এর প্রধান হাসান মীর এবং আমি রাজশাহী এর আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় আমরা পোড়ামাটির কাজ দেখতে গিয়েছি সামাদ স্যারের গাড়িতে এবং এইসব আলোকিত মানুষ সবার সঙ্গে থেকে আমিও সমৃদ্ধ হয়েছিলাম। আমি মাস্টার্স শেষ করে ১৯৭৪ সালের মে মাসের শেষে ঢাকায় চাকরির উদ্দেশ্যেসেসে। উনি আমাকে শুভকামনা জানিয়ে উনার পরিচিত বিভিন্ন জনের কাছে চিঠি লিখেছিলেন যেন উনারা আমাকে চাকরি পেতে সাহায্য করেণ। উনাদের মাধ্যমে আমার চাকরি হয়নি। যাই হোক আমি ওনার কাছে এ কারণে কৃতজ্ঞ। উনার বন্ধুদের সঙ্গে এখনো আমার যোগাযোগ আছে। আসার আগে শেষ কথা বলেছিলেন যে “ঢাকায় যদি চাকরি না পাও তাহলে ফেরার সময় লালসালু কিনে নিয়ে এসো কয়েক গজ”। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন ? উনি বলেছিলেন “যে মাজারের ব্যবসা খুব চালু ব্যবসা। রাস্তার পাশে স্বপ্ন দেখেছো বলে কোন এক জাগ্রত পীরের মাজারের বানিয়ে ফেলবে এবং এতে তোমার যে রোজকার হবে তাতে তোমার চাকরি করতে হবে না।”

খ্যাতিমান লেখিকা এবং রাজনীতিবিদ দৌলতুননেসা স্যারের বড়বোন ছিলেন। একসময় গাইবান্ধায় যাচ্ছি শুনে ওনার জন্য আমার হাতে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিটি দিয়েছিলাম এবং উনার বোন জিজ্ঞেস করলেন যে পুটু (স্যারের ডাক নাম) কেমন আছে? ওর সঙ্গে আমার শেষ যোগাযোগ হয়েছিল সে যখন একটা মেমকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। সেই সময়টি হচ্ছে ১৯৬২ সাল। এরপর নাকি স্যরের সংগে নাকি আর যোগাযোগ হয়নি ।স্যারের পরিবার সম্বন্ধে যতটুকু জানি সবাই খুব প্রতিভাবান ছিলেন হয়তো একটু বেশি প্রতিভাবান ছিলেন। সে কারণে উনার চিন্তাভাবনাগুলো এলোমেলো ছিল। উনি উনার বাবার নরকঙ্কাল উনার শোবার ঘরে রাখতে চ্যেছিলেন যেন সবসময় উনি কথা বলতে পারেণ। দুঃখ করে বলেছিলেন যে লোকজন রাজী হয়নি। উনি একদিন আমাকে বলেছিলেন যে উনি মারা গেলে উনার শবদেহ যেন প্রমত্ত পদ্মায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আমার সব সময় মনে হয়েছে উনি এক রহস্যময় পুরুষ। জোরালো তর্ক করতে পারতেন যে কোন বিষয়ের উপরে পক্ষে ও বিপক্ষে। কোনটি ঠিক উনার মনের কথা সেটি অনেক সময় ধাঁধার মত কি জিনিসের উপর পক্ষে জোরালো কথা বলতে পারতেন । আমাদের শিক্ষক হিসেবে যেগুলি ক্লাশে পড়াতেন মনের মধ্যে গেঁথে যেত।

আমি ১৯৭৬ সালে বিয়ে করতে রাজশাহী আসি। আমার স্ত্রী আপনারা সবাই জানেন এই বিভাগেরই ছাত্রী, আমার সহপাঠিনী শামসুন্নাহার ছানা। উনি আমাদের বিয়েতে খুব সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছেন। ছাত্র অবস্থায় আমাদের দুজনের প্রনয়ের কথা জানতেন এবং দুজনকে খুব পছন্দ করতেন। কোন এক কারণে উনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর ৪৫ বছর চলে গেছে ভাবলাম স্যার বৃদ্ধ হয়েছেন। দেখা করা দরকার। আমি ও ছানার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর রফিঊল ইসলাম আমাদের দুজনকে উনার সঙ্গে দেখা করবার জন্য ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে নিয়ে যান। আমাদের দেখেই চিনতে পারলেন উনি বললেন “কেমন আছো ? তুমি কি চা বাগানে এখনও আছো? ছানা কে জিজ্ঞাসা করলেন তোমার ছোটো বোন মনা কেমন আছে? আমরা উনার স্মৃতিশক্তির কথা ভে্বে বিস্মিত হলাম। সেই সময় উনি বিছানায় শয্যাশায়ী মস্তিষ্ক কিন্তু সচল। উনি ধর্মের বিষয়ে অনেক কথা বললেন। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কথা বললেন। এরপরে গত দুই বছর আমার রাজশাহী যাওয়া হয়নি এই মহামারীর কারণে। বার বার ভেবেছি যে কোন সময় উনার পরপারে যাবার ডাক আসবে হয়তো আর দেখা হবে না। তাই হোল। স্যার অনন্তলোকে যাত্রা করলেন। রেখে গেলেন অনেক স্মৃতি। আমরা যারা ছাত্র ছাত্রী সবাই উনাকে স্মরণ করব শ্রদ্ধাভরে। প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদ বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল আমা্দের হৃদয়ে , অনুভবে। শুভরাত্রি।

(আশরাফ আহমেদ, উদ্ভিদতত্ত্ব বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ