পদ্মভূষণ সমাচার

ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে ‘পদ্মভূষণ’ পদক গ্রহণ করছেন ড. আনিসুজ্জামান। ছবি: বাসস

ড. আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা অধ্যাপক ও গবেষক। তার সাথে আমার কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তবে তিনি একবার পাকিস্তান আমলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার বক্তৃতাটি আমি মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলাম। ভালো লেগেছিল তার বক্তব্য পেশের ধরন। যত দূর মনে পড়ছে, তার বক্তৃতার বিষয় ছিল মুসলমানি বাংলা, যার উদ্ভব ঘটেছিল সাধারণ বাংলা ভাষার সাথে অজস্র ফারসি এবং ফারসির মাধ্যমে পাওয়া আরবি শব্দের মিশ্রণে। এই ভাষায় গড়ে উঠেছিল একটি লিখিত সাহিত্য। বাংলার মুসলিম সমাজে এক সময় চলত এই বাংলা ভাষা। খ্রিষ্টান মিশনারিরা বাংলাভাষী মুসলমানের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য এই মুসলমানি বাংলায় বাইবেলের অনুবাদ করেন ও তা ছাপিয়ে প্রকাশ করেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে। একজন ব্রিটিশ ধর্মযাজক রেভারেন্ড গোল্ডস্যাক সঙ্কলন করেন মুসলমানি বাংলা ইংরেজির অভিধান। মুসলমানি বাংলায় কেবল যে মুসলমানেরাই লিখেছেন তা নয়, দু-একজন হিন্দু সাহিত্যিকও চেষ্টা করেছেন এ ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতে। ভাষাতাত্ত্বিক কিছু নমুনা নেয়া যেতে পারে :

এমনি ছুরতে তারে দিল বারিতালা।
চন্দ্রকে জিনিয়া তার ছুরত উজালা॥
কলেমা পড়িনু মোরা জাত মজাইয়া।
আকবত পাব বলি ভরসা করিয়া॥
তাহাতে করিলে তুমি সবারে নৈরাশ।
আর না যাইব মোরা মা বাপের পাস॥

ড. আনিসুজ্জামানের সেদিনের বক্তৃতা শুনে আমার মনে হয়েছিল বাংলাভাষী মুসলমান যদি মুসলমানি বাংলার চর্চা না ছেড়ে এই ভাষাতেই সাহিত্যচর্চা করতেন, তবে সেটা হতো তাদের জন্য শ্রেয়। আমরা জানি, উর্দু একটা পৃথক ভাষা নয়। পশ্চিমী হিন্দি ভাষার সাথে তার ব্যাকরণগত কোনো পার্থক্য নেই। উর্দু ভাষা সৃষ্টি হতে পেরেছে দিল্লির কাছে প্রচলিত পশ্চিমী হিন্দির সাথে প্রচুর ফারসি শব্দ ও ফারসি ভাষার মাধ্যমে আগত শব্দের মিশ্রণের ফলে। উর্দুকে বলা যেতে পারে মুসলমানি হিন্দি। কিন্তু সেটা আমরা বলি না। কেবল বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই আমরা বলি মুসলমানি বাংলা। হিন্দি আর উর্দুর মধ্যে আরেক পার্থক্য হলো হিন্দি লেখা হয় নাগরি অক্ষরে। কিন্তু উর্দু লেখা হয় ফারসি-আরবি হরফে। যাকে বলা হয় মুসলমানি বাংলা তা কিন্তু লেখা হতো বাংলা অক্ষরে, ফারসি-আরবি অক্ষরে নয়। তবে বইগুলো ছাপা হতো, এখন বাংলা বইয়ের যা শেষ পাতা, তা হতো মুসলমানি বাংলার প্রথম পাতা।

আমার মনে পড়ছে একটা ফরাসি চুটকি গল্পের কথা। এক ফরাসি ভদ্রলোক একটা বিদেশী গল্পের বই কেনেন, যার ভাষা ও লিপি ছিল তার কাছে অজ্ঞাত। কিন্তু বইটির মার্জিনে দেয়া ছিল ফরাসি ভাষায় অনুবাদ। তিনি ফরাসি ভাষায় বইটি পড়তে শুরু করেন। ভাবেন পরে শিখবেন যে ভাষায় বইটি লেখা হয়েছে সেই ভাষাটিকে। কিন্তু তার খুব অদ্ভুত মনে হলো ফরাসিতে গল্পটি পড়ে। কারণ, তিনি দেখলেন গল্পের নায়ক মরে গেল, কিন্তু পরে সে ভালোবাসল একটি মেয়েকে। তবে মেয়েটির সাথে তার বিয়ে হলো না। কারণ, মেয়েটি ভালোবাসল আরেকটি ছেলেকে। ফরাসি ভদ্রলোক তার এক বহুভাষাবিদ বন্ধুর কাছে গেলেন। এবং তাকে বইটি দেখিয়ে বললেন, এ কেমন ভাষা, যেখানে গল্পের নায়ক মরে যাওয়ার পর প্রেমে পড়তে পারে। তার বন্ধু তাকে বললেন, বইটি আরবি ভাষায় লেখা। একে ফরাসি ভাষায় লেখা বইয়ের মতো না পড়ে পড়তে হবে উল্টো দিক থেকে। তাহলে আর গল্পটি বুঝতে অসুবিধা হবে না। আরবি একটি উন্নত ভাষা। এ ভাষায় লেখা হয়েছে অনেক গল্পকাহিনী। মুসলমানি বাংলা পড়তে হতো উল্টো দিক থেকে। যদিও আমরা বাংলা লেখি বাম থেকে ডান দিকে, আরবি-ফারসির মতো ডান থেকে বাম দিকে নয়।

ড. আনিসুজ্জামানের বক্তৃতা আমি শুনেছিলাম মনোযোগ দিয়ে। কারণ, সে সময় পাকিস্তানের শাসকবর্গ বলছিলেন, আমরা যদি ফারসি-আরবি শব্দবহুল বাংলা লেখি, তবে সেটা শিখতে ও বুঝতে উর্দুভাষাভাষীদের অসুবিধা হবে না। বাড়বে পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্য। মনে হয়েছিল, ড. আনিসুজ্জামান চাচ্ছেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক ঐক্য বাড়াতে। আর তাই তিনি বেছে নিয়েছেন মুসলমানি বাংলাকে তার গবেষণা ও বক্তৃতার বিষয় হিসেবে। কিন্তু ড. আনিসুজ্জামান এখন তার চিন্তা-চেতনায় একেবারেই বদলে গেছেন। তিনি এখন এ দেশে চাচ্ছেন প্রমিত বাংলার প্রতিষ্ঠা। আগে যা তিনি কখনোই চাননি। প্রমিত বাংলা বলতে ঠিক কোন বাংলাকে বুঝতে হবে, সেটা আমাদের কাছে মোটেও পরিষ্কার নয়। যত দূর জানি, ড. আনিসুজ্জামান এই বাংলার লোক নন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের চব্বিশপরগনা জেলা থেকে। এখন জেলাটিকে সম্ভবত উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশপরগনায় বিভক্ত করা হয়েছে। আমি ঠিক জানি না। সম্ভবত ড. আনিসুজ্জামান এসেছিলেন উত্তর চব্বিশপরগনা থেকে। ব্রিটিশ শাসনামলে ভাষাতাত্ত্বিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এসেছিলেন সে সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করতে। তিনিও ছিলেন চব্বিশপরগনা জেলারই লোক। কিন্তু তিনি কখনো প্রমিত বাংলা প্রচলনের আন্দোলন করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ সময় চেয়েছে সাধু বাংলা গদ্যকে বিশেষভাবে ধরে রাখতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন চাকরি করতেন মোহিতলাল মজুমদার। তিনি তখনকার নদীয়া জেলার লোক হয়েও চাননি চলতি বাংলার প্রচলন।

অর্থাৎ ভাষা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনামলে সৃষ্টি হতে পেরেছিল বেশ কিছুটা দূরত্ব। সাধু বাংলা ছিল সারা বাংলার বইয়ের ভাষা। সেটা ছিল সবার কাছেই অনেক সহজ ও আয়ত্তগম্য। বাংলা ভাষার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করলে দেখি, পর্তুগিজ খ্রিষ্টান মিশনারি ম্যানুয়েল দ্য আস্সুম্প্সাওঁ খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য বই লেখেন Crepar Xaxtrer Orthbhed। বইটি ১৭৪৩ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহর থেকে প্রকাশিত হয়। বইটিতে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু বইটিতে যে বাংলা ব্যবহার করা হয়েছে তাকে মোটামুটিভাবে বলা চলে সাধু বাংলা গদ্য। ম্যানুয়েল দ্য এই ভাষা শেখেন ঢাকার ভাওয়াল অঞ্চল থেকে। অর্থাৎ ধরে নেয়া যায়, সে আমলে ঢাকা ও তার সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে সাধু বাংলা গদ্যের প্রচলন ছিল। ম্যানুয়েল দ্য বাংলা ব্যাকরণ ও বাংলা পর্তুগিজ শব্দকোষ প্রণয়ন করেছিলেন।

সাধারণভাবে মনে করা হয়, বাংলা গদ্যের উদ্ভব হয়েছে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। কিন্তু এখন অনেকেই এই প্রচলিত মতকে আর মানতে চাচ্ছেন না। বাংলা গদ্যের একটা চল ইংরেজ আসার আগেই উদ্ভূত হতে পেরেছিল। আর পূর্ববঙ্গে ছিল তার বিশেষ অধিষ্ঠান। কিন্তু এখন এ দেশে প্রমিত বাংলার প্রচলন-চেষ্টা চলছে। হতে পারে এর পেছনে আছে একটা বিশেষ রাজনৈতিক পরিকল্পনা।

ড. আনিসুজ্জামানকে ভারত সরকার পদ্মভূষণ খেতাব দিলো। কেন তাকে তারা পদ্মভূষণ খেতাব দেয়ার উপযুক্ত ভেবেছেন আমরা তা জানি না। তবে পদ্মভূষণ খেতাব দেয়ার আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বলতে শোনা গেল, ড. আনিসুজ্জামান কেবলই একজন বাংলা ভাষার গবেষকই নন; তিনি একজন বিশিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি। জানি না, ধর্মনিরপেতা নিয়ে ভারত এত বড়াই করছে কেন। মাত্র কিছু দিন আগেই ভারতে দেখা গেল উত্তর প্রদেশের মুজাফফরপুরে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হতে। যার ফলে প্রায় ৪০ হাজার মুসলমানকে রাতারাতি হতে হয়েছে উদ্বাস্তু। ভারতে বাস্তবে কতটুকু ধর্মনিরপেতা বিরাজ করছে আমরা তা জানি না। কিন্তু আমাদের দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তি ভারতের কাছ থেকে পদ্মভূষণ খেতাব নিতে কিছুমাত্র অস্বস্তিবোধ করলেন না। যেটা আমাদের মতো অনেক সাধারণ ব্যক্তিকে করছে বিস্মিত।

ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলতেন, ভারতের চারটি মূলনীতি আছে। এগুলো হলো, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, উদার গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেতা ও সমাজতন্ত্র। ভারতে এখন আর কেউ সমাজতন্ত্রের কথা আগের মতো বলছে না। চাচ্ছে না সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা। ভারতে উদার গণতন্ত্র আছে। আর সেটা প্রশংসা পাওয়ারই যোগ্য। শ্রীমতী গান্ধী বলতেন, ভারতের ধর্মনিরপেতা কোনো ধর্মের বিরোধিতা করা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ভারতে বোঝায়, বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীর মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষা। কিন্তু সেটা বাস্তবে হতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিয়েও সৃষ্টি হতে পারছে কিছু সংশয়। কারণ, ভারতে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে বাড়তে দেখা যাচ্ছে মনোমালিন্য।

ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তার সাথে আমরা চাই সম্পর্কের উন্নয়ন। ভারত যদি আমাদের জ্ঞানীগুণীজনদের সম্মাননা প্রদান করেন, তাকে আমরা দোষবহ বলে মনে করি না। কিন্তু এভাবে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়ে বাংলাদেশের কাউকে সোনার পদক পরানো আমাদের অনেকের কাছেই মনে হতে পারছে না খুব সমীচীন হচ্ছে বলে। ভারতের এক নেতা ও এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে পাকিস্তান দিয়েছিল পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাব। কিন্তু যত দূর মনে পড়ছে, ভারত সরকার মোরারজি দেশাইকে পাকিস্তানের কাছ থেকে কোনো খেতাব নিতে বিরত রেখেছিলেন। আমরা ভারতকে আমাদের দেশের কাউকে খেতাব দিতে বাধার সৃষ্টি করতে চাই না। তবে খেতাব নিতে যেয়ে আমাদের নিজেদেরই ভাবা উচিত এই খেতাবের আসল মূল্য কতটা।

(৭ এপ্রিল ২০১৪, সোমবার, দৈনিক নয়াদিগন্ত)

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ