একসময় পদ্মা সেতু বলতে বুঝিয়েছে সাড়াপুলকে (হার্ডিঞ্জ ব্রিজ)। সাড়াপুল তৈরি হয়েছিল ১৯১৫ সালে। এতে কেবলই আছে রেলপথ। নেই কোনো মোটর বা অন্য যান চলাচলের রাস্তা। বর্তমানে পদ্মার ওপর আর একটি সেতু নির্মাণের চেষ্টা চলেছে। যাতে থাকবে রেল এবং অন্যান্য যাবাহনের চলাচলের ব্যবস্থা। এটি হবে বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় সেতু। এর দৈর্ঘ্য হবে ৬ হাজার ১৫০ মিটার আর প্রস্থ হবে ২১ দশমিক ১ মিটার। সেতুটি তৈরি হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে। আর শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালের মধ্যে। কিন্তু সেতুটি তৈরি শুরু করা যায়নি। কারণ সেতু তৈরির জন্য অর্থ জোগান দেয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এখন আর পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ লগ্নি করতে চাচ্ছে না। বলছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে হতে পারে যথেষ্ট দুর্নীতি। আর এর ফলে হতে পারে বিশ্বব্যাংকের দেয়া অর্থের একটা বড় অংশের বিরাট অপচয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ তাই থেমে আছে।
পত্রিকার খবরে জানা গিয়েছিল, যদি চীনকে প্রস্তাব দেয়া যায়, তবে চীন পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ লগ্নি করতে রাজি হতে পারে। কিন্তু বর্তমান সরকার এ বিষয়ে চীনকে কোনো প্রস্তাব দেয়নি। সে মালয়েশিয়ার কতগুলো কোম্পানির সাথে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে। মালয়েশিয়া কোম্পানিগুলোর কনসোর্টিয়াম লগ্নি করবে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ, যা সুদসহ শোধ হবে সেতুর ওপর দিয়ে যাতায়াতকারী যানবাহন থেকে টোল আদায় করে। মালয়েশিয়ার কোম্পানির কনসোর্টিয়াম বলেনি, তাদের কাছ থেকে অর্থ ঋণ নেয়ার জন্য শতকরা কী হারে তাদের সুদ দিতে হবে। বিশ্বব্যাংক খুব কম সুদে অর্থ লগ্নি করে। মালয়েশিয়ার কোম্পানিগুলোকে দেয় সুদের হার অত কম হতে পারবে বলে মনে হয় না। কত দিনে সুদে-আসলে টোলের অর্থে তাদের লগ্নির অর্থ শোধ করা যাবে, সেটা থাকছে অনিশ্চিত।
মালয়েশিয়ার অর্থনীতি বাংলাদেশের তুলনায় অনেক অগ্রসর। কিন্তু তা সত্ত্বেও মালয়েশীয় কোম্পানির কনসোর্টিয়াম পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে থাকছে গুরুতর প্রশ্ন। মালয়েশিয়া প্রযুক্তির দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক অগ্রসর। কিন্তু তার প্রযুক্তি পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য উপযুক্ত হবে কি না তা নিয়ে জাগছে সংশয়। আমরা বঙ্গবন্ধু সেতু (যমুনা সেতু) নির্মণের জন্য নির্ভর করেছিলাম দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানির ওপর। কিন্তু এই বিখ্যাত সেতুতে ইতোমধ্যেই ফাটল দেখা দিতে শুরু করেছে, যা হয়ে উঠেছে বিশেষ চিন্তার কারণ। মালয়েশিয়া কোম্পানির ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে ঘটতে পারে একই রকম ঘটনা।
পদ্মা নদীর ওপর ভারত ১৯৭৪ সালে নির্মাণ করেছে ফারাক্কা ব্যারাজ, যা বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এর ফলে পদ্মা নদীর স্রোতের গতিবেগ অনেক মন্থর হয়ে পড়েছে। রবি মওসুমে পদ্মায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে আগের তুলনায় অনেক কম। পদ্মা নদী থেকে যেসব শাখা নদীর উদ্ভব হয়েছে, শীতকালে তাতে থাকছে না পানি। তারা শুকিয়ে যাওয়ার পথে। এখন আমরা পদ্মায় নির্মাণ করতে যাচ্ছি নতুন করে একটি পদ্মা সেতু। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নদীর ওপর তৈরী সেতু আসলে শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে একটা ছোটখাটো বাঁধ বা ব্যারাজ। কারণ সেতুর পিলারে নদীর পানি বাধাগ্রস্ত হয়। আর তার ফলে নদীপ্রবাহের গতিবেগ আর আগের মতো থাকতে পারে না। যেহেতু নদীর প্রবাহ মন্থর হয়ে পড়ে, তাই নদীবে জমতে থাকে নদীবাহিত পলিমাটি। নদীতে সৃষ্টি হতে থাকে চর। নদী হারায় তার আগের নাব্যতা।
ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে পদ্মা হারিয়েছে তার সাবেক নাব্যতা। নতুন পদ্মা সেতু নির্মাণে এই নাব্যতার মাত্রা যে আরো কমে যাবে সেটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। নদী ছিল এবং এখনো হয়ে আছে আমাদের দেশে যোগাযোগের অন্যতম উপায়। নৌপথে চলে নৌকাযোগে এখনো আমাদের দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য। নৌপথে ব্যবসায়-বাণিজ্য কমলে যে আমাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে সেটা সহজেই অনুমান করা চলে। সেতু নির্মাণ না করেও করা চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি। নদীর তল দিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে একটা দেশের পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন এখন আর কিছু কঠিন কাজ নয়। কিন্তু নদীর নিচে সুড়ঙ্গ নির্মাণ করে আমরা আমাদের যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে চাচ্ছি না। আমরা আমাদের দেশে যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি করতে চাচ্ছি নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করে। আমাদের এই নীতি হয়ে উঠতে পারে দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষতির কারণ।
আমাদের দেশে ইতোমধ্যে অপরিকল্পিতভাবে পথঘাট অনেক তৈরি করা হয়েছে। এসব পথে পানি নিষ্কাশনের জন্য যেসব সাঁকো নির্মাণ করা হয়েছে, তা দিয়ে পানি ঠিকমতো প্রবাহিত হয়ে যেতে পারছে না। ফলে দেশের অনেক অঞ্চলে সৃষ্টি হতে পারছে ক্ষতিকর পানিমগ্নতা। হচ্ছে না আগের মতো ফসল। নদী কেবল একটা দেশে পানি বয়ে আনে না, নদী একটি দেশের পানি নিকাশি ব্যবস্থা। আমাদের দেশে আগে বন্যাসমস্যা ছিল। এখন পানি নিষ্কাশন হয়ে উঠছে অনেক অঞ্চলে একটা বড় রকমের সমস্যা। আর এ সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার একটা বড় কারণ, নদী দিয়ে আর আগের মতো পানি প্রবাহিত হয়ে যেতে না পারা।
আমরা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এমন অনেক কিছু করছি, যা প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফলে সৃষ্টি হতে পারছে অনেক অবাঞ্ছিত সমস্যা। যার একটি দৃষ্টান্ত হলো পানিমগ্নতার মাত্রা বেড়ে যাওয়া। মানুষ জ্ঞানের অভাবে একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আর একটা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। আমরা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গভীর নলকূপের সাহায্যে সেচব্যবস্থা করেছি। মাটির মধ্যে প্রতি বছর বৃষ্টির পানি জমা হয়। নলকূপের সাহায্যে অথবা কুয়া খুঁড়ে আমরা যে পানি পাই, তা হলো মাটির মধ্যে সঞ্চিত বৃষ্টির পানি। আমরা গভীর নলকূপের সাহায্যে মাটির নিচে থেকে যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করছি, বৃষ্টির পানি ঠিক সেই হারে জমতে পারছে না। ফলে মাটির মধ্যে ঘটছে পানির অভাব। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। গভীর নলকূপে দেখা যাচ্ছে পানির অভাব। ফলে ব্যাহত হচ্ছে সেচব্যবস্থা। গভীর নলকূপের সাহায্যে পানি উঠানোর ফলে খালবিল, নদীনালার পানি চলে যাচ্ছে মাটির মধ্যে। খালবিল, নদীনালা শুকিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু নদীনালা,খালবিল শুকিয়ে যাচ্ছে, তাই আর আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না মাছ। মাছের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। মাছ আমাদের প্রাণিজ প্রোটিনের বিশেষ উৎস। মাছের অভাব সৃষ্টি করছে আমাদের পুষ্টির সমস্যা। এটা একটা বড় সমস্যায় হয়ে উঠেছে। খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে আমরা যেন সৃষ্টি করছি ভিন্নভাবে খাদ্য সমস্যা। মাটির নিচের পানি তুলে নেয়ার ফলে অনেক ছোট ছোট নদী হতে চাচ্ছে বিলুপ্ত। কিন্তু আমাদের দেশে নদী বাঁচানোর জন্য কোনো নীতিমালা এখনো গড়ে তুলতে পারিনি।
আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি। কিন্তু ভাবছি না এর প্রভাবে পদ্মা নদী কী রূপ নিতে পারে; এর ফলে পদ্মার শাখা নদীগুলোর পানি প্রবাহ হতে পারে কী পরিমাণে তিগ্রস্ত। চীন যদি তিব্বতের সাঙ্গু নদীর পানি নিতে শুরু করে, তবে ভারতের আসামে ঘটবে ব্রহ্মপুত্র নদে পানির অভাব। আর আমাদের যমুনা নদীতেও আসবে না আগের মতো পানি। যমুনা নদী এসে পড়েছে পদ্মায়। যমুনা নদীতে পানি কমলে পানি কমবে পদ্মাতেও। ভারত থেকে এসেছে বরাক নদী। বরাক নদী বাংলাদেশে দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। একটি শাখা হলো সুরমা আর একটি শাখা হলো কুশিয়ারা। কুশিয়ারা আর সুরমা পরে আবার মিলিত হয়েছে। এই মিলিত স্রোত হলো মেঘনা নদীর পানির মূল উৎস। ভারত যদি টিপাইমুখ বাঁধ দেয়, তবে বরাক নদীতে আসবে না আর আগের মতো পানি। মেঘনা নদীতে ঘটবে পানির অভাব। মেঘনা এসে মিলিত হয়েছে পদ্মার সাথে। মেঘনায় পানি না আসায় প্রভাব পড়বে পদ্মার পানিপ্রবাহের ওপর। অর্থাৎ আমাদের মূল নদী ব্যবস্থাই হয়ে উঠতে যাচ্ছে যথেষ্ট অনিশ্চিত। আমরা ১৯৭১ সালে ঘটা করে বলেছিলাম, পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা। কিন্তু এই ঠিকানাকে আর আগের মতো সুনিশ্চি বলা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আমরা যদি আমাদের নদীর ওপর একের পর এক সেতু গড়তে যাই, তবে আমাদের নদীব্যবস্থার হতে পারে সমূহ ক্ষতি।
বিএনপি এখন ক্ষমতায় নেই। সে পদ্মা সেতু নিয়ে করছে আওয়ামী লীগের সমালোচনা। কিন্তু নদী সম্পর্কে বিএনপির সুস্পষ্ট কোনো নীতি আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে বলছে না, সেতুর বদলে নদীর নিচে সুড়ঙ্গ কেটে দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে। নদী বিষয়ে আমরা বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু নদী বিষয়ে দেশের দু’টি বড় রাজনৈতিক দলেরই সুচিন্তিত নদীনীতি আছে বলে মনে হচ্ছে না।
২০১২ সালে প্রকাশিত