পরাশক্তি হবার বাসনায় ভারত

Himanshu Bhatt/NurPhoto via Getty Images

ইংরাজিতে যাকে বলে “রকেট” (rocket), বাংলায় তাকেই বলে “হাউই”। “হাউই” শব্দটা বাংলা ভাষার নয়। এসেছে ফারসী “হাবাঈ” শব্দ থেকে। দক্ষিণ ভারতে মহিসুরে (কর্ণাটক) ১৭৮০ থেকে ১৭৮৪ খৃষ্টাব্দ ধরে চলেছিল হায়দার আলী ও তার পুত্র টিপু সুলতানের সঙ্গে বৃটিশ ভারতের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হায়দার আলী ও তার পুত্র টিপু সালতান বাঁশের চোঙ্গায় বারুদ পুরে হাউই বানিয়ে তা ছুঁড়ে ছিলেন বৃটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে। সেসময় এটা দেখে বৃটিশ বাহিনীও শিখে ফেলে হাউই দিয়ে যুদ্ধ করবার কৌশল। বৃটিশ সেনাপতি স্যার উইলিয়াম কনগ্রেভ (Sir Willium Comgrave) ১৮০৬ সালে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে প্রথমে ফ্রান্সে এবং পরে ১৮০৭ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে যুদ্ধ করেন নেপোলিয়নের সঙ্গে। কিন্তু ইউরোপে কামানের গোলার উন্নতির ফলে যুদ্ধে রকেটের প্রয়োজন কার্যত স্থগিত হয়ে যায়।

১৯৪৫ সালে জার্মানরা বানান, যাকে ইংরেজিতে বলে V2 রকেট। এর সাহায্যে জার্মানিরা লন্ডনের উপর স্লাইকোনাইট দিয়ে তৈরি বোমা নিক্ষেপ করে। যা ছিল তখনকার দিনে সবচেয়ে শক্তিশালী রাসায়নিক বিস্ফোরক। V2 রকেট আর আগের দিনের রকেট মোটেও এক শ্রেণীর নয়। এই রকেট ইস্পাতের তৈরি। এর অগ্রভাগে থাকে বিস্ফোরক। বিস্ফোরক যে কক্ষে থাকে, তার পরে থাকে আরও তিনটি কক্ষ। যার একটিতে থাকে তরল অক্সিজেন। আর একটিতে থাকে অ্যামায়েল অ্যালকোহল। আর একটিতে এদের উভয়কে মিশ্রিত করে ইলেক্ট্রিক স্পার্ক এর সাহায্যে ধরানো হয় আগুন। এই মিশ্রণে আগুন ধরালে উৎপন্ন হয় প্রচুর পরিমাণে গ্যাস। যা রকেটের পশ্চাতের ছিদ্রপথ দিয়ে প্রবল বেগে নির্গত হতে থাকে। আর এর প্রতিক্রিয়ায় রকেট আকাশে উঠতে পারে আর পেতে পারে বিপুল গতিবেগ। আগের দিনের রকেট বায়ুমন্ডল ছাড়া চলতে পারে না। কারণ বায়ুমন্ডলের অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় তার মধ্যের বারুদকে পোড়াবার জন্য। কিন্তু বর্তমানে আমরা যাকে সাধারণভাবে বলি রকেট, তার মধ্যে দেওয়া থাকে এমন জ্বালানী, যা পুড়তে বাইরের বায়ুমন্ডলের অক্সিজেন লাগে না। V2 রকেট খুলে দেয় বিভিন্ন ধরণের মহাকাশযান নির্মাণের পথ। মানুষ এখন চাঁদে যেয়ে ফিরে আসতে পারছে V2 রকেট আবিষ্কার হতে পারবার জন্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন বেশ কিছু সংখ্যক V2 রকেট নির্মাণ কর্মীকে জার্মান থেকে বন্দী করে নিয়ে যায় সেদেশে। সোভিয়েত তার নিজেদের ইঞ্জিনিয়ার, নিজেদের এবং এসব জার্মান কর্মীরা মিলে বানাতে সক্ষম হয় খুবই উন্নতমানের রকেট। এই রকেটের সাহায্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইঞ্জিনিয়াররা প্রথম ১৯৫৭ খৃষ্টাব্দের অক্টোবরে আকাশে উৎক্ষেপন করতে সক্ষম হন কৃত্রিম উপগ্রহ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ রকেটের সাহায্যে এখন কৃত্রিম উপগ্রহ আকাশে স্থাপন করছে। যা পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। কৃত্রিম উপগ্রহ মানুষের বহু কাজে লাগছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় রকেট নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে পিছিয়ে পড়েছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সে তদানিন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নকে পশ্চাতে ফেলে এগিয়ে যেতে পারে।

জার্মান ইঞ্জিনিয়ার ফন বর্ণ (Von Braun, 1913-1977), যিনি ১৯৪৫ সালে জার্মানিতে V2 রকেট নির্মাণ করেছিলেন, যুদ্ধ শেষে তিনি জার্মানী ছেড়ে চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে তিনি তৈরি করেন স্যাটার্ণ রকেট, যার সাহায্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাঁদে মানুষ পাঠিয়ে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে পারে ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এপর্যন্ত ছয়বার চাঁদে মানুষ পাঠিয়ে তাঁদের ফেরত আনতে পেরেছে। মনে করা হয়, তার লক্ষ্য ছিল চাঁদে পরমাণু অস্ত্রের ঘাঁটি গড়া এবং এমন যন্ত্রপাতি স্থাপন করা, যার সাহায্যে পৃথিবীর সব দেশের উপর নজর রাখা যাবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও তা করেনি। যদিও সেটা করতে পারতো।

ভারতের রকেট-গবেষণা শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায়। ভারতের নির্মিত প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ “আর্যভট্ট” রাশিয়া থেকে উৎক্ষেপন করা হয়। আর্যভট্ট ছোঁড়া হয় ১৯৭৫ সালের ১৯ এপ্রিল। ১৯৭৯ সালের ৭ জুন ভারতের তৈরি দ্বিতীয় কৃত্রিম উপগ্রহ “ভাষ্কর-১” ছোঁড়া হয় রাশিয়ায় অবস্থিত আর একটি উৎক্ষেপন কেন্দ্র থেকে রুশ রকেটের সহায়তায়।

রাকেশ শর্মা নামে ভারতের বিমান বাহিনীর জনৈক স্কোয়াড্রন লিডার ১৯৮৭ সালের ৩০ এপ্রিল সোভিয়েত নির্মিত একটি মহাকাশ যানে চড়ে মহাশূণ্যে অবস্থান করেন সাত দিন। তাঁর সহযাত্রী ছিলেন আরো দুজন। তাঁরা ছিলেন রাশিয়ান অ্যাস্ট্রোনট। রাকেশ শর্মা প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন রাশিয়াতেই। ২০০৮ সালে ভারত নিজে চাঁদে একটা রকেট নিক্ষেপ করতে পারে। যাকে ভারতের পক্ষ থেকে এখন উল্লেখ করা হচ্ছে “চন্দ্রযান-১”। এটি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে। ভারতের গবেষকরা ধারণা করেন, চাঁদের দক্ষিণ মেরুর মাটি ভেজা। আর এখানে আছে পানি। ভারত “চন্দ্রযান-২” চাঁদে পাঠায় ২২ জুলাই ২০১৯। যা থেকে চাঁদে নামানো হয় একটি শকট, যার মধ্যে এমন যন্ত্রপাতি ছিল, যাদের সাহায্যে প্রমাণ পাওয়া যেতে পারতো চাঁদে পানি আছে কিনা। কিন্তু চন্দ্রযান-২ থেকে নামাবার সময় শকটটি চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ে বিকল হয়ে যায়। তা থেকে পাওয়া সম্ভব চাঁদের পানি সংক্রান্ত কোন খবর।

ভারতের এই চন্দ্র অভিযান থেকে প্রমাণ হল, ভারত কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণে যে পরিমাণ সাফল্য অর্জন করেছে, রকেট বিদ্যায় তা এখনও অর্জন করতে পারেনি। অন্যদিকে বহু ভারতবাসীর মনে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, যেখানে ভারতের বহু অঞ্চলেই মানুষের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছেনা, সেখানে চাঁদে পানি আছে কি নাই সে সংবাদ জেনে আমরা কি করব? কেন ভারত সরকার এত অর্থ বরাদ্দ করবার প্রয়োজন অনুভব করছে চন্দ্র অভিযানে!

লেখাটি প্রথম প্রকাশ বিডি ভিউজে, ২০২০ সালে।  

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ