‘প্রগতিশীল’ আর ‘প্রতিক্রিয়াশীল’-এর ধারণা সৃষ্টি হয় ইউরোপে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে। ফরাসি দেশে যারা বিপ্লবের ধারণাকে সমুন্নত রেখে রাজনীতি করতে চান, তাদের বলা হতে থাকে প্রগতিশীল। আর যারা তাদের বিরোধিতা করেন, ফিরে যেতে চান ফরাসি বিপ্লবের আগের অবস্থায়, তাদের বলা হতে থাকে প্রতিক্রিয়াশীল।
ফরাসি বিপ্লবের সময় ঘোষণা করা হয় মানবাধিকারের দাবি। এই অধিকারের পক্ষে যারা থাকেন তারা হলেন প্রগতিশীল। যারা এর বিরোধিতা করেন তাদের বলা হতে থাকে প্রতিক্রিয়াশীল। ‘প্রগতিবাজ’ কথাটা কিছুটা নিন্দাসূচক। প্রগতিবাজ বলতে বোঝায় সেসব বাম রাজনীতিককে, যারা নিজেদের দাবি করেন মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের অনুসারী হিসেবে। ১৯১৭ সালে নভেম্বর মাসে ঘটে রুশ বিপ্লব। এর পর থেকে সৃষ্টি হয় প্রগতিবাজের ধারণা। প্রগতিবাজরা বহুদলীয় গণতন্ত্রে আস্থাবান নন। তারা বিশ্বাস করেন, কেবল তাদের নেতৃত্বেই সমাজে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই একদলীয় শাসনের ধারণাকে বলা যায় প্রগতিবাদী ও প্রগতিবাজদের মধ্যে মূল আদর্শগত পার্থক্য। আওয়ামী লীগ ছিল উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক দল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে আশ্চর্যজনকভাবে দলটি প্রভাবিত হয় প্রগতিবাজদের দ্বারা। আওয়ামী লীগ বলে যে, তারা সমাজতন্ত্র চায়। আর তা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন এক দলের শাসনব্যবস্থা। শেখ মুজিব গড়েন বাকশাল। বাকশালের ধ্যান-ধারণা এখনো ছাড়তে পারেনি আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাথে এ দেশের আর সব বড় দলের মতবাদিক পার্থক্য হলো, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ঘিরে। অন্যান্য দল যেখানে চাচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্র, আওয়ামী লীগ সেখানে প্রকারান্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে এক দলের রাজত্ব। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিল মূলত সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অনুকরণে। সে বলেছিল, বাকশাল গঠনের লক্ষ্য হলো, দুঃখী মানুষের গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আজ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্র। রাশিয়া এখন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পথ ছেড়ে অনুসরণ করতে চাচ্ছে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিশ্র অর্থনীতি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ১৫টি রিপাবলিক নিয়ে। এখন তারা পৃথক হয়ে পড়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারেনি জাতিসত্তার সমস্যার সমাধান করতে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মার্কসবাদ লেনিনবাদ এখন আর কোনো আবেদনবহ রাজনৈতিক দর্শন নয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশে এই দর্শনের উত্তরসূরিরা নিয়ন্ত্রিত করতে পারছে আওয়ামী লীগের নীতি; যেটাকে অনেকের কাছেই মনে হচ্ছে বিস্ময়কর। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একজন উদার গণতন্ত্রী। তিনি গণতন্ত্র বলতে বুঝতেন ব্রিটিশ গণতন্ত্রকে। আর তিনি চেয়েছেন, সেই পথই অনুসরণ করবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু তাঁর চিন্তা চেতনার সাথে আজকের আওয়ামী লীগের কোনো সুদূর যোগাযোগও নেই। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগ করতেন। তিনি সমর্থন করেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি। কিন্তু যখন তিনি দেখেন যে, এর ফলে সাবেক বাংলা বিভক্ত হয়ে পড়বে, তখন তিনি তোলেন পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের দাবি। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু ১৯৪৭ সালে যে স্বাধীন বাংলার দাবি তোলেন, বাংলাভাষী হিন্দু তাতে সাড়া দেননি। এমনকি জ্যোতি বসুর মতো বাম রাজনীতিক সমর্থন করেছিলেন বাংলার বিভক্তিকে। পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের কিছুটা নিয়ে সৃষ্টি হয় আজকের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। পক্ষান্তরে উত্তর, মধ্য ও পূর্ববঙ্গ নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান। গণভোটের মাধ্যমে আসামের শ্রীহট্ট জেলা যুক্ত হয় পূর্ব পাকিস্তানের সাথে। শ্রীহট্ট বা সাবেক সিলেট জেলা এক সময় ছিল বাংলা প্রদেশের অংশ। ১৮৭৪ সালে তাকে যুক্ত করা হয়েছিল আসামের সাথে। গণভোটে তারা ফিরে আসে আবার বাংলা ভাষাভাষী পূর্ব পাকিস্তানে। এভাবে রচিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। শ্রীহট্টের গণভোটের কথা মনে পড়ছে। কারণ এই গণভোটের সময় কমিউনিস্টরা বলেছিলেন যে, শ্রীহট্টবাসীর উচিত হবে ভারতে যোগ দেয়া। যুক্তি হিসেবে তারা বলেছিলেন, ভারত হলো একটা বিরাট ও উন্নত রাষ্ট্র; পাকিস্তান যা কখনোই হতে পারবে না। এদের কথা শুনে সাবেক শ্রীহট্টবাসী যদি পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে ভারতে যোগ দিতেন, তবে বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষেত্রফল হতো ৪৭৮৫ বর্গমাইলের কম। ইংরেজ আমলের শ্রীহট্ট জেলার আয়তন ছিল ৫৪৪০ বর্গমাইল। সাবেক শ্রীহট্ট জেলার করিমগঞ্জ থানা গণভোটে পাকিস্তানে যোগ দেয় না। সিলেটে গণভোট হয়েছিল থানাকে একক ধরে। এ দেশের কমিউনিস্ট বা প্রগতিবাজরা নিয়েছেন ভারতের পক্ষে। আজো তারা কাজ করছেন ভারতেরই পক্ষে। বর্তমান আওয়ামী লীগের ভারত তোষণ নীতির মূলে আছেন তারা। বর্তমানে এই প্রগতিবাজরা হয়ে উঠেছেন এক নিখিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। আর এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে তারা রবীন্দ্রনাথকে করে তুলতে চাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষের Culture Hero বা সংস্কৃতি বীর। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে যুক্তিবিহীন অন্ধ ধারণা। রবীন্দ্রনাথের ওপর আরোপ করা হচ্ছে অতিমানবিক গুণাবলি। যার ফলে রবীন্দ্রনাথ যেন হয়ে উঠতে চাচ্ছেন এ দেশের মানুষের জন্য অবতার হিসেবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন দু’টি রাজনৈতিক দল বড় হয়ে উঠেছে। একটি দল হলো আওয়ামী লীগ, অপরটি হলো বিএনপি। এই দুই দলের মধ্যে চলেছে মতার লড়াই। কিন্তু মতার লড়াই-ই এই দু’টি দলের একমাত্র কথা নয়। দু’টি দলের আদর্শিক পার্থক্যকে নিতে হবে বিবেচনায়। বর্তমান আওয়ামী লীগ বলছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা। কিন্তু সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বাংলাদেশে বাস করছে না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলাভাষী হলেও ভারত ভেঙে তারা এসে যুক্ত হতে চাচ্ছে না বাংলাদেশের সাথে। আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তাই বলা চলে না বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে আছে ক্ষমতা নিয়ে লড়াই। কিন্তু এক্ষেত্রে ক্ষমতা নিয়ে লড়াই সব কথা নয়। বিএনপি বিশ্বাস করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে, আওয়ামী লীগের মতো কোনো নিখিল বাঙালি জাতীয়তাবাদে নয়। বিএনপি কোনো বাম রাজনীতি করে না। বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শ নয় সমাজতন্ত্র। বিএনপি বিশ্বাস করে মিশ্র অর্থনীতিতে। এ দল বিশ্বাস করে উদার গণতন্ত্রে। জিয়া ক্ষমতায় আসার পর দেশে যে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়, তার ফলে নতুন করে শুরু হতে পেরেছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতি। জিয়ার গঠিত বিএনপি চায়নি আওয়ামী লীগের বিলুপ্তি। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রবণতা হলো এক দলের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা। আর সেই সাথে বিএনপির বিলুপ্তি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে তাই বলা চলে না একই রকম রাজনৈতিক দল। বিএনপি পরিচালিত হচ্ছে না প্রগতিবাজদের দ্বারা।
আওয়ামী লীগ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে খুব হইচইয়ে মেতে উঠেছে। আওয়ামী লীগের বক্তব্য, রবীন্দ্রনাথ হলেন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সেতুবন্ধ। আর তাই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে রবীন্দ্র চিন্তা-চেতনা হলো অন্যতম চাবিকাঠি। এ দেশের প্রগতিবাজরা প্রমাণ করতে চেষ্টা করছেন যে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তার ধারক ও বাহক। রবীন্দ্র ভাবধারা তাই হতে পারে আমাদের চিন্তার প্রসারতা প্রদানে বিশেষ সহায়ক।’ কিন্তুু রবীন্দ্র চিন্তা-চেতনা কি সত্যিই প্রগতিশীল ছিল? কী অর্থে তাকে বলতে হবে প্রগতিশীল? কারণ রবীন্দ্র কাব্যে ধ্বনিত হয়েছে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী চিন্তা-চেতনা। রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় মানুষকে ফিরতে বলেছেন, বেদ-উপনিষদের যুগে। এর মধ্যে প্রগতিশীল ভাবধারার পরিচয় কোথায়? রবীন্দ্রনাথ বাইরের বিশ্বে ভারতীয় কবি হিসেবে পরিচিত, বাংলাদেশের কবি হিসেবে নন, যদিও তিনি লিখেছেন বাংলা ভাষায়। রবীন্দ্র কাব্যের কোথাও নেই বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা; যেমন বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পরিচয় আমরা পেতে পারি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সনেটে। কোনো কবিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করতে হলে মাইকেল মধুসূদনকে করা যেতে পারে; রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয় নয়। শেখ হাসিনা তার একটি সাম্প্রতিক বক্তৃতায় বললেন, রবীন্দ্রনাথ নাকি বাঙালির অনুভব-উপলব্ধির শিকড়ে প্রোথিত। কিন্তু আমার মনে পড়ে ১৯৭১ সালের কথা। এ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার চেয়ে এ দেশের মানুষকে জীবনানন্দ দাশের কবিতা বেশি পড়তে দেখেছি। এ সময় জীবনানন্দ দাশ হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিশেষ প্রেরণার স্থল। এখন শুধু রবীন্দ্রনাথকে সামনে এনে আর সব বাংলা সাহিত্যিককে যেন উপেক্ষা করা হচ্ছে। এটাকে মোটেও বাঞ্ছিত বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের আগেই বাংলা সাহিত্য হাঁটতে আরম্ভ করেছিল। রবীন্দ্রনাথের আগেই জন্মেছেন মাইকেল মধুসূদনের মতো কবি। আবির্ভাব ঘটেছে বঙ্কিম ও সঞ্জীবচন্দ্রের মতো প্রাঞ্জল বলিষ্ঠ গদ্য লেখকের। রবীন্দ্রনাথ বাংলা গদ্যের জনক নন।
রবীন্দ্রনাথকে বলা হচ্ছে ‘অসাম্প্রদায়িক’। রবীন্দ্রনাথ কতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, তা জানি না। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরে ২০ বিঘা জমি কিনে সেখানে একটা একতলা বাড়ি বানান। তিনি বাড়িটির নাম দেন- শান্তি নিকেতন। রবীন্দ্রনাথ এখানে ১৯০১ সালে ব্রাহ্মচর্চার আশ্রম এবং একটি আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এই বিদ্যালয়ে কোনো মুসলমান ছাত্রের পড়ার অধিকার ছিল না। পরে রবীন্দ্রনাথ এখানে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। তিনি এর জন্য চাঁদা চান ভারতের বিভিন্ন দেশীয় রাজার কাছ থেকে। হায়দরাবাদের নিজাম প্রদান করেন এক লাখ টাকা। এক লাখ টাকা তখন ছিল অনেক টাকা। এরপর রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীতে কিছু মুসলমান ছাত্রের পড়ার ব্যবস্থা করেন। যে ক’জন মুসলিম ছাত্র বিশ্বভারতীতে পড়ার সুযোগ পান, তাদের মধ্যে একজন হলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। হায়দরাবাদের নিজাম যদি চাঁদা না দিতেন তবে বিশ্বভারতীতে মুসলমান ছাত্র পড়ার ব্যবস্থা আদৌ হতো বলে মনে হয় না। কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার ছিলেন খুবই অত্যাচারী জমিদার। রবীন্দ্রনাথকেও বলা যায় না এর ব্যতিক্রম। রবীন্দ্রনাথ কখনো চাননি জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা হোক। তিনি মনে করতেন, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা হলে তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়বেন আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতা করেছেন জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের। এ দিক থেকেও তাকে বলা চলে না প্রগতিশীল। জমিদার হিসেবে তার খুব সুখ্যাতি ছিল না। তিনি গরিব কৃষক প্রজার খাজনার টাকায় ভ্রমণ করেছেন পৃথিবীর নানা দেশ। অথচ তার নিজের প্রজাদের জন্য করেননি বিশেষ কিছুই। রবীন্দ্রনাথের জমিদারি ছিল নওগাঁ জেলার আত্রাই থানায়। এই থানার পতিসর নামক স্থানে ছিল রবীন্দ্রনাথের জমিদারির তহশিল ও কুঠিবাড়ি। তহশিলে যারা কাজ করতেন তারা প্রজাদের থেকে আদায় করেছেন বেআইনি বাড়তি খাজনা বা আবওয়াব এবং নজরানা। আমি পতিসরে অনেকবার গিয়েছি। ওই অঞ্চলের প্রধান ব্যক্তিদের কাছে শুনেছি নানা কথা। রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ির ঠিক পেছনে আছে একটি বড় দীঘি। এই দীঘিতে কোনো মুসলমান গোসল করতে পারত না। কারণ, মনে করা হতো মুসলমান ওই দীঘিতে গোসল করলে দীঘির পানি অপবিত্র হবে। পতিসরের তহশিলে মুসলমান কৃষক প্রজাদের খাজনা দিতে হতো দাঁড়িয়ে থেকে; তাদের বসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। শুনেছি, অনেক পরে রবীন্দ্রনাথ এদের বসার একটা ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সেটা অনেক পরে। আজ তবু রবীন্দ্রনাথকে বলা হচ্ছে আমাদের জাতীয় চেতনার উৎসস্থল হিসেবে। এর আদৌ কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। বাংলার মুসলমান সমাজ রবীন্দ্র চিন্তা-চেতনার দ্বারা কোনোভাবেই প্রভাবিত হয়নি।
বাংলাভাষী মুসলমানের মধ্যে সর্বপ্রথম সুন্দর বাংলা গদ্য লিখেছিলেন মীর মশারফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১)। মীর মশারফ হোসেন বাংলা গদ্য লিখতে শিখেন কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘গ্রামবার্তা’ নামক প্রত্রিকার সম্পাদক কাঙাল হরিনাথের কাছ থেকে। কাঙাল হরিনাথ রবীন্দ্রনাথের পিতার সমালোচনা করেন কৃষক প্রজার ওপর অত্যাচারের কারণে। রবীন্দ্রনাথের পিতা কাঙাল হরিনাথকে খুন করার জন্য গুণ্ডা নিয়োগ করেন। কিন্তু হরিনাথের পক্ষে বিপুল জনসমর্থন থাকায় রবীন্দ্রনাথের পিতার এই উদ্দেশ্য সফল হতে পারেনি। এটা ঠাকুর পরিবারের জন্য হয়ে আছে বিশেষ কলঙ্কজনক ইতিহাস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম আরম্ভ হয় ১৯২১ সালের জুলাই মাস থেকে। এর কয়েক মাস আগে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পি জি হার্টগ সাহেবকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হয় কতকটা বিলাতের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে। এর চালচলন ছিল বিলাতি। কিন্তু বাংলাভাষী হিন্দুরা সব সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলতে চেয়েছেন মুসলমান প্রভাবিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। যেটা মোটেও সত্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর ছিল বিশেষ অবদান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দান করেছিলেন অনেক জমি। কিন্তু তিনি মারা যান ১৯১৫ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে পূর্ববাংলার মুসলমান সমাজে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব হতে থাকে। তাদের প্রভাবে বাংলাভাষী মুসলমান সমাজে আসা সম্ভব হয় একটা বিশেষ মানসিক জাগরণ। বিশ্বভারতীর সাথে সে জাগরণের কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই। বিশ্বভারতীর কর্মকাণ্ড আরম্ভ হয় ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীর মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয় লিখেছেন, ‘১৯২২ সাল হইতে ১৯৪৭ সালের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক ও ছাত্রসমাজ যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছেন তাহার সহিত তুলনা করিলে ঐ সময়ের মধ্যে বিশ্বভারতীর কৃতিত্ব এ বিষয়ে নগণ্য বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি হইবে না।… কেবল চিত্রকলা ও নৃত্যগীত অনুষ্ঠানকে ইহার ব্যতিক্রম বলা যায়। এই দুই বিষয়ে বিশ্বভারতীর অবদান অনস্বীকার্য।’ (বাংলাদেশের ইতিহাস; চতুর্থ খণ্ড)। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগের তথাকথিত প্রগতিবাজরা বোঝাতে চাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের জন্য সৃষ্টি হতে পেরেছে বাংলাভাষী মুসলমান মানসে বিরাট জাগরণ। যেটাকে ঐতিহাসিক সত্য বলে স্বীকার করা যায় না। বাংলাভাষী মুসলমানের জাগরণে বিশ্বভারতী কোনো অবদান রাখেনি; অবদান রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইতিহাসে অনেক কিছু ঘটে যার ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়র্দী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। আম শব্দটা আরবি ভাষার। শব্দগত অর্থে জনগণ। পরে ১৯৫৫ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব আওয়ামী মুসলিম লীগের জায়গায় দলটির নাম করেন আওয়ামী লীগ। তিনি ‘মুসলিম’ কথাটি উঠিয়ে দেন। আওয়ামী লীগকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চান সাবেক পাকিস্তানের একটি দল হিসেবে, যার লক্ষ্য হবে পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক কল্যণব্রতী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। এ দিক থেকে তিনি বেশ কিছুটা প্রভাবিত হন ব্রিটিশ লেবার পার্টির চিন্তা-চেতনার দ্বারা। কিন্তু তার চিন্তা-চেতনা কখনোই কঠোর বামপন্থী ছিল না অথবা হয়নি। জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিতা স্যার শাহনেওয়াজ ভুট্টো ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিগত বন্ধু। হোসেন শহীদ সোহরাওয়র্দী এক দিন সিন্ধুতে শাহনেওয়াজ সাহেবের বাড়িতে গিয়ে বলেন তার পুত্র জুলফিকার আলী ভুট্টোকে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে। কিন্তু ভুট্টোর পিতা বলেন, তিনি তার পুত্রকে রাজনীতির দিকে প্রভাবিত করতে পারেন না। তার পুত্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে রাজনীতিতে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে হাত মিলাবে কি না। ভুট্টোকে সোহরাওয়ার্দী সাহেব খুব পছন্দ করতেন। ১৯৫৭ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য হিসেবে প্রেরণ করেন। জুলফিকার আলী ভুট্টোর তখন বয়স ছিল মাত্র ২৯ বছর। ১৯৬৭ সালে ভুট্টো গড়েন তার নিজস্ব রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি। কেউ তখন ভাবতে পারেননি পিপলস্ পার্টি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে সৃষ্টি হবে বিরাট রাজনৈতিক বিরোধ; যার ফলে ভেঙে পড়বে সাবেক পাকিস্তান। সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার কোনো ইচ্ছা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ছিল না। শেখ মুজিবেরও যে ছিল, এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য কী করে পরে মণিসিংহদের প্রভাবে পড়ে বাকশাল গঠনের কথা ভাবতে পেরেছিলেন সেটার ব্যাখ্যা করা মনে হয় খুবই কঠিন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখনো আটকা পড়ে আছে একদলীয় বাকশালী চিন্তা-চেতনার দ্বারা। আর তারা এখন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নীতি ও আদর্শের কথা ভুলেও চাচ্ছেন না আলোচনা করতে। নিচ্ছেন না তার নাম।