প্রগতির প্রয়োজন নেই

‘প্রগতি’ কথাটা অর্থ আমার কাছে কোনো দিনই পরিচ্ছন্ন ছিল না। আর এখনো তা আমার কাছে হয়ে আছে যথেষ্ট কুহেলী ঘেরা। অনেকের কাছে কৃষিকাজকে মনে হয়েছে ছোট কাজ। আমাদের ভাষায় ‘চাষা’ শব্দটা বিবেচিত হয়েছে গালি হিসেবে। যদিও কৃষকের শ্রমে ফলেছে ফসল আর আমরা বেঁচেছি তা খেয়ে। কিন্তু তবু কৃষককে দেখা হয়েছে হেয় করে। কার্ল মার্কস কৃষকদের চিহ্নিত করেছেন রণশীল শ্রেণী হিসেবে। অন্য দিকে, কলকারখানার শ্রমিকদের চিহ্নিত করেছেন সমাজজীবনে প্রগতিশীল শক্তি হিসেবে। বলেছেন, তারা ঘটাবে সমাজ বিপ্লব। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার অন্যতম কারণ হলো খাদ্যাভাব ও কৃষি অর্থনীতিকে অবহেলা করা। মার্কসবাদীরা বোঝাতে চান যে, ঘরের কাজ হলো খাটো কাজ। মেয়েরা যত দিন ঘরের কাজে নিয়োজিত থাকবেন, তত দিন তারা স্বাধীন হতে পারবেন না। হয়ে থাকবে পুরুষের অধীন। সমাজ থাকবে পুরুষ শাসিত হয়ে। মার্কসবাদীরা নারী পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে দেখতে চেয়েছেন শ্রেণিদ্বন্দ্ব। মার্কসবাদ মেনে নিলে সমাজজীবনে পরিবারপ্রথার অবলুপ্তি ঘটাতে হবে। যার পরিণতি দাঁড়ায় খুবই বিপর্যয়কর। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই সেটা অনেক সহজে উপলব্ধি করা চলে।

সাবেক রাশিয়ায় মানুষ এখন বলছে প্রগতির প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন স্থিতিশীল সুস্থসমাজ। কিন্তু বাংলাদেশে একদল মানুষ এখনো হয়ে আছেন মার্কসবাদী। এটা আমাদের জাতীয় জীবনের সঙ্কটকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে বিপর্যয়কর পথে। মার্কসবাদীরা মনে করেন বর্তমান বিয়েব্যবস্থা নাকি সৃষ্টি হয়েছে মেয়েদের শাসন ও শোষণ করার জন্য। তাদের গৃহকর্মে আটকে রাখার জন্য। কিন্তু গৃহকর্মের যে একটা বিরাট অর্থনৈতিক ভূমিকা রয়েছে, সেটাকে করতে চাওয়া হচ্ছে অস্বীকার। নারী গৃহকর্মে নিয়োজিত থাকে বলেই পুরুষেরা বাইরে কাজ করতে পারে। এই শ্রমবিভাজন বহু প্রাচীন এবং এখনো যথেষ্ট প্রয়োজনীয়। বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক Bronislaw Malinowski বিয়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, সন্তান উৎপাদন ও প্রতিপালনের জন্য চুক্তি (A Contract for production and maintenance of children)। বিয়েব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে তুলতে তাই মানবশিশুর অবস্থা হয়ে ওঠে সঙ্কটজনক। আর সেই সাথে জাতীয় জীবনও এগিয়ে চলে অবয়েরই পথে। দায়িত্বহীন যৌনজীবন কোনো সমাজেই এ যাবৎ প্রশংসিত হতে পারেনি। যৌনজীবনকে যুক্ত করা হয়েছে সন্তান উৎপাদন ও প্রতিপালনের দায়িত্বের সাথে। একেবারে বনে বাদারে বাস করে, এমন মানবসমাজের ক্ষেত্রেও যৌনবিশৃঙ্খলাকে মনে করা হয় নিন্দনীয়। অন্য দিকে, কোনো সমাজেই নারীর সাথে যথেচ্ছ ব্যবহারকে মনে করা হয় না সমর্থনীয় বলে।

নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে এটা এখন পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। মানুষের নীতি চেতনাকে বিশ্লেষণ করলে তিনটি বাস্তবতার সন্ধান মেলে। এরা হলো : আত্মরা, বংশরা ও সম্পত্তি রা। যা কিছু মানুষের আত্মরা, বংশরা ও সম্পত্তিরার প্রতিকূল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, মানুষ তাকে চিহ্নিত করতে চেয়েছে দুর্নীতি হিসেবে। সমাজের নীতি চেতনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এই তিন বাস্তবতার কথাই নানাভাবে এসেছে ও আসে। মানুষের জীবন অন্য প্রাণীর মতো মৃত্যুর গণ্ডি দিয়ে ঘেরা। কিন্তু মানুষ যতটা মৃত্যুসচেতন, অন্যপ্রাণী সম্ভবত তা নয়। মানুষের মনে সব সময় কাজ করতে চায়, একটি বিশেষ অভিপ্রায় : জীবনে জীবন রাখি, মরণেরে দাও ফাঁকি। সন্তানের নিরাপত্তার জন্য সে রেখে যেতে চায় সম্পত্তি। এ হলো সম্পত্তি চেতনার উৎস। এসব কথা মনে আসছিল একটি দৈনিক পত্রিকার খবর পড়ে। পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে, সংসার ভাঙছে শহরে বেশি এবং তালাকে এগিয়ে মেয়েরা। শহরে এখন মেয়েরা যে পরিমাণ বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছেন, ছেলেরা তা ঘটাচ্ছেন না। শহরে নারীরা বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছেন শতকরা ৭০.৮৫ ভাগ আর ছেলেরা ঘটাচ্ছেন শতকরা ২৯.১৫ ভাগ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১২ জুন ২০১৫)।

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, ঢাকার পর চট্টগ্রাম ও সিলেটে তালাক ঘটছে বেশি। দেশে সর্বত্র তালাকের পরিমাণ এক নয়। গ্রামের মেয়েরা এখনো শহুরে মেয়েদের মতো তালাকপ্রবণ হয়ে ওঠেননি। হতে পারে আমাদের সমাজজীবনের ভাঙন শেষ পর্যন্ত গ্রাম্য মেয়েদের রণশীলতার জন্যই রা পেতে পারবে। রা পেতে পারবে আমাদের বংশধারা। তাই আমার মনে হচ্ছে, প্রগতির প্রয়োজন নেই। দেহাতি সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে হবে, কেননা তা সন্তান প্রতিপালনের অনুকূল। জীবন সত্য, আর সত্যই জীবন। যা জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে অথবা রাখতে সহায়তা করে, তাই সুনীতি। সুনীতির আর কোনো মানদণ্ড নেই। কোনো জাতির জন্মহারের তুলনায় মৃত্যুর হার যতি বাড়ে, তবে সে জাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

ইউরোপে একসময় (১৯৬০-এর দশকে) ফরাসিদের জন্মহার অনেক নিচে নেমে এসেছিল। এ সময় ফরাসি সরকারের অন্যতম ল্য হয়ে দাঁড়ায় ফরাসিদের জন্মহার বৃদ্ধি। এজন্য সন্তান জন্মালে দেয়া হতে থাকে প্রতি পরিবারকে বিশেষ ভাতা ও সন্তান প্রতিপালনের জন্য বিভিন্ন প্রকার আর্থিক অনুদান। এর ফলে বেড়ে যায় ফরাসিদের জন্মহার। ইউরোপে ফরাসিরা আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে। যৌনবিশৃঙ্খলা, সন্তান প্রতিপালনে অনীহা একটি জাতিকে ভেতর থেকে দুর্বল করে ফেলতে চায়। লুপ্ত করে ফেলতে চায় তার প্রাণশক্তিকে। জানি না আমাদের জাতি প্রগতির নামে কোন আত্মঘাতী পথে যাত্রা করতে চাচ্ছে।

নানা কারণে আমাদের দেশে পরিবার প্রথা ভাঙছে কেবল মেয়েদের কারণেই নয়। পুরুষেরা যাচ্ছেন দূর বিদেশে কাজ করতে। তাদের স্ত্রীরা হচ্ছেন বহুক্ষেত্রেই বিপথগামী। এখন শোনা যাচ্ছে সরকারিভাবে বহু মেয়েকে বিদেশে পাঠানো হবে জিগিরি করতে। তাদের জীবনে কী দুর্যোগ নেমে আসবে, আমরা জানি না। তারা ঘরসংসারী হতে পারবেন কি না সেটা থাকছে বিশেষভাবে অনিশ্চিত হয়ে। এভাবে কাজের জন্য মেয়েদের বিদেশে ছোটা কতটা সঙ্গত হচ্ছে, আমি জানি না।

ফিলিপাইন থেকে বহু মেয়ে আরবে কাজ করতে গিয়ে পড়েছিলেন ভয়াবহ যৌন হয়রানির মধ্যে। তাদের সমগ্র জীবনটাই হয়ে উঠেছিল বিষময়। যারা বিদেশে যাচ্ছেন, তারা সবাই যে যাচ্ছেন অভাবে পড়ে, তা নয়। যাচ্ছেন সম্পদের লোভে। কিন্তু জীবন সম্পদের জন্য নয়, জীবনের জন্যই সম্পদ। জীবনের ব্যর্থতা সম্পদ দিয়ে পূরণ করা যাবে না। কখনোই যায় না। গ্রাম্যপ্রবাদে বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আমরা চোখের ওপরেই দেখতে পাচ্ছি, বিদেশে গিয়ে সম্পদ অর্জনের আশায় কত মানুষকে মরতে হচ্ছে গণকবরে। এসব দেখে কি আমরা পারছি না আমাদের পরিণাম সম্পর্কে সচেতন হতে?

অনেক দেশেই মেয়েরা কেবল সন্তান প্রতিপালনের কাজে নিয়োজিত থাকেন না। বহুবিধ কাজ করে অর্জন করেন জীবিকা। অনেক দেশেই গড়ে উঠেছে উন্নতমানের কুটির শিল্প আর মেয়েরাই কুটির শিল্পে হচ্ছেন বিশেষভাবে নিয়োজিত। দৃষ্টান্ত হিসেবে সুইজারল্যান্ডের কথা বলা যেতে পারে। সুইজারল্যান্ডে মেয়েরা ঘরে বসে বানান ঘড়ির নানা অংশ, যা বিক্রি করে তারা হতে পারেন বিশেষভাবে লাভবান। আমাদের দেশেও নারীকেন্দ্রিক অনুরূপ কুটির শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। আমরা রাজনীতি নিয়ে যতটা মাথা ঘামাচ্ছি, কী রকম সমাজজীবন চাই, তা নিয়ে করতে চাচ্ছি না সেভাবে চিন্তাভাবনা। যদিও তা করা দরকার। না হলে জাতি হিসেবে আমাদের সত্তা বিলুপ্ত হতে পারে।

প্রকাশিত দৈনিক নয়াদিগন্তে, ২০ জুন ২০১৫।

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ