প্রণব মুখোপাধ্যায়ের চট্টগ্রাম দর্শন

The Prime Minister of Bangladesh, Ms. Sheikh Hasina meeting the President, Shri Pranab Mukherjee, at Rashtrapati Bhavan, in New Delhi on August 19, 2015

প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন এবং এখনও আছেন ভারতের কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কংগ্রেস কোনো দিনই একটা সশস্ত্র বিপ্লববাদী দল ছিল না। তাই হঠাৎ তার সূর্যসেনের প্রতি এতটা ভক্তি জাগল কেন, সেটা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, সূর্যসেন হলো একটি উপলক্ষ। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল অন্য। তিনি ঢাকায় এসে একান্তে বতর্মান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কী বিষয় নিয়ে এক ঘণ্টাকাল আলোচনা করেছেন, আমরা তার কিছুই জানি না। আনন্দবাজার পত্রিকার খবর সত্যি হলে বলতে হবে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে কী করে অগ্রসর হতে হবে, সে বিষয়ে নাকি দিয়েছেন বিশেষ পরামর্শ।

বাংলাদেশ এখন নানা কারণেই ভারতের কাছে একটি বিশেষ বিবেচ্য হয়ে উঠেছে। ভারতের প্রধান সেনাপতি বলছেন, চীন-ভারত যুদ্ধ নাকি বেধে যেতে পারে। এই যুদ্ধ বেধে গেলে ভারতকে তার সৈন্য, যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ অরুণাচল ও আসামে নিয়ে যেতে হতে পারে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে তাই ভারত চাচ্ছে একটি ভারতবান্ধব সরকার। প্রণব বাবু কংগ্রেস করেন কিন্তু বিজিপির সঙ্গেও রয়েছে তার অন্তরঙ্গতা। তিনি কংগ্রেস সরকার থাকার সময় হয়েছিলেন ভারতের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত। কিন্তু বিজিপি ক্ষমতায় এলে তিনি তার পদ থেকে সরে না গিয়ে থেকেছেন প্রেসিডেন্ট। যদিও সরে যাওয়াটা ছিল যুক্তিযুক্ত। কারণ তিনি বিজিপি সরকার নির্বাচিত ছিলেন না। যে কারণেই হোক, আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের কংগ্রেসের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে হার্দিক। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত প্রভাব আছে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার ওপর। নরেন্দ্র মোদি সরকার চাচ্ছে সেটাকে কাজে লাগাতে। তাই যদিও প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বাংলাদেশ দিলো সরকারি প্রটোকল। আর বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার তাকে দিলেন একই রকমভাবে সংবর্ধনা। মনে হলো প্রণব মুখোপাধ্যায় ব্যক্তিগত সফরে আসেননি; এসেছেন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সরকারিভাবে।

প্রণব বাবু চট্টগ্রাম গিয়ে তার বক্তৃতায় বলেছেন, চট্টগ্রামে যে কেবল ব্রিটিশ শাসনামলেই রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছে, তা নয়। পাকিস্তান আমলেও হয়েছে। তিনি বলেছেন, চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে প্রথম দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। সেটাও ছিল একটি বিরাট রাজনৈতিক ঘটনা। কিন্তু তিনি বলেননি জিয়ার নাম। আমার মনে পড়ে জিয়া ক্ষমতায় এসে যখন প্রথম দিল্লিতে সফরে যান, তখন নিলম সঞ্জিব রেড্ডি ছিলেন ভারতের প্রেসিডেন্ট। তিনি জিয়াকে দিল্লির বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক হিসেবে। কিন্তু প্রণব বাবু খুব সাবধানে এড়িয়ে গেলেন জিয়ার নাম। এটাকেও মনে হচ্ছে খুব রহস্যজনক।

Indian National Congressপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন অ্যাংলোইন্ডিয়ান অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্ভেন্ট। যার নাম হলো অ্যালান অক্টালিয়াস হিউম (১৮২৯-১৯২২)। হিউমের পিতা জোসেফ হিউম ইংরেজ ছিলেন না; ছিলেন স্কচ। অ্যালান হিউম থাকতেন বোম্বাইতে। তিনি কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তখনকার ভাইস রয় লর্ড ডাফরিনের নির্দেশে। ব্রিটিশ সরকার চেয়েছিল ভারতের রাজনীতি পরিচালিত হোক নিয়মতান্ত্রিক পথে কংগ্রেসের মাধ্যমে। ভারতে আর কখনো যেন ১৮৫৭ সালের মতো কোনো সিপাহি অভ্যুত্থান না ঘটে। কংগ্রেসের সাথে সরকারের থেকেছে বিশেষ সুসম্পর্ক। ১৮৮৫ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে তিনজন ইংরেজ হয়েছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক সভার সভাপতি। এ হলো কংগ্রেস দলের ইতিহাস। কংগ্রেস একটি বিপ্লববাদী দল নয়। প্রণব বাবু নিজেও কোনো দিন কোনো বিপ্লববাদী ছিলেন না। কিন্তু তিনি ভাব দেখালেন যে, তিনি হয়ে উঠেছেন সূর্যসেনের একজন আন্তরিক ভক্ত। এটাকে অনেকের কাছে মনে হতে পারে অতিভক্তি। আর মনে পড়তে পারে অতিভক্তি সম্পর্কে বাংলাভাষায় প্রচলিত অতিচেনা প্রবচনটিকেও।

যাকে বলা হয় সশস্ত্র বিপ্লববাদ বা বল প্রয়োগ করে এই উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করার চেষ্টা, ব্রিটিশ সরকার যাতে নাম দিয়েছিল Terrorism; বাংলায় যাকে বলা হতো সন্ত্রাসবাদ এবং হিন্দিতে বলা হতো আতঙ্কবাদ। তার উদ্ভব হয়েছিল মহারাষ্ট্রে। সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছিল এই উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে। মহারাষ্ট্রে এর উদ্ভব ঘটে গোড়া ব্রাহ্মণ নেতা বাল গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে। এ সময় পুনা শহরে প্লেগ মহামারীর আকারে দেখা দেয়। যেহেতু প্লেগের জীবাণু ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই পুনার ডিস্টিক্ট কমিশনার র্যান্ড সাহেব ইঁদুর মারতে হুকুম দেন। কিন্তু ইঁদুর হলো হিন্দু দেবতা গণেশের বাহন। হিন্দুরা তাই প্রচার করতে শুরু করে যে, খ্রিষ্টান ইংরেজরা হিন্দুধর্মকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইঁদুর মারার পরিকল্পনা নিয়েছে। তিলক এই মতবাদকে সমর্থন করেন এবং চান এর ভিত্তিতে ব্রিটিশবিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়তে। তার দু’জন সাগরেদ গুলি করে র্যান্ড সাহেবকে মেরে ফেলে। র্যান্ড যা বলেছিলেন তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল। তিনি চেয়েছিলেন ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করে প্লেগের বিস্তার রোধ করতে; হিন্দুধর্মকে ধ্বংস করতে নয়। কিন্তু তিলক এ ক্ষেত্রে টেনে আনেন ধর্মের কথা। সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে হিন্দুত্বের আবেগ। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাংলাদেশের বিপ্লববাদীরা করেছে মা কালীর পূজা। প্রচার করেছে মা কালী তাদের শক্তি জোগাবেন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে। বাংলাদেশে মুসলমানেরা কোনো সন্ত্রাসবাদী দল গড়েনি হিন্দুদের মতো। হিন্দুরা মুসলমানকে গ্রহণ করেনি তাদের গড়া সন্ত্রাসবাদী দলে। কারণ, হিন্দুরা মুসলমানকে সাধারণভাবেই ভেবেছে অচ্ছুৎ। মুসলমানের ছোঁয়া লাগলে তাদের জাত চলে যাবে। কেবল তাই নয়, সন্ত্রাসবাদী দলগুলোতে নেয়া হয়নি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের; ওই একই কারণে। ধরা হয়েছে তাদের ছোঁয়ায় উচ্চবর্ণের হিন্দুদের জাত চলে যাবে। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন তাই সীমিত থেকেছে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে।

উচ্চবর্ণের হিন্দু বলতে বুঝিয়েছে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এবং বৈদ্যদের। সূর্যসেন ছিলেন কায়স্থ। সূর্যসেনের দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর নেতা অম্বিকা চক্রবর্তী ছিলেন ব্রাহ্মণ। অর্থাৎ সূর্যসেনের দল চলেছিল মূলত কায়স্থ ও ব্রাহ্মণ নেতৃত্বে। সূর্যসেনের দলের নাম ছিল Indian Republican Army। দলটির নাম তারা রেখেছিলেন Irish Republican Arm’র অনুকরণে। আইরিশ সশস্ত্র বিপ্লবীদের পন্থার অনুসরণ করতে চেয়েছিল চট্টগ্রামের ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’। চট্টগ্রামে ডেপুটি পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন আসানুল্লাহ। তাকে সূর্যসেনের দলের একজন গুলি করে হত্যা করে সূর্যসেনের নির্দেশে। এতে চট্টগ্রামের মুসলমানদের মধ্যে হয় খুবই বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বেধে যেতে চায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। চট্টগ্রাম ছিল বাংলাদেশের একমাত্র বড় শহর, যেখানে মুসলমানেরা ছিল সংখ্যাগুরু। আর তারা ছিল অনেকেই সচ্ছল সওদাগর। এদের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা ছিল খুবই ভিন্ন। সূর্যসেনের দলের সামরিক অভ্যুত্থান এদের কাছে মনে হয়নি কেবলই ব্রিটিশবিরোধী অভ্যুত্থান। মনে হয়েছে হিন্দু রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। কিন্তু প্রণব বাবু এসে আমাদের বুঝাতে চাইলেন যে, সূর্যসেন ছিলেন একজন বীর ব্রিটিশবিরোধী যোদ্ধা।

বাংলা প্রদেশে দু’টি বড় সন্ত্রাসবাদী দল ছিল। একটি দলের নাম ছিল ‘অনুশীলন সমিতি’। অনুশীলন দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সতীশচন্দ্র বসু। দলটির নাম গ্রহণ করা হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টবাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) লেখা উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ থেকে। সবারই জানা আছে, যতগুলো গ্রন্থ এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ সৃষ্টিতে ইন্ধন জুগিয়েছে, তার মধ্যে আনন্দমঠের স্থান হলো প্রধান। অনুশীলন সমিতির আদর্শ ছিল ধর্মরাজ্য স্থাপন। আর সেটা ছিল আনন্দমঠভিত্তিক হিন্দু আদর্শ অনুপ্রাণিত। অনুশীলন সমিতি প্রথম গঠিত হয় কলকাতায়। কিন্তু তার শাখা দ্রæত চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে এর প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় ঢাকা শহর। বাংলা প্রদশের আরেকটি বড় সন্ত্রাসবাদী দলের নাম ছিল ‘যুগান্তর’। যুগান্তর দলও গঠিত হয়েছিল কলকাতায়। কিন্তু পূর্ববঙ্গে এই দল অনুশীলনের মতো অত শক্তিশালী ছিল না। তবে সূর্যসেন ছিলেন এর সঙ্গে সংযুক্ত। সূর্যসেনের অভ্যুত্থানের সঙ্গে অনুশীলন সমিতির কোনো সহযোগিতা ছিল না। এমনকি চট্টগ্রামেও। সন্ত্রাসবাদী দলগুলোর মধ্যে আরম্ভ হয়েছিল প্রচণ্ড বিরোধ। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্যসেন ও অম্বিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে রিপাবলিকান আর্মির প্রথম অভ্যুত্থান ঘটে। রিপাবলিকান আর্মি চট্টগ্রামের দামপাড়া মহল্লায় অবস্থিত পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার আক্রমণ করে অধিকার করে। কিন্তু অস্ত্রাগারের অস্ত্রশস্ত্র যেখানে রাখা হতো, তার থেকে বেশ কিছু দূরে আরেক জায়গায় রাখা হতো গুলি। রিপাবলিকান আর্মি অস্ত্রাগার দখল করেছিল বটে, কিন্তু অস্ত্রে ব্যবহারের জন্য গুলি দখল করতে পেরেছিল না। রিপাবলিকান আর্মি ওই একই দিনে রেলস্টেশনের কাছে অবস্থিত রেল পুলিশের অস্ত্রাগারও দখল করে। এ হলো চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন বলে যে অভ্যুত্থান পরিচিত, তার মূল ঘটনা।

রিপাবলিকান আর্মি ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে দেখে যে, কোনো লোকজন সেখানে নেই। রিপাবলিকান আর্মি এরপর টেলিগ্রাফ অফিস এবং টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিস পুড়িয়ে দেয়। চট্টগ্রামের ব্রিটিশ প্রশাসন তাদের লোকজন অনেক অস্ত্রশস্ত্রসহ নিয়ে যেতে সক্ষম হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। তাদের প্রধান লক্ষ্য হয় চট্টগ্রাম বন্দরে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। তারা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কলকাতায় সেনা সাহায্য চেয়ে পাঠায়। সেনা সাহায্য এসে পৌঁছালে তারা চট্টগ্রাম শহর তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে ওঠা সম্ভব ছিল না রিপাবলিকান আর্মির। রিপাবলিকান আর্মির অস্ত্র ছিল রিভলভার ও পিস্তল। কিন্তু ব্রিটিশ আর্মির হাতে ছিল উন্নতমানের রাইফেল ও মেশিনগান। তারা সরে যেতে বাধ্য হয় চট্টগ্রাম শহর থেকে। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রিপাবলিকান আর্মির একজন মহিলা নেতা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে রিপাবলিকান আর্মির কয়েকজন সদস্য গিয়ে আক্রমণ করে ইউরোপিয়ান ক্লাব। তারা ক্লাবের জানালা দিয়ে ছুড়ে মারে তাদের তৈরি হাতবোমা, যা বিস্ফোরিত হয়ে ১১ জন শ্বেতাঙ্গ আহত হয় ও একজন মারা যায়। বোমার একটি টুকরা এসে লেগেছিল প্রীতিলতার গায়ে। তিনি গুরুতরভাবে আহত হন। তিনি তার সহযোগীদের দ্রæত চলে যেতে বলেন এবং নিজে পটাশিয়াম সাইনাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। প্রীতিলতার মৃতদেহ পুলিশ তল্লাশি করে তার ব্লাউজে একটি কৃষ্ণের ছবি সেলাই করে আটকানো দেখনে পায়। প্রীতিলতা ছিলেন বিশেষভাবে শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত। যে শ্রীকৃষ্ণ জড়িত ভগবত গীতার সঙ্গে।

সূর্যসেন যিনি মাস্টারদা নামে বেশি পরিচিত, তিনি ও তার সহযোগীরা পালিয়ে হিয়ে আত্মগোপন করেন গৈরিলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে। সেখানে ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রæয়ারি রাতে সহবিপ্লবীদের সাথে বৈঠক করার সময় সহযোগী ব্রজেন সেনের ভাই নেত্ররঞ্জন সেন পুলিশকে তার উপস্থিতির কথা জানিয়ে দেয়। পুলিশ ঘোষণা করেছিল, সূর্যসেনকে যে ধরিয়ে দিতে পারবে, তাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। নেত্ররঞ্জন সেন সূর্যসেনকে ধরিয়ে দিয়ে পুরস্কার পেয়েছিলেন। তবে সূর্যসেনের দলের লোক গুলি করে মেরে ফেলে নেত্ররঞ্জন সেনকে। সূর্যসেন ধরা পড়ার পর বিচারে তার ফাঁসি হয়। সূর্যসেনের স্থলে নেতা হন তারকেশ্বর দস্তিদার। কিন্তু তারকেশ্বর দস্তিদারও ধরা পড়েন এবং তারও হয় ফাঁসি। গৈরিলা গ্রাম থেকে তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন রিপাবলিকান আর্মির বিখ্যাত মহিলা নেতা কল্পনা দত্ত। কল্পনা দত্তও ধরা পড়েন এবং তার সাজা হয় যাবজ্জীবন।

কিন্তু এরপর একটি অদ্ভুদ কাণ্ড ঘটে। যার কথা আগে ভাবা যায়নি। জাপানের সঙ্গে বাধে ব্রিটেনের যুদ্ধ। জাপানের সেনাবাহিনী ১৯৪২ সালে সমুদ্রপথে এসে বর্মা দখল করে। জাপানি বাহিনী এসে যায় চট্টগ্রাম সীমান্তে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এ সময় ঘোষণা করে জাপানকে রুখবার। তারা প্রতিশ্রæত হয় ব্রিটেনকে যুদ্ধে সর্বপ্রকার সাহায্য করবার। যেসব সূর্যসেনের সহযোগী জেলে ছিলেন, তারা সবাই যোগ দেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে। ব্রিটিশ সরকার এদের সবাইকেই ছেড়ে দেন। কল্পনা দত্ত ছাড়া পান। তিনি ছাড়া পেয়ে বিবাহ করেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পুরন্দ চন্দ্র জোশিকে। যিনি ছিলেন উত্তর প্রদেশের লোক। অর্থাৎ সূর্যসেনের দলের লোকেরা ব্রিটিশ বিরোধিতা পরিত্যাগ করে হয়ে ওঠেন ব্রিটেনের সহযোগী শক্তি। এই ইতিহাস প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অজানা থাকার কথা নয়। এক দিনের ব্রিটিশবিরোধীরা হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটেনেরই পরম মিত্র।হ

দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশ, ২০ জানুয়ারি ২০১৮। 

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ