‘আইনের শাসনের’ ধারণা আমরা পেয়েছি ইংরেজদের কাছ থেকে। কিন্তু ‘আইনের শাসন’ কথাটা বলা যত সহজ, একটা দেশে তা প্রতিষ্ঠা করা অত সহজ নয়। সুন্দর আইন থাকলেই যে একটা দেশে আইনের শাসন থাকবে, তা নয়। বিলাতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেখানেও এক সময় বিচারকরা ঘুষ খেত অথবা উপহার গ্রহণ করত। বিখ্যাত দার্শনিক ফ্রানসিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬), বিলাতের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি থাকার সময় উৎকোচ গ্রহণ করেন। কিন্তু কথাটা জানাজানি হয়ে যায়। তাঁকে দাঁড়াতে হয় অপরাধীর কাঠগড়ায়। জরিমানা করা হয় চল্লিশ হাজার পাউন্ড এবং বলা হয়, রাজা যতদিন ইচ্ছা করবেন ততদিন তাঁকে থাকতে হবে লন্ডন টাওয়ারে বন্দি। তিনি কোন দিন কোন সরকারি চাকরি আর পাবেন না। নানা কারণে বেকনকে অবশ্য অত টাকা জরিমানা দিতে হয়নি। আর থাকতেও হয়নি বন্দি। কিন্তু তাঁর সামাজিক মর্যাদা এর ফলে বিশেষভাবে হ্রাস পেয়েছিল।
বেকন ছিলেন বহুমখী প্রতিভা। তিনি লেখেন ইংরেজি ভাষার স্মরণীয় প্রবন্ধ আর বিজ্ঞান-গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে একটি অতি মূল্যবান গ্রন্থ যা তাঁকে দেয় দার্শনিক প্রসিদ্ধি। উপরের কাহিনীটুকু বললাম এই জন্যে যে, আজকাল আমাদের দেশেও বিচারকরা উৎকোচ গ্রহণ করছেন বলে অবিযোগ শোনা যাচ্ছে। জীবনে আমি মামলা-মকদ্দমা যতদূর পেরেছি এড়িয়ে চলেছি। আমি বেশ কিছুদিন ফরাসি দেশে ছিলাম, সে সময় ছোট একটা মামলা করতে হয়েছিল আমাকে। মামলা করতে হয়েছিল এক মটর চালকের বিরুদ্ধে। সে আমাকে চাপা দিয়েছিল। আমি মামলায় জিতেছিলাম। যে টাকা ক্ষতিপূরণ হিসাবে পেয়েছিলাম, তা দিয়ে একটা ছোট মটরগাড়ি কিনেছিলাম। গাড়ি চাপা না পড়লে আমি কখনও মটরগাড়ি কিনতে পারতাম না।
যা হোক, সে আর এক কাহিনী। ফরাসি আদালতের বিচারপদ্ধতি আমাকে মুগ্ধ করে। ফরাসি দেশে সর্বনিম্ন আদালতেও একজন বিচারক বিচার করেন না। থাকেন তিনজন বিচারক। ব্যবস্থাটা ভালো। কারণ, একজন বিচারকের বিচারে ভুল হবার সম্ভাবনা যতটা থাকে, তিন জনের বিচারে তা থাকে না। আর কেউ যদি বিচারকে ঘুষ দিতে চায়, তবে তা দিতে হবে তিন জনকে। একজন বিচারককে যদি এক লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়, তবে তিন জনকে দিতে হবে তিন লাখ টাকা। তাই একজন বিচারককে ঘুষ দিয়ে যত সহজে মামলার রায়কে নিজ পক্ষে নেওয়া যেতে পারে, তিন জন বিচারক থাকলে, তা অত সহজে হতে পারবে না।
অবশ্য আইন-আদালত সবদেশেই প্রায় একই রকম। আমাকে পেশকারকে টাকা দিতে হয়েছিল, যাতে মামলার দিন একটু তাড়াতাড়ি পড়ে। ফরাসি দেশের আদালতেও আইনের বাইরে অনেক ‘কাজ’ প্রচলিত আছে। আদালতের কেরানিকেও প্রণামী দিতে হয়। তবে তার মাত্রা আমাদের দেশের মত অত বেশি নয়। মামলার ব্যাপারে আগে থেকেই অনক ক্ষেত্রে উকিলরা চুক্তি করে নেন, কত টাকা তাঁকে দিতে হবে। তার বেশি তিনি কখনও মক্কেলের কাছ থেকে আর দাবি করতে পারেন না। হিসাবের চাইতে বেশি খরচ পড়লে সে ব্যয় উকিল হিসাবে তাঁকেই বহন করতে হয়। আমার মামলাটা ছিল ক্ষতিপূরণের মামলা। তাঁর সঙ্গে আমার চুক্তি হয়েছিল, মামলায় জিতলে আমি যা পাব, তার শতকরা দুই ভাগ তাঁকে দিতে হবে। আর পেশকার, কেরানি ইত্যাদিতে যা দু’দশ টাকা দেবার, তা-ও আমাকে দিতে হবে। আমি মামলায় জিতেছিলাম। কিন্তু জিতবার পর উনি আমাকে তাঁর প্রাপ্য অংশের একটা বিরাট অংশ ছেড়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমার মত অদ্ভুত প্রকৃতির মক্কেল তিনি আগে কখনও দেখেননি। তিনি আমাকে অনেক ব্যাপারে বেশ কিছুটা উপদেশও দেন যেন কেন। যা তাঁর আইন ব্যবসার চৌহদ্দিতে পড়ে না। তাঁর শেষ উপদেশটা ছিল, ফরাসি মেয়েদের সঙ্গে মিশবে না। একজন খাঁটি ফরাসি উকিল আমাকে এরকম উপদেশ দেবেন, তা আমি আদৌ ভাবতে পারিনি।
কোন সমাজ উন্নতি করছে কি করছে না, তা মাপবার জন্যে সমাজতাত্তি¡করা অনেক পদ্ধতি বাতলেছেন। তার মধ্যে একটা হল, কোন একটা দেশে মামলা মকদ্দমার হার বাড়ছে না কমছে, তার হিসাব করা। বিলাতে রানি প্রথম এলিজাবেথের আমলে যে পরিমাণ মামলা-মকদ্দমা হত, এখন আর তা হয় না। সে যুগের তুলনায় আজকের বিলাতের সমাজ-জীবনকে তাই বলা চলে অনেক উন্নত।
হাল আমলের কোন পরিসংখ্যান আমার জানা নেই। কিন্তু ইংরেজ আমলে কৃষক তার আয়ের তিনভাগের প্রায় এক ভাগ ব্যয় করত মামলার পিছনে। এখন উপজেলায় কোর্ট স্থাপন করে, বিচারকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের দোরগোড়ায়। জানি না, ঐ সব কোর্ট থেকে গ্রাম বাংলার মানুষ কেমন বিচার পাচ্ছে। তবে কোর্টগুলিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে রক্তচোষা এক শ্রেণির টাউট। আর সম্ভবত মামলা-মকদ্দমার হার সারা দেশেই গিয়েছে অনেক বেড়ে। আমাদের দেশের আইন ব্যবসায়ীরা যেভাবে মক্কেলের কাছ থেকে নানা ছুতায় টাকা নিচ্ছেন, সেটাও হয়ে উঠেছে অসহনীয়। অবশ্য ব্যতিক্রম আছে। এখনও এমন উকিল আছেন, যাঁরা আর্থিক নিস্কাসন করেন না। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এঁরা অধিকাংশই খুব বয়স্ক। যাঁরা ইংরাজ আমলের ঐতিহ্যের সাথে কিছুটা পরিচিত। অথবা এক পুরুষে উকিল নন, উকিলের ছেলে, উকিল। যাঁরা কিছুটা লিগ্যাল এথিক্স লাভ করছেন। আমার ধারণা, ইংরেজ রাজত্বের শেষ দিকে এ দেশে উকিলদের মধ্যে তাঁদের পেশাগত যে নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি হয়েছিল, আজ আর তা অবশিষ্ট নেই। আমাদের অন্ততঃ সেই অবস্থায় ফিরে যাবার চেষ্টা করা উচিৎ।
অনেক দেশেই উকিলরা কেবল ওতালতি করেন না। অনেকে ওকালতির ফাঁকে ফাঁকে করেন সাহিত্য চর্চা, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। লেখেন দর্শনের বই। দেশকে সাধারণভাবে সাহায্য করতে চান তাঁদের ভাবনা চিন্তা দিয়ে। বিখ্যাত ফরাসি গণিতবিদ ফারমা পেশায় ছিলেন উকিল। ওকালতি করবার পর অবসর সময়ে তিনি করতেন গণিত নিয়ে গবেষণা। ফারমা খারাপ উকিল ছিলেন না। কিন্তু বিশ্ব এখন তাঁকে একজন বিরাট গণিতবিদ হিসেবেই মনে রেখেছে। সাধারণত অন্য দেশে যাঁরা আইন পড়েন, তাঁরা হলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। তাঁদের প্রতিভাও তাই নানা পথে চলে। কিন্তু আমাদের দেশে বোধ হয় এর উল্টো ব্যাপারটাই সত্য। ইংরেজ আমলের ইতিহাস যখন পর্যালোচনা করি, দেখতে পাই, বহু উকিল, বহু ব্যারিস্টার সাহিত্য চর্চা করেছেন। শিল্প-সাহিত্য-দর্শন নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। যাকে বলা হয় ‘বাংলার কালচার’, তাতে তাঁদের দান রয়েছে যথেষ্ট। অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত মুনসেফের চাকরি করেও ছোটগল্প লিখেছেন চমৎকার। বিশেষ করে মুসলিম জনজীবন নিয়ে। এই সব উকিল, ব্যারিস্টার সবাই ছিলেন হিন্দু (এস, ওয়াজেদ আলী একমাত্র মুসলমান নাম, যা উল্লেখ করা যেতে পারে)। আমার মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের মধ্যে সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্য আজো অনেক পরিমাণে টিকে আছে। কিন্তু আমাদের (মুসলমার) মধ্যে ঐ রকম একটা পরিমন্ডলে এখনও সৃষ্টি হয়নি। হবার আপাত সম্ভাবনাও যেন নেই।
কিছুদিন আগে আমি কয়েকজন উকিলের কাছাকাছি এসেছিলাম। এঁদের আলোচনার মধ্যে কেবলই দলীয় রাজনীতির কচ্কচি ছাড়া আর কিছুই পেলাম না। কয়েকজন বামপন্থী উকিল অবশ্য কিছুটা বুক চাপড়েই বললেন, হায় হায়, সমাজতন্ত্রের কী হল! মনে হল, রাশিয়ার বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ তাঁদের সত্যি ব্যথিত করেছে। আমি তাঁদের বল্লাম, রাশিয়ার উকিলরা এখন অনেক মুক্তভাবে ওকালতি করবার সুযোগ পাবে। আর রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আইনের শাসন, কম্যুনিস্ট শাসন যা ধ্বংস করে দিয়েছিল। মনে হল, কথাটা তাঁদের মোটেও ভাল লাগলো না। দশ বছর আগে হলে, আমাকে তাঁরা বলে বসতেন সিআইএ’র লোক।
একটা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা বেশ কঠিন কাজ। এর জন্যে প্রয়োজন দেশবাসীর এক সাধারণ মানসিক জাগরণ। যে জাগরণ অনেক দেশে আইন ব্যবসায়ীরাই এনে দিয়েছেন। কারণ, তাঁরা দেশকে দিয়েছেন চিন্তাগত নেতৃত্ব।