বনরুই (Pangolin) এক রকম স্তন্যপায়ী প্রানী। কিন্তু বাইরে থেকে দেখে মনে হয় কতকটা সরীসৃপের মত। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্ট অঞ্চলে একসময় প্রানীটি প্রচুর পাওয়া যেত। আমাদের দেশে মারমা ও চাকমা উপজাতির প্রিয় খাদ্য বনরুইয়ের মাংস। তবে বাঙ্গালী মুসলমান বনরুই আহার করে না। যদিও বনরুইকে বলা চলে না হারাম। বনরুই খেলে মানুষ অসুস্থ হয় না। কিন্তু বর্তমানে বনরুই হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম আলোচ্য জন্তু। কারণ করোনা ভাইরাস এসেছে বাদুড় থেকে; আর বাদুড় থেকে তা এসেছে, বলা হচ্ছে, বনরুইয়ের মাধ্যমে। কী করে এটা সম্ভব হলো, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়।
করোনা ভাইরাস বাদুড়ে মারাত্মক রোগ উৎপাদন করে না। বনরুইকেও করে বলে মনে হয় না। কিন্তু মানুষে করে। করোনা ভাইরাসের এই তথ্য এখন সারা বিশ্ব জ্ঞাত হতে পেরেছে। ভাইরাস মানুষের দেহ কোষকে বাধ্য করে ভাইরাস-প্রোটিন ও ভাইরাস-নিউক্লিক এসিড উৎপাদন করতে। এক পর্যায়ে এর জন্য দ্রুত মানব দেহ কোষ ধ্বংস হতে থাকে। মানুষ মারা যায়। ভাইরাসজনিত কারণে আমাদের সর্দি লাগে। আবার ভয়ঙ্কর পোলিও রোগ হয়। তবে পোলিওর টীকা আবিস্কার হওয়ায় রোগটি এখন অত মারাত্মক হয়ে নেই।
চেষ্টা চলছে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা আবিষ্কারের। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমরা জানতে পারব করোনার টিকা আবিষ্কারের কথা। জার্মানী এক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর হতে পেরেছে। টিকা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায়। একসময় গুটি বসন্ত আমাদের দেশে যথেষ্ট হতো। গুটি বসন্ত রোগ নিয়ন্ত্রণে আমরা টিকা নিতাম। বাংলাদেশের অধিকাংশ বয়স্ক লোকের দেহে গুটি বসন্ত টিকার চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ১৯৭৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর গুটি বসন্ত ভাইরাস মুক্ত হতে পেরেছে। গুটি বসন্ত আর এখন আলোচ্য ক্ষতিকর রোগ হিসাবে বিবেচিত নয়। ভাইরাস ধ্বংস করে একটি মারাত্মক ভাইরাস ব্যাধি বিলুপ্ত করা চলে। আমাদের দেশ থেকে দেওযা চলে তার দৃষ্টান্ত।
খবরে আশ্চর্য হলাম যে, জার্মানীর মতো একটি দেশে, যা জ্ঞান-বিজ্ঞানে যথেষ্ট এগিয়ে আছে, তার রাজ্য অর্থমন্ত্রী করোনা ভাইরাসের আক্রমণে জার্মানীর অর্থনৈতিক অবস্থা কি দাঁড়াবে, তার কথা ভেবে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনাটিতে আমি বিস্মিত না হয়ে পারছিনা। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বে চিকিৎসা বিজ্ঞানে সবচেয়ে অগ্রসর দেশ। কিন্তু সেখানে ২০২০ সালের ৩০ মার্চের রিপোর্ট অনুযায়ী ২৪ ঘন্টায় ৫১৮ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ‘বি’ গ্রুপের রক্ত বহন করে। ‘বি’ গ্রুপের রক্ত বহনকারীরা অন্যান্য গ্রুপের রক্তবাহীদের চেয়ে অধিক রোগ প্রতিরোধে সক্ষম। আমরা যাতে সর্দি কম লাগে, সেজন্য নাকে খাঁটি সরিষার তেল দিই। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নাকে খাঁটি সরিষার তেল দিলে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। করোনা ভাইরাস আর সাধারণ সর্দির ভাইরাস একই শ্রেনিভুক্ত। করোনা প্রসঙ্গে অনেক রকম মন্তব্য শোনা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়, যাকে পশ্চিম বাংলার মুসলমানরা সাধারণভাবে ডাকতে আরম্ভ করেছেন ‘মমতা বুবু’, তিনি বলছেন, নরেন্দ্র মোদীর টাকার চেয়ে আযানের ধ্বনির জোর বেশি।
আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম প্যাঙ্গোলিন (Pangolin) নিয়ে। প্যাঙ্গোলিন আমাদের দেশে বহু যুগ ধরে আছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমনের আগে প্যাঙ্গোলিনের কথা আলোচ্য হয়ে ওঠেনি। বাদুড় উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রানী। প্যাঙ্গোলিনও স্তন্যপায়ী প্রানী। কিন্তু তা গাছে থাকে না। তাই বাদুড় থেকে প্যাঙ্গোলিনে কি করে করোনা ভাইরাস আসতে পারল, সেটা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। যদিও প্রানীটি গাছে চড়তে পারে, তবে মাটিতেই থাকে বেশি।
বিলাতের বিখ্যাত পত্রিকা ‘ন্যাচার’ জার্ণালের মতে, চীনে পাচার হওয়া মালয় প্রজাতির বনরুইয়ের মধ্যে করোনা ভাইরাসের দুই ধরণের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাসের সঙ্গে মিল আছে মানুষের শরীরে পাওয়া কোভিড-১৯ এর। চোরাই পথে আসা মালয় প্রজাতির বনরুইয়ের এই ভাইরাস পাওয়া যাওয়ার পর এই প্রশ্নটাও উঠেছে যে, এই প্রজাতির বনরুইয়ের শরীরেই বা ভাইরাস ঢুকল কীভাবে। সেটা কি পাচারের সময় আশেপাশে থাকা বাদুড় থেকে এসেছিল, নাকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের যে প্রাকৃতিক আবাসস্থল, সেখানেই ঘটেছিল?
বলা যায় যে, করোনা মহামারি প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। এক্ষেত্রে আছে মানুষের একটা ভূমিকা। যার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ওলট-পালট হতে চলেছে। আমাদের ভৌগলিক আবহাওয়া করোনা ভাইরাসের অনুকূল নয়। করোনা ভাইরাস উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়ায় দ্রুত সংখ্যায় বাড়তে পারে না। তাই আমাদের দেশে এর প্রকোপ অন্য দেশের মতো হবে না। সাড়ে তিনশত মার্কিন নাগরিক করোনা আক্রমণের ভয়ে বাংলাদেশ পরিত্যাগ করে চলে গেলেন। কিন্তু ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতে হয়, নিজ দেশের তুলনায় এখানেই পেতে পারতেন অধিক নিরাপত্তা।
প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে, বিডি ভিউজে।