বহুভাবেই ইতিহাসকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে

অমর একুশে নিয়ে অনেক পত্রিকায় অনেক কিছুই লেখা হয়েছে। সেসব লেখা পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম ইতিহাসকে কতভাবে ঢেলে সাজানোর প্রচেষ্টা চলেছে, সে সম্বন্ধে। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্টের আগে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না। আজকের বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত হয়েছিল সাবেক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলেই। কিন্তু এখন চেষ্টা করা হচ্ছে হাজার বছরের বাঙালির কথা বলার। কিন্তু হাজার বছর আগে বাংলাদেশের বর্তমান মানচিত্রের কোনো অস্তিত্বই ছিল না।

বর্তমান বাংলাদেশের মানচিত্রটি এ রকম হলো কেন, সেটা নিয়ে ভাবা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, হাজার বছরের বাঙালির কথা। যেন হাজার বছর আগেও বাংলাদেশের মানচিত্র একই রকম ছিল। আমরা ভাবতে চাচ্ছি না, বর্তমান বাংলাদেশের মানচিত্র এভাবে অঙ্কিত হতে পেরেছে কেন। এমনকি ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের মানচিত্র আর বর্তমান বাংলাদেশের মানচিত্র এক নয়। বাংলাদেশ নামটা ব্যবহার করা হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। ভাষাতাত্ত্বিক শ্রী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তার লেখা ‘বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’ বইয়ের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় বাংলা নামের উৎপত্তিকে এইভাবে দেখিয়েছেন : বঙ্গ + আল = বঙ্গাল। এই বঙ্গাল থেকে উদ্ভব হয়েছে বাঙ্গাল নামের। বাঙ্গাল নামের সাথে ফারসি ‘অহ’ প্রত্যয় যোগ হয়ে ফারসি নাম দাঁড়ায় ‘বঙ্গালহ’। এ থেকে মধ্যযুগের বাংলায় উদ্ভব হয় ‘বাঙ্গালা’ নাম। পরে আধুনিক বাংলায় লেখা হতে থাকে ‘বঙ্গ্লা’।

আমরা এখন বলছি, দেশটার নাম বাংলা বা বাঙলা। অর্থাৎ আমাদের দেশের নাম আসলে হলো ফারসি ভাষার। বঙ্গ’র সাথে আল শব্দটা যোগ হয়েছে কেন, তার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আবুল ফজলের লেখা ‘আইন-ই-আকবরি’তে। তিনি তার এই বিখ্যাত বইতে বলেছেন, দেশটিকে আগে বলা হতো বঙ্গ। কিন্তু যেহেতু এখানে ‘আল’ বেঁধে পানি আটকে চাষাবাদ করা হয়, তাই বঙ্গ’র সাথে আল শব্দটি যোগ হয়ে বঙ্গাল নামের উদ্ভব হতে পেরেছে। আল শব্দের মানে স্থানীয় ভাষায় পানি আটকানোর বাঁধ। মধ্যযুগের আগে এই নামের কোনো দেশ ছিল না। যেটাকে বলা হয় এ দেশের ইতিহাসে মুসলিম যুগ, সে যুগেই পাওয়া যায় এই বিশেষ নামটি।

পর্তুগিজরা বাংলার চট্টগ্রামে প্রথম আসে ১৫১৭ সালে। এ সময় বাংলাদেশ শাসন করছেন নসরৎ শাহ। বাবর তার আত্মজীবনীতে নসরৎ শাহকে বাঙ্গালী বলে উল্লেখ করেছেন। এর আগে কোনো সুলতানের নামের সাথে বাঙ্গালী বিশেষণটি কেউ যুক্ত করেননি। নসরৎ শাহ’র আদেশে প্রথম সংস্কৃত থেকে বাংলায় মহাভারত অনূদিত হয়েছিল। একটি বিষয় লক্ষ করার মতো, তা হলো সুলতানি আমলের আগে বাংলা ভাষার কোনো বই এখনো পাওয়া যায়নি। সুলতানি আমল থেকেই কেবল পাওয়া যাচ্ছে বাংলা ভাষায় লিখিত বই, যা আমরা পড়ে বুঝতে পারি। যা পড়ে বুঝতে কোনো বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয় না। চর্যাপদকে এখন আর অনেকেই মনে করছেন না বাংলা ভাষার আদ্যপরিচয় বলে। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞের সাহায্য ছাড়া আমরা বাংলা ভাষাভাষীরা ওইসব পদের কোনো অর্থ উদ্ধার করতে পারি না।

কিন্তু সুলতানি আমলের প্রারম্ভ পর্যায়ের লিখিত বাংলা বই পড়ে আমরা অনেক সহজেই তাদের বুঝতে পারি। এ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় লিখিত সর্বপ্রাচীন যে বইটি পাওয়া গেছে, তা হলো মোহাম্মদ সগীরের লেখা ‘ইউসুফ-জোলেখা’। বইটি তিনি লিখেছেন পারস্যের কবি জামির লেখা ইউসুফ-জোলেখার অনুসরণে। শাহ মোহাম্মদ সগীরকে মনে করা হয় সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ’র শাসন আমলের লোক। সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ’র শাসন আমল ধরা হয় ১৩৯০ থেকে ১৪১০ খ্রিষ্টাব্দ। অর্থাৎ ফারসি ভাষার সান্নিধ্যে এসে আরম্ভ হয় বাংলা ভাষার চর্চা। সুলতানি আমলে সৃষ্টি হতে পেরেছিল বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার একটা বিশেষ পরিবেশ, যা আগে ছিল না। যদিও এ সময় দরবার ও আদালতের ভাষা ছিল ফারসি। কীর্তিবাস ওঝা সুলতান রোকন-উদ-দীন বারবাক শাহ’র রাজত্বকালে অর্থাৎ ৮৬০ থেকে ৮৮১ হিজরির মধ্যে। খ্রিষ্টাব্দ হিসাবে ১৪৫৫ থেকে ১৪৭৬ এর মধ্যে। হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কীর্তিবাস ওঝাকে বধ করতে চান সংস্কৃত থেকে বাংলায় রামায়ণ অনুবাদ করার কারণে।

সুলতান রোকন-উদ-দীন বারবাক শাহ এটা জানতে পেরে কীর্তিবাসের নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা করেন যা থেকে অনেক সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, বাংলার সুলতানেরা বাংলা ভাষা চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। পর্তুগিজরা দেশেটার নাম তাদের ভাষায় লিখতে শুরু করেন ‘বেঙ্গলা’ (Bengala), যা থেকে পরে উদ্ভব হয় ইংরেজিতে ‘বেঙ্গল’ (Bengal) নামের। পর্তুগিজরা এ দেশ কখনো দখল করতে পারেনি। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গ ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহু লোক একসময় পর্তুগিজ ভাষার কথা বলতে পারতেন। পর্তুগিজ ভাষা থেকে বহু শব্দ এসেছে বাংলা ভাষায়। যেমন- বোতল, বোতাম, তোয়ালে, আলমারি, বালতি, জানালা, সাবান, ইস্ত্রি। ফারসি ভাষা বাংলাদেশে দরবার ও আদালতের ভাষা হিসেবে চলেছিল প্রায় ৭০০ বছর ধরে। বাংলা ভাষায় ২০০০-এর বেশি শব্দ এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। ফারসি ভাষায় অনুপ্রবেশ ঘটেছে বহু আরবি শব্দের। ফারসির মাধ্যমে এসব আরবি শব্দ এসেছে বাংলা ভাষায়। বাংলা ভাষা এখন ব্যবহৃত হচ্ছে আড়াই হাজারের ওপর ফারসি ও ফারসি ভাষার মাধ্যমে প্রাপ্ত আরবি শব্দ। যাদের বাদ দিলে বাংলা ভাষা অচল হয়ে পড়বে। কিছু তুর্কি শব্দও এসেছে বাংলা ভাষায়। যেমন- বেগম, কাঁচি, দারোগা, বোচকা।

এসব কথা মনে পড়ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ পড়ে। প্রবন্ধটির নাম হচ্ছে ‘ভাষা আন্দোলন ও সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট’। এই প্রবন্ধটির রচয়িতা রফিকুল ইসলাম। তিনি তার প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির প্রাণ উৎসর্গ করার ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষার সাংবিধানিক মর্যাদার সংগ্রামের পরিণতি কিন্তু এর গভীরে ছিল বাঙালির হাজার বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। উপমহাদেশের বাংলাভাষী পূর্বাঞ্চল কখনো শাসিত হয়েছে কর্নাটকি ব্রাহ্মণ সেন রাজাদের দিয়ে সংস্কৃত ভাষায়, কখনো তুর্কি, কখনো আফগান আবার কখনো মুঘলদের দিয়ে ফারসি ভাষায়। এরপর দীর্ঘ ইংরেজ শাসন ইংরেজি ভাষায়। মোটকথা দশম থেকে বিশ শতকের প্রায় অর্ধাবধি বাংলা ও বাঙালি বহিরাগত বিভিন্ন জাতি, ভাষা ও শক্তি দিয়ে শাসিত, শোষিত, বঞ্চিত হয়েছে।… সাতচল্লিশ সালে দেশবিভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছিল আমাদের জন্য নতুন গোলামির নামান্তর। পাকিস্তানের সূচনালগ্ন থেকেই আমরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রতারণা ও বঞ্চনার শিকার হই। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, বর্ণমালা ও সংস্কৃতি নিয়ে পাকিস্তানিরা শুরু থেকেই যে চরম ছিনিমিনি খেলা করে তারই প্রতিক্রিয়ায় আটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন এবং বায়ান্ন থেকে পঞ্চান্ন সাল পর্যন্ত বাঙালিকে তার ভাষা ও জাতিসত্তা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। সে সংগ্রাম দমনের জন্য পাকিস্তানে সামরিক শাসনের উদ্ভব ঘটে, চলে দুই দশকের চরম জাতিগত নিপীড়ন। এই ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে বাঙালি রুখে দাঁড়ায়।’

প্রথমত প্রশ্ন ওঠে বাঙালি বলতে কাদের বুঝতে হবে। কেননা, সব বাংলা ভাষাভাষী এক রাষ্ট্রের প্রতাকাতলে আসেনি। কেন আসেনি সে প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে অবশ্যই আসবে পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস। যেটাকে বাদ দেয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, যা ছিল একদিন পূর্ব পাকিস্তান, তাই এখন হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই সীমানা অঙ্কিত হয়েছে সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার কারণে। আজকের বাংলাদেশ ব্রিটিশ আমলের বাংলা প্রদেশ ভাগ হয়ে উৎপন্ন হয়নি। হয়েছে সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বিভক্ত হয়েইে। সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যদি একটি ঐতিহাসিক ভুল হয়ে থাকে, তবে বর্তমান বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। যদি পাকিস্তান না হতো, তবে আজকের বাংলাদেশ হতো বর্তমান ভারতের অংশ। আর আমাদের শিখতে হতো হিন্দি। হিন্দি হতো আমাদের রাষ্ট্রভাষা, বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হতে পারত না। রফিকুল ইসলামের যুক্তি বোঝা তাই আমাদের পক্ষে সহজসাধ্য নয়। কিন্তু রফিকুল ইসলামের মতো অনেক লেখক একই কথা বলছেন আর স্বনামধন্য পত্রিকাগুলোতে তা ছাপা হচ্ছে দেদার। রফিকুল ইসলাম যদি ইতিহাস ঘাঁটেন তবে অবশ্যই দেখবেন যে, সুলতানি আমল থেকেই হতে পেরেছে বাংলা নামক দেশের ধারণা। তার আগে বাংলা বলে কোনো রাষ্ট্র ছিল না।

একটা জাতি গড়ে উঠে ইতিহাসের নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে। আমরাও গড়ে উঠেছি ইতিহাসের ধারায়। যেকোনো দেশের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাবে, সেখানে বাইরে থেকে এসেছে নানা মানুষের ধারা। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ইংরেজ আমলে এ দেশে ইংরেজি ভাষার সাহচর্যে হতে পেরেছে আধুনিক বাংলা গদ্যের বিকাশ। যে সাহিত্য নিয়ে আমরা গৌরব করি সে সাহিত্য মূলত সৃষ্টি হতে পেরেছে ব্রিটিশ শাসন আমলে। রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ লাভ করেছিলেন ১৯১৩ সালে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে ইউরোপ শুনতে পেয়েছিল গির্জার গানের প্রতিধ্বনি; কিছুটা প্রাচ্যের রঙে রঞ্জিত আকারে। কিন্তু এটা সম্ভব হয়েছিল ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে, বাংলা ভাষার মাধ্যমে নয়। কিন্তু বিশ্ববাসী জেনেছিল বাংলা বলে একটা ভাষা আছে। বিরাট ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ইংরেজি ভাষার পরেই বাংলা নামক ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারছে।

বাংলাভাষী মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে এখনো যথেষ্ট আলোচনা হয়নি। যতটুকু হয়েছে তা থেকে দেখা যায়, একসময় বাংলার শিক্ষিত মুসলমান পরিবারের ছেলেরা অনেকগুলো ভাষা শিখতেন। মহাকবি আলাওল শিখেছিলেন ফারসি, পুর্বীহন্দি বা কোসলী, উড়িয়া এবং সংস্কৃত। তিনি ফারসি ও কোসলী সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করেছিলেন তার নিজের কাব্যগ্রন্থসমূহ। ‘পদ্মাবতী’ কাব্যগ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন মালি মুহাম্মদ জায়সীর কোসলী বা পূর্বীহিন্দিতে রচিত ‘পাদুমাবৎ’ কাব্যগ্রন্থের অনুসরণে। ‘সেকেন্দারনামা ও ‘হপ্ত-পয়কর’ রচনা করেছিলেন পারস্যের বিখ্যাত মহাকবি ‘নিজামী’ রচিত কাব্যের অনুসরণে। তিনি ‘তোহ্ফা’ বা ‘তত্ত্বোপদেশ’ রচনা করেন ফারসি থেকে। এতে আলোচিত হয়েছে মুসলমান ধর্মের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্পর্কে। এ পর্যন্ত আলাওলের যত লেখা পাওয়া গিয়েছে, তা সবই লিখা হয়েছে ফারসি-আরবি অক্ষরে, বাংলা অক্ষরে নয়। এক সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে ফারসি-আরবি অক্ষরে বাংলা লেখা হতো। এমনকি ব্রিটিশ শাসন আমলেও চট্টগ্রামে ফারসি-আরবি অক্ষরে ছাপিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বাংলা সংবাদপত্র।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মালয়েশিয়ার ‘মালাই’ ও ইন্দোনেশিয়ার ভাষা আসলে হলো একই ভাষা। এগুলো লিখা হতো প্রায় চট্টগ্রামের মতোই একই অক্ষরে। চট্টগ্রামের বাংলা তাই হয়তো লিখিত হয়েছে অনুরূপভাবে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। মালয়েশিয়া বাংলাদেশের অনেক আগেই ইসলামকে গ্রহণ করেছে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে। ইন্দোনেশিয়া এখনো তা করেনি। তবে নিকট ভবিষ্যতে তা করতেও পারে। বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ এখন যাচ্ছেন মালয়েশিয়ায় চাকরি করতে। মালায় ভাষা তাই আমাদের জন্য শেখা আবশ্যিক হয়ে উঠছে। মালায় ও ইন্দোয়েশিয়ার ভাষা প্রায় একই। একটি শিখলে আর একটি শেখা হবে। বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে একটা বিশেষ বন্ধন, যেটা নিয়ে এখনো যথেষ্ট আলোচনা হতে দেখা যাচ্ছে না।

আমরা অতীত নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করছি। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা করতে যাচ্ছি না। অতীত নিয়ে যা আলোচনা করছি তাও হতে চাচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ। প্রমাণের চেষ্টা হচ্ছে পাকিস্তান আন্দোলন ছিল অযৌক্তিক আর সাবেক পাকিস্তকানে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ছিল সাবেক পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের মানুষ দিয়ে শোষিত। কিন্তু পাকিস্তান আমলে ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, যার পক্ষ থেকে ছাপা হতে শুরু হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে বাংলা ভাষায় লিখিত গ্রন্থ। যা ইতঃপূর্বে কখনো প্রকাশিত হয়নি। সাবেক পাকিস্তানে ঢাকাকে করা হয় দ্বিতীয় রাজধানী। ঢাকাকে দ্বিতীয় রাজধানী করার জন্য প্রয়োজনীয় বাড়িঘর তৈরির ভার দেয়া হয় স্থপতি লুই আই কানকে। অর্থাৎ সাবেক পাকিস্তানের চেষ্টা চলেছিল পশ্চিম ও পুবের মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টির। ১৯৭০ সালে নির্বাচন হয়েছিল প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়ার দেয়া লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অনুসারে। যাতে বলা হয়, সাবেক পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন, যা হবে একটি প্রজাতন্ত্র। এর মতাদর্শ হবে ইসলাম। এই বিশেষ অর্ডারে জনসংখ্যা অনুপাতে ভোটার হওয়ার বিধান গৃহীত হয়েছিল। যে কারণে পূর্ব পাকিস্তান পেতে পেরেছিল কেন্দ্রে সংখ্যাগুরু আসন। শেখ মুজিব নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন ইয়াহিয়া প্রদত্ত আইনকাঠামো মেনে। অর্থাৎ তিনি মেনে নিয়েছিলেন সাবেক পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র। জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোনো প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগ কেবল পূর্ব পাকিস্তানেই প্রার্থী দিয়েছিল না, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশ থেকেও দিয়েছিল প্রার্থী। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ দাবি করেনি, সে হলো কেবল পূর্ব পাকিস্তানের একটি দল। সে নিজেকে দাবি করেছিল একটি সর্ব পাকিস্তানি দল হিসেবে। শেখ মুজিব তার ৭ মার্চের বক্তৃতায় নিজেকে দাবি করেছিলেন পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু দলের নেতা হিসেবে। তিনি চেয়েছিলেন সর্ব পাকিস্তানেরই প্রধানমন্ত্রী হতে। সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার পরও শেখ মুজিব চেয়েছিলেন বর্তমান পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক গড়তে। তাই তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ঢাকায় আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখন এসব কথা চেপে যাওয়া হচ্ছে। কেবলই সমালোচনা করা হচ্ছে বর্তমান পাকিস্তানকে। যার নেতারা কোনোভাবেই জড়িত নন আমাদের শাসন ও শোষণের সাথে। কেন পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা না করে তা আরো তিক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে সেটা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট নয়। বর্তমান পাকিস্তান বাংলা ভাষার বিকাশকে রুদ্ধ করার সামর্থ্য রাখে না। আর সে চেষ্টা সে করছে বলেও মনে হয় না। অথচ একুশে ফেব্রুয়ারিতে করা হলো পাকিস্তানের নানা সমালোচনা। যেটা লক্ষ করারই মতো।

ঢাকায় ভাষাশহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয় শহীদ মিনার নির্মাণের। এর ভার পড়েছিল তখনকার ঢাকার খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী হামিদুর রহমানের ওপর। বেসরকারিভাবে তার সহযোগী ছিলেন নভেরা আহমদ। তিনিও ছিলেন না স্থপতি। তিনি ছিলেন ভাস্কর। হামিদুর রহমান যে পরিকল্পনা করেন তা তিনি বাস্তবে রূপায়ণ করার আগেই কলহে জড়িয়ে পড়েন কর্তৃপক্ষের সাথে। তিনি নিজেকে বিযুক্ত করেন শহীদ মিনার তৈরির কাজ থেকে। কলহের কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, যে আর্থিক বরাদ্দ তিনি দাবি করেছিলেন কর্তৃপক্ষ তা প্রদান করতে সম্মত না হওয়া। বর্তমান শহীদ মিনার একটি অসম্পূর্ণ স্থাপত্যকর্ম। কিন্তু অনেকে মনে করছেন এটা একটি উৎকৃষ্ট স্থাপত্যের নিদর্শন। যেটা ভাবার কোনো কারণ নেই, যেহেতু এটা একটি অসম্পূর্ণ স্থাপত্য। অনেকে এটা জানেন না তাই আমি উল্লেখ করছি বিষয়টিকে, অন্য কোনো কারণে নয়। পরে ঢাকার শহীদ মিনার অনুকরণ করে গ্রামেগঞ্জে তৈরি হয়েছে ছোট বড় অনেক শহীদ মিনার। মানুষ ভেবেছে এই অসম্পূর্ণ স্থাপত্যকেই উৎকৃষ্ট স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে, যার অপনয়ন দরকার। শহীদ মিনার এখন হয়ে উঠেছে যেন একটি প্রার্থনার স্থান। তাকে ভাবা হচ্ছে পবিত্র স্থান। তাতে নিবেদন করা হচ্ছে পুষ্পার্ঘ্য। যেমন পূজারিরা প্রতিমা দেন পূজার ক্ষেত্রে। কিন্তু শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল ভাষা শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের লক্ষ্যে, অন্য কোনো কারণে নয়।

পত্রিকা পড়ে জানলাম খালেদা জিয়াকে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনে যেতে হতে হয়েছে নাকি পুলিশি বাধার সম্মুখীন। আমি জানি না, এটা কতটা ঘটনা। যে প্রশ্নটি আমার মনে জাগছে, তা হলো বিএনপির সৃষ্টি হয়েছিল মৌলিক ইসলামি মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার জন্য। কিন্তু শহীদ মিনারে এভাবে পুষ্পার্ঘ্য প্রদান ইসলামি মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেননা, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মধ্যে আছে তিনটি উপাদান : একটি হলো বর্তমান ভৌগোলিক বাংলাদেশ, আর একটি হলো বাংলাভাষা আর তৃতীয়টি হলো ইসলামের স্বাতন্ত্র্য। বাংলাভাষী মুসলমানদের একটি বড় অংশ শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনকে মনে করছেন একত্ববাদের সাথে সাংঘর্ষিক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি শহীদ মিনারে গিয়ে বাংলা ভাষার প্রকাশ শক্তিকে বাড়ানো যাবে না। এর জন্য করতে হবে বাংলা ভাষার চর্চা। করতে হবে বাংলা ভাষায় গ্রন্থ রচনা। আনুষ্ঠানিকতা আমাদের করতে পারে লক্ষ্যভ্রষ্ট। আমি কোনো দিন শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করতে যায়নি। তবে বাংলা ভাষার চর্চা করে গেলাম সারা জীবন ধরে।

কোনো জাতি কেবল রাজনীতি করেই বড় হতে পারেনি। শ্রম করেই হতে হয়েছে সম্পদশালী। আমাদেরও সম্পদশালী হতে হবে শ্রমের মাধ্যমে সম্পদ সৃষ্টি করে। আবেগপ্রবণ না হয়ে হতে হবে কর্মযোগী।

দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬।

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ