বর্তমান বাংলাদেশ একটা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র। মানুষ এখানে চাচ্ছে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে এর রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পারিচালিত করতে। আর উদার গণতন্ত্র বলতে আদর্শ করতে চাচ্ছে ব্রিটিশ গণতান্ত্রিকব্যবস্থাকে। বাংলাদেশ একটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। বাংলা ভাষাকে সাধারণত স্থাপন করা হয় আর্য ভাষা পরিবারে। কিন্তু আর্য ভাষা পরিবারের চেয়ে দ্রাবিড় ভাষা পরিবারভুক্ত ভাষার সাথে যেন আছে বাংলা ভাষার অধিক মিল। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা চলে, অন্য আর্য ভাষায় ক্রিয়াপদ ছাড়া বাক্য গঠন করা যায় না। কিন্তু বাংলা ভাষায় যায়। এ বিষয়ে বাংলা ব্যাকরণের মিল থাকতে দেখা যায় তামিল ভাষার ব্যাকরণের সাথে।
বস্তুগত দিক থেকে দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়ভাষী মানুষের সভ্যতার অনেক মিল থাকতে দেখা যায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সাথে। যেমন, দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড়ভাষী মানুষের মতোই বাংলাভাষী মানুষ সিদ্ধ চালের ভাত খায়। দক্ষিণ ভারতের ধানচাষ পদ্ধতি আর বাংলাদেশের মানুষের ধানচাষ পদ্ধতি একই। বাংলাদেশের মানুষ দক্ষিণ ভারতের মানুষের মতো মাটির দেয়াল দেয়া উলুখড়ে ছাওয়া ঘরে বাস করে। বাংলাদেশের মানুষ উত্তর ভারতের মানুষের মতো ছুরি দিয়ে তরকারি-পাতি কাটে না। দক্ষিণ ভারতের মানুষের মতো কাটে বঁটি দিয়ে। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক দিক থেকে আমরা অনেক বেশি হলাম দ্রাবিড়।
কথাগুলো বলতে হচ্ছে, কারণ প্রশ্ন তোলা হচ্ছে আমাদের জাতিসত্তা নিয়ে। আমরা এখন একটি পৃথক জাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে চাচ্ছি। আর চাচ্ছি নিজেদের রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত করতে। অর্থাৎ আমাদের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র হয়ে উঠছে দু’টি প্রধান আদর্শ বা ভাবনৈতিক বিষয়।
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে জাতিসত্তা সমস্যা ক্রমেই গুরুতর হচ্ছে। ভারত একটি এক জাতির রাষ্ট্র নয়। সে আসলে হলো একটি বহু জাতিক রাষ্ট্র (Poly-National State)। ভারতে জাতিসত্তার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলেছে হিন্দুত্বের আবেগ সৃষ্টি করে। যেটা কখনই বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। যাতে তিনি এক জায়গায় বলেছেন- ‘আমাদের বাঙালির দুইটা দিক আছে। একটা হলো ‘আমরা মুসলমান, আরেকটা হলো আমরা বাঙালি।’
শেখ মুজিবুর রহমানের এই কথাগুলো আমার মনে আসছে। কেননা, সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ২৫ মে (২০১৮) শান্তিনিকেতনে একঘণ্টাকাল একান্তে রাজনৈতিক আলোচনা হতে পারল। যার বিষয়বস্তু এখনো আছে আমাদের কাছে অজানা। তবে আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে মনে হচ্ছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ না জিততে পারে, তবে নাকি বাংলাদেশে এমন এক রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসবে, যারা হবে পাকিস্তানপন্থী। এর ফলে ভারতকে পড়তে হবে দারুণ বিপর্যয়ের মধ্যে। তাই ভারত সরকারের উচিত হবে সর্বপ্রকার চেষ্টা করা, যাতে করে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকতে পারে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী বিজেপি যদি চেষ্টা করে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জেতাবার জন্য, তবে বাংলাদেশের মুসলিম জনসমষ্টি কতটা এই প্রচেষ্টায় সাড়া দেবে, তা বলা যায় না। বরং হতে পারে এর উল্টো প্রতিক্রিয়া। কমতে পারে আওয়ামী লীগেরই ভোট।
বাংলাদেশ একটা মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। বাংলাদেশের ইতিহাস এমন যে, এ দেশের মানুষ বিজেপির হিন্দুত্ববাদকে দিতে পারে না প্রশ্রয় ও আশ্রয়। বাংলাদেশের লাগোয়া হলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ। যাকে এখন মান দেয়া হয়েছে কেবলই ‘বঙ্গ’। এখানে এখন ক্ষমতায় আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি হলেন ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেছেন ইসলামের ইতিহাসে। মুসলিম সভ্যতার প্রতি তার মনে আছে একটা বিশেষ দুর্বলতা। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হতে পেরেছেন বিশেষভাবে মুসলিম ভোট পাওয়ার কারণে। পশ্চিম বাংলার জনসংখ্যার শতকরা ২০ ভাগ হলো মুসলান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের কাছে এখন হয়ে উঠেছে আদরের ‘মমতা বুবু’। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রোহিঙ্গা সমস্যায় নিয়েছেন বাংলাদেশের পক্ষ। তিনি বিরোধিতা করছেন আসাম থেকে বাংলাভাষী মুসলমানদের বিতাড়নের। কিন্তু আসামের প্রাদেশিক বিজেপি সরকার চাচ্ছে বাংলাভাষী মুসলিম বিতাড়ন। নরেন্দ্র মোদি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নিতে রাজি নন। এ হেন একটি পরিস্থিতিতে তিনি উদ্যোগী হয়ে কী করে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে ভোট পেতে সাহায্য করতে পারেন, সেটা বোঝা দুষ্কর।
আমরা জানি না, আসলেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাকে বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে বলেছেন কি না। অন্য দিক থেকেও বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে। কেননা, ভারত যদি আমাদের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে চায়, তবে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইতে পারে হস্তক্ষেপ করতে। কেননা, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, এই শক্তি চাইতে পারে না যে, বাংলাদেশ থাকুক কেবল ভারতের প্রভাব বলয়ে। ফলে আগামী নির্বাচন কতটা মুক্ত ও নিরপেক্ষ হবে, তা বলা যাচ্ছে না।
অনেক কিছু নিয়েই ভাবার আছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। আর্যবাদ জার্মানিতে ঘটিয়েছিল উদার গণতন্ত্রের মৃত্যু। ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিল এডলফ হিটলারকে। জার্মানরা ভেবেছিল তারা হলো খাঁটি আর্য। তাই তাদের অধিকার আছে বিশ্বকে শাসন করার। কিন্তু যুদ্ধ তাদের ঘটিয়েছিল করুণ পরাজয়।
নরেন্দ্র মোদি তার রাজনৈতিক জীবনের একপর্যায়ে ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সাথে জড়িত। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ১৯২৫ সালে ভারতের নাগপুরে প্রতিষ্ঠা করেন কেশব বালিরাম হেজওয়ার। পরে ১৯৩০ সালে এই দলের নেতৃত্ব যায় এমএস গোলয়ালকারের (M S Golwalkar) হাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আরএসএস হয়ে উঠে এডলফ হিটলারের বিশেষ সমর্থক। নরেন্দ্র মোদির হাতে ভারতের গণতন্ত্র কতটা নিরাপদ তা নিয়ে ভারতেই দেখা দিচ্ছে নানা প্রশ্ন। এ হেন নরেন্দ্র মোদির সাথে আওয়ামী লীগের দহরম মহরম বিশ্বের গণতন্ত্রমনা রাষ্ট্রগুলোকে তার ওপর বিরূপ করে তোলায় হবে স্বাভাবিক।
যেহেতু রবীন্দ্রনাথকে কালচারাল হিরো করে বাংলাদেশে রাজনীতি করার চেষ্টা হচ্ছে, তাই পরিশেষে রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ তার শিক্ষার হেরফের প্রবন্ধে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেবার কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ভারতের সবার মাতৃভাষা এক নয়। তিনি তার শেষ জীবনে হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করতে বলেন এবং ১৯৩৯ সালে শান্তি নিকেতনে স্থাপন করেন ‘হিন্দি ভবন’। যেখানে হিন্দি ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষাদানের বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। এর আগে ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তি নিকেতনে স্থাপন করেন ‘চীনা ভবন’। এ সময় চীন ও ভারত ছিল পরম বন্ধু।
কিন্তু বর্তমানে তা আর নয়। চীনা ভবন এখন হয়ে উঠেছে অকেজো। এ হেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ প্রচুর অর্থ ব্যয়ে স্থাপন করল ‘বাংলাদেশ ভবন’। এই ভবনের দিয়ে বাংলাদেশ কীভাবে উপকৃত হবে, তা বোঝা যাচ্ছে না। কেননা বিশ্বভারতী হলো ভারতের একটি পিছিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর চেয়ে ভারতের অন্য আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনেক ভালো লেখাপড়া হয়। বিশ্বভারতী খ্যাতি পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের কারণে। কিন্তু তিনি আর এখন বেঁচে নেই।
আমরা আলোচনা করছিলাম বাংলাদেশের উদার গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ উদার গণতন্ত্রে আস্থাশীল ছিলেন বলে মনে হয় না। তিনি ছিলেন মহামানববাদী। ভাবতেন মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছেন মহামানবেরা। তিনি একটি গান লেখেন ‘ঐ মহামানব আসে’। এই গানের মহামানব কে ছিলেন, তা বলা যায় না। তবে রবীন্দ্রনাথ ইটালির ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিতো মুসলিনীর করেছিলেন যথেষ্ট প্রশংসা। আমরা এই ইতিহাস সম্বন্ধে অবগত নই। আর তাই আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রনাথকে চিত্রিত করতে পারছেন একজন গণতন্ত্রী মানবতাবাদী হিসেবে।