২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবি সে আন্দোলন করছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য। কিন্তু প্রশ্ন চলে আসে, ঐক্যফ্রন্ট ঠিক কী ধরনের গণতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে। কেননা এ পর্যন্ত বাংলাদেশে একাধিক ধরনের গণতন্ত্রের উদ্ভব হতে পেরেছে। ভারতের মতো ব্রিটিশ গণতন্ত্রের মূলধারা প্রবহমান থাকেনি।
বর্তমান বিশ্বে আমরা প্রধানত তিন ধরনের গণতন্ত্র দেখতে পাই। এরা হলো প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির গণতন্ত্র, পার্লামেন্টারি পদ্ধতির গণতন্ত্র আর আধা-প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির (Semi presidential) গণতন্ত্র। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির গণতন্ত্রের আদর্শ দৃষ্টান্ত হলো বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে সাধারণত ধরা হয় গ্রেট ব্রিটেনকে; আর আধা-প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি গণতন্ত্রের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয় ফ্রান্সকে। ফ্রান্সে মানুষ যেকোনো দেশের মানুষের তুলনায় অনেক বেশি ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগ করে। কিন্তু তথাপি এরা পারেনি গ্রেট-ব্রিটেনের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে। ফ্রান্সে গড়ে উঠেছিল যাকে বলে নেগেটিভ গণতন্ত্র।
ফ্রান্সে একসময় ঘটত ঘন ঘন মন্ত্রিসভার পতন। যেমন- ফ্রান্সে তৃতীয় রেপুবলিক চলেছিল একটানা সত্তর বছর। কিন্তু এ সময় তার মন্ত্রিসভার পতন ঘটেছিল ১৬০ বার। ফ্রান্স চলেছে প্রধানত তার দেশপ্রেমিক আমলাতন্ত্রের নির্দেশে। সরকারের ধারাবাহিকতা প্রবহমান থেকেছে তাদের মাধ্যমে। ফ্রান্সে আমলাতন্ত্র প্রাবল্য পেয়েছে। ব্যুরোক্র্যাসি শব্দটি ফরাসি। ইংরেজি ভাষায় শব্দটি এসেছে ফরাসি ভাষা থেকে। এ রকম একটা সরকার চাই দেশকে ভেতর থেকে দুর্বল করে তুলতে। যদিও ব্রিটেনের পর ফ্রান্সের সাম্রাজ্য হয়েছে সবচেয়ে বড়।
ফ্রান্সের ইতিহাসে যাকে বলে চতুর্থ রেপুবলিক, তা চলেছিল ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। চতুর্থ রেপুবলিক টিকে ছিল প্রায় ১২ বছর। এই ১২ বছরে ফ্রান্সে মন্ত্রিসভার পতন ঘটেছিল ২০ বার। তাই বলা যায় না ফ্রান্সের ভোট ছিল, আর তাই ছিল গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের জন্য ভোট প্রয়োজন। ভোট না থাকলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। অথচ ভোট থাকলেই যে যথাযথ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উদ্ভূত হয় তা কিন্তু নয়।
আমরা বাংলাদেশে ভোট ও গণতন্ত্রকে সমার্থক করে তুলতে চাচ্ছি। যেটা যথাযথ হচ্ছে বলে মনে করার কোনো বুনিয়াদ নেই। আধুনিক ফ্রান্সের জনক হলেন জেনারাল দ্য গোল। তিনি একটি সামরিক ক্যু দেতার মাধ্যমে ফ্রান্সে ক্ষমতায় আসেন ১৯৫৮ সালের মে মাসে। তিনি ক্ষমতায় আসার পর ফ্রান্সে প্রবর্তন করেন আধা প্রেসিডেন্ট ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় যেমন থাকেন প্রেসিডেন্ট, তেমনি আবার থাকেন প্রধানমন্ত্রী। তবে প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা থাকে বেশি। প্রেসিডেন্টের হুকুম ছাড়া মন্ত্রীসভার পতন হতে পারে না। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে মন্ত্রিসভা পেতে পারে অনেক স্থায়িত্ব।
প্রেসিডেন্ট দ্য গোল ক্ষমতায় এসে যে কাজটি প্রথম করেন তা হলো : ফরাসি মুদ্রাব্যবস্থার সংস্কার, যা ফরাসির মুদ্রাস্ফীতি সমস্যাকে সমাধান দিতে পারে। দ্য গোল মনে করতেন, সমাজতন্ত্র নয়; মুক্তবাজার অর্থনীতি চাই। কিন্তু মুদ্রানীতির ওপর থাকতে হবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ। তা না হলে বাড়তে চাইবে লাগাম ছাড়া ভাবে দ্রব্যমূল্য। ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য চাই একটা দেশের মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতার স্থিরতা। সাবেক পাকিস্তানে একটি সামরিক ক্যু দেতার মাধ্যমে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসেন ১৯৫৮ সালের আক্টোবর মাসে। আইয়ুব কিছুটা প্রভাবিত হন ফ্রান্সের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে।
তিনিও গ্রহণ করেন ফ্রান্সের মতো আধা প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। সাবেক পাকিস্তান ভেঙে হয় বাংলাদেশ। যা ছিল একদিন পূর্ব পাকিস্তান তাই হয়েছে এখন বাংলাদেশ। বর্তমান বাংলাদেশের উদ্ভবের মূলে আছে পাকিস্তানের অভ্যুদয়। পাকিস্তান না হলে আজকের বাংলাদেশ হতো না। সেটাকে ধরা চলে শতসিদ্ধ হিসেবে। বাঙালি হিন্দু কোনো দিনই চাননি বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে। তাই সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষ আসতে পারেনি একটি রাষ্ট্রের পতাকাতলে। বাংলা যাদের মাতৃভাষা তাদের প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ বাস করেন বাংলাদেশে। আর বাদবাকি প্রায় ৪০ ভাগ বাস করেন ভারতে।
আজকের বাংলাদেশ মূলত সৃষ্টি হতে পেরেছে বাংলাভাষী মুসলমান থাকারই কারণে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় বাংলাভাষী মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন হতে চেয়েছেন। কিন্তু চাননি আর কোনো রাষ্ট্রের সাথে মিশে যেতে। আর এখনো তাদের মধ্যে বিরাজ করছে সেই একই মানসিক বাস্তবতা।
১৯৭৫ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। তার ওপর থেকেছে বেশ কিছুটাই আইয়ুব খানের প্রভাব। তিনিও গ্রহণ করেন আধা পেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা। তার অর্পিত ব্যবস্থায় যেমন ছিল প্রেসিডেন্ট, তেমনি আবার ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। যদিও প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা ছিল বেশি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসেন আধা প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে। বর্তমান ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি পদ্ধতির শাসনব্যবস্থার দাবি তোলেন শেখ হাসিনা, কতকটা ভারতের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে।
বেগম জিয়া শেখ হাসিনার দাবি মেনে নেন। দেশে প্রবর্তিত হয় বর্তমান পার্লামেন্টারি পদ্ধতির গণতন্ত্র। কিন্তু শেখ হাসিনা নিজেই এখন যেন আর মানতে রাজি হচ্ছেন না পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ধারা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের নতুন নির্বাচনের আগে পুরনো পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। পুরনো কেবিনেট কাজ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে। পুরনো কেবিনেট কাজ চালিয়ে চলে ধরাবাধার বিষয়ে। তারা কোনো নতুন আইন তৈরি করে না। অথবা নিতে যায় না কোনো গুরুতর সিদ্ধান্ত। নির্বাচনের ব্যাপারে থাকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। কিন্তু আমাদের দেশে এখন পুরনো পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া হচ্ছে না। কেবিনেট নিতে পারছে গুরুতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত।
দেশে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবেই। কেননা, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে বাংলাদেশে নির্বাচন হোক। তার চাপকে এড়িয়ে যাওয়া নানা কারণে আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বিএনপিকে তাই আসতে হচ্ছে নির্বাচনে। যেহেতু বেগম জিয়া রাজবন্দী নন, তার শাস্তি হয়েছে ফৌজদারি অপরাধে, তাই তিনি ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কি না সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। একই কারণে স্পষ্ট নয় তারেক রহমান নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কি না।
বাংলাদেশে পরিবারতন্ত্র প্রাধান্য পাচ্ছে। জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন পরিবারতন্ত্রের ঘোর বিরোধী। তিনি চেয়েছিলেন পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বিপক্ষে আইন প্রণয়ন করে যেতে; কিন্তু তিনি তা পারেননি। পারলে সেটা হতে পারত বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য খুবই মঙ্গলজনক। জেনারেল জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন ফরাসি ধাঁচের গণতন্ত্র। অর্থাৎ আধা প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি। যাতে সরকারের থাকতে পারে স্থিতিশীলতা ও কর্মদক্ষতা। অর্থনীতিতে তিনি অনুসরণ করতে চান মিশ্র অর্থনীতি। আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনি অনুসরণ করতে চান বাংলাদেশী সংস্কৃতি। এ কারণে তিনি পেতে পেরেছিলেন দেশবাসীর বিরাট অংশের বিশেষ আস্থা ও শ্রদ্ধা। যেটা এখন হতে পারছে দল হিসেবে বিএনপির রাজনৈতিক পুঁজি।