ডেঙ্গু জ্বর বাংলাদেশে আগে হতো কিনা আমাদের তা জানা নাই। ডেঙ্গু বাংলাদেশে প্রায় মহামারি আকারে দেখা দেয় ২০০০ সালে সেপ্টেম্বর মাসে। ডেঙ্গু জ্বর এসময় ঢাকা শহরে মহামারির আকারে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এবারের মত তা ছড়িয়ে পড়েনি ঢাকা শহরের বাইরে। রোগটি উত্তর আফ্রিকায় যথেষ্ট হয়। হতে পারে বাংলাদেশ থেকে মানুষ উত্তর আফ্রিকায়, বিশেষকরে লিবিয়াতে চাকুরি করতে যেয়ে বহন করে এনেছে এই রোগের জীবানু। উত্তর আফ্রিকায় রোগটি প্রাণঘাতী নয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখন তা হয়ে উঠেছে প্রাণঘাতী।
এই রোগের জীবানু একরকম ভাইরাস। ভাইরাসরা খুব ছোট রোগ-জীবানু। এদের দেহের ব্যাস শূণ্য দশমিক এক মাইক্রোণ (১ মাইক্রোণ=১ মিলিমিটারের ১০০০ ভাগের এক ভাগ)। ইলেক্ট্রোন মাইক্রোসকোপের সাহায্যে ডেঙ্গু ভাইরাসের ছবি তোলা হয়েছে। এরা দন্ডাকৃতির। এদের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এরা হলো রাইবো ভাইরাস। রাইবো ভাইরাসদের দেহে থাকে কেবল রাইবো নিউক্লিয়িক এসিড। ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস আর ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের ভাইরাস হলো একই শ্রেণির। আমাদের দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর কখনও প্রাণঘাতী হয়ে ওঠেনি। ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস একজন ডেঙ্গু জ্বর আক্রান্ত রোগীর দেহ থেকে সুস্থ মানুষের দেহে নীত হয় মশকের দ্বারা। এই মশকের নাম রাখা হয়েছে Aedis aegypti । এই মশার পুরুষ মশারা রোগটা ছড়ায় না। রোগটা ছড়ায় কেবল এই মশার প্রজাতিভুক্ত মেয়ে মশারা। কারণ এই মশার পুরুষ মশারা মানুষের রক্ত পান করেনা। কেবল মেয়ে মশারাই মানুষের রক্ত পান করে। পুরুষ মশা বাঁচে গাছের পাতার রস খেয়ে। মানুষের বা অন্য প্রাণীর রক্ত খেয়ে নয়।
ডেঙ্গু কেবল মানুষের হয় না। বানরের হয়। কুকুরেরও হয়। যেসব রোগ মশার মাধ্যমে ছড়ায়, তাদের হাত থেকে বাঁচবার একটা উপায় হলো ঠিকমত মশারী টাঙ্গিয়ে ঘুমানো। যাতে মশা না কামড়াতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। এই টিকার ব্যবহার করেও আমরা রোগটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। জানিনা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কেবল ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশক নিধনের উপর আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা এতো অধিক গুরুত্ব আরোপ করছেন, মানুষকে টিকা দেবার উপর গুরুত্ব আরোপ না করে। ম্যালেরিয়া হয় একশ্রেণির প্রটোজোয়া বা এককোষী প্রাণির জন্য। যা আক্রান্ত রোগীর দেহ থেকে সুস্থ মানুষের দেহে নীত হয় Anopheles maculipennis প্রজাতির স্ত্রী মশাদের দ্বারা। যারা মানব দেহের রক্ত পান করে বাঁচে।
বাংলাদেশে একসময় ম্যালেরিয়া একটা মারাত্মক রোগ ছিল। কিন্তু এখন আর তা নয়। কারণ আমরা এই রোগের জীবানু বহনকারী মশাকে ডিডিটি নামক কীটনাশক ছড়িয়ে নিধন করতে পেরেছি। কিন্তু এটা করতে যেয়ে বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছে। ডিডিটি এখন কীটনাশক হিসাবে আর ব্যবহার করা হচ্ছে না। কারণ তা হয়ে উঠতে পারে অন্য প্রাণির এবং মানুষের জন্যও ক্ষতিকর। পাকিস্তান আমলে একদল বিশেষজ্ঞের অনুমোদনে পূর্ব-পাকিস্তানের কৃষিবিদরা কীটনাশক হিসাবে আমদানী করেছিল মারাত্মক বিষাক্ত পদার্থ এনড্রিন। কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট সতর্ক হতে হবে। না হলে তার দ্বারা আমরা হতে পারি বিষেশভাবে ক্ষতিগ্রস্থ।ডেঙ্গু জ্বরের কোন চিকিৎসা নাই। কোন ব্যক্তির এই জ্বর হলে তাকে রাখতে হবে মশারির মধ্যে। যাতে করে ডেঙ্গু ভাইরাস বহকারী মশা তার রক্ত পান করার পর কোন সুস্থ মানুষকে কামড়াতে না পারে। এটা করলে রোগটির বিস্তার অনেক পরিমাণেই কমে যাবে। রোগটার বিস্তার বন্ধ করতে পারা হওয়া উচিত আমাদের আশু লক্ষ্য।
একসময় গুটি বসন্ত বাংলাদেশে একটা মারাত্মক ব্যাধি ছিল। কিন্তু গুটি বসন্তের ভাইরাস এখন ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে অথবা পৃথিবীর আর কোন দেশে এখন আর গুটি বসন্ত হচ্ছে না। বাংলাদেশ গুটি বসন্ত মুক্ত দেশে পরিণত হতে পেরেছে ১৯৭৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর। একটা মারাত্মক ব্যাধিকে চিরতরে নির্মূল করা সম্ভব। গুটি বসন্ত নির্মূলকরণ তার একটি উজ্বল দৃষ্টান্ত। গুটি বসন্তের (small pox) তুলনায় ডেঙ্গু জ্বর কোন মারাত্মক ব্যাধি হিসাবে বিচার্য হতে পারে না। ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে দেশে আরম্ভ হয়েছে রাজনীতি। যেটা হওয়া উচিৎ নয়।
প্রকাশিত হয় বিডিভিউজে, ২০২০ সালে।