বাংলাদেশে ধানচাষে বিপর্যয়

ধানগাছ জলাভূমির উদ্ভিদ। বাংলাদেশে খাল-বিল, নদী-নালার ধারে বুনো ধানগাছ (Oryza sativa var fatua, Prain.) যথেষ্ট হতে দেখা যায়। যাকে সাধারণ বাংলায় বলা হয় ঝরাধান। অনেকে মনে করেন এই ঝরাধান থেকেই মানুষের নির্বাচনের মাধ্যমে উদ্ভব হতে পেরেছে আজকের আবাদি ধানের। বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলে মানুষ বহুদিন আগে থেকেই ধান চাষ করে আসছে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভুম জেলার মহিষাদল নামক জায়গায় মাটি খুঁড়ে একটি মৃৎ পাত্রে কিছু কয়লা হয়ে যাওয়া ধান পাওয়া গিয়েছে। রেডিও একটিভ-কার্বন ১৪ পদ্ধতিতে এই কয়লা হয়ে যাওয়া ধানের বয়স নির্ণীত হয়েছে ১৩৮০ থেকে ৮৫৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে। অনেকে মনে করেন, বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলে মানুষ প্রথম ধানচাষ শুরু করে এবং পরে তা ছড়িয়ে যায় অন্যত্র। তবে এ ব্যাপারে ভিন্নমতও আছে। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদন করে মহাচীন। তারপর ভারত। এরপরে আসে জাপান ও বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চতুর্থ ধান উৎপাদনকারী দেশ। বাংলাদেশের কৃষক যত কম পুঁজি নিয়োগ করে ধান উৎপাদন করেন সেটা বিস্ময়কর। তবে ধান উৎপাদনে আমরা যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছি, তা বোধ হয় নয়। তবে সেটা হওয়ারই পথে। কেননা, সরকার থেকে এখন ধান আমদানির ওপর আমদানিশুল্ক বসানো হয়েছে। যাতে করে বাইরে থেকে ধান আমদানি হয় কম।

১৯৬০-এর দশকের আগে বাংলাদেশে যেসব ধানের আবাদ হয়, তাদের চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হতো। এগুলো হলো : আমন, গভীর পানির ধান, আউশ এবং বোরো। আমন ধানের মধ্যে রোপা আমন ছিল প্রধান। বাংলাদেশেই যে পরিমাণ ধানের আবাদ হতো তার শতকরা ৭৫ ভাগ ছিল রোপা আমন। এই ধান জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে বীজতলায় বীজ বুনে যে ধানের চারা হতো তাকে তুলে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ধানক্ষেতে কাদা করে সেই কাদার মধ্যে রোপণ করা হতো। এই ধান কাটা হতো কার্তিক মাস থেকে শুরু করে পৌষ মাস পর্যন্ত। এই ধান বছরে সব সময় আবাদ করা যেতো না। কেননা, এই ধানের ফুল ও ফল (ধান আসলে ফল) হতে প্রয়োজন হতো স্বল্প দিবালোকের। দিবালোক বেশি হলে ধানগাছ বেড়ে উঠত, কিন্তু ফুল হতো না।

যাকে বলা হতো গভীর পানির ধান, তা আসলে হলো আমন ধান। এই ধানেরও ফুল-ফল হতে লাগত স্বল্পদৈর্ঘ্য দিন। এ দিক থেকে এই ধান ছিল আমন ধানেরই মতো। এই ধান লাগান হতো ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসের মধ্যবর্তী সময়ে। এই ধান সেই সব জায়গায় লাগান হতো, যেসব জায়গা বর্ষাকালে পানিতে ডুবে যায়। আর এই পানি থাকে পাঁচ-ছয় মাস ধরে পাঁচ থেকে ১২ ফিটের কাছাকাছি। এই ধানের বৈশিষ্ট্য হলো, পানি যত বাড়ে ধান গাছের দৈর্ঘ্যও তত বাড়ে। কোনো কোনো সময় এই ধান দিনে এক ফিট লম্বা হতেও দেখা যায়। ধানের শিষ পানির উপরে হয়। এই ধান কাটতে হয় নৌকায় করে। তাই এই ধানকে অনেক সময় বাওয়া ধানও বলে। এই ধান লাগানো হতো বীজধান ছিটিয়ে।
যাকে বলা হতো আউশ ধান, তাকে বছরের যেকোনো সময় লাগান যেতো। কিন্তু এই ধানের ফলন উচ্চ তাপমাত্রায় হতো ভালো। নিম্ন তাপমাত্রায় এর ফলন হতো কম। এই ধানকে সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ছিটিয়ে বোনা হতো এবং কাটা হতো শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে। এ জন্যএই ধানটিকে ভাদই ধানও বলা হতো। প্রকারভেদে এ ধানটি চাষে লাগত ৮০ থেকে ১২০ দিন।

যাকে বলা হতো বোরো ধান, তা হতে লাগত কম তাপমাত্রা। এই ধান খুব নিচু জমিতে আবাদ করা হতো। যেখানে পানি একেবারে শুকিয়ে যেতো না। কার্তিক মাসে বীজতলায় বীজ বুনে পৌষ-মাঘ মাসে নদী-তীরবর্তী বা বিল জমিতে পানি সরে যাওয়ার সাথে সাথে এই ধানের চারা রোপণ করা হতো এবং কাটা হতো সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ মাসে। কিন্তু এই ধান খুব আদ্রিত ছিল না। কেননা এর ভাত হজম করা ছিল কষ্টকর, চালে বেশি মাড় থাকার কারণে। অনেক জায়গায় এই ধান লাগানো হতো কেবল গো-খাদ্যের জন্য।

উপরে আমরা যে ধানচাষের বিবরণ দিলাম, সেই ধারা এখন আর অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এই ধারা না হওয়ার কারণ, আমরা এখন যেসব ধানের আবাদ করছি তা আর আমাদের সনাতন ধান নয়। আমরা এদের পেয়েছি বিদেশ থেকে। এদের উদ্ভাবন ঘটেছিল ফিলিপাইনের অন্তর্গত লস বেনোস-এর আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রে। এইচ এম বিচেল ১৯৬২-৬৩ সালে উদ্ভাবন করেন ইরি-৮ ধান (IRRI= International Rice Research Institute)। এই ইরি-৮ লাগনো শুরু হয় বোরো মওসুমে। আর এই ধানকে বলা হতে থাকে বোরো ইরি। আমাদের আমন ধানের জায়গায় লাগানো হতে থাকে ইরি-২০। আমাদের দেশের সনাতন ধান বাদ পড়ে যায়। ইরি ধানের বৈশিষ্ট্য হলো এদের বছরের যেকোনো সময় লাগানো যায়। এদের বীজের কোনো সুপ্ত অবস্থা নেই। আমাদের সনাতন ধানের বীজের সুপ্ত অবস্থা ছিল। বীজের সুপ্ত অবস্থা বলতে বোঝায়, ওই বীজকে একটি সময় পর্যন্ত লাগানো চলে না। লাগালে বীজটি অঙ্কুরিত হতে চায় না। কিন্তু ইরি ধান পাকলে সেই ধান ক্ষেত থেকে বীজধান নিয়ে ঠিক পরে পরেই আবার লাগানো চলে। ফলে একটি জমিতে দুইবার অনেক সহজে ধান আবাদ করা চলে। অর্থাৎ এক ফসলি জমিকে করে তোলা যায় দু’ফসলি। ইরি ধানের গাছ লম্বা হয় না। এই ধানগাছ হলো বেটে ( ৬০ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি অর্থাৎ দুই ফিটের মতো)। এই ধানগাছ তাই অনেক সহজে খাড়া হয়ে থাকতে পারে। মাটিতে হেলে পড়ে না। তাই ধানের শীষ সহজে নষ্ট হতে পারে না। এর পাতা হয় অনেক খাড়াখাড়া। এর পাতায় তাই সূর্যালোক পড়তে পারে অনেক বেশি। কিন্তু যেহেতু এই ধান হলো বেটে জাতের, তাই বন্যার পানিতে সহজেই ডুবে নষ্ট হতে পারে। যেমন এবার হতে পারল। গত বছর চৈত্র মাসের শেষ ভাগে এবং এ বছরের (১৪২৪) বৈশাখ মাসের প্রথম ভাগে প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় ধানগাছ ডুবে গেল। ধানগাছ অবশ্য ডুবত না, যদি পানি নিকাষী (Drainage) ব্যবস্থা থাকত। তাই দাবি উঠছে পানি নিকাষী ব্যবস্থা করার। ৩৫ বছর পর এবার এভাবে এতটা বৃষ্টি হতে পারল। যদি আমরা ইরি ধানের আবাদ না করতাম, তবে আমাদের ধানচাষে এরকম বিপর্যয় আসত বলে মনে হয় না।

আগে মানুষ গভীর পানির ধান অনেক আবাদ করত। কিন্তু এখন আর করছে না। গভীর পানির ধানের ফলন খুব কম ছিল না। আর তারা পানিতে ডুবত না। এই ধানের উৎপাদন খরচও ছিল কম। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, আমাদের সনাতন ধান মাটি থেকে যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করত, ইরি ধান করে তার প্রায় ১৩ গুণ বেশি। ইরি ধানে তাই প্রদান করতে হয় আমাদের সনাতন ধানের চেয়ে অনেক বেশি সার। তা না হলে জমির উর্বরতা বজায় থাকে না। আমাদের বহু জমিতেই ইতোমধ্যেই দস্তার অভাব দেখা গেছে, যা ইতঃপূর্বে ছিল না। আমাদের দেশে এখন পানির অভাব হচ্ছে। আমাদের দেশে যথেষ্ট বৃষ্টি হয়। কিন্তু সারা বছর হয় না। আমরা যদি বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারি, তবে আমরা তার সাহায্যে আমাদের অন্য খাদ্যশস্যের আবাদ বাড়িয়ে খাদ্য সমস্যার সামাধান করতে সক্ষম হতে পারি। আমাদের দেশে শীতকালে এখন গম ও গোলআলুর চাষ বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে গোলআলু হতে চাচ্ছে আমাদের প্রধান খাদ্য-ফসল। শীতকালে অর্থাৎ রবি মওসুমে সেচব্যবস্থা জোরাল করতে হবে। তাহলে বোরো ধানে ক্ষতি হলে দেশ পড়বে না খাদ্য সমস্যার মধ্যে।

বাংলাদেশে অনেক বিল আছে। বিলগুলো সৃষ্টি হতে পেরেছে দুইভাবে। অনেক বিল হলো নদীর পুরনো খাত, যাতে শীতকালে পানি থাকে না। কিন্তু বর্ষাকালে ভরে উঠে বৃষ্টির পানিতে। আর এক রকম বিল আছে, যার সৃষ্টি হতে পেরেছে মাটি দেবে নিচু হয়ে যাওয়ার ফলে। এই নিচু জমিতে জমে থাকে পানি। হাওর হলো এরকমই বিল। হাওরের মাটি খুঁড়ে ৫০-৬০ ফিট নিচে পাওয়া গেছে গাছের গুঁড়ি। যা থেকে প্রমাণিত হয়, ওই সব জায়গায় এক সময় বড় বড় গাছ হতো, তারপর মাটি দেবে গেছে। অন্য জায়গা থেকে পানিতে বয়ে আসা মাটি জমেছে মরে যাওয়া গাছের গুঁড়ির ওপর। সিলেট বিভাগে অনেক হাওর আছে। যাদের সৃষ্টি হয়েছে মাটি দেবে যেয়ে। আমরা লিখছি হাওড়। অনেকে লিখেন হাওর। এই দুই বানানই চলে।

যতদূর জানি হাওড় শব্দটা আরবি ভাষার। আরবি থেকে তা বাংলাভাষায় এসেছে ফারসি ভাষার মাধ্যমে। হাওড় মানে জলাভূমি (Marshy Land)। জলাভূমির একটা বৈশিষ্ট্য হলো, এতে এমন অনেক গাছ হয়, যার শিকড় থাকে পানির নিচে মাটিতে। কিন্তু বিটপ থাকে পানির ওপরে। হাওরে সব উদ্ভিদ পানির ওপর ভাসমান অবস্থায় থাকে না। তাদের শিকড় থাকে মাটিতে প্রোথিত। সিলেট অঞ্চলে মাটি এখনও দেবে যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে বাড়তে পারে হাওরের পরিমাণ। অধিক বর্ষণের ফলে কেবল সিলেট বিভাগের হাওরেই পানি উপচিয়ে যে ফসলের ক্ষতি হয়েছে, তা নয়। প্রবল বর্ষণের ফলে চলন বিলে পানি বেড়ে তা উপচিয়ে ক্ষতি করেছে তার আশেপাশের অনেক ফসল। কিন্তু পত্রিকার খবর পড়ে মনে হচ্ছে, কেবল হাওর অঞ্চলেই ক্ষতি হতে পেরেছে, যেটা সত্য নয়।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আগেকার দিনে বোরো ধানের যথেষ্ট ক্ষতি হতো শিলাবৃষ্টি ও কালবৈশাখীর ঝড়ে। কৃষকরা তাই তাড়াতাড়ি কাটতেন এই ধান। ফেলে রাখতেন না খেতে। ধানের অনেক ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু সেটা হতো না যথাসময়ে ধান কেটে নিলে। ধানের ক্ষতি হওয়ার একটি কারণ হলো কৃষকের ধান কাটতে গড়িমসি। অনেক দেশেই এখন কৃষি আবওহাওয়া দফতর থেকে কৃষককে আবওহাওয়া সম্পর্কে অগ্রিম সতর্কতা প্রদান করা হয়। আমাদের দেশেও এ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে ধান ডোবার কারণ হলো মানুষের কার্যকলাপ। আমাদের দেশে উত্তর দিক হলো উঁচু। আর দক্ষিণ দিক হলো নিচু। সাধারণত তাই বৃষ্টির পানি উত্তর থেকে দক্ষিণে গড়াতে চায়। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক জায়গায় সড়ক বানানো হচ্ছে পূর্ব-পশ্চিম করে। আর তাতে রাখা হচ্ছে না যথাযথ সংখ্যায় পানি-কপাট। ফলে বৃষ্টির পানি স্বাভাবিকভাবে গড়িয়ে যেতে পারছে না। এর ফলে ডুবছে ধান। ধান ডোবার কারণে পত্রিকায় বলা হচ্ছে, বিরাট ত্রাণব্যবস্থা করার কথা। কিন্তু এই ত্রাণব্যবস্থার খরচ জাতি হিসেবে আমরা কতটা বহন করতে পারি? একজন অভুক্ত মানুষকে অবশ্যই অন্ন প্রদান করতে হবে। কিন্তু আর একজন মানুষকে ক্ষুধাগ্রস্ত করে নয়। সরকারের অর্থ হলো কর প্রদানকারীদের অর্থ। কিন্তু এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের কর প্রদানের ক্ষমতা হলো খুবই সীমিত। এই সীমিত অবস্থার কথা বিবেচনায় রেখে করতে হবে ত্রাণ আয়োজন।

দৈনিক নয়াদিগন্ত/০৫ মে ২০১৭। 

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ