আজ এমন একটা বিষয় নিয়ে লিখতে যাচ্ছি, যেটা ঠিক আমার চিন্তাচেতনার এলাকায় পড়ে না। কিন্তু তথাপি এ বিষয়ে সামান্য কিছু বলতে যাচ্ছি, কেননা বিষয়টিকে করে তোলা হচ্ছে রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দুইজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হয়েছেন বলাৎকারের শিকার। আর তাদের নিয়ে হচ্ছে পত্রপত্রিকায় যথেষ্ট আলোচনা। কিন্তু যেটা সাধারণভাবে বোঝা যাচ্ছে না, তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী দু’জন কিভাবে বলাৎকারীদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। আর কেনই বা তারা হোটেলে তাদের একজনের জন্মদিন উপলক্ষে কৃত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। বলাৎকারীরা যে ভালো লোক নয় সেটা অনেকেই জানতেন। তাই নানারূপ সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছে। এরা আসলেই কেমন ছাত্রী তা নিয়েও সৃষ্টি হতে পারছে বিশেষ সন্দেহ। এই ছাত্রী দু’জন বলাৎকারের শিকার হননি, তাদের নিজের আবাসস্থলে। অথবা দিল্লির মেডিক্যাল ছাত্রীর মতো বলাৎকারের শিকার হননি রাজপথে চলন্ত বাসে। ঘটনাটিকে মনে হচ্ছে একটি বিশেষ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। আদালতে মামলা হয়েছে, বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে কিছু বলা সঙ্গত হবে না। কিন্তু এই দুই ছাত্রীকে অবশ্যই পড়তে হবে উকিলের কঠিন জেরার মুখে। ধর্ষণের প্রমাণ তাদের দিতে হবে। যেটা যথেষ্ট সহজসাধ্য হবে না। কেননা, তারা হোটেলে গিয়েছিলেন স্বেচ্ছায় এবং এমন এক ব্যক্তির জন্মদিনে, যার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আন্তরিক পরিচয় সমর্থনীয় হতে পারে না।
কিন্তু আমাদের দেশের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর এই প্রসঙ্গে একটি সংবাদ নিবন্ধ লিখেছেন ‘বাংলাদেশে নৈরাজ্য’ নামে (যুগান্তর, ২১ মে ২০১৭)। তিনি তার লেখায় বলতে চেয়েছেন, বাংলাদেশের সব ধনী ব্যক্তি যেন হয়ে উঠেছেন ধর্ষক। এটা হলো ধনতান্ত্রিক সমাজেরই একটা ঘৃণ্য প্রতিচ্ছবি। কিন্তু ইতিহাস বলে, কেবল ধনতান্ত্রিক সমাজেই যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এমন নয়। ফিউডাল বা সামন্ত সমাজেও ছিল ধর্ষণের ঘটনা। বরং ধনতান্ত্রিক সমাজের চেয়ে সে সময় এই ঘটনা ছিল আরো ভয়ঙ্কররূপে। বাংলাদেশে সিন্দুকী বলে একদল লোক ছিল, যারা গ্রামগঞ্জ থেকে সুন্দরী মেয়ে অথবা গৃহবধূকে চুরি করে নিয়ে বিক্রি করত জমিদার রাজাদের কাছে। সেরকম নারী চুরি বর্তমান সমাজে ঘটছে বলে শোনা যায় না। রাজশাহী অঞ্চলে মাইফুল রাজার কাহিনী যথেষ্ট প্রচলিত। একজন স্নানরত গৃহবধূকে তিনি ধরে নিয়ে চলে যান। মাইফুল রাজার কাহিনীতে এই গৃহবধূকে বিলাপ করতে দেখা যায়, কেন আসলাম নদীতে নাইতে। তিনি আরো বলেন, আমার স্বামী আমার জন্য দুঃখ করো না। আমার বালিশের মধ্যে রয়েছে অনেক সোনার গয়না। তুমি সেগুলো বিক্রি করে যে অর্থ পাবে, তা দিয়ে আর একটি কন্যাকে বিবাহ করো। আমার সাথে তোমার এই করুণ বিচ্ছেদ নিয়ে অশ্রুসিক্ত হইও না। উমর সাহেব মনে করেন কেবল ধনতান্ত্রিক সমাজেই সৃষ্টি হয়েছে বড়লোক আর গরিব। কিন্তু ধনী-গরিবের পার্থক্য বহু আগে থেকেই হয়েছে। ফ্রান্সের বিশেষ অঞ্চলের জমিদাররা প্রজাদের বিয়ে হলে তাদের স্ত্রীকে প্রথম পাঠাতে বলতেন তাদের কাছে। কেননা, কেবল তাদেরই অধিকার ছিল তাদের প্রজাদের কন্যাদের কৌমার্য মোচনের। এটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মতন। একে বলা হতো ‘লোয়া দ্য সিনিয়র’।
আমাদের দেশে হিন্দু-বিয়েতে বেশ্যাবাড়ির উঠানের মাটি লাগে। আর এই মাটি যদি রাজ-বেশ্যার হয়, তবে সেটা খুব ভালো। নাটোরের মহারাজার একাধিক রাজবেশ্যা ছিল। এরকমই শুনেছি। রাজশাহী থেকে বিয়ের সময় অনেক হিন্দুবাড়ি থেকে নাটোরের রাজবাড়ীর বেশ্যার উঠান থেকে মাটি আনার কথা আমি আমার ছেলেবেলাতেও শুনেছি। যদিও ব্যাপারগুলো বোঝা তখন আমার পক্ষে সহজ ছিল না। হিন্দু বিধবাদের বিবাহ হতো না। তাদের অনেকেই বাধ্য হতো গণিকা হতে। বিধবাদের বলা হতো ‘রন্ড বা রাড়’। বেশ্যাবাড়িকে তাই সাধারণভাবে বলা হতো রাড়ের বাড়ি। এ ছিল সমাজজীবনের চিত্র।
রাজশাহী ছিল ছোট শহর। এই শহরের জনসংখ্যা যখন ছিল ২৪ হাজারের কাছাকাছি, তখন নাকি শহরে গণিকা ছিল প্রায় ছয় হাজার। রাজশাহীতে একটি পাড়ার নাম ছিল গণকপাড়া। এটা আসলে ছিল গণিকাদের পল্লী। অনেক পরে জেনেছিলাম এখানে থাকত তিন রকমের গণিকা। একদল গণিকাকে বলা হতো ‘বাঁধা’। আর একদলকে বলা হতো ‘টাইম’। আর একদলকে বলা হতো ‘ছুট’। বাঁধা’রা ছিল উঁচুদরের গণিকা। এরা একজনের কাছে বাঁধা থাকত। আর কারো শয্যাসঙ্গী হতো না। টাইম’রা সময় ঠিক করে নিতো কার সঙ্গে তারা থাকবে। যেমন শনিবারে কারো সাথে থাকবার কথা থাকলে ওই দিন আর কারো সঙ্গে থাকত না। আর ছুটি’রা ছিল একেবারে সাধারণ গণিকা। যাদের এসব মানবিচ ছিল না। আমাদের এখানে অনেক সম্পন্ন-বাড়ির হিন্দু মহিলা মনে করতেন, তাদের স্বামীর গণিকা থাকা ভালো। না হলে লোকে ভাববে তাদের স্বামীর যথেষ্ট পুরুষত্ব নেই। তাই তারা চাইতেন তাদের স্বামীর রক্ষিতা থাক। অনেক বিচিত্র ভাবনা প্রচলিত ছিল। আমি হিন্দুপাড়ায় জন্মেছিলাম ও বেড়ে উঠেছিলাম। তাই এসব কথা এসেছিল আমার কানে। মুসলমান সমাজে এরকম যৌন বিশৃঙ্খলা ছিল না। যদিও অনেকেরই থাকত একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী। হিন্দুরা ছিলেন চাকরিজীবী। মুসলমানরা ছিলেন কৃষিজীবী। মুসলমানরা থাকতেন গ্রামে। হিন্দুরা অনেকেই চাকরির জন্য থাকতেন শহরে। কিন্তু নানা কারণে স্ত্রীকে রাখতে বাধ্য হতেন গ্রামে। গণিকা-সংসর্গ তাই তাদের জন্য ছিল অপরিহার্য। মুসলমান স্ত্রীলোকেরা বিধবা হলে অনেক সহজে আবার বিবাহ করতে পারতেন। তারা তাই যাপন করতেন বিবাহিত জীবন। গণিকাপল্লীতে প্রয়োজন হতো না তাদের আশ্রয় নেয়ার। এ ছাড়া স্বামী এবং পিতামাতার সম্পত্তিতে তাদের ছিল অধিকার। সে অধিকার তারা ভোগ করতেন। স্বামী মরে গেলে তাই তাদের পথে বসতে হতো না। বহু মুসলিম মহিলা বিধবা হলে হতেন ‘সিবনী’। তারা কাঁথা ও সুজনী সেলাই করে বিক্রি করতেন। তাতে চলত তাদের জীবন।
আমি এসব কথা বলছি হিন্দু সমাজকে খাটো করার জন্য নয়। চোখে যা দেখেছি, তার ওপর নির্ভর করে আমার এসব কথা বলা। দু-একজন মুসলমান মেয়ে যে গণিকা হয়নি, এমন নয়। কিন্তু গণিকাপল্লীতে তাদের থাকতে হয়েছে হিন্দু নাম নিয়ে। অনেক সময় করতে হয়েছে কৃষ্ণের পূজা। কেননা কৃষ্ণপূজা গণিকাপল্লীতে ছিল যথেষ্ট প্রচলিত। মানুষ গণিকাপল্লীতে যেত আর আসত। গণিকারা তাই বলত, শ্রীকৃষ্ণ যখন যার, তখন তার। এই নিয়ে ভাবলে চলে না। যারা তাদের কাছে আসে, তারা কৃষ্ণের মন নিয়েই আসে। একই কামনার ধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছে যুগযুগান্তর ধরে। এই ধারা শেষ হওয়ার নয়। রাজশাহীতে অনেক বৈষ্ণবী ছিল। তারাও কার্যত ছিল গণিকা। তারা কারো স্থায়ী স্ত্রী হতে চাইত না। নানারকম যৌন বিকার ছিল বৈষ্ণবদের মধ্যে। একদল বৈষ্ণবকে বলা হতো সখীভাবক। এরা পুরুষ কিন্তু মেয়েদের মতো সাজপোশাক করত। মেয়েদের নাম গ্রহণ করত। এরা হতো সমকামী। সমকামিতার মাধ্যমে লাভ করতে চাইত ভগবদ প্রেম। সাধারণভাবেই বৈষ্ণবরা মনে করতেন পরকীয়া প্রেম তাদের সাধনার অঙ্গ। কেননা নিজের স্ত্রীর সঙ্গে প্রেমের চেয়ে পরস্ত্রীর সাথে প্রেম আরো অনেক প্রগাঢ়। আর এই প্রেম মানুষকে দেখায় ভগবদ প্রেমের পথ। নানা তান্ত্রিক মতবাদ এই দেশে প্রচলিত ছিল। শরীরের মধ্যে আছে অনেক নাড়ি বা তন্ত্র। এদের মধ্য দিয়ে উপযুক্ত সাধন পদ্ধতির মাধ্যমে মহাশক্তিকে পরিচালিত করা যায় মস্তিষ্কে। লাভ করা যায় পরম শান্তি। আসলে এদের এই সাধনপদ্ধতির ফলে যা ঘটত, তা হলো ব্যাপক বীর্যপাত। বাউলরা এরকম সাধন এখনো করে থাকে, যা নিয়ে আমরা এখন করছি অহঙ্কার। বলছি বাউলদের মধ্যে আছে নাকি আমাদের সংস্কৃতির মূল্যবান পরিচয়।
হিন্দুদের মধ্যে ‘জায়াজীব’ বলে একটি সম্প্রদায় ছিল, যারা তাদের স্ত্রীকে দেহপসারিণী করে জীবিকা অর্জন করত। অর্থাৎ এ দেশের সমাজজীবনে হিন্দুদের মধ্যে ছিল যৌনজীবনে বিশেষ নৈরাজ্য। এখন যা আর নেই। অনেকে বলছেন, তান্ত্রিক-ধর্ম ছিল অনেক উন্নত। কেননা, তার দ্বারা হতে পারত শারীরিক উন্নতি। কিন্তু তান্ত্রিকরা অনেক বীভৎস আচরণ করত। যেমন মানুষের মৃতদেহের ওপর বসে মরার মাথার খুলিতে উলঙ্গ স্ত্রী-পুরুষ একত্রে সুরাপান করত। কাপালিকদের কথা বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসেও পাওয়া যায়।
সব ব্যক্তি ধর্ষক হয় না। অনেক ব্যক্তিই ধর্ষক হয় যৌন হরমোনজনিত কারণে। এদের শাস্তি দেয়ার আগে এদের দেহক্রিয়া সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন। কারণ এরা যা করে তার ওপর এদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না বিশেষ দৈহিক কারণেই। এরা অনেকে ইচ্ছা করেই যে ধর্ষক হয়, তা নয়। ধর্ষণ অনেকের ক্ষেত্রেই হতে পারে একটি শারীরিক ব্যাধি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। এই উন্নয়ন হচ্ছে ব্যক্তি উদ্যোগে। এসব উদ্যোক্তাকে অর্থনীতিবিদ সমপিটারের ভাষায় বলা যায়, ক্যাপটেন অব ইন্ডাস্ট্রি। উদ্যোক্তা ছাড়া আমাদের অর্থনীতির উন্নয়ন সম্ভব হবে না। কিন্তু উমর সাহেব যেন বলতে চাচ্ছেন, সব অর্থনৈতিক উদ্যোক্তাই হলেন ধর্ষক। আর তারা সমাজজীবনে সৃষ্টি করছেন যৌন বিশৃঙ্খলা। যেটা সত্য নয়। হতে পারে এদের কেউ কেউ যৌনজীবনে উচ্ছৃঙ্খল; কিন্তু তা বলে সবার সম্বন্ধে ঢালাও সিদ্ধান্তে আসা আমি মনে করি যথার্থ নয়। কেননা একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যথেষ্ট শ্রমসাধ্য কাজ। আর তার জন্য চলতে হয় যথেষ্ট হিসাবপত্র করে। নইলে পোহাতে হয় লোকসান। আর ব্যবসায় জ্বলে লালবাতি। আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অধ্যাপককে জড়াতে দেখা যাচ্ছে তাদের ছাত্রীর সঙ্গে যৌন কেলেঙ্কারিতে। কিন্তু তা বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সাধারণভাবেই হয়ে উঠেছেন ধর্ষক অথবা কাম-উন্মাদ, এরকম সাধারণ সিদ্ধান্তে আসা কখনোই ঠিক হবে না। কেবল ধনতান্ত্রিক সমাজেই দেখা যায় যৌন নৈরাজ্য, আর পুঁজিপতিরাই এর জন্য দায়ী, উমর সাহেবের এই সিদ্ধান্তের সাথে সহমত পোষণ করা তাই সহজ নয়। উমর সাহেব লিখেছেন যুগান্তর পত্রিকায়। আর আমি লিখছি নয়া দিগন্তে। কেননা, আমি নয়া দিগন্তের একজন কলাম লেখক। যদিও কলাম লিখি স্বাধীনভাবে।
নয়া দিগন্তে প্রকাশ, ২৭ মে ২০১৭।