বাংলাদেশে বাজ পড়ে মানুষের মৃত্যু

কোনো কিছুর শ্রেণিবিভাগ করে আলোচনা করলে তার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান লাভ করা সহজ হয়ে ওঠে। বিলাতে লিউক হাওয়ার্ড নামে একজন রসায়নবিদ ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মেঘদের চারভাগে ভাগ করেন। এবং এদের দেন ল্যাটিন নাম। ল্যাটিন নামের ইংরেজি উচ্চারণে এরা হলো : সিরাস (অলক বা পলক মেঘ), স্ট্রাটাস (স্তর মেঘ), কিউমুলাস (স্তূপ মেঘ) এবং নিম্বাস (বর্ষণ মেঘ)। এরপর মেঘদের দশ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এবং তাদেরও দেয়া হয়েছে ল্যাটিন নাম। সব মেঘে বজ্রপাত ঘটে না। বজ্রপাত ঘটে প্রধানত কিউমুলো-নিম্বাস বা পুঞ্জ-বর্ষণ মেঘ। এই মেঘের রঙ খুব কালো। এর শীর্ষদেশ দেখে মনে হয় কিছুটা গম্বুজের মতো। আমাদের দেশে এই মেঘ দেখা যায় উত্তর-পশ্চিম কোণ (বায়ুকোণ) থেকে উদ্ভব হতে। এই মেঘে প্রবল ঝড় ও বজ্র-বিদ্যুৎসহ মুষলধারে বৃষ্টি অথবা শিলাবৃষ্টি হয়। ঝড়ের হাওয়া আসে প্রধানত উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য লিখেছেন :

ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধবেগে ধেয়ে চলে আসে
বাধাবন্ধহারা
গ্রামান্তের বেণুকুঞ্জে নীলাঞ্জনছায়া সঞ্চারিয়া-
হানি দীর্ঘধারা।

রবীন্দ্রনাথ তার এ কবিতাটি লিখেছিলেন ১৩০৫ বঙ্গাব্দের ৩০ চৈত্র এক ঝড়ের দিনে। কিন্তু কালবৈশাখীর ঝড়ের বাতাস প্রধানত আসে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে। আর তাই ইংরেজিতে এই ঝড়কে বলে Nor’Wester। এই ঝড়ের হাওয়া কখনো কখনো হয়ে ওঠে টর্নেডো বা বিশেষ ধরনের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়। অর্থাৎ ঝড়ের হাওয়া খুব অল্প স্থানজুড়ে ভয়ঙ্কর গতিবেগে ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্তু এটা খুব কম ক্ষেত্রেই ঘটে। কালবৈশাখীর ঝড় হয় চৈত্র-বৈশাখ মাসে। এটা বাংলাদেশের জলবায়ুর একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এ সময়ই ঘটে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত। বাংলাদেশে সারা বছর বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে না। বছরের অন্য সময় কিউমুলো-নিম্বাস মেঘ সৃষ্টি হয় না। আমাদের দেশে যে মেঘে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়, তাকে বলা যায় নিম্বো-স্ট্রাটাস বা বর্ষণ-স্তর মেঘ। এই মেঘ স্তরে স্তরে সোজাভাবে সাজানো থাকে, পুঞ্জের আকারে নয়। এই মেঘের রঙ সাধারণত হয় গাঢ় ধূসর বর্ণ। যাকে বলে বিদ্যুৎ চমকানো তা নিয়ে প্রথম বিশেষভাবে গবেষণা করেন বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন ১৭৫২ সালে। তিনি ঘুড়ি উড়িয়ে মেঘ থেকে তড়িৎ আনতে পারেন এবং বলেন যাকে বলে বিদ্যুৎ চমকানো, তা আসলে হলো মেঘের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া তড়িৎ স্ফুলন (ইলেকট্রিক্যাল স্পার্ক)।

বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন আবিষ্কার করেন লাইটনিং কন্ডাক্টর। লাইটনিং কন্ডাক্টর বলতে বুঝায় লম্বা সুচালো লৌহদণ্ড। যার সাথে যুক্ত থাকে লোহার পাত। এই লোহার পাতের নিম্ন ভাগ থাকে মাটিতে প্রোথিত। এই লাইটনিং কন্ডাক্টরের মধ্যে আকাশের মেঘ থেকে আসা বিদ্যুৎ বা বাজ সহজেই প্রবাহিত হয়ে মাটির মধ্যে চলে যেতে পারে। এর ফলে বাজ পড়ে কোনো ক্ষতি হতে পারে না। লাইটনিং কন্ডাক্টর স্থাপন করা হয় উঁচু উঁচু অট্টালিকার ছাদে। ব্রিটিশ শাসনামলে এ দেশের সরকারি অট্টালিকার ছাদে লাইটনিং কন্ডাক্টর বা বজ্রনিবারক দণ্ড স্থাপন করা হতো। কিন্তু জানি না কেন এখন আর এ রকম কোনো বজ্রনিবারক দণ্ড স্থাপন করা হচ্ছে না। এ রকম দণ্ড কি বাজ পড়া নিবারণে কোনো ভূমিকা রাখে না?

কিউমুলো-নিম্বাস মেঘের মধ্যে ঠিক কিভাবে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তা নিয়ে এখনো যথেষ্ট মতভেদ আছে। তবে সাধারণভাবে মনে করা হয়, এই মেঘের মধ্যে ভাসমান বরফের টুকরাদের মধ্যে ঘর্ষণ লেগে তড়িৎ বা বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়। যখন খুব বেশি সৃষ্টি হয়, তখন তার একাংশ এসে পড়তে পারে মাটিতে। এই অংশকে বলা হয় বাজ। বাজ হলো আসলে একগুচ্ছ ইলেকট্রন বা নেগেটিভ বিদ্যুৎকণিকা। বাজ কোনো জিনিসের শক্ত টুকরা নয়। মাটি সব সময় পজেটিভ বিদ্যুৎ সমৃদ্ধ। তাই ইলেকট্রনরা এসে পড়তে চায় মাটিতে। মাটির মাধ্যমে ইলেকট্রনরা আকর্ষিত হয়ে থাকে। এসব হলো তত্ত্বকথা। তবে যা এখন প্রমাণিত সত্য, তা হলো বাজ হলো নেগেটিভ তড়িৎ-কণা বা ইলেকট্রনের সমষ্টি। এক সময় মানুষ ভেবেছে, বাজ পড়ে দেবতার কোপে। মানুষ পূজা করেছে বজ্রের দেবতাকে। হিন্দুরা বজ্রের দেবতাকে বৈদিক যুগে বলতেন ইন্দ্র। কিন্তু এখন বাজ যে একটি বৈদ্যুতিক ঘটনা, সেটা হতে পেরেছে খুবই সুপ্রতিষ্ঠিত। হিন্দুরা বজ্রপাত নিবারণের জন্য ইন্দ্রদেবের আর পূজা করেন না।
মেঘের মধ্যে তড়িতের প্রভাবে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ও পানির মধ্যে একাধিক রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। যার ফলে উদ্ভব হয় নাইট্রিক এসিডের। এই নাইট্রিক এসিড (HNO3) খুব লঘু দ্রবণ হিসেবে বৃষ্টির পানির সাথে মাটিতে এসে পড়ে, যা বাড়ায় মাটির উর্বরতা। বাংলাদেশের মাটির উর্বরতার এটা একটা কারণ।
আমাদের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতে আগের তুলনায় এখন বেশি ব্যক্তি প্রাণ হারাচ্ছেন। এটা বজ্রপাত বেশি হওয়ার ফলে ঘটছে, না জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে ঘটছেÑ সেটা নিয়ে থাকছে প্রশ্ন। জনসংখ্যা বেড়েছে। হাটে-ঘাটে মানুষ গিজগিজ করছে। তাই বাজ পড়লে আগের তুলনায় হতে পারছে অধিক লোকের মৃত্যু। আমরা বলেছি, কিউমুলো-নিম্বাস মেঘে বজ্রের সৃষ্টি হয়। আগের তুলনায় কিউমুলো-নিম্বাস মেঘ বেশি হচ্ছে, সাধারণভাবে দেখে সেটা ধরা যাচ্ছে না। কিউমুলো-নিম্বাস মেঘ বেশি না হলে বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়তে পারে না। যা হোক বিষয়টি বিশেষজ্ঞদের বিচার্য। আমরা এ ব্যাপারে মোটেও বিশেষজ্ঞ নই। যা বলছি তা সামান্য সাধারণ জ্ঞান থেকে।

বাংলাদেশের জলবায়ু এখনো বিরাটভাবে বদলে যায়নি। মোটামুটি আগের মতোই আছে। তবে ভারত চাচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের পানি খাল কেটে গঙ্গায় নিয়ে যেতে। গঙ্গা থেকে খাল কেটে পানি নিয়ে যেতে চাচ্ছে দক্ষিণ ভারতের কাবেরী নদীতে। ভারত এটা করলে বাংলাদেশ আর আগের মতো নদীমাতৃক দেশ থাকবে না। বাংলাদেশের জলবায়ুতে আসবে বড় রকমেরই পরিবর্তন। ক’দিন আগে ১৬ মে পালিত হলো ফারাক্কা দিবস। এই দিন প্রখ্যাত নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী করেছিলেন ফারাক্কা মিছিল। যতদূর মনে পড়ছে, ১৫ মে ভাসানী রাজশাহীতে এক ঘরোয়া আলাপচারিতায় বলেছিলেন, তড়িঘড়ি করে সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দেয়া ঠিক হয়নি। পাকিস্তান না ভাঙলে ভারতের ওপর পশ্চিম ও পূর্ব দিক দিয়ে চাপ দিয়ে ফারাক্কা সমস্যার সমাধান হতে পারত সহজ। ভারতের সাথে এরপর হতে পেরেছে হাসিনা-দেবগৌড় চুক্তি। কিন্তু ভারত বাংলাদেশকে হাসিনা-দেবগৌড় চুক্তি অনুসারে পানি দিচ্ছে না। এখন ভারত যদি ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে নেয়, তবে সেটা হবে বাংলাদেশের জন্য আরো ক্ষতিরই কারণ। বদলে যাবে বাংলাদেশের জলবায়ু। আমাদের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঘটছে অধিক বজ্রপাত। যেটা হয়ে উঠেছে জাতির জন্য একটা বড় সমস্যা। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে আমরা ভারতের নীতির কারণে পড়তে যাচ্ছি মহাবিপর্যয়েরই মধ্যে। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর খবর ছাপা হলো ফারাক্কা দিবসের ঠিক এক দিন আগে। জানি না, এ খবরটি ছাপা হয়েছে ফারাক্কা দিবসের থেকে মানুষের দৃষ্টিকে কিছুটা অন্য দিকে সরিয়ে নেয়ার জন্য কি না।

দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত, ২১ মে ২০১৬।

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ