ভাষা মানুষের জীবনে একটা বিরাট বাস্তবতা। মানুষ ভাষার মাধ্যমে মনোভাব ব্যক্ত করে। ভাষার মাধ্যমে চিন্তা করে। ভাষার মাধ্যমে ধরে রাখতে চায় তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে। ভাষা আধুনিক জাতীয়তাবাদের অন্যতম উপাদান; যদিও একমাত্র উপাদান নয়। জাতিসত্তার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় ভাষাকে কেন্দ্র করে। রাশিয়ানরা রুশ ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিল হাঙ্গেরিতে; কিন্তু হাঙ্গেরিয়ানরা এটা মেনে নিতে চায়নি। হাঙ্গেরিয়ায় রুশবিরোধী অভ্যুত্থানের এটা ছিল একটা কারণ। বাংলাদেশের মানুষ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছে, উর্দু ভাষার আধিপত্য মেনে নিতে চায়নি বলে। ব্যাকরণগত দিক থেকে হিন্দি আর উর্দুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। হিন্দি ও উর্দুর মধ্যে একটা পার্থক্য হলো, উর্দু ভাষায় থাকতে দেখা যায় ফারসি ও আরবি শব্দের প্রাধান্য। অন্য দিকে হিন্দি ভাষায় থাকতে দেখা যায় সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য। এ ছাড়া হিন্দি ভাষা লেখা হয় দেবনাগরি অক্ষরে। অন্য দিকে উর্দু লেখা হয় আরবি-ফারসি অক্ষরে। হিন্দি প্রধানত বলে উত্তর ভারতের গ্রামের লোকে; কিন্তু উর্দু বলে শহরের বাসিন্দারা। এ দিক থেকে উর্দুকে বলতে হয় শহুরে ভাষা। হিন্দি এখনো শহুরে ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। হিন্দি খুব গ্রহণপটু ভাষা নয়। অর্থাৎ হিন্দি চায় না বিদেশী শব্দকে সহজে গ্রহণ করতে। পক্ষান্তরে উর্দু অনেক গ্রহণপটু ভাষা। ইংরেজি ভাষা থেকে উর্দু অনেক শব্দ গ্রহণ করেছে এবং এখনো করছে। এ দিক থেকে উর্দু হলো অনেক সমৃদ্ধ ভাষা। অনেক ভাষাতাত্ত্বিকের মতে, উর্দু সাহিত্য হিন্দি সাহিত্য থেকে আছে এগিয়ে।
ব্রিটিশ শাসনামলে সেনাবাহিনীতে চলত রোমান উর্দু। রোমান উর্দু বলতে বোঝাত রোমক বর্ণমালায় লিখিত উর্দুকে। উর্দুর বিশেষ বিকাশ ঘটতে পেরেছে ব্রিটিশ শাসনামলে। উর্দু এখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু এখনো উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষা হয়ে ওঠেনি। উর্দু এখনো বলতে গেলে হয়ে আছে, উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের মাতৃভাষা। ভারতের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং গর্ব করে বলেছিলেন, উর্দু তার মাতৃভাষা। জওয়াহের লাল নেহরু ঠিক হিন্দি বলতে পারতেন না। বক্তৃতা দিতেন আসলে উর্দু ভাষাতেই। উর্দু ভাষার প্রাণকেন্দ্র হলো ভারতের উত্তর প্রদেশ। ভারতের উর্দুভাষী অঞ্চল থেকে যারা গেছেন পাকিস্তানে, তাদের সাথে ঠিক বনিবনা হচ্ছে না স্থানীয় বাসিন্দাদের। উর্দু করাচি শহরে চলে, কিন্তু সিন্ধু প্রদেশে নয়।
ভারতে ভাষা এখনো হয়ে আছে একটা বড় রকমের সমস্যা। দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় ভাষা পরিবারভুক্ত ভাষায় যারা কথা বলেন তারা মানতে চাচ্ছেন না হিন্দির দৌরাত্ম্য। ফলে এখনো করা সম্ভব হয়নি হিন্দিকে বাস্তবে রাষ্ট্রভাষা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ-কারবার এখনো চলেছে ইংরেজি ভাষারই মাধ্যমে। তামিলনাড়ুতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দি ভাষায় কোনো চিঠি লিখলে তার সাথে দিতে হচ্ছে ইংরেজি অনুবাদ। এ হলো আজকের ভারতের ভাষা সমস্যার ক্ষেত্রে এক বিশেষ বাস্তবতা।
কথাগুলো বলতে হচ্ছে এই কারণে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সম্প্রতি বলেছেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত করার লক্ষ্যে আমাদের হিন্দি ভাষা শেখা উচিত (নয়া দিগন্ত, ২৩ জানুয়ারি ২০১২)। কিন্তু তিনি বলেননি হিন্দি শেখার মাধ্যমে ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক উন্নত হবে কিভাবে। কারণ বাংলাদেশের পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ।পশ্চিমবঙ্গের ভাষা হলো বাংলা। হিন্দি শিখে তাদের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের উত্তর-পূর্বে রয়েছে ভারতের যে সাতটি প্রদেশ, তাদের কারো প্রাদেশিক সরকারি ভাষা হিন্দি নয়। হিন্দি ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে এসব প্রদেশের মানুষের মনে সৃষ্টি হতে পেরেছে প্রবল ক্ষোভ। হিন্দি ভাষা শিখে আমরা তাই এদের সাথে উন্নত সম্পর্ক সৃষ্টির কথা ভাবতে পারি না। তাদের সাথে উন্নত সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হলে আমাদের শিখতে হবে এসব অঞ্চলের মানুষের ভাষা। বিশেষ করে আসামের অহমিয়া, মেঘালয়ের খাসিয়া ও মিজোরামের মিজো ভাষা। কারণ এদের সাথে আছে আমাদের সাধারণ সীমান্ত। আমরা তাই বুঝতে সক্ষম হচ্ছি না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কী করে বলতে পারছেন হিন্দি ভাষা শিখে ভারতের সাথে উন্নত সম্পর্ক সৃষ্টির কথা। বাংলা যত লোকের মাতৃভাষা, তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগের বাস বাংলাদেশে। আর শতকরা ৪০ ভাগের বাস হলো ভারতে। কিন্তু পশ্চিম বাংলার বাইরে ভারতের বাংলাভাষী মানুষ এখন বাংলা ভাষায় কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ তাদের বিবেচনা করা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে আগত অবাঞ্ছিত মানুষ হিসেবে। এভাবে বাংলাভাষী মানুষকে অবাঞ্ছিত ভাবলে বাংলাদেশের মানুষের সাথে ভারতের সম্পর্ক কখনওই উন্নত হতে পারবে না। বাংলা ভাষা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে ভারত সরকারকেও। বাংলা ভাষাকে দিতে হবে বিশেষ মর্যাদা। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন বলে আমাদের মনে হচ্ছে না।
ভারতের ২৮টি প্রদেশের মধ্যে ৯টির প্রাদেশিক সরকারি ভাষা হলো হিন্দি। এই প্রদেশগুলো হলো- বিহার, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাচল ও রাজস্থান। এদের কারো সাথে বাংলাদেশের কোনো সীমান্ত নেই। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত আছে বিহার ও ঝাড়খন্ডের সাথে; কিন্তু আমাদের এদের সাথে কোনো সীমান্ত নেই। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বিহারের পুর্নিয়া জেলায় অনেক লোক বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ঝাড়খন্ডেও রয়েছে অনেক বাংলাভাষাভাষী মানুষ। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোর মধ্যে আসামের গোয়ালপাড়া ও কাছার জেলার মানুষ কথা বলেন বাংলা ভাষায়। ত্রিপুরা রাজ্যে এক সময় চলত টিপরা ভাষা। কিন্তু এখন সেখানকার ভাষা বিশেষভাবেই হয়ে উঠেছে বাংলা। বাংলা ভাষার স্থান পৃথিবীর মূল ভাষাগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে সপ্তম কি অষ্টম। ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা যথেষ্ট উন্নত। বিশেষ করে হিন্দি ভাষার তুলনায়। তাই হিন্দি চর্চা করে ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করা বৃথা। হিন্দির চেয়ে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই আমরা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের সাথে প্রয়োজনে অনেক সহজে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি। ভারত ঠিক এক জাতির দেশ নয়। ভারত কার্যত বহু জাতির দেশ। ভারতকে আমাদের সেভাবেই বিচার করতে হবে। তা না হলে ভারত সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হতে চাইবে বিভ্রান্তিকর। অনেক কিছুই ঘটছে ভারতে। হিন্দি ভাষায় যেমন এখন ব্যবহারের চেষ্টা চলছে আরবি-ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার বৃদ্ধির; তেমনি আবার দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়ভাষী মানুষেরা চাচ্ছেন তাদের ভাষায় যেসব সংস্কৃত শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেসব শব্দকে বাদ দিতে। সমগ্র দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়ভাষী অঞ্চলে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে সংস্কৃত শব্দবিরোধী মনোভাব। বিশেষ করে তামিলভাষী প্রদেশ তামিলনাড়-তে। তামিলনাড়-কে ব্রিটিশ শাসনামলে বলা হতো মাদ্রাজ প্রদেশ। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর প্রদেশটির নাম হয়েছে তামিলনাড়ু। তামিল ভাষায় ‘নাড়-’ শব্দের অর্থ হলো দেশ। তামিলনাড়- শব্দের বাংলা করলে বলতে হবে তামিলদের দেশ। তামিলনাড়- হলো দ্রাবিড় ভাষাভাষী সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। ভারতে দেখা দিয়েছে আর্য সংস্কৃতির মধ্যে বিশেষ বিরোধ। ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমানে- আর্য সংস্কৃতির প্রসার কখনওই সেভাবে ঘটেনি। এখানে রয়েছে মঙ্গলীয় মানব ধারার প্রাধান্য। ভারত বিভক্ত হয়ে পড়ছে আর্য, দ্রাবিড় ও মঙ্গল (কিরাত) দ্বন্দ্বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র। এখানে হিন্দি শিক্ষার ব্যবস্থা করা অন্যায় হয়েছে বলে আমরা মনে করি না। কিন্তু হিন্দি শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যে বক্তব্য দিয়েছেন তার সাথে কোনোভাবেই পোষণ করতে পারছি না ঐকমত্য। তিনি এমন এক সময় তার এই অভিমত ব্যক্ত করলেন যখন দেশে ঘটছে আরো অনেক কিছু। আমরা পাকিস্তান আমলে উর্দু শিখতে চাইনি, কিন্তু এখন ভারতের সাথে উন্নত সম্পর্ক সৃষ্টির নামে শিখতে চাচ্ছি হিন্দি। আমাদের এই হিন্দি শিখতে চাওয়া ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কতটা চাপের ফল সেটা নিয়েও জাগতে পারছে সন্দেহ। এই হিন্দি শেখার হুজুগ বিশেষভাবে উঠতে পারছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। যেটা জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি করছে বাংলাদেশের ওপর ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিস্তারের পরিকল্পনার একটা চেষ্টা হিসেবে।
২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি লন্ডনে প্রবাসী বিখ্যাত বাংলাভাষী সাংবাদিক সিরাজুর রহমান রেডিও তেহরানকে একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন। এতে তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালে তাজউদ্দিন সরকার ভারত সরকারের সাথে ৭ দফা চুক্তি করেছিল। সেই চুক্তিতে ছিল বাংলাদেশে নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। থাকবে না স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। ভারত বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেবে। কিন্তু শেখ মুজিব এই চুক্তি মানেননি। ভারত সরকার এখন অগ্রসর হচ্ছে ১৯৭১ সালের চুক্তি বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে। সিরাজুর রহমান সাহেবের বক্তব্য কতটা নির্ভরযোগ্য তা আমরা বলতে পারি না। তবে ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন বিবিসির সাংবাদিক। আর সেই সুবাদেই তিনি তাজউদ্দিন সরকার সম্পর্কে নানা বিষয়ে হলেন বিশেষভাবে জ্ঞাত। তাই তার কথা হেলাফেলা করা চলে না। একই সময়ে আমরা দেখছি, ভারত এখন চাচ্ছে কেবল আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করতেই নয়, এ দেশে হিন্দি ভাষার প্রসার বাড়াতেও। বলা হচ্ছে, হিন্দি ও বাংলা নিকট সম্পর্কীয় ভাষা। ব্যাকরণগত দিক থেকে যা আদৌ সত্য নয়। আমাদের তাই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে ভারতের অভিসন্ধি সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন হওয়ার। ভারত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে মেনে নিয়েছিল কৌশলগত কারণে। সে এখন চাচ্ছে পাকিস্তানের ধ্বংস। সে এটা চাচ্ছে মার্কিন সহযোগিতায়। বাংলাদেশ সম্পর্কেও তার মনোভাব বাংলাদেশের অনুকূল নয়। সম্প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন ত্রিপুরায়। ত্রিপুরার মানুষ আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে যেভাবে সংবর্ধনা জানিয়েছেন, সেটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মনঃপূত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। পরোক্ষভাবে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে প্রটোকল নিয়ে।
ভারতের খ্যাতনামা সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার আরব উপদ্বীপ থেকে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ও বহুল পঠিত গালফ নিউজ পত্রিকার ২৮ জানুয়ারি ২০১২ সংখ্যায় লিখেছেন- তার কাছে যেসব সংবাদ আছে, তা থেকে সিদ্ধান্ত করা যায়, বাংলাদেশে সম্প্রতি যে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল তাতে ছিল আসামের উলফা এবং মনিপুর ও নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা। তাই একে কেবল বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কুলদীপ নায়ারের বক্তব্য যদি নির্ভরযোগ্য হয়, তবে বলতে হবে, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের অধিক অবগত হতে হবে। হিন্দি ভাষার মাধ্যমে সারা ভারতের মানুষ কী ভাবছে সেটা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কারণ ভারতে কেবল হিন্দিভাষী মানুষ বাস করে না; ভারত বহুভাষী মানুষের আবাসভূমি।