রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে দলটি যদি গণতান্ত্রিক দল হতে চায়, তবে তার থাকতে হয় নীতি। আর এই নীতি নির্ধারিত হতে হয় দলের সদস্যেদের দ্বারা; কোন একজন ব্যাক্তি বিশেষের দ্বারা নয়। কিন্তু বিএনপি’র নীতি এখন নির্ধারিত হতে যাচ্ছে, মনে হয় একজন ব্যাক্তির দ্বারা। আর তিনি হলেন জিয়াউর রহমানের পুত্র তারেক রহমান।
জিয়া ১৯৭৬ সালে ৪ আগস্ট বলেছিলেন রাজনৈতিক দল গঠনের নীতিমালা সম্বন্ধে। তিনি বলেছিলেন, ‘কোন দল কোনো মৃত বা জীবিত ব্যক্তিকে নিয়ে ব্যক্তি কেন্দ্রিক অভিবিশ্বাস গড়ে তুলতে পারবেন না। জিয়া সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। জিয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে। জিয়া বিশ্বাস করতেন মিশ্র অর্থনীতিতে। তাঁর সময় আরম্ভ হয় বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানি। আরম্ভ হয় তৈরি পোশাক রফতানি। শুরু হয় গলদা চিংড়ি রফতানি। এই তিনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সঞ্চারিত হয় নতুন মাত্রা। ঘোঁচে তাঁর তলাবিহীন ঝুড়িনাম। যা এক সময় প্রদান করেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র সেক্রেটারি হেনরি কিসিঞ্জার।
আজকের বাংলাদেশের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির মূলে আছে জিয়া অনুশ্রিত মিশ্র অর্থনীতি। জিয়া তাঁর নীতি নির্ধারণের সময় দলের অন্য আর সব নেতাদের সঙ্গে, বিশেষ করেওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন। তার মধ্যে ছিলনা কোন একনায়কতন্ত্রী মনোভাব। জিয়ার ধানের শীষের ডাক তাই গিয়ে পৌঁছাতে পেরেছিল গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে। গণতন্ত্রের বিশেষ ভিত্তি হলো তিনটি: জনমত, রাজনৈতিক দল এবং নিরপেক্ষ ভোট। এছাড়া একটা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। অথবা থাকতে পারেনা প্রতিষ্ঠিত।
বিএনপি’র নেতা তারেক রহমান হঠাৎ করেই যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন বর্তমান আইন পরিষদে। যার নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সারাবিশ্বে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম খ্যাতনামা দৈনিক পত্রিকা Washington Post ,পত্রিকায় বলা হয়েছে, এ রকম নির্বাচন কমুনিস্ট পার্টি শাসিত উত্তর কোরিয়ায় আশা করা যায়, কিন্তু বাংলাদেশে নয়। কিন্তু তারেক জিয়া সেই নির্বাচনকেই শেষ পর্যন্ত দিলেন বৈধতা। বলছেন এরপশ্চাতে আছে একটা কৌশলগত কারণ। কিন্তু ‘বলছেন না এই কৌশলগত কারণ টি আসলে কী। আমরা শুনেছিলাম বিএনপি’র অনেক গণনীয় নেতা ভাবছিলেন খালেদা জিয়াকে মুক্তি করবার জন্য গণ আন্দোলন করবারর কথা, কিন্তু বিএননি সে পথে পা বাড়ালো না। দেশবাসীর কাছে তারেক রহমাকে মনে হচ্ছে একজন ভীত সন্ত্রস্ত নেতা হিসাবে। গণআন্দোলন হবার ফলে বিএনপিতে সৃষ্টি হতে পারত নতুন নেতৃত্ব, আর তারেক জিয়ার নেতৃত্বের অবসান। বিএনপি আর থাকত না একটি পরিবার কেন্দ্রীক দল হিসাবে। পরিণত হত, আবার আগের মতই একটি জনমত কেন্দ্রীক রাজনৈতিক দলে। আসলে দেশে ঠিক কী হতে যাচ্ছে, আমরা তা জানিনা।
বাংলাদেশ এখনও একটা সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র নয়। আমাদের রাজনীতি তাই হওয়া উচিত সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র গড়ার রাজনীতি। কেবলই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের রাজনীতি নয়। জিয়া বিশেষ ভাবেই এটা উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। জিয়া তাই করতে চাননি বংশের রাজনীতি। বলেছেন বংশের রাজনীতি করার বিপক্ষে। যা তাঁর (প্রেসিডেন্ট জিয়া) বক্তৃতা মালার মধ্যে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। আমার মনে পড়ে বেগম জিয়া প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হবার পরে পরেই তাঁর ভগ্নীকে টেনে এনেছিলেন বিএনপির রাজনীতিতে। করেছিলেন মন্ত্রী। এ থেকেই সূত্রপাত হয় বিএনপিতে পরিবারতন্ত্রী রাজনীতি। আওয়ামীলীগে পরিবারতন্ত্র গোড়া থেকেই ছিল। আওয়ামীগে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব করতেন। নেতৃত্ব করতেন শেখ ফজলুল হক মণি; যিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের আপন ভাগ্নে। আওয়ামীলীগে নেতৃত্ব করতেন শেখ মুজিবুর রহমানের আপন দুলা ভাই আবদুর রব সেরনিয়াবাত। যিনি ছিলেন মস্কোপন্থী কম্যুনিস্ট। শেখ মণি ও সেরনিয়াবাতের চাপে শেখ মুজিব ঝুঁকে পড়েন মস্কোর দিকে।
আমরা আলোচনা করছিলাম রাজনীতিতে পারিবারতন্ত্র নিয়ে। পরিবারতন্ত্রের ফলে রাজনীতি কত জটিল, অগণতান্ত্রিক ও ভয়াবহ হতে পারে, আমাদের রাজনীতি থেকে তার প্রমাণ মেলে। আমাদের রাজনীতি বেশি দিনের নয়। কিন্তু তা খুবই রক্তাপ্লুত। চেষ্টা করলে হয়তো সেটা কমানো যেত। কি এমন গোপন কৌশল কাজ করছে তারেক রহমানের মধ্যে, যা তার দলের আর কারও জানবার অধিকার থাকতে পারেনা? বেগম জিয়া ভেবেছিলেন, তিনি কারারুদ্ধ হলে স্বতস্ফুর্তভাবে হবে বিরাট আন্দোলন, কিন্তু তাও হলোনা। কেননা, খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা এখন আর সেই পর্যায়ে নাই। আমরা বাইরের লোক। বিএনপির ভেতরে কী রাজনীতি হচ্ছে, সেটা আমরা জানিনা। তবে এইটুকু বুঝতে পারি যে, বিএনপি যদি তার শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে আলোচনা না করে নীতিনির্ধারণ করতে থাকে, তবে জনগন থেকে দ্রুত বিচ্ছিন্ন হয়েই পড়বে।
আমরা অনেকেই ভাবতাম বাংলাদেশে ধীরে ধীরে দ্বিদলীয় গণতন্ত্র গড়ে উঠবে, কতকটা বিলাতের মত। একদিকে থাকবে বিএনপি, আর একদিকে থাকবে আওয়ামীলীগ। কিন্তু বাস্তবে তা হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছেনা। গণতন্ত্রই হয়তো টিকতে পারবেনা। কেননা, চরম অবস্থার মধ্যে গণতন্ত্র টিকতে পারে না। আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ চরম পন্থাকে উৎসাহিত করতে পারে।
বিলাতের বিখ্যাত পাক্ষিক পত্রিকা ইকোনোমিস্ট-এর মতে, বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দল হলো তিনটি। একটি হলো আওয়ামীলীগ, আর একটি হলো বিএনপি, আর তৃতীয়টি হলো জামায়াত ই ইসলামী। জামায়াত ই ইসলামীও শুনছি নাকি দুভাগে বিভক্ত হতে যাচ্ছে। তবে এই ভাগ খুবই গভীর হতে যাচ্ছে বলে অনুমিত হচ্ছে না। কেননা, জামায়াতের মধ্যে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্য দুটি রাজনৈতিক দলের চাইতে অনেক বেশি আলোচনা হবার প্রথা প্রচলিত আছে। আলোচনার মাধ্যমে নীতিনির্ধারণ দলকে অধিক গণতন্ত্রী করে তোলে। তবে রাজনীতিতে দল ভাঙবার একটা প্রবণতা কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, একটি বিদেশী রাষ্ট্র আছে এর পশ্চাতে। যে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে এর জন্যে।
ভারতেও নির্বাচন পরবর্তীতে হতে পারে একটা বড় রকমের গন্ডগোল; আর্য ভারত ও দ্রাবিড় ভারতের সংঘাত। আর এই সংঘাতের একটা প্রভাব পড়তে পারে আমাদের রাজনীতিতে। তারেক জিয়া এই উপমহাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে কতটা জ্ঞাত, তা আমরা জানি না। মনে হয়, ভারত সম্পর্কে তার চিন্তা-চেতনায় কোন অভিঘাত নাই। এক সময় ভারত সম্পর্কে খালেদা জিয়ার যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল। কিন্তু এখন অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে তিনি হয়তো ক্ষমতা লাভের জন্য ভারতকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করতে পারেন। বিশেষ করে ভারতের প্রবল বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন চীনের কাছ থেকে কিনছেন যুদ্ধ-জাহাজ, সাবমেরিন ও অন্যান্য সমরাস্ত্র।
প্রকাশিত ২০১৯ সালে, বিডি ভিউজে।