বিশ্বের উপাদান

ছবি: ইন্টারনেট

আমরা এখন পর্যন্ত যত দূর জানি, প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক দিমক্রিতুস (Democritus) প্রথম অ্যাটম (Atom) শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, প্রতি পদার্থ সেই পদার্থের কতগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকার সমষ্টি মাত্র। এদের তিনি উল্লেখ করেন, অ্যাটম বলে। গ্রিক ভাষায় অ্যাটম শব্দের অর্থ হলো অবিভাজ্য অর্থাৎ এসব কণিকাকে আর ভাগ করা যায় না। দিমক্রিতুস আরো বলেন, বোঝার সুবিধার জন্য আমরা মিষ্টি, তিতা, গরম, ঠাণ্ডা, রঙ- এসব কথা ব্যবহার করি। কিন্তু আসলে অ্যাটম ও শূন্য নিয়ে হলো ব্রহ্মাণ্ড। অ্যাটমের বাংলা করা হয়েছে পরমাণু। কিন্তু পরমাণুবাদ বিজ্ঞানের অংশ হয়ে ওঠে ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি। যখন বিলাতের ম্যানচেস্টার শহরে জন ডালটন (১৭৬৬-১৮৪৪) প্রদান করেন তার পরমাণুতত্ত্ব (Atomic Theory). তিনি বলেন, যৌগিক পদার্থরা মৌলিক পদার্থের রাসায়নিক সংযোগে গঠিত। যৌগিক পদার্থদের বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়, যেসব মৌলিক পদার্থ দ্বারা তারা গঠিত, তাদের। যেমন, ১৮ গ্রাম পানিতে থাকে ১৬ গ্রাম অক্সিজেন ও দুই গ্রাম হাইড্রোজেন। তড়িৎ-এর সাহায্যে ১৮ গ্রাম পানিকে বিশ্লেষণ করলে দুই গ্রাম হাইড্রোজেন ও ১৬ গ্রাম অক্সিজেন পাওয়া যায়। পানির আণবিক সঙ্কেত হলো H2O। এর অর্থ হলো, পানির প্রতিটি অণুতে আছে দু’টি করে হাইড্রোজেন অ্যাটম ও একটি করে অক্সিজেন অ্যাটম। অক্সিজেন হাইড্রোজেনের চেয়ে ১৬ গুণ ভারী। অক্সিজেনের সংযোগ শক্তি (Valency) ৮। হাইড্রোজেনের রাসায়নিক সংযোগ শক্তি হলো ১। রসায়নে যখন বলা হয় পারমাণবিক ওজন, তখন আসলে বোঝানো হয়, হাইড্রোজেন থেকে ওই মৌলিক পদার্থটি কত গুণ ভারী। কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানের অ্যাটম আর রসায়ন বিজ্ঞানের অ্যাটম ঠিক সমার্থক নয়। রসায়ন বিজ্ঞানে আমরা সাধারণভাবে বলি, অক্সিজেনের পারমাণবিক ওজন হলো ১৬। কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানে অক্সিজেনের একটি পরমাণুর ওজন হলো ৬০২০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০। এই সংখ্যাটাকে বলা হয় অ্যাভোগাদ্রোর (Avogadro) সংখ্যা। আমরা এ বিষয়ে আর বিশদ আলোচনার মধ্যে যাবো না। রসায়ন বিজ্ঞানের পরমাণু বা অ্যাটম এখনো ভাঙা যায় না। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরমাণুরা একই থাকে।

ডালটন বলেছিলেন, পরমাণুরা অবিনশ্বর। কিন্তু আমরা এখন জানি, অনেক মৌলিক পদার্থের পরমাণু ভেঙে অন্য পদার্থে পরিণত হতে পারে। এদের বলা হয় তেজস্ক্রিয় পদার্থ। তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে তিন রকম রশ্মি নির্গত হয়। এদের বলা হয় আলফা, বিটা ও গামা। এখন পরমাণুকে কতকটা সৌর জগতের মতো মনে করা হয়। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে প্রোটন নামের আরো সূক্ষ্ম কণিকা। প্রোটন কণিকারা পজেটিভ তড়িৎধর্মী। তাদের প্রদক্ষিণ করে ইলেকট্রন কণিকা। ইলেকট্রন নেগেটিভ তড়িৎযুক্ত কণিকা। এরা প্রোটনের তুলনায় অনেক হালকা। পরমাণুকেন্দ্রে প্রোটন ছাড়া থাকতে পারে নিউট্রন কণিকা। নিউট্রনরা তড়িৎবিহীন। এদের ওপর মৌলিক পদার্থের রাসায়নিক ধর্ম নির্ভর করে না। আলফা বিকিরণে থাকে প্রোটন কণিকারা। অর্থাৎ আলফা বিকিরণ হলো পজেটিভ তড়িৎধর্মী। বিটা কণিকারা হলো নেগেটিভ তড়িৎধর্মী। এরা আসলে হলো ভারী ইলেকট্রন। গামা বিকিরণ হলো সাধারণ আলোর মতো ফোটন কণার প্রবাহ। বিটা বিকিরণ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে প্রথম আসে নিউট্রিনোর ধারণা। নিউট্রিনোরা হলো নিউট্রনের মতোই তড়িৎবিহীন। তাই তাদের নাম দেয়া হয়েছিল নিউট্রিনো। অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র নিউট্রন। এদের ওজন প্রায় নেই বললেই চলে। অনেকে মনে করতেন এরা আসলে হলো ওজনহীন। কিন্তু এখন এদের ওজন নিরূপণ করা যাচ্ছে। এ বছর দু’জন পদার্থ বিজ্ঞানীকে নিউট্রিনোর ওজন মাপার উপায় নির্ধারণ করতে পারার জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো। এদের একজন হলেন জাপানি পরমাণু বিজ্ঞানী তাকাকি কাজিতা, অন্যজন হলেন কানাডার পরমাণু বিজ্ঞানী আর্থার ম্যাকডোনাল্ড। জীবদেহ পরমাণুদের দ্বারা গঠিত। জীবের মৃত্যু ঘটলে তার দেহের পরমাণুরা ঠিকই থাকে। কিন্তু জীবন থাকে না। অনেকে ভেবেছেন, জীবন একটা পৃথক বস্তু। যা জীব থেকে নির্গত হলে জীবের মৃত্যু ঘটে। জার্মানিতে এক সময় এই জীবন পদার্থের ওজন বের করার চেষ্টা চলেছিল। এসব জার্মান বৈজ্ঞানিক Myxomycetes নামে জীবন্তবস্তু নিয়ে গবেষণা করেন। এদের দেহ হড়হড়ে জেলি জাতীয় বস্তুর মতো। এরা হলো খুব সরল প্রকৃতির জীব। এদের অনেকে স্থাপন করতে চান উদ্ভিদজগতে। আবার কেউ কেউ স্থাপন করতে চান প্রাণিজগতে। জার্মান বৈজ্ঞানিকেরা এদের জীবন্ত অবস্থায় খুব সাবধানে ওজন করেন। পরে বিশেষভাবে মেরে ফেলে আবার খুব সাবধানে ওজন করেন। কিন্তু তারা লক্ষ করেন যে, জীবন্ত Myxomycetes-এর ওজন আর মৃত Myxomycetes-এর ওজনে কোনো পার্থক্য ধরা পড়ে না। অর্থাৎ জীবন বলে যদি পৃথক কোনো বস্তু থেকে থাকে, তবে তা হলো ওজনবিহীন। বলা যায় না ভবিষ্যতে কোনো বৈজ্ঞানিক জীবনবস্তুর ওজন মাপার পন্থা আবিষ্কার করতে পারবেন কি না।

কিছুদিন আগেও অনেক বৈজ্ঞানিক মনে করতেন, নিউট্রিনোদের কোনো ওজন নেই। আমরা বলেছি, তেজস্ক্রিয় বস্তুদের নিয়ে গবেষণা করে প্রমাণিত হয়েছে যে, অনেক মৌলিক পদার্থ তেজস্ক্রিয়। যাদের থেকে তিন প্রকার রশ্মি বিকিরিত হয়। তেজস্ক্রিয় পদার্থে একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত হলো রেডিয়াম। রেডিয়াম থেকে আলফা বিকিরণ নির্গত হওয়ার ফলে অনেক রেডিয়াম অণু পরিণত হয় র‌্যাডন গ্যাস অণুতে। প্রাচীনকালে অনেকে চেষ্টা করেছেন, পরশপাথর ছুঁইয়ে লোহাকে সোনায় পরিণত করতে। কিন্তু তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। তাই রসায়নবিদেরা মনে করতেন একটি মৌলিক পদার্থের আর একটি মৌলিক পদার্থে রূপাান্তরিত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তেজস্ক্রিয় বস্তু নিয়ে গবেষণার ফলে এই ধারণার বিলুপ্তি ঘটেছে। লোহা একটি তেজস্ক্রিয় ধাতব নয়। কিন্তু রেডিয়াম একটি তেজস্ক্রিয় ধাতব বস্তু। ধাতববস্তুর পরমাণুতে ইলেক্ট্রনগুলো খুব আলগাভাবে আটকা থাকে। তাই ধাতববস্তুর মধ্য দিয়ে তড়িৎ সহজেই প্রবাহিত হতে পারে। রেডিয়ামের মধ্য দিয়েও তড়িৎ সহজেই প্রবাহিত হতে পারে। কিন্তু র‌্যাডন একটি ধাতব পদার্থ নয়। তাই এর মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহিত সহজেই হতে পারে না। র‌্যাডনকে ঠাণ্ডা করে শক্ত বস্তুতে পরিণত করে দেখা গেছে, এর মধ্য দিয়ে তড়িৎকে সহজে প্রবাহিত করা যায় না। এখন আমরা জানি যে, তড়িৎ আসলে হলো, ইলেকট্রন প্রবাহ মাত্র। বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে মৌলিক পদার্থের কিছু সংখ্যক ইলেকট্রন মাত্র। রাসায়নিক বিক্রিয়া হলো ইলেকট্রনের ব্যাপার মাত্র। আমাদের দেহে অনেক রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে চলেছে। তাও ঘটে চলেছে কেবল পরমাণুর ইলেকট্রনের মাধ্যমে। প্রোটন বা অন্য কোনো কণিকার মাধ্যমে নয়। সবচেয়ে সরল অ্যাটম হচ্ছে হাইড্রোজেন অ্যাটম। সাধারণ হাইড্রোজেন অ্যাটমে থাকে একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রন। কিন্তু যাকে বলে ভারী হাইড্রোজেন অথবা ডয়টেরিয়াম, তার পরমাণুতে থাকে একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন। ভারী হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি যৌগ লিথিয়াম ডয়ট্রনেট দিয়ে বানানো হচ্ছে হাইড্রোজেন বোমা। সাধারণ হাইড্রোজেন দিয়ে হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করা গেলেও তা হতে চায় খুব ব্যয়বহুল। তাই এখন হাইড্রোজেন বোমা তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে লিথিয়াম ডয়ট্রনেট যৌগ।

আমাদের দেহে পরমাণুতে কী পরিমাণ নিউট্রন আছে, তা আমি জানি না। আমাদের দেহের পরমাণুতে নিউট্রিনো কী সংখ্যায় থাকে তাও আমার জানা নেই। এই না জানার জন্য আমাদের দেহে সংঘটিত রাসায়নিক বিক্রিয়া বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। কেননা, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে কেবল মৌলিক পদার্থের ভ্যালেন্সি ইলেকট্রন (Valency Electron)। আমি পদার্থ বিজ্ঞানের লোক নই। নিউট্রিনো নিয়ে যা বললাম, তা বললাম খুব সাধারণ জ্ঞান থেকে। তবে আমার মনে হচ্ছে, নিউট্রিনোর মতো যাকে আমরা বলি জীবন পদার্থ, তারও ওজন একদিন হয়তো বিজ্ঞানীরা মাপার কৌশল বের করতে পারবেন। তবে অনেকে মনে করনে, জীবনবস্তু বলে কিছু নেই। জীবন বিশ্বের কোনো বিশেষ উপাদান নয়। তা কেবলই রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল মাত্র।

দৈনিক নয়াদিগন্ত/০৯ অক্টোবর ২০১৫

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ