চীনারা প্রথমে বারুদ আবিষ্কার করে। বারুদ বানাতে লাগে সোরা, গন্ধক ও কাঠ কয়লার গুঁড়ো। এদের একত্রে মেশাতে হয় বিশেষ পরিমাণে। চীনারা প্রথম হাউই বানায় বাঁশের চোঙ্গায়। তারাই প্রথম শুরু করেন হাউই ছুড়ে যুদ্ধ করা। চীন থেকে মধ্য এশিয়া হয়ে হাউই তৈরির কৌশল আসে এই উপমহাদেশে। হায়দার আলী এবং তার পুত্র টিপু সুলতান ইংরেজ সৈন্যের বিরুদ্ধে সিরঙ্গপত্তনামে (Seringapatam) ইংরেজ সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন বাঁশের চোঙ্গায় বারুদ পুরে হাউই তৈরি করে (১৭৮০-১৭৮৪)। ইংরেজরা হাউই ছুড়ে যুদ্ধের কৌশল শেখে দণি ভারতে যুদ্ধের সময়। তারা এটা শিখে ইউরোপে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে লোহার চোঙ্গায় বারুদ পুরে হাউই তৈরি করে (১৮০৬-১৮০৭)। নেপোলিয়ানের সৈন্যের বিরুদ্ধে ইংরেজরা কোপেন হেগেনে ছুড়েছিল ২৫ হাজার হাউই। ইংরেজিতে হাউইকে বলা শুরু হয় রকেট।
কিন্তু বর্তমানে রকেট বলতে হাউইকে আর বোঝায় না। যুদ্ধে এখন যে রকেট ব্যবহার হয়, তার উদ্ভব ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে। এই রকেট তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় বিশেষ ধরনের জ্বালানি, যা থাকে রকেটের মধ্যে। এই জ্বালানি রকেটের মধ্যেই একটি বিশেষ কে পোড়ানো হয়। রকেট চলতে পারে বাইরের বাতাসের অক্সিজেন ছাড়াই। জার্মানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লন্ডনে সাইকোনাইটেনের সাহায্যে তৈরী বোমা নিপে করেছিল রকেটের সাহায্যে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ভি-টু রকেট। এতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় অ্যালকোহল। ভি-টু রকেটে অ্যালকোহল রাখা হয় একটি প্রকোষ্ঠে। আর একটি প্রকোষ্ঠে রাখা হয় তরল অক্সিজেন। এদের এনে পোড়ানো হয় আরেকটি প্রকোষ্ঠে। এর ফলে যে গ্যাস উৎপন্ন হয়, তার ধাক্কায় রকেট এগিয়ে চলে সামনের দিকে। গ্যাস নির্গত হয় রকেটের পশ্চাৎ দিকে বিশেষ পথে। যেহেতু জ্বালানি রকেটের মধ্যে তরল অক্সিজেনের সাহায্যে পোড়ানো হয়, তাই বাইরের বাতাসের অক্সিজেনে কোনো প্রয়োজন হয় না। এরকম রকেটের সাহায্যে তাই এখন মহাকাশ অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে। জেড বিমান বাতাস ছাড়া চলতে পারে না। কেননা, জ্বালানি পোড়াবার জন্য প্রয়োজন হয় বাইরের বাতাসের মুক্ত অক্সিজেন। কিন্তু রকেটের তা প্রয়োজন হয় না। তবে রকেট এবং জেড বিমান দুটোই চলে নির্গত গ্যাসের ধাক্কায়, নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে। আবদুল কালাম বানিয়েছেন ভারতের রকেট। এতে নিশ্চয় যথেষ্ট বুদ্ধি লেগেছে। কারণ, তাকে বের করতে হয়েছে কৃত কৌশল। কিন্তু রকেটের মূল নীতি আগে থেকেই ছিল জানা। এক্ষেত্রে তিনি যে তার কোনো মৌলিক চিন্তার অবদান রেখেছেন, তা নয়। আমরা বৈজ্ঞানিক তাকেই বলি, যিনি কোনো কিছু আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তার নিজস্ব চিন্তার স্বাক্ষর রাখেন। ভারতের রকেট এখন মঙ্গলগ্রহ প্রদক্ষিণ করছে। ভারত এই রকেট মঙ্গলগ্রহ প্রদণি করবার জন্য কেন পাঠিয়েছে, তা আমরা জানি না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা ইতোমধ্যেই সেখানে রকেটের সাহায্যে রোবট পাঠিয়েছে। নাসার মাধ্যমে যেসব সংবাদ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে দেখা যাচ্ছে, মঙ্গলগ্রহে কোনো নদী নেই। তরল পানি নেই। মঙ্গলগ্রহে খুব উঁচু পাহাড় আছে। কিন্তু পাহাড়ের মাথায় জমে নেই বরফ। মঙ্গলগ্রহে আছে অনেক নুড়িপাথর, যা থেকে অনুমান করা চলে, মঙ্গলগ্রহে একসময় ছিল নদী। আর নদীর স্রোতে য় হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল এ ধরনের মসৃণ নুড়িপাথর। মঙ্গলগ্রহে বায়ুমণ্ডল ঘন নয়। এতে মুক্ত অক্সিজেনের পরিমাণ খুব কম। মানুষের মতো প্রাণীর শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন মঙ্গলের বাতাসে এখন আর নেই। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে সম্ভবত একসময় ছিল যথেষ্ট মুক্ত অক্সিজেন। কিন্তু তা মঙ্গলের মাটিতে লোহার সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পরিণত হয়েছে ফেরিক অক্সাইডে। মঙ্গলের মাটি তাই হলো লালচে। মঙ্গলগ্রহের তাপমাত্রা খুব কম। সেখানকার অসহ্য শীতে মানুষ বিশেষ ধরনের জামা ছাড়া বাঁচতে পারবে না। তাই মনে হচ্ছে, মঙ্গলগ্রহে গিয়ে পৃথিবীর মানুষের উপনিবেশ গড়া সম্ভব হবে না। এরকম গ্রহ মঙ্গল সম্পর্কে জানতে ভারত কেন বিপুল অর্থ ব্যয়ে রকেট পাঠাতে আগ্রহী হয়েছে, আমরা তা জানি না। যে ভারতে প্রতি বছর না খেতে পেয়ে বহু কৃষক আত্মহত্যা করছেন, সেই ভারতের জন্য এরকম কোনো রকেট তৈরি কতদূর সঙ্গত হচ্ছে, তা নিয়ে ভারতের জনমনেও জাগছে নানা প্রশ্ন। আবদুল কালাম ভারতে রকেটের জনক বলে পরিচিত। তিনি এরকম বিপুল ব্যয়কে সমর্থন করে গেছেন।
আমরা যতদূর জানি, আবদুল কালাম ছিলেন উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদী। তিনি চেয়েছিলেন, ভারতকে একটি প্রথম শ্রেণীর সামরিক শক্তিতে পরিণত করতে। কিন্তু অস্ত্র যুদ্ধ করে না; যুদ্ধ করে রক্ত মাংসের মানুষ। তারা না খেয়ে যুদ্ধ করে কখনোই পারে না যুদ্ধে জয়লাভ করতে। দুই দু’টি বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের একটি কারণ হলো, সে দেশের খাদ্যাভাব। যুদ্ধরত সৈন্যদের জন্য রুটি তৈরির ময়দায় জার্মানি একপর্যায়ে বাধ্য হয়েছিল করাতের গুঁড়ো মেশাতে, যা আহার করে বহু জার্মান সৈন্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। রকেট দিয়ে যুদ্ধ করে ভারত তাই কোনোভাবেই একটি পরাশক্তিতে পরিণত হতে পারে না। যদি না তার খাদ্য সরবরাহ যথেষ্ট বর্ধিত হয়। বিপুলসংখ্যক জনসাধরণকে অনাহারে অর্ধাহারে রেখে ভারত একটি প্রথম শ্রেণীর সামরিক শক্তিতে কখনোই পরিণত হতে পারে না। সে চেষ্টাকে বলতে হবে দুরাশা মাত্র।
আমরা বৈজ্ঞানিক বলতে বুঝি, যারা বিজ্ঞানে দান করেছেন তাদের মৌলিক চিন্তা। দৃষ্টান্ত হিসেবে তামিলনাড়ুর বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ভেঙ্কট রমনের নাম করা যেতে পারে। যিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ লাভ করেন ১৯৩০ সালে। তামিলনাড়–তে জন্মেছিলেন বিখ্যাত রামানুজমের মতো বিখ্যাত গণিতজ্ঞ। যাদের সাথে আবদুল কালামের কোনো তুলনা করতে যাওয়া হবে একেবারেই অসঙ্গত।
বৈজ্ঞানিক বলতে আমরা বুঝি বিজ্ঞানের কোনোক্ষেত্রে যিনি কোনো মৌলিক অবদান যুক্ত করতে পারেন। যেমনÑ ওপরের দৃষ্টান্তে ভেঙ্কট রমন। ফলিত বিজ্ঞানের ক্ষেত্র বৈজ্ঞানিক বলতে বুঝি এমন ব্যক্তিকে, যিনি নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পেরেছেন। কিন্তু আবদুল কালাম নতুন কিছু আবিষ্কার করেননি। রকেটের আবিষ্কারক তিনি নন। রকেট তৈরির জন্য যেসব হিসাবপত্রের দরকার হয়, তাও ছিল অনেক আগে থেকেই তৈরি। সেক্ষেত্রেও যে তিনি কিছু যোগ করেছেন, তা নয়। তিনি ছিলেন একজন দ ইঞ্জিনিয়ার ও প্রশাসক। যার নেতৃত্বে তৈরি হতে পেরেছে শক্তিশালী ভারতীয় রকেট।
১৯৯৮ সালের ১১ মে ভারত রাজস্থানের মরুভূমিতে মাটির নিচে ঘটায় তিনটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ। এরপর একই জায়গায় ১৩ মে ঘটায় আরো দু’টি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ। পাকিস্তান ওই একই সালে ২৮ মে দক্ষিণ-পশ্চিম বেলুচিস্তানের মরুময় স্থানে মাটির নিচে ঘটায় পাঁচটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ। এরপর ৩০ মে ওই একই জায়গায় ঘটায় আরো দু’টি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ। এ থেকে সহজেই অনুমান করা চলে যে, পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা ভারতের আগেই তৈরি করতে পেরেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তারা বিস্ফোরণ ঘটাতে চায়নি। পাকিস্তান মঙ্গলগ্রহ প্রদক্ষিণ করানোর মতো রকেট তৈরি করেনি। কিন্তু সে বানাতে সক্ষম হয়েছে এমন রকেট, যার সাহায্যে সে ভারতের যেকোনো শহরে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ সক্ষম। অর্থাৎ ভারত পরমাণু বোমা তৈরি করে এই উপমহাদেশে শক্তির ভারসাম্যকে ওলটপালট করে দিতে পারেনি।
অন্য দিকে, চীন পারমাণবিক অস্ত্রে আছে ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে। যত দূর জানি, চীন বানাতে পেরেছে হাইড্রোজেন বোমা, যা ভারত সম্ভবত এখনো বানাতে সম হয়নি। চীনের সাথে ভারতের এখন শান্তি আলোচনা চলেছে লাদাখে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫ হাজার ৬৫ মিটার ঊর্ধ্বে অবস্থিত। এত উঁচুতে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে আলোচনা ইতিহাসে নজিরবিহীন।
সম্প্রতি পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক আবদুল কাদের খান বলেছেন, ভারতের পরমাণু অস্ত্র রাশিয়ার কাছ থেকে ধার করা। তিনি আবদুল কালামকে বলেছেন, একজন প্রকৌশলী। কোনো বৈজ্ঞানিক প্রতিভার অধিকারী তিনি ছিলেন না। ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়ার কাছ থেকে ধার করা কি না, আমরা তা জানি না। তবে তিনি আবদুল কালাম সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, মনে হয় তা বস্তুনিষ্ঠ। আবদুল কাদের খান ছিলেন জিওলজির ছাত্র। সেই সুবাদে তিনি হয়ে ওঠেন ইউরেনিয়াম নিয়ে গবেষণায় উৎসাহী। আর নির্মাণ করতে সক্ষম হন পাকিস্তানের পরমাণু বোমা। তার বড় কৃতিত্ব হলো, তিনি অনেক কম খরচে পরমাণু বোমা তৈরির কৌশল আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছেন। পাকিস্তানের পরমাণু বোমা বানাতে নাকি খরচ পড়ে ভারতের পরমাণু বোমা বানানোর খরচের চেয়ে অর্ধেক। আমরা বোমা বিশারদ নই। এ বিষয়ে তাই কোনো মন্তব্য করতে পারি না। তবে সাধারণভাবে এটুকু অনুমান করতে পারি, ভারত পরমাণু বোমা তৈরি করে এই উপমহাদেশের শক্তির ভারসাম্যকে একেবারেই ওলটপালট করে দিতে পারেনি। পাকিস্তানের পরমাণু বোমা এখনো বজায় রাখতে পেরেছে শক্তির ভারসাম্য। যার দ্বারা পরোভাবে বাংলাদেশও হতে পেরেছে উপকৃত।
আবদুল কালাম ভারতের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি ভারতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ২০০২ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত। ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রেসিডেন্ট শাসিত দেশ নয়। ভারত হলো, কার্যত প্রধানমন্ত্রী শাসিত দেশ। ভারতের প্রেসিডেন্ট কেবল নামমাত্র ভারতে সর্বোচ্চ প্রশাসক। কিন্তু আমাদের দেশের পত্রপত্রিকায় আবদুল কালাম সম্পর্কে এমনভাবে লেখা হলো, যেন তিনি প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ছিলেন ভারতের সবচেয়ে প্রধান রাজনৈতিক শক্তিধর ব্যক্তি। যেটা আদৌ ঘটনা ছিল না। ভারতের সংবিধান অনুসারে যা কখনো হওয়া সম্ভব নয়। আমরা বলেছি, আবদুল কালাম ছিলেন একজন উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদী। কিন্তু তামিলনাড়–তে প্রবল হয়ে উঠেছে তামিল জাতীয়তাবাদ। তামিলরা চাচ্ছেন, একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে, যার সাথে মরহুম আবদুল কালামের চিন্তার কোনো সঙ্গতি ছিল না। তামিলনাড়–তে মুসলমানের সংখ্যা হলো মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫ ভাগের কাছাকাছি। তারা রাজনীতিতে কোনো সক্রিয় অংশ নিচ্ছেন না। প্রধানত ব্যবসাবাণিজ্য করেই হতে চাচ্ছেন সচ্ছল। ভারতের রাজনীতিতে তামিল মুসলমানেরা কোনো ফ্যাক্টর নয়।
বিজেপি গত বছরের লোকসভা নির্বাচনে তামিলনাড়– থেকে জিততে পারে মাত্র দু’টি আসনে। কিন্তু বিজেপি আবদুল কালামকে চাচ্ছে ভারতের একজন Culture Hero বানাতে। সেটা কতদূর সম্ভব হবে, আমরা তা বলতে পারি না। ভারত আবদুল কালামকে কালচার হিরো বানাতে পারে, কিন্তু আমাদের কিছু পত্রপত্রিকায় তাকে নিয়ে এমনভাবে লেখা হলো, যেন তিনি আমাদেরও একজন Culture Hero। যেটা আমার কাছে মনে হলো, বেশ কিছুটা অসঙ্গতিপূর্ণ। কেননা, বাংলাদেশ একটা পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আবদুল কালাম আমাদের কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন ভারতের একসময়ের রাষ্ট্রপতি। তিনি এমন কিছু আবিষ্কার করেননি, যাতে করে বাংলাদেশের মানুষ উপকৃত হতে পারে।
দৈনিক নয়াদিগন্ত/০৮ আগস্ট ২০১৫