ভারতের ঐক্যে হিন্দুত্ব

Photo: Divyakant Solanki/EPA, via Shutterstock

ভারতের আসাম প্রদেশে ঠিক কি হতে যাচ্ছে, আমরা অনেকেই তা আন্দাজ করতে পারছি না। কারণ, আসাম ভারতের একটা অঙ্গরাষ্ট্র।নিজে কোন একটা পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়। ভারত কেবল একটা ইউনিয়ন (union) বা যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, দ্বি-নাগরিকত্ব আছে, কিন্তু ভারতে দ্বি-নাগরিকত্ব বলে কিছু নাই।

ভারতের সংবিধানের পাঁচ নম্বর ধারা অনুসারে ভারতের প্রত্যেক নাগরিক কেবলমাত্র ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, কোন রাজ্য সরকাররের নাগরিক নন। আমরা বুঝতে পারছিনা কেন কিকারণে আসামে NRC (=National Registration of Citizens) করা হচ্ছে। বলাহচ্ছে, যাঁরা এই তালিকা থেকে বাদ পড়বেন, তারা হয়ে পড়বেন রাষ্ট্রবিহীন (stateless)। ভারতকে একটি যুক্তরাষ্ট্র বা ইউনিয়ন বলা হলেও ভারত আসলে হলো এক-কেন্দ্রিকরাষ্ট্র। ভারতের কথিত অঙ্গ রাষ্ট্রগুলিতে রাজ্যপাল সেই রাজ্যের নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত হননা। যেমন হয়ে থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

ভারতে প্রত্যেক অঙ্গরাষ্ট্রের গভর্ণর বা রাজ্য পাল নিয়োগ পান কেন্দ্রীয় সরকার থেকে। কেবল তাই নয়, উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মচারীরাও নিয়োগ পেয়ে থাকেন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে। সব অঙ্গ রাজ্যের উচ্চ পদস্থ কর্মচারীগণ নিযুক্তি পান ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে, ভারতের সংবিধানের ৩১২ নম্বর ধারা অনুসারে। কেবল এই নয়, ভারতের লোকসভা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে যে কোন অঙ্গ রাজ্যের সীমানা বা আয়তন পরিবর্তন করতে পারে। আর এর জন্য মূল রাজ্যের আইন সভার কোন সম্মতি গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। ভারত অঙ্গরাষ্ট্র সমূহের গভর্ণর বা রাজ্য পাল ভারতের প্রেসিডেন্ট (রাষ্ট্রপতি) এর অধীন। ভারতের এই সাংবিধানিক কাঠামোতে কিভাবে এনআরসি করা সম্ভব হচ্ছে, সেটাই আমাদের উপলব্ধিতে আসতে পারছে না।

বিজেপি দল ও বিজেপি সরকার এর অনেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীবলছেন, আসাম থেকে বাংলাভাষী মুসলমানদের চলে যেতে হবে। কারণ তারা নাকি গিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু এত লোক কি করে ভারতের সীমান্তরক্ষীদের চোখে ধূলো দিয়ে আসামে প্রবেশ করতে পারলো, সেটা দেখা দিচ্ছে একটা বড়রকমের প্রশ্ন হয়ে। মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছে। ভারত সরকার যদি চায়, তবে বাংলাভাষী মুসলমানদের যে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে পারবেনা, এমন মনে করা যায়না। আমাদের এখনই যথেষ্ট সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের জলপাইগুড়ি ও কোচ বিহার জেলার সীমান্ত রয়েছে আসামের সঙ্গে। সেখান থেকে বাংলাভাষী মানুষ আসামে যেতে পারে। কারণ, তারা ভারতের নাগরিক। আর আসাম একটা পৃথক রাষ্ট্র নয়, পশ্চিমবঙ্গের মতোই ভারতের একটা অঙ্গরাজ্য অথবা প্রদেশ।

আসামের ধুবড়ী ও গোয়ালপাড় জেলার লোক বাংলা ভাষায় কথা বলেন। এই দুটিজেলাকে ইংরেজ শাসন আমলে তদানিন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে বিযুক্ত করে আসাম এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এই দুটি জেলা কেবল বাংলাভাষী নয়, মুসলিমপ্রধান। বৃটিশ শাসন আমলে তদানিন্তন ময়মনসিংহ জেলা ও কিছু পরে ত্রিপুরা (কুমিল্লা) জেলা থেকে অনেক বাংলাভাষী মুসলমান যেয়ে উপনিবিষ্ট হন তদানিন্তন আসাম প্রদেশে। কিন্তু এঁদের বংশধরদের এখন বহিরাগত বলে তাড়াবার প্রশ্নউঠছে কেন? বাংলাভাষী মুসলমান আসামে যেয়ে বন কেটে দেশটাকে কৃষিভূমিতে পরিণত করেছেন। যাতে আসাম হতে পেরেছে অনেক সমৃদ্ধ। বাংলাভাষী মুসলিম কৃষক আসামে যাওয়াতে আসাম ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। একটি হিসাব অনুসারে বৃটিশ শাসন আমলে প্রায় পাঁচলাখ বাংলাভাষী মুসলমান যেয়ে উপনিবিষ্ট হন তদানিন্তন আসামে। এটা ঠিক একদেশ থেকে আর এক দেশে যেয়ে গায়ের জোরে উপনিবেশ গড়া ছিলনা।

আসামের সবচেয়ে বড় শহর হলো গৌহাটি। আসামীরা বলেন “গুয়াহাটি”। এর আগের নাম ছিল “গুবাক-হাটি”। গুবাক-হাটি নাম টি ফারসী। ফারসীতে “গুবাক” বলতে বোঝায় সুপারি। “হাট” বলতে বোঝায় কেনা-বেচার জায়গা। বাংলার স্বাধীন সুলতানরা এককালে গৌহাটি পর্যন্ত জয় করেছিলেন। তাঁদের শাসন আমলেই উদ্ভব হতে পেরেছিল নামটির। গৌহাটিতে আরবি ভাষায় লিখিত একটি শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে।যা থেকে জানা যায়, বাংলার সুলতান শাম্‌সউদ্দীন ইলিয়াস শাহের পুত্র এখানে একটি টাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গৌহাটি শহরের দিসপুর নামক এলাকায় এখন নির্মাণ করা হয়েছে আসামের রাজধানী দিসপুর শহর।

আসামের অনেক মন্দিরে পড়েছে সুলতানী আমলের গোড়ের মসজিদের প্রভাব। মন্দিরে করা হয়েছে উল্টানো বাটির মতো গম্বুজ। আজ আসাম এর সঙ্গে বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিরাট ব্যবধানের কথাঅনেকে বলছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সংলগ্ন পশ্চিম আসামের স্থাপত্য ও ভাষা তার প্রমাণ দেয় না।পশ্চিম আসামের কথ্য ভাষা যথেষ্ট বাংলা ভাষাররই মতো। ভূপেন হাজারিকা বাংলা ভাষায় চমৎকার গান লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন। তিনি কথা প্রধান বাংলা গান দ্বারা প্রভাবিত হয়েইএটা করতে পেরেছেন বলে অনুমান করা চলে।

এক সময় আসামের বিখ্যাত চিত্র প্রযোজক ছিলেন প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া। তিনি ছায়াছবি করেন বাংলা ভাষায়। যাতে তিনি যুক্ত করেন রবীন্দ্র সঙ্গীত। সিনেমাতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংযোজন তাঁর আগে আর কেউ করেছিলেন বলে আমার মনে পড়েনা। রবীন্দ্র সঙ্গীত সমৃদ্ধ তাঁর বিখ্যাত ছায়াছবিটির নাম ছিল “মুক্তি”। আসামী (অহমীয়া) ভাষা আর বাংলা একই অক্ষরে লেখা হয়। কেবল অহমীয়া ভাষায় “র” লেখা হয় “ব” এর পেট কেটে। বাংলা ও অহমীয়া বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছিল ত্রিহুতে। যা এখন ভারতের বিহার প্রদেশের অংশ। বিহার এর ত্রিহুতে এখন চলে নাগরী অক্ষর।

বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) এখন ভারতের জাতীয় ঐক্যকে বাড়াতে চাচ্ছে হিন্দুত্বের মাধ্যমে। কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতের তিনটি প্রদেশে বিশেষ ভাবে মানুষ গ্রহণ করছে খৃষ্টানধর্ম (ব্যাপটিস্ট)। এরা কোনভাবেই অনুপ্রাণীত হতে পারছেননা বিজেপির হিন্দুত্বের মতবাদ দ্বারা। আমরা আশা করেছিলাম,নরেন্দ্র মোদী অনুসরণ করবেন অটলবিহারী বাজপেয়ীকে। অটলবিহারী বাজপেয়ী ছিলেন একজন মধ্যপন্থী নেতা। তিনি তাঁর নীতিনির্ধারণে উগ্র হিন্দুত্ববাদকে প্রশ্রয় প্রদান করতে চাননি। যেমন চাননি নরেন্দ্র মোদী।

উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগাল্যান্ড (Nagaland) রাজ্যের মানুষ মানব ধারার দিক থেকে বিশেষ ভাবেই মঙ্গোলীয়। এদের ভাষা হলো বৃহত্তর চীনা ভাষা পরিবারভুক্ত। নাগারা অনেকেই এখন গ্রহণ করছেন খৃষ্টানধর্ম। নাগারা চাচ্ছেন স্বাধীন হতে। অনেক দিন থেকেই তাঁরা চাচ্ছেন স্বাধীন হতে। এবারের (২০১৯) স্বাধীনতা দিবসে নাগারা নাগাল্যান্ডে ভারতের পতাকা না উড়িয়ে উড়িয়েছেন পৃথক স্বাধীন নাগাল্যান্ডের পতাকা। বৃটিশ ভারতের প্রশাসন নাগাল্যান্ড অধিকার করে ১৮৭৯ খৃষ্টাব্দে। এর আগে তা ভারতভুক্ত ছিল না। ১৯৫৬ খৃষ্টাব্দ থেকে নাগারা করছেন স্বাধীন নাগা-রাজ্যের আন্দোলন। এখন তা আবার তীব্র হতে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে।

প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ এ, বিডি ভিউজে। 

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ