দৈনিক বর্তমান ২৪ মার্চ ২০১৪ সংখ্যায় ‘ভারতের নাম বদল’ শিরোনামে একটি খবর পড়লাম। ওই পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ভারতের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে একটি দল (নাম বলা হয়নি) তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছে, তারা যদি জয়ী হয় তবে ভারতের নাম বদলিয়ে দেবে। তারা ভারতের বর্তমান নাম বদলে করবে United States of India বা ইউএসআই। বিষয়টি আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। কারণ ভারতের নাম বদলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র করতে গেলে ভারতের সংবিধানকে বিশেষভাবেই বদলে ফেলতে হবে। কেননা এ ক্ষেত্রে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করার চেষ্টা চলে (যা হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি), তাহলে ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলোকে দিতে হবে এখনকার চেয়ে অনেক বেশি স্বায়ত্তশাসন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আর নিযুক্তি দেয়া সম্ভব হবে না অঙ্গরাষ্ট্রগুলোতে গভর্নর বা রাজ্যপালের। প্রতিটি অঙ্গরাষ্ট্রের রাজ্যপালকে হতে হবে সেই অঙ্গরাজ্যের নাগরিক। আর তাকে নির্বাচিত হতে হবে ওই বিশেষ অঙ্গরাজ্যের মানুষের ভোটে।
ইচ্ছা করলেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ভেঙে দিতে পারবে না (এখন যেমন পারে) অঙ্গরাজ্যের বিধানসভাকে। কোনো অঙ্গরাজ্যের সীমান্তের পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না কেন্দ্রীয় সরকার। ক’দিন আগে যেমন অন্ধ্র প্রদেশকে ভেঙে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করল তেলেঙ্গানা প্রদেশ, এ রকম কোনো নতুন প্রদেশ গঠন করা কেন্দ্রের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। অর্থাৎ নাম বদল হওয়ার অর্থ, কেবলই একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার হবে না; এর হবে একটি সুদূরপ্রসারী ফল। দলটি আরো বলেছে, তারা আসন্ন নির্বাচনে জিতলে লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলমের (এলটিটিআই) ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে। দলটির নাম না বললেও মনে হচ্ছে দলটি হলো তামিলনাড়ুর। আর হতে পারে অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড় মুনেত্রা কাজাগাম (All India Anna Dravida Munnetra Kazhagam)। যার নেত্রী হলেন তামিলনাড়– প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। দলটির নামের বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়াবে, নিখিল ভারত প্রগতিশীল দ্রাবিড় ফেডারেশন। এর প্রভাব এখন কেবল ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের মধ্যে সীমিত নেই; যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে দ্রাবিড় ভাষাপরিবারভুক্ত ভাষায় কথা বলে, দক্ষিণ ভারতের এমন অন্যান্য তামিল ভাষাভাষী প্রদেশেও (যেমন, কেরালা, অন্ধ্র, কর্নাটক)। অর্থাৎ ভারত এখন বিভক্ত হতে যাচ্ছে আর্য ও দ্রাবিড় ভারতে। আমার কাছে তাই এই নাম বদলের ঘটনাটিকে মনে হচ্ছে খুবই গুরুত্ববহ।
ভারতে চলে আসছে ব্রিটিশ ধারার পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র। অনেকে মনে করছেন, ভারতে হওয়া উচিত যুক্তরাষ্ট্রের মতোই প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির গণতন্ত্র। না হলে ভারত ভেঙে যাবে। কেননা ভারতে এখন দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন প্রদেশকে নির্ভর করে শক্তিশালী আঞ্চলিক দল গড়ে উঠতে। আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সঙ্ঘাত না এড়াতে পারলে ভারতের রাষ্ট্রিক ঐক্য বিনষ্ট হতেই পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সারা দেশের অস্থায়ী নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে; যারা নির্বাচনের পর আর কোনো ক্ষমতার অধিকারী থাকেন না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার নিজের পছন্দমতো সেক্রেটারি (মন্ত্রী) বেছে নেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হতে পেরেছে যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষমতার স্বাতন্ত্র্যবিধান। যুক্তরাষ্ট্রে শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন পরিষদ যথেষ্ট পৃথকভাবে নিজেদের কাজ করে যেতে পারে। ভারতেও এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়া যুক্তিযুক্ত, নইলে ভারত ঐক্যবদ্ধ একটি দেশ হিসেবে টিকে থাকবে বলে মনে হচ্ছে না অনেকেরই কাছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে একটি বিরাট পার্থক্য আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সব অঙ্গরাজ্যের ভাষা হলো এক। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের ভাষা ও অঙ্গরাজ্যগুলোর ভাষার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র ভাষা হলো ইংরেজি; কিন্তু ভারত বহুভাষাভাষী মানুষের দেশ। আর ভাষাগুলো হলো খুবই উন্নত। কারণ প্রত্যেকেরই আছে লিখিত সাহিত্য। ভারতকে একভাষাভাষী দেশ করা সহজ নয়। হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করা যাচ্ছে না। দ্রাবিড়ভাষীরা আর্য ভাষা হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হচ্ছেন না। ভারত কার্যত চলেছে ব্রিটিশ শাসনামলের মতো ইংরেজি ভাষাকে নির্ভর করে। আর মনে হচ্ছে এই নির্ভরতা অনির্দিষ্টকাল ধরেই চলবে। তামিলনাড়ুর নেত্রী নিজে অবশ্য অনেকগুলো ভাষায় কথা বলতে পারেন। তবে তিনি শৈশবে পড়াশোনা করেছেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। তিনি ইংরেজি বলেন খুবই সুন্দর। মাতৃভাষা তামিলের ওপর আছে তার যথেষ্ট দখল। তিনি হিন্দি ভাষাও জানেন। অর্থাৎ ভাষার দিক থেকে তিনি পেতে পারেন সহজেই সর্বভারতীয় নেতৃত্ব। আগামী নির্বাচনে ভারতের লোকসভায় বিজীয় হয়ে কারা মন্ত্রিসভা গঠন করবেন তা আমরা জানি না। তবে যত দূর ধারণা করা যায়, মন্ত্রিসভা হবে একাধিক দলের সম্মিলনে। ভারতের রাজনীতি ভারতের ব্যাপার, বাংলাদেশের ব্যাপার নয়; কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এই নির্বাচন সম্পর্কে হয়ে উঠেছেন যথেষ্ট আগ্রহী। ভারতে যদি কংগ্রেস ক্ষমতায় না থাকে, তবে বাংলাদেশেও পড়বে তার বিরাট প্রভাব। কেননা ভারতীয় কংগ্রেস ও বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের মধ্যে গড়ে উঠেছে বিশেষ মৈত্রীর বন্ধন। ভারতে কংগ্রেস সরকার না থাকার একটা অর্থ দাঁড়াবে, বাংলাদেশে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়ে পড়া। অর্থাৎ ভারতের রাজনীতির ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশেরও রাজনীতির ভবিষ্যৎ।
এই উপমহাদেশে কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৮৫ সালে। উপমহাদেশে কংগ্রেস হলো সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দল। এর আগে এই উপমহাদেশে কোনো দল ছিল না। রাজনৈতিক দলের ধারণা আমরা পেয়েছি ইংল্যান্ড বা বিলাতের কাছ থেকে। কংগ্রেস দল গঠন করেছিলেন একজন ব্রিটিশ নাগরিক, যার নাম ছিল অ্যালান ও স্টাভিয়ান হিউম (Allan O. Hume)। তিনি ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। মাতার দিক থেকে ভারতীয়। হিউম নিজে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। তিনি কংগ্রেসের লক্ষ্য হিসেবে বলেছিলেন, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি স্বায়ত্তশাসিত দেশ (Dominion Status) লাভ করা। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৮৫ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে তিনজন ইংরেজ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন এ দলের। এভাবেই হতে পেরেছিল কংগ্রেসের সূচনা। পরে তা হয়ে উঠতে থাকে একটি প্রকৃত ভারতীয় জাতীয়তাবাদী দলে। কংগ্রেসের মতো দল থাকার ফলেই ভারত গণতন্ত্রের পথে হতে পেরেছে অগ্রসর। ভারতে টিকেছে গণতন্ত্র; কিন্তু বর্তমানে দলটি হয়ে পড়েছে খুবই দুর্বল। এর কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে বলে আর মনে হচ্ছে না অনেকেরই কাছে। ভারতে বিজেপি হয়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী দল। বিজেপি একটি সর্বভারতীয় সংগঠন। তার ঘোষিত নীতি হিন্দুত্ববাদী। এই দল ক্ষমতায় এলে ভারতে হিন্দু-মুসলমান সঙ্ঘাত বৃদ্ধি পেতেই পারে। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঘটতে পারে সম্পর্কের আরো অবনতি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবছেন, নির্বাচনে তার দল পশ্চিমবঙ্গে ভালো করতে পারলে তিনিও ঘটনার স্রোতে হতে পারেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোট পাওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাত মেলাচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর সাথে। এরও একটা বিশেষ প্রভাব এসে পৌঁছতে পারে বাংলাদেশে। অর্থাৎ ভারতের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের ওপর বাংলাদেশের রাজনীতির স্রোতধারাও হয়ে পড়ছে নির্ভরশীল। তাই আমরা ভারতের নির্বাচন নিয়ে একেবারে না ভেবে থাকতে পারছি না। অবশ্য ভারতের নির্বাচন ভারতেরই ব্যাপার। তা আমাদের সরাসরি কোনো রাজনৈতিক ভাবনার বিষয় নয়।
(৩১ মার্চ ২০১৪, সোমবার, দৈনিক নয়াদিগন্ত)