হিন্হিদুত্ন্দুবত্ব কথাটা এখন ভারতের রাজনীতিতে খুব জোরশোরে শোনা যাচ্ছে। শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত হিন্দু মহাসভার নেতা বিনায়ক দামদর সাভারকার (১৮৮৩-১৯৬৬)। সাভারকার ছিলেন ভয়ঙ্কর ধরনের মুসলিমবিদ্বেষী। তিনি মনে করতেন, কেবল ব্রিটিশ শাসনের অবসানের মধ্য দিয়েই ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা আসবে না। ভারতকে যথার্থভাবে স্বাধীন হতে হলে, ভারতীয় সমাজজীবনকে গড়তে হবে বেদাশ্রিত হিন্দুত্বের ভিত্তিতে। ফিরতে হবে বৈদিক যুগে। তিনি আরো বলেন, ভারতে মুসলমানেরা এসেছেন বাইরে থেকে। হিন্দুত্বের প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাদের ভারত থেকে দিতে হবে বহিষ্কার করে। তারা পরদেশী।
ইসলাম হিন্দুত্বের সাথে মোটেও খাপ খায় না। যতগুলো কারণে পাকিস্তান আন্দোলন জোরালো হতে পেরেছিল, এর মধ্যে একটি ছিল এই মুসলিম বিতাড়নের হুমকি। ভারতের বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) ছিলেন মহাত্মা গান্ধী নামে পরিচিত। তাকে দিল্লিতে নাথুরাম বিনায়ক গডসে নামে এক মারাঠি হিন্দু যুবক রিভলবারের গুলি ছুড়ে হত্যা করেন। গডসে ছিলেন সাভারকারের হিন্দুত্ববাদে উদ্দীপিত। মহাত্মা গান্ধী এ সময় চাচ্ছিলেন দিল্লিতে যে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চলেছিল, তা প্রশমিত করতে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে মহাত্মা গান্ধী পূর্ব বাংলায় নোয়াখালীতে এসেছিলেন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা থামাতে; কিন্তু মুসলমানেরা কেউ এর জন্য তাকে খুন করতে চাননি। বরং দাঙ্গা থামাবার জন্য তারা বাড়িয়েছিলেন সহযোগিতার হাত। মহাত্মা গান্ধী মারা যান এক উন্মত্ত হিন্দুত্ববাদী যুবকের হাতে, ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার মাত্র ছয় মাস অতিবাহিত না হতেই। এই ছিল ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিশেষ সূচনা।
এখন এ কথা শুনলে অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হবে, পাকিস্তানের ধারণাটা ঠিক মুসলমানদের মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল না। পাঞ্জাবের বিখ্যাত হিন্দু নেতা লালা লাজপৎ রাই (১৮৬৫-১৯২৮) প্রথম ১৯২৫ সালে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা সমাধানের জন্য প্রস্তাব করেন যে, তখনকার ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে দু’টি স্বতন্ত্র মুসলমান প্রদেশ গঠন করতে হবে। তাদের দিতে হবে স্বায়ত্তশাসন। পাকিস্তান গড়ার ধারণা আসতে পেরেছে, অনেকের মতে লালা লাজপৎ রাইয়ের এই ধারণা থেকে।
হিন্দু ধর্ম ও সমাজজীবনের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, বর্ণাশ্রম প্রথা। হিন্দু সমাজ ছিল চারটি প্রাথমিক বর্ণে বিভক্ত। এরা হলো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ব্রাহ্মণদের কাজ ছিল পূজা-অর্চনা ও জ্ঞানচর্চা। ক্ষত্রিয়দের কাজ ছিল যুদ্ধ করা। বৈশ্যদের কাজ ছিল পশুপালন, কৃষিকাজ ও সওদাগরি। শূদ্রদের কাজ ছিল কেবলই খেটে খাওয়া এবং প্রথম তিন বর্ণের সেবা করা। চতুরবর্ণের মধ্যে এক বর্ণের লোক অন্য বর্ণের কাছ থেকে আহার্য ও পানীয় গ্রহণ করত না। এদের মধ্যে স্থাপিত হতে পারত না বৈবাহিক সম্পর্ক। বর্ণ কথাটার অর্থ ছিল রঙ। একে ভাবা যায় একধরনের বর্ণবাদী ব্যবস্থা। মহাভারতের শান্তি পর্বে বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণদের গায়ের রঙ হলো ফর্সা; ক্ষত্রিয়দের গায়ের রঙ হলো রক্তাভ, বৈশ্যদের গায়ের রঙ হলো পীতাভ, আর শূদ্রদের গায়ের রঙ কালো।
পরে এই চারবর্ণ ভেঙে আরো ছোট ছোট জন্মগত শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এই শ্রেণীগুলোকে বলা হতে থাকে ‘জাতি’। হিন্দু সমাজজীবনে যেমন জাতিভেদ প্রথা দেখা যায়, অন্য আর কোনো সমাজজীবনে তা পরিদৃষ্ট হয় না। মহাত্মা গান্ধী এই জাতিভেদ প্রথার বিরোধী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এর অবসান। এ ক্ষেত্রেও তার চিন্তাচেতনার সাথে ছিল হিন্দুত্ববাদীদের বিশেষ বিরোধ। ভারতের হিন্দু সমাজে এখন জাতিভেদ প্রথা আগের মতো অতটা তীব্র হয়ে নেই। কিন্তু অনেক পরিমাণে আছে হিন্দি ভাষাভাষী অঞ্চলে। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এখানে এখন গড়েছেন নিজেদের জাতিভিত্তিক রাজনৈতিক দল। হতে পারছে যাকে বলে জাত-পাতের রাজনীতি। ভারতের এককালের বিখ্যাত সমাজতন্ত্রী নেতা ড. রামমনোহর লহিয়া (১৯১০-১৯৬৭) একটি প্রবন্ধ লেখেন ‘দ্য কাস্ট সিস্টেম’ (১৯৬৪) নামে। ইংরেজিতে জাতিভেদ প্রথাকে বলা হয় কাস্ট সিস্টেম। ইংরেজি ভাষায় কাস্ট শব্দটা এসেছে পর্তুগিজ ‘কাস্তা’ শব্দ থেকে।
পর্তুগিজ ভাষায় কাস্তা মানে বংশ। হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা নিয়ে প্রথম বিশেষভাবে আলোচনা করেন পর্তুগিজরা। রামমনোহর লহিয়ার মতে, কাস্ট সিস্টেম কেবল মাত্র শ্রমবিভাজনকে নির্ভর করে গড়ে ওঠেনি। এর মূলে কাজ করেছে হিন্দু ধর্মের বিশেষ বিশ্বাস। তাই ভারতে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক শোষণের কথা ভাবলে চলবে না, সমাজতন্ত্রীদের ভাবতে হবে জাতিভেদ প্রথা বিলুপ্ত করা নিয়ে। বন্ধ করতে হবে মানুষের ওপর মানুষের অমানবিক আচরণকে। কিন্তু এই অমানবিক আচরণ ভারতের বহু প্রদেশেই এখনো যথেষ্ট বিদ্যমান। আর হিন্দুত্বের ধারণা একে চলেছে সমর্থন করে। হিন্দুদের কাছে মুসলমানেরা সাধারণভাবে বিবেচিত হয়েছেন অচ্ছুত বা ম্লেচ্ছ হিসেবে।
খ্রিষ্ট্রীয় চতুর্দশ শতাব্দীদে মরক্কো থেকে ভারতে আসেন বিখ্যাত আরব পর্যটক ইবনে বতুতা। তিনি বাংলাদেশেও এসেছিলেন। তিনি তার ভ্রমণকাহিনীতে বলছেন যে, তৃষ্ণার্ত মুসলমান পথিক পানি পান করতে চাইলে হিন্দুরা তা দিত না। ভাবেন, এর ফলে তাদের বাসন অপবিত্র হবে। যদিও এই উপমহাদেশের উত্তরভাগে তখন চলেছিল মুসলিম নৃপতিদের শাসন। ভারতে এখন ক্ষমতায় এসেছে বিজিপি দল।
বিজেপির মূল রাজনৈতিক আওয়াজ হচ্ছে হিন্দুত্বের প্রতিষ্ঠা। এই হিন্দুত্ব বলতে এখন ব্যবহারিক রাজনীতিতে যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো, মুসলিমবিদ্বেষ। বিজিপির হিন্দুত্ব আর মুসলিমবিদ্বেষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমার্থক। যাকে কিছুটা তুলনা করা চলে হের হিটলারের আর্যবাদের সাথে। হের হিটলারে আর্যবাদ বাস্তবে দাঁড়িয়েছিল ইহুদি নিধন। আর ভারতের আর্যবাদী হিন্দুত্ব হয়ে দাঁড়াচ্ছে মুসলিম নিধন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বিজিপি ভারতে একটা মোটেও শক্তিশালী দল ছিল না। বিজিপি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙে দিতে পারার পর থেকে। এই মসজিদ ভেঙে দেওয়ার নেতৃত্ব দেন তখনকার বিজিপির অন্যতম নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানি। ভারতের মুসলমানেরা ভয় পাচ্ছেন এই ভেবে যে, ভারতের আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে দিয়ে বিজিপি একটা হিন্দু-মুসলমান সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে। ভারতের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৪ ভাগ হলেন মুসলমান।
মুসলমানেরা সাধারণত ভোট দেন কংগ্রেসকে। বিজেপি তাই বিশেষভাবে সৃষ্টি করতে পারে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। আমাদের দেশে অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন, যারা মনে করেন, মুসলমানেরা হলেন ধর্মান্ধ; কিন্তু মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুরা কোনো অংশেই কম ধর্মান্ধ নন। আর তাই তারা বিশ্বাস করতে পারছেন, বাবরি মসজিদের মেহেরাবে রামের মূর্তি মাটি ফুঁড়ে নির্গত হতে পেরেছে। অনেকে হয়তো ভাবছেন, ভারতের রাজনীতি নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তিত না হলেও চলে; কিন্তু ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা বাংলাদেশে ঢোকার কথা ভাবতে পারেন ‘হরহর বোমবোম’ বলে। ভারতে বিজিপির সমর্থক দল হচ্ছে শিবসেনা ও বজরং। যারা হলো ভয়ঙ্করভাবে মুসলিমবিদ্বেষী।
আমাদের দেশে অনেক বামপন্থী চিন্তক আছেন, যারা মনে করেন ‘মানুষের ইতিহাস শ্রম সংগ্রামের ইতিহাস’। কিন্তু সাদা মানুষ কালো মানুষকে ঘৃণা করে। এই ঘৃণাটাকে সর্বতোভাবে কি শ্রেণী-সংগ্রামের ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ভাগে একসময় সাদা মানুষ গড়েছিল কঁ কষীঁ কষধহ নামে একটি দল। যারা একসময় অসহায় নিগ্রোদের ধরে ধরে খুন করত এবং পেতো পৈশাচিত আনন্দ। মানুষের ইতিহাসের সব কিছু অর্থনীতির ছকে ফেলে ভাষ্য করা যায় না। ব্যাখ্যা করা যায় না ভারতের ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলমান বিরোধকে। ভারতের ইতিহাসকে এখন ঢেলে সাজানো হচ্ছে। আগে বলা হতো, আর্যরা ভারতে এসেছিলেন বাইরে থেকে।
কিন্তু এখন বিজেপির পণ্ডিতেরা বলছেন, আর্যরা বাইরে থেকে আসেননি। তারা ছিলেন ভারতেরই লোক। ভারতে থেকে তারা ছড়িয়ে পড়েন চার দিকে, সভ্যতার আলোকবর্তিকা বহন করে। কিন্তু এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৩৫ সালে পারস্যের তখনকার সরকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কাছে আবেদন রাখেন যে, পারস্যকে ডাকা হোক ইরান বা আর্যদের দেশ হিসেবে। প্রাচীন পার্সিক ভাষাকে বলা হয় আবেস্তিক। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে তা হলো বিশুদ্ধ আর্যভাষা। বিজিপি এখন বলছে, হিন্দুত্বের কথা। কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিকেরা বলেন যে, হিন্দু নামটা এসেছে প্রাচীন ফারসি ভাষা থেকেই। সংস্কৃত ভাষায় যেখানে কোনো শব্দের প্রথম ধ্বনি হতে দেখা যায় ‘স’, সেখানে ফারসিতে হতে দেখা যায় ‘হ’। যেমন সংস্কৃততে ‘সুরা’, সেখানে ফারসিতে হয় ‘হুরা’। যেখানে সংস্কৃতিতে হয় ‘সপ্ত’, সেখানে ফারসিতে হয় ‘হপ্ত’।
যেখানে সংস্কৃততে ‘সিন্ধু’, সেখানে ফারসিতে হয় ‘হিন্ধু’। প্রাচীন ফারসিতে হিন্ধু বলতে বুঝিয়েছে সিন্ধুনদের তীরবর্তী লোকদের। হিন্ধু শব্দটা পরবর্তীকালে হয়েছে হিন্দু। তাই বিজিপির খাঁটি আর্যের ধারণাকে বলা যায় না সঠিক। এই উপমহাদেশে মানুষ বহুবার এসেছে মধ্য এশিয়া থেকে। মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিলেন কুশানরা। উত্তর ভারতে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল এক সাম্রাজ্য। কুশানরা আর্য ছিলেন না। তারা ছিলেন তুর্কি মানবধারার মানুষ। বিখ্যাত কুশান সম্রাট কোনিষ্ক, যার রাজত্বকালকে ধরা হয় ১২০ থেকে ১৬২ খ্রিষ্টাব্দ। তার একটি মূর্তি পাওয়া গিয়েছে উত্তর ভারতের মথুরার কাছে। মাটি খুঁড়ে পাওয়া এই মূর্তিটির মাথা ভাঙা। মস্তকটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু মূর্তিটি যে কোনিষ্কের, সেটার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। তার কারণ, মূর্তিটির গায়ের খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা আছে কোনিষ্কের নাম।
মূর্তিটিতে কোনিষ্কের গায়ে পাথর কেটে করা হয়েছে আচকান, পরনে করা হয়েছে চুড়িদার পায়জামা। পায়ে করা হয়েছে নাগরা জুতা। কোমরে করা হয়েছে ঝোলানো সোজা তলোয়ার। মূর্তিটি দেখে মনে হতে পারে একজন মুসলমান সৈনিকের। কিন্তু মূর্তিটা হলো কুশান সম্রাট কোনিষ্কের। সম্রাট কোনিষ্কের রাজধানী ছিল পেসয়ার বা পুরুষপুর। এখানে খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা শিলালিপিও পাওয়া গিয়েছে। কেবল আর্যরা এসেই এ দেশে রাজত্ব করেছেন, এমন নয়। যেসব মুসলমান মধ্য এশিয়া থেকে উত্তর ভারত জয় করেছিলেন, তারাও ছিলেন মূলত তুর্কি মানবধারাভুক্ত মানুষ। বাংলাদেশে উচ্চবর্ণের হিন্দু বলতে বুঝায় ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যকে। উচ্চবর্ণের হিন্দুর মধ্যে কায়স্থর সংখ্যা হলো সবচেয়ে বেশি।
এদের চেহারার মিল খুঁজে পাওয়া যায় মধ্য এশিয়ার গালাচ ও তাজিকদের সাথে। যারা হলেন তুর্কি মানবধারার মানুষ। কেন এদের সাথে তুর্কি মানবধারার এই মিল, তার কোনো ব্যাখ্যা এখনো নৃতাত্ত্বিকেরা দিতে পারেননি। বাংলাদেশে কুশান সম্রাটদের মুদ্রা পাওয়া গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে কুশান সম্রাটরা রাজত্ব করেছিলেন বলে অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন না। আমরা ইতিহাসের জটিল বিতর্কের মধ্যে যেতে চাই না; কিন্তু ইতিহাসের এসব কথা মনে করছি বিজিপির হিন্দুত্ববাদের সমালোচনা করার জন্যই।