১৯১১ সালে চীনে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়। চীন পরিণত হয় একটি প্রজাতন্ত্রে। ১৯১২ সালে সান ইয়াৎ-সেন (১৮৬৬-১৯২৫) হন চীন প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট। ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের সরকার চায় ব্রিটিশ-ভারত ও তিব্বতের মধ্যে সীমান্ত চিহ্নিত করতে। এই লক্ষ্যে ব্রিটিশ ভারতের সরকার সিমলায় একটি সম্মেলন ডাকে। এতে ব্রিটিশ-ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন ম্যাক মাহন (Mac Mahon)। ম্যাক মাহন যে সীমান্তরেখা অঙ্কিত করেন তিব্বতের প্রতিনিধি সেটা মেনে নেন। কিন্তু চীনের প্রতিনিধি যাকে ওই সম্মেলনে ডাকা হয়েছিল তিনি চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে ম্যাক মাহন লাইনকে ভারত ও তিব্বতের মধ্যে সীমারেখা মানতে অস্বীকার করেন এবং কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর না করে ফিরে যান নিজ দেশে। এ সময় তিব্বত নামমাত্র ছিল চীনের অধীন।
সে বাস্তবে হয়ে উঠেছিল একটা স্বাধীন দেশ। এভাবেই সে মেনে নিয়েছিল ম্যাক মাহন রেখাকে। ১৯৪৮ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি চীনে ক্ষমতায় আসে। পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু এই সরকারকে চীনের প্রকৃত সরকার হিসেবে মেনে নেন। ১৯৫৪ সালে ২৯ এপ্রিল তিনি (অর্থাৎ ভারত সরকার) চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ককে দাঁড় করাবার জন্য চীন-ভারত একটা বিশেষ চুক্তিতে উপনীত হয়। এই চুক্তিতে তিব্বতের ওপর চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বময় কর্তৃত্ব, আরেক কথায় সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এর ফলে উদ্ভব হয় তিব্বত-ভারত সীমান্ত নিয়ে জটিলতা। ভারত চায়, চীন ম্যাক মাহন রেখাকে মেনে নিক। কিন্তু চীন সেটা মানতে অস্বীকার করে। চীন বলে তার প্রতিনিধি ম্যাক মোহন সীমারেখাকে তিব্বত এবং ভারতের মধ্যে সীমারেখা বলে মানেনি এবং এখনো সে ম্যাক মাহন রেখাকে ভারত-চীনের মধ্যে সীমারেখা বলে স্বীকার করবে না।
অতীতে তিব্বত ম্যাকমাহন রেখাকে ব্রিটিশ-ভারত ও তিব্বতের মধ্যে সীমানা হিসেবে মেনেছে। কিন্তু তিব্বত সরকারের কোনো অধিকার ছিল না ব্রিটিশ-ভারতের সরকারের সাথে ওই ধরনের কোনো চুক্তি করার। যেহেতু ভারত সরকার ১৯৫৪ সালে তিব্বতের ওপর চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বময় কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছে, তাই এখন নতুন করে চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত চুক্তি হতে হবে। লাদাখ বলতে বোঝাত কাশ্মির দেশীয় রাজ্যের একটি জেলাকে। লাদাখ অঞ্চল একসময় ছিল তিব্বতের অংশ। কাশ্মিরের ডোগরা রাজা ১৮৮৪ সালে এই অঞ্চল দখল করেন। ফলে লাদাখ পরিণত হয় কাশ্মিরের একটি জেলা হিসেবে। কিন্তু চীনের কমিউনিস্ট সরকার লাদাখকে তার এলাকা বলে দাবি করে এবং লাদাখের বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর প্রতিষ্ঠা করে তার কর্তৃত্ব। ভারত এটা ঠেকাতে পারেনি। অথবা ঠেকাতে চায় না।
চীন তিব্বত থেকে লাদাখের মধ্য দিয়ে একটি সড়ক নির্মাণ করে সিং কিয়াং (জিং জিয়াং) যাওয়ার জন্য। ভারত এই সড়ক নির্মাণে কোনো আপত্তি করেনি। কিন্তু পরে সে দাবি করতে আরম্ভ করে যে, লাদাখ ভারতের অংশ। ফলে ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয় ভারত-চীন সীমান্ত যুদ্ধ। ভারত এই যুদ্ধে চীনের কাছে খুব করুণভাবে পরাজিত হয়। লাদাখ অঞ্চলে চীন ভারতের কাছ থেকে ৮২৮৮০ বর্গকিলোমিটার (৩২০০০ বর্গমাইল) জায়গা দখল করে নিয়েছে এবং এই দখল এখনো বজায় রেখেছে। লাদাখ অঞ্চলের মানুষ দেখতে তিব্বতিদের মতোই এবং ধর্মে তারা হিন্দু নয়, তিব্বতিদের মতোই লামা বৌদ্ধবাদী।
ব্রিটিশ শাসনামলে নর্থ ইস্টার্ন ফ্রন্টইয়ার এজেন্সি বা NEFA বলতে বোঝাত তখনকার আসাম প্রদেশের একটা অংশকে, যা শাসিত হতো আসাম প্রদেশের গভর্নর দিয়ে। এখন এই অঞ্চল নিয়ে ভারত গড়েছে তার একটি প্রদেশ, যার নাম দেয়া হয়েছে অরুণাচল। ভারত অরুণাচল প্রদেশ গঠন করেছে ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি। চীন ভারতের অরুণাচল প্রদেশের ৭৭৭০০ বর্গকিলোমিটার (৩০০০০ বর্গমাইল) জায়গা তার নিজের বলে দাবি করছে। এখানেও চীনের সাথে ১৯৬২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের যুদ্ধ হয়। ভারত এখানে চীনের সাথে যুদ্ধে আরো করুণভাবে পরাজিত হয়।
ভারতের সৈন্য এই অঞ্চলে ম্যাক মাহন রেখা থেকে এখন সাড়ে বারো মাইল দক্ষিণে সরে এসে অবস্থান করছে। ভুটান ছিল ব্রিটিশ-ভারতের একটি আশ্রিত রাজ্য। ভুটান এখন হয়েছে ভারতের আশ্রিত রাজ্য, যদিও আগের মতো আর অতটা আশ্রিত নয়। চীন ভুটানের পূর্বভাগের ৭৭৭ বর্গকিলোমিটার (৩০০ বর্গমাইল) জায়গা তার নিজের বলে দাবি করছে। ডোকলাম গিরিপথ এই অঞ্চলে অবস্থিত। ডোকলাম গিরিপথের মধ্য দিয়ে চীন একটি সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ভারত এই সড়ক নির্মাণে বাধা দিতে পাঠিয়েছে সৈন্য।
ডোকলাম নিয়ে ভারত-চীন সঙ্ঘাতের উপক্রম হয়েছে। ভুটান ডোকলামের ওপর মনে হচ্ছে চীনের কর্তৃত্ব মেনে নিতে চাচ্ছে। কিন্তু ভারত চাচ্ছে না। ভারত-চীন যুদ্ধ বাধবে কি না, আমরা তা বলতে পারি না। সেটা নির্ভর করবে ভারত ও চীনের নীতির ওপর। তবে মনে হচ্ছে, চীন অগ্রসর হচ্ছে একটা দীর্ঘমেয়াদি সামরিক পরিকল্পনা নিয়ে। চীন পাকিস্তানের গোয়াদরে একটি বিরাট সাবমেরিন ঘাঁটি গড়ে তুলেছে বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সংবাদে প্রকাশ।
অন্য দিকে, চীন অতি সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে হামবানতোতা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছে। সেখানেও সে গড়ে তুলছে একটা বিরাট সাবমেরিন ঘাঁটি। চীনের সব সাবমেরিন থেকেই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ব্যবস্থা আছে। মনে হচ্ছে চীন চাচ্ছে ভারতকে নৌপথেও ঘিরে ফেলতে। ভারত চীনকে এখনো এভাবে নৌপথে ঘিরে ফেলার কোনো ব্যবস্থা নিতে পেরেছে বলে আমাদের জানা নেই। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল এখন হয়ে উঠেছে খুবই ভারতবিরোধী। চীন-ভারত সঙ্ঘাতে (যদি বাধে) মনে হচ্ছে নেপাল নেবে ভারতেরই পক্ষ।
সিকিম ছিল ভারতের একটি আশ্রিত রাজ্য। তথাপি ভারত সিকিমকে বিশ্বাস করতে না পেরে ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে তা দখল করে নেয়। সিকিম এখন চাচ্ছে স্বাধীন হতে। সিকিমের ল্যাপচারা চাচ্ছে তাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে চীনের সাহায্য পেতে। মনে হচ্ছে চীন তাদের সাহায্য করতেই ইচ্ছুক। ভুটান পড়েছে দোটানায়। মনে হচ্ছে সে ভারতকে টপকে চীনের সাথে একটা কোনো চুক্তি করে ফেলতেও পারে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে রয়েছে বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন। চীনের চুম্বি উপত্যকা থেকে শিলিগুড়ি করিডোর ১৩০ কিলোমিটারের মতো দূরে অবস্থিত। চীন-ভারত সঙ্ঘাত বাধলে চীন চাইতে পারে এই করিডোর বা যাতায়াত পথ দখল করে নিতে।
শিলিগুড়ি করিডোর বলতে বোঝায় বাংলাদেশ ও নেপালের মথ্যে অবস্থিত ২৭ কিলোমিটার চওড়া জায়গাকে। এই জায়গার মধ্য দিয়ে ভারতের প্রধান ভূভাগের সঙ্গে যুক্ত হলো পূর্ব-ভারতের সাতটি প্রদেশ। এই জায়গার ওপর ভারতের কর্তৃত্ব না থাকলে ভারতকে তার পূর্বাঞ্চলের সাতটি প্রদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি ভারতকে এটা করতে দেবে? কেননা এটা করতে গেলে সে-ও আক্রান্ত হতে পারে চীনের দ্বারা।
এখন যখন পেছনের দিকে তাকাই, তখন মনে পড়ে ১৯৭১ সালের কথা। ১৯৭১-এর পাক-ভারত যুদ্ধ চলেছিল ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। পাকিস্তান হয়তো ইচ্ছা করলে আরো কয়েক মাস যুদ্ধ করতে পারত, কিন্তু চীন পাকিস্তানকে যুদ্ধ থামাতে বলে। পাকিস্তান ভারতের সাথে করে সন্ধি। কিন্তু চীন কেবল ভারতের সাথে পাকিস্তানকে সন্ধি করতে বলেছিল না। সে বলেছিল শেখ মুজিবকে কারামুক্ত করে দ্রুত বাংলাদেশে পাঠাতে, যাতে করে আওয়ামী লীগে তাজউদ্দীনের কর্তৃত্ব শেষ হতে পারে।
অন্য দিকে, সে বলে পাকিস্তান থেকে দ্রুত ২৪ হাজার বাংলাভাষী মুসলমান সৈন্যকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে। এদের মধ্যে ১১০০ জন ছিলেন সেনা অফিসার পর্যায়ভুক্ত। এরা ছিলেন খুবই রক্ষণশীল ও ভারতবিদ্বেষী। প্রধানত এদের সহায়তাতেই হতে পেরেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থান। লক্ষ করার বিষয় হলো, চীন এগিয়ে আসে মোশতাক সরকারকে সহায়তা করার জন্য। চীন মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোশতাক সরকারকে ঠিক এভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল না।
দৈনিক নয়াদিগন্ত, ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ এ প্রকাশিত।