ভারত-বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা চুক্তির কথা শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারত দু’টি ভিন্ন রাষ্ট্র। এ দু’টি রাষ্ট্রের কোনো সাধারণ শত্রু নেই। সুতরাং কার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা চুক্তি, তা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনে সৃষ্টি হতে পারছে নানা প্রশ্ন। রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের যে টানাপড়েন চলেছে, ভারত ইচ্ছা করলে তা মিটিয়ে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারত। কিন্তু দেশটি এ ক্ষেত্রে নীরব থাকা সমীচীন মনে করেছে।
ভারত এখন পর্যন্ত বিশ্বের সব থেকে বড় সমরাস্ত্র কেনা দেশ। কিন্তু বাংলাদেশ নাকি চাচ্ছে ভারতের কাছ থেকে সমরাস্ত্র কিনতে। এই সমরাস্ত্রের মান কী হবে আমরা তা জানি না। সবচেয়ে প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার হচ্ছে, ভারতের তৈরি বিস্ফোরক। ভারত সব কিছুতেই ভেজাল মেশায়। ভারতের বিস্ফোরক হতে পারে ভেজাল বিস্ফোরক। ভারতের কাছ থেকে তাই সমর সম্ভার ক্রয় সামরিক দিক থেকে কতটা সুবিবেচনার কাজ হচ্ছে, সেটি কেবল বলতে পারেন বিশেষজ্ঞরা।
ভারত আমাদের দেশটাকে ঘিরে আছে তিন দিকে। ভারতের সাথে মৈত্রী আমাদের ভৌগোলিক কারণেই কাম্য। এ জন্য বাংলাদেশ-ভারত হওয়া উচিত অনাক্রমণ চুক্তি, কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তি নয়। কেননা ভারত এবং আমাদের কোনো সাধারণ শত্রু নেই, যে নাকি বাংলাদেশ ও ভারতকে আক্রমণ করতে পারে।
একটি দেশে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের সময় দু’টি বিষয় হতে হয় বিশেষভাবে বিবেচ্য, একটি হলো তার ইতিহাস আরেকটি হলো তার ভৌগোলিক অবস্থান।
চীন ও নেপালের সাথে ভারতের সম্পর্ক মোটেও মসৃণ নয়। এ দু’দেশের সাথে ভারতের সঙ্ঘাত ঘটা খুবই সম্ভব। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত সঙ্ঘাত এখনো হয়ে আছে পুরনো দুষ্ট ক্ষতের মতো। ভারতের সাথে যদি নেপাল অথবা চীনের সঙ্ঘাত ঘটে তবে নেপাল ও চীন দখল করতে চাইতে পারে শিলিগুড়ি করিডোর। এটি ১৭ মাইল বা ২৭ কিলোমিটারের কাছাকাছি চওড়া, যার অবস্থান বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে। চীন অথবা নেপালের সাথে যদি ভারতের সঙ্ঘাত বাধে, তবে তারা এই করিডোর বা যাতায়াত পথ দখল করে নিতে চাইতে পারে। কেননা এই পথ দখল করে নিলে ভারত পারবে না উত্তর-পূর্ব ভারতে রসদ ও সৈন্য পাঠাতে। তখন ভারতকে রসদ ও সৈন্য পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আমাদের কোনো ইচ্ছা না থাকলেও বাংলাদেশকে হয়ে উঠতে হবে রণক্ষেত্র। চীনের চুম্বি উপত্যকা থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব ১৩০ থেকে ১৫০ কিলোমিটারের বেশি নয়। চীনের সাথে ভারতের সঙ্ঘাত বাধলে চীনও চাইতে পারে শিলিগুড়ি করিডোর দখল করতে। বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে যাওয়া তাই ভৌগোলিক বিচারে বিপজ্জনক। কারণ তাহলে চীন ও নেপাল বাংলাদেশকে ভাবতে পারে বৈরী রাষ্ট্র।
আসামে অহমিয়ারা চাচ্ছে স্বাধীন হতে। ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি হলে তারাও হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের বৈরী। আসাম থেকে উলফারা ঢুকতে চাইতে পারে বাংলাদেশে; ভারতের অস্ত্র ও সৈন্য চলাচল বন্ধ করার জন্য।
অন্য দিকে বাংলাদেশের ইতিহাস এমন যে, প্রতিরক্ষা চুক্তি করা যেতে পারে না। আজকের বাংলাদেশের উদ্ভব হয়েছে পাকিস্তান ভেঙে। পাকিস্তানের উদ্ভব হতে পেরেছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদকে নির্ভর করে। এই মুসলিম জাতীয়তাবাদ ব্রিটিশ শাসনামলে সৃষ্টি হয়েছিল সে সময়ের রাষ্ট্্িরক ব্যবস্থায় যার রেশ এখনো বজায় আছে। বাংলাদেশ এখনো ভারতকে সেভাবে বিশ্বাস করতে পারছে না। কেননা ভারতে ক্রমে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রকট হয়ে উঠছে যার অন্যতম লক্ষ্য অখণ্ড ভারত গড়া। সহজ কথায়, বর্তমান পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে সামরিকভাবে গ্রাস করা এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ভারত-বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা চুক্তি হওয়া আদৌ ইতিহাসনির্ভর হতে পারে না।
বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ আক্রান্ত হলে ঐতিহাসিক কারণে একমাত্র ভারতের দ্বারাই হতে পারে। সাবেক পাকিস্তান এখন আর নেই। ১৭০০ কিলোমিটার দূর থেকে বর্তমান পাকিস্তান ভারতকে এড়িয়ে আসতে পারে না বাংলাদেশ দখল করতে তাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য ভারত-বাংলাদেশ ঐক্যের কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না এবং এ জন্য হতে পারে না যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি। আমরা ১৯৭১-এর সময়ে বাস করছি না। পাকিস্তানের গোয়াদরে চীন গড়ে তুলেছে বিরাট নৌঘাঁটি। চীনের সাথে পাকিস্তানের কোনো সামরিক চুক্তি সরাসরি না থাকলেও আছে উহ্য প্রতিরক্ষার সমঝোতা। গোয়াদর বন্দর রক্ষার জন্য, বিদেশী পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশ, চীন নাকি ইতোমধ্যে পাঠিয়েছে ১০ হাজার সৈন্য। কাশ্মির নিয়ে ভারত পাকিস্তান সঙ্ঘাত মেটেনি। কিন্তু নতুন করে বৈরিতা দেখা দিয়েছে সিন্ধু নদের পানি নিয়ে।
সিন্ধু নদের পানি নিয়ে যদি ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয় তবে আমরা নিশ্চয়ই সে সঙ্ঘাতে অংশী হতে পারি না। কিন্তু ভারতের সাথে যদি আমরা প্রতিরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ হই, যে কোনো ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘাতে বাধ্য হয়ে ভারতের প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। এসব কথা ভেবেই আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়া কতটা সমীচীন হবে সে সম্বন্ধে।
১৯৭১-এর পৃথিবী আর আজকের পৃথিবী এক নয়। বাংলাদেশের মানুষ তখন যতটা ভারতমুখী হয়েছিল এখন তা নয়। ১৯৭১-এ পাকিস্তান একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ছিল না। এখন যুদ্ধ হলে তা নেবে ভয়াবহ রূপ। এই যুদ্ধে ভারত যে জিতবেই এমন নিশ্চয়তা নেই; কেননা ১৯৭১-এ সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ভারতের বন্ধু। তখন চীনের ভয় ছিল সে যদি পাকিস্তানের হয়ে ভারতের সাথে যুদ্ধে জড়ায় তবে পেছন থেকে আক্রান্ত হতে পারে সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারা। কিন্তু এখন আর তার সে ভয় নেই। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। রাশিয়াও নেই ভারতের সাথে সামরিক সম্পর্কে আবদ্ধ। পাকিস্তান আক্রান্ত হলে চীন ও নেপাল গ্রহণ করতে পারে পাকিস্তানের পক্ষ। সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত ছিল ১৫টি রিপাবলিক নিয়ে। এর মধ্যে ছয়টি রিপাবলিক ছিল মুসলিম অধ্যুষিত। এই ছয়টি রিপাবলিক এখন চাচ্ছে পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের সাথে সামরিকভাবে জোট বাঁধতে; অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তান বন্ধুহীন হয়ে পড়বে না। তাই বলা যায় না, ভারত এই যুদ্ধে জিতবেই।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার নিজের দেশ রক্ষার জন্য আত্মনিবেদিত; কিন্তু তার মধ্যে বিরাজ করছে একটা মুসলিম চেতনা। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তাই চাইতে পারে না ভারতের হয়ে অন্য কোনো মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে লড়তে, যাতে তার দেশের কোনো স্বার্থ নেই। এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে, ভারত যদি বর্তমান পাকিস্তানকে গ্রাস করতে পারে তবে বাংলাদেশকে গ্রাস করার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যাবে । ভারত-বাংলাদেশকে গ্রাস করতে পারেনি পাকিস্তানের সাথে পারমাণবিক যুদ্ধে না জড়াতে চাওয়ার জন্য। কিন্তু ভারতের ক্ষমতায় এখন উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকার। তার পক্ষে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব।
দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত, ০৫ এপ্রিল ২০১৭।