ভেনিজুয়েলার বর্তমান সঙ্কট

Photo: EPA-EFE/PAOLO AGUILAR

সমাজে ধনী-গরিবের ব্যবধান থাকার অর্থ দাঁড়ায় না সমাজটা পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদী সমাজ বলতে বোঝায় এমন সমাজব্যবস্থা, যার অর্থনীতির ভিত্তি হলো জটিল যন্ত্র। ইউরোপে পুঁজিবাদের সূচনা হয় গ্রেট ব্রিটেনে। স্টিম ইঞ্জিনকে নির্ভর করে। স্পেন পর্তুগালে এ ধরনের কোনো যন্ত্রবিপ্লব ঘটে না। যেসব দেশকে বলা হয় ল্যাটিন আমেরিকার দেশ, তারা পশ্চিম গোলার্ধে অবস্থিত। পশ্চিম গোলার্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাকে বাদ দিলে আর সব রাষ্ট্রকে বলা হয় ল্যাটিন আমেরিকার দেশ। এসব দেশের অর্থনীতিতে এখনো ঘটেনি সেভাবে যন্ত্রের প্রয়োগ। যেমন ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও কানাডায়। যন্ত্রবিপ্লব প্রথম ঘটে ব্রিটেনে। এরপর ফ্রান্স ও জার্মানিতে। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সহজেই এসে পৌঁছায় যন্ত্র নির্মাণের কৃত কৌশল।

কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে সেটা হতে পারে না। কেননা, এসব দেশের ভাষা হলো স্প্যানিশ, কেবল একটি ছাড়া। ব্রাজিলের ভাষা হলো পর্তুগিজ। ব্রাজিলের ভৌগোলিক আয়তন প্রায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান। ব্রাজিল ল্যাটিন আমেরিকার অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি কলকারখানা গড়েছে। দক্ষিণ ব্রাজিলে ঘটতে পেরেছে কিছুটা, যাকে বলে যন্ত্রবিপ্লব। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে এখনো ঘটতে পারেনি যন্ত্রবিপ্লব। ল্যাটিন আমেরিকায় ঘটতে পারেনি গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতিষ্ঠা। এর কারণ, স্পেন পর্তুগালে ছিল না কোনো গণতন্ত্রের চর্চা; যেমন ছিল ব্রিটেনে। ব্রিটিশ গণতন্ত্রের প্রকর্ষ ঘটেছে মার্কিন গণতন্ত্রের মধ্যে।

বর্তমানে ভেনিজুয়েলার সঙ্কটকে বুঝতে হলে বুঝতে হয় তার অর্থনীতিকে এবং ঐতিহাসিক কারণে থাকা গণতান্ত্রিক চেতনার অভাবকে। ভেনিজুয়েলায় পেট্রোলিয়াম তোলা শুরু হয় ১৯২২ সাল থেকে। এই পেট্রোলিয়াম উত্তোলনে অংশ নেয় মার্কিন ও ডাচ কোম্পানি। পেট্রোলিয়াম উত্তলনের জন্য প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ভেনিজুয়েলার আছে বিরাট খনিজ তেলসম্পদ।

কিন্তু এই সম্পদের সাহায্যে ভেনিজুয়েলা চালায় না তার কলকারখানা। আসলে সে নিজের কলকারখানা এখনো সেভাবে গড়ে তোলেনি। সে তার তেল রফতানি করে প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার তেলের প্রধান ক্রেতা। তেলের পরই ভেনিজুয়েলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে লৌহ-আকর। কিন্তু ভেনিজুয়েলায় নিজ দেশে লৌহ ও ইস্পাত তৈরির কোনো কারখানা গড়েনি। চেয়েছে লৌহ-আকর রফতানি করে প্রভূত পরিমাণে কম খরচে প্রচুর লাভবান হতে। এভাবেই ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি হয়ে পড়েছে বিশেষভাবে মার্কিননির্ভর। ভেনিজুয়েলা তার ব্যবহার্য সব দ্রব্য আমদানি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। শুধু তাই নয়, সে তার কৃষি অর্থনীতিকেও করেছে অবহেলা।

এখন বলা হচ্ছে, ভেনিজুয়েলায় যা কিছু ঘটছে, তার সবই হতে পারছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চক্রান্তে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেনিজুয়েলায় চক্রান্ত করতে পারছে, কারণ ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি হয়ে পড়েছে বিশেষভাবেই মার্কিননির্ভর। ভেনিজুয়েলার আর্থিক আয় ছিল প্রধানত পেট্রোলিয়াম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিনেছে এই পেট্রোলিয়াম। পরে একে পরিশুদ্ধ করে উৎপাদন করেছে পেট্রল। কিন্তু ভেনিজুয়েলা পেট্রোলিয়াম পরিশোধনেরও কোনো ব্যবস্থা করেনি। নির্ভর করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। আর নির্ভর করেছে ডাচ সেল কোম্পানির ওপর। যারা কারখানা গড়েছে ভেনিজুয়েলার লাগোয়া ডাচ গায়ানাতে। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন খনিজ তেলের দাম পড়ে গেছে। ফলে ভেনিজুয়েলার আয় গেছে কমে।

ফলে বিদেশ থেকে সে কিনতে পারছে না ব্যবহার্য দ্রব্যাদি। এমনকি প্রয়োজনীয় ওষুধ। ভেনিজুয়েলার এই আর্থিক সঙ্কট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্টি করেনি। সৃষ্টি হতে পেরেছে ভেনিজুয়েলার রাজনীতিবিদদের অপরিণামদর্শিতারই ফলে। কিন্তু আমাদের দেশের পত্রপত্রিকা পড়লে মনে হচ্ছে, ভেনিজুয়েলার বর্তমান সঙ্কটের কারণ হলো মার্কিন চক্রান্ত। অথচ আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে তেলের দাম পড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই। ভেনিজুয়েলায় যে রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তার কারণ নিকোলাস মাদুরোর ভোট ডাকাতি করে প্রেসিডেন্ট হওয়া। নিকোলাস মাদুরো ছিলেন হুগো শ্যাভেজের রাজনৈতিক শিষ্য। শ্যাভেজ ছিলেন কিছুটা সমাজতন্ত্রী। তিনি মনে করতেন, তিনি ক্ষমতায় না থাকলে ভেনিজুয়েলার কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়নে কেউ উদ্যোগ নেবে না।

হুগো শ্যাভেজ প্রেসিডেন্ট থাকার সময় নিকোলাস মাদুরো হন ভাইস প্রেসিডেন্ট। হুগো শ্যাভেজ মারা যাওয়ার পর ২০১৩ সালের নির্বাচনে নিকোলাস মাদুরো প্রেসিডেন্ট হন। এ সময় তার বিপক্ষে ভোট ডাকাতির অভিযোগ ওঠে। কিন্তু সেনাবাহিনীর সমর্থনে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারেন। এরপর নির্বাচন হয় ২০১৮ সালে। এই নির্বাচনে তিনি লাভ করেছেন ৬৭.৮ শতাংশ ভোট। এবারের নির্বাচনে অভিযোগ উঠেছে আরো বড় রকমের ভোট ডাকাতির।

দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক সঙ্কট। এই রাজনৈতিক সঙ্কট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্টি করেনি। সৃষ্টি হতে পেরেছে ভেনিজুয়েলার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্যই। এই ভোট ডাকাতির রূপ এতই নগ্ন যে, উদার গণতন্ত্রে আস্থাশীল কোনো দেশ একে সমর্থন দিতে পারছে না। ৫০টি দেশ মানতে রাজি হচ্ছে না নিকোলাস মাদুরোকে বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে। এ ৫০টি দেশের মধ্যে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশ। আছে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি ও কলম্বিয়ার মতো দেশ। দক্ষিণ আমেরিকার একমাত্র বলিভিয়া ছাড়া আর কেউ নিকোলাস মাদুরোকে বৈধ প্রেসিডেন্ট বলে স্বীকার করতে রাজি হচ্ছে না। কিন্তু আশ্চর্যরকমভাবে রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, ইরান নিকোলাস মাদুরোকে সমর্থন দিচ্ছে বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে। এর ফলে দেখা দিয়েছে আন্তর্জাতিক সমস্যা।

ফিদেল ক্যাস্ত্রো রুল (১৯২৬-২০১৬) কিউবায় ক্ষমতায় আসেন ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে। তিনি চান সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুকরণে কিউবায় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রবর্তন করতে। কেবল তাই নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নকে তিনি সুযোগ দেন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র-ঘাঁটি নির্মাণের। যে ঘাঁটি থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইচ্ছা করলে রকেট যোগে পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো শহরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা জানতে পেরে গ্রহণ করে কিউবা আক্রমণের উদ্যোগ। সোভিয়েত ইউনিয়ন রণতরী পাঠায় মার্কিন আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে। কিন্তু সে যুদ্ধ না করে ফিরিয়ে নেয় তার রণতরী। আর বলে, সে কিউবায় কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণ করবে না। এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হতে পারে। এ সময় একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন কিউবা প্রতিরক্ষার জন্য রণতরী পাঠায়, ঠিক সেই সময় ১৯৬২ সালে চীন হিমালয় সীমান্তে ভারতকে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে চীনের হাতে ভারতের ঘটে শোচনীয় পরাজয়। কিন্তু বর্তমানে বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, ভেনিজুয়েলার সঙ্কটে চীন ও রাশিয়া হতে পারছে একমত।

কিন্তু ভৌগোলিক দিক থেকে ভেনিজুয়েলা রাশিয়া থেকে অনেক দূরে। কৃষ্ণসাগর ও বাল্টিক সাগরের বন্দর থেকে রণতরী পাঠিয়ে ভেনিজুয়েলায় রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করা খুব সহজ হবে না। চীন থেকে রণতরী পাঠাতে হলে তা সময় নেবে আরো বেশি। তাকে পাড়ি দিতে হবে প্রশান্ত মহাসাগরের দীর্ঘ পথ। কিন্তু তাহলেও সে সরাসরি যেয়ে পৌঁছতে পারবে না ভেনিজুয়েলায়। তাকে ভেনিজুয়েলায় যেতে হলে যেতে হবে কলম্বিয়ার মধ্য দিয়ে। নিতে হবে কলম্বিয়ার অনুমতি। কিন্তু কলম্বিয়া তা দেবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, হুগো শ্যাভেজ ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রোর বিশেষ বন্ধু এবং সমাজতন্ত্রী। নিকোলাস মাদুরো শ্যাভেজের ভাবশিষ্য। কিন্তু একটা বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে, তা হলো ১৯৯১ সালে ভেঙে পড়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। রাশিয়া এখনো একটি বিরাট সামরিক শক্তি।

কিন্তু রাশিয়ার সমরশক্তি থাকলেও আছে খাদ্যাভাব। যুদ্ধ দীর্ঘ হলে রুশ সৈন্যরা পড়বে খাদ্যাভাবে। রাশিয়ার সাথে এখন যুদ্ধ হচ্ছে ইউক্রেনের। ইউক্রেন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের খাদ্যভাণ্ডার। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ আর নেই। চীন দীর্ঘ যুদ্ধ করতে পারবে কি না বলা যায় না। কেননা যুদ্ধ বাধলে চীনে কমিউনিস্ট-বিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান ঘটতে পারে। চীনে বিরাটসংখ্যাক মানুষ চাচ্ছে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান। কিউবা সমর্থন করছে নিকোলাস মাদুরোকে।

কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার দেশে এখন আর কিউবার প্রভাব আগের মতো নেই। কেননা, এ কথা এখন প্রমাণিত যে, কিউবায় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি আসলে সাফল্য লাভ করতে পারেনি। তা হয়েছে ব্যর্থ। কিউবার মানুষের অভাব-অনটন ঘটেনি। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির আওতায় অর্থনৈতিক উৎপাদন না বেড়ে কমে যেতে চেয়েছে। কিউবা একসময় চেয়েছে মার্কিন ডলার গ্রহণ না করতে। কিন্তু এখন চাচ্ছে সে তা বিশেষভাবেই অর্জন করতে। বিশ্বের এ পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে না ভেনিজুয়েলাকে নিয়ে একটা বড় রকমের যুদ্ধ বাধা সম্ভব। যেমনটি আশঙ্কা করছেন আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী।

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ