প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমালোচনা করা হচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদী হিসেবে। এর একটি কারণ হলো তিনি চাচ্ছেন তার দেশে বিদেশী পণ্য আমদানির ওপর উচ্চ হারে আমদানি শুল্ক আরোপ করতে। কিন্তু তিনি যা করতে চাচ্ছেন তা মার্কিন ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা নয়। এর আগে রিপাবলিক্যান দলভুক্ত একাধিক প্রেসিডেন্ট সেটি করেছেন, যাকে বলে অবাধ বাণিজ্য। সেটি বিশ্বজনীন দৃষ্টি নিয়ে দেখলে মনে হতে পারে উত্তম নীতি। কিন্তু জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় সেটি হতে পারে খুবই ভুল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি উচ্চ হারে বিদেশী পণ্য আমদানির ওপর আমদানি শুল্ক না বসাতো তবে হতে পারত না তার আপন অর্থনীতির বিকাশ। গড়তে পারত না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেট ব্রিটেনের মতোই শিল্প বিপ্লব। পৃথিবী আজো একটি বিশ্ব রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। এখনো তা বিভক্ত হয়ে আছে বহু জাতি রাষ্ট্রে। জাতীয় নীতি তাই গঠিত হচ্ছে জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনা করেই। জাতীয় স্বার্থকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
জাতি আছে তাই আছে জাতীয়তাবাদ। মার্কিন জাতীয়তাবাদ ট্রাম্প সৃষ্টি করেননি। পোপ ফ্রান্সিস ট্রাম্পের মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন হিটলারের আগমন ধ্বনি। কিন্তু ক্যাথলিক গির্জা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কার্যত স্বাগত করেছিল। কেননা সে ভেবেছিল মুসোলিনি হিটলার পারবেন নাস্তিক কমিউনিস্টদের প্রতিরোধ করতে। কিন্তু আজ ক্যাথলিক গির্জা ট্রাম্পের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে। তবে হিটলার মুসোলিনির সাথে ট্রাম্পের তুলনা চলে না। কেননা ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছেন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হয়ে। তার কোনো ব্যক্তিগত বাহিনী নেই। ট্রাম্প বলছেন সংবাদিকেরা হলেন সবচেয়ে অসৎ প্রকৃতির লোক। এটি তিনি বলছেন ক্ষোভে। কেননা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো বিখ্যাত পত্রিকা ছাপিয়েছিল ভুয়া জনমত জরিপের হিসাব, যাতে দেখানো হয়েছিল জনমত ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। ট্রাম্প কোনো মতেই নির্বাচনে জয়ী হতে পারবেন না। কিন্তু ট্রাম্প নির্বাচনে জিতেছেন। প্রমাণিত হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকার জনমত জরিপ ছিল একেবারে বানোয়াট। বিভিন্ন মার্কিন পত্রপত্রিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাবমূর্তিকে বিবর্ণ করবার জন্য প্রচার করা হয়েছিল নানা কুৎসা। আমরা এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় প্রত্যক্ষ করলাম পত্রপত্রিকা কত মিথ্যা কথা বলতে পারে। অবশ্য হলুদ সাংবাদিকতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগেও ছিল। হঠাৎ করেই যে এর আবির্ভাব হয়েছে, এমন নয়।
গণতন্ত্রে কোনো দল বা কোনো ব্যক্তি চিরদিনের জন্য ক্ষমতায় আসেন না। জনমত বদলায় ভোটের মাধ্যমে এক দলের জায়গায় আরেক দল, এক নেতার জায়গায় আরেক নেতা ক্ষমতায় আসেন। ১৯৫১ সালে মার্কিন কংগ্রেস আনে মার্কিন সংবিধানের ২২তম সংশোধনী। যার ফলে এখন আর কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুইবারের বেশি অথবা আট বছরের অধিক সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন না। ওবামাকে তাই চলে যেতেই হতো কিন্তু অনেক পত্রপত্রিকার মন্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, তাকে যেন ষড়যন্ত্র করে সরানো হয়েছে। হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সেটি যেন অনেক পরিমাণে হতো বারাক হোসেন ওবামার ক্ষমতায় থাকা। কেননা হিলারি ক্লিনটন অনুসরণ করতেন তার পদাঙ্ক। কিন্তু রিপাবলিক্যান দল থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ফলে সবই ওলোট-পালট হয়ে গেল। অনেক পত্রিকায় এ জন্য উঠেছে শোকের রোল। কিন্তু এ রকম ওলোট-পালট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই যে প্রথম হচ্ছে তা নয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উলসন করেছিলেন লিগ অব নেশনসের (League Nations) পরিকল্পনা। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় League Nations. কিন্তু ১৯২০ সালের নির্বাচনে রিপাবলিক্যান দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন Warren G. Harding তিনি চান না League Nations যোগ দিতে। বলেন ইউরোপের গণ্ডগোল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়ানো আর ঠিক হবে না। তিনিও দেন মার্কিন জাতীয়তাবাদী মনোভাবের বিশেষ পরিচয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন অসব America First তার আগে অনেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট একই রকম কথা বলেছেন, অবশ্য কিছুটা ভাষায় পার্থক্য ছিল। তারা স্বাক্ষর রেখেছেন মার্কিন জাতীয়তাবাদে। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তাই বলা চলে না একজন উগ্র মার্কিন জাতীয়তাবাদী প্রেসিডেন্ট। কেননা তিনি যা বলছেন, মার্কিন ইতিহাসে তা মোটেও নজিরবিহীন নয়। তিনি মেক্সিকানদের দলে দলে আসতে দিতে চাচ্ছেন না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কারণ এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে ল্যাটিন আমেরিকার দেশের মতো একটা দেশ। বিশৃঙ্খল এবং গণতন্ত্রবিহীন। ইংরেজিভাষী প্রোটেস্টেন আমেরিকান নাগরিকেরা অনেক আগে থেকেই চাচ্ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ল্যাটিন আমেরিকান আসা বন্ধ করা হোক। ডোনাল্ড ট্রাম্প গ্রহণ করেছেন তাদের সেই পুরনো দাবিকে। তিনি চাচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাংলো স্যাকশান সভ্যতার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে। যার আরম্ভ হয়েছিল ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আটলান্টিক সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সভ্যতার পেছনে আছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অঞ্চলকে বলা হয় নিউ ইংল্যান্ড, তার বিশেষ দান এখানে ইংল্যান্ড থেকে প্রথম এসে উপনিবিষ্ট হয়েছিলেন পিউরিটান খ্রিষ্টানরা। যুক্তরাষ্ট্রের সভ্যতায় পিউরিটান খ্রিষ্টানদের আছে বিশেষ অবদান। তারাই হলেন মার্কিন জাতীয়তাবাদের আদি উৎস। মার্কিন জাতীয়তাবাদ ডোনাল্ড ট্রাম্প সৃষ্টি করেননি। তিনি এর প্রতিনিধিত্ব করছেন মাত্র।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন তিনি বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন রোধের আন্দোলনে মার্কিন অর্থ দান বন্ধ করবেন। কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন আসলে ঘটছে কি না সেটি স্পষ্ট নয়। এ ছাড়া এই পরিবর্তন মানুষের কর্মকাণ্ডে কতটা হতে পারছে সেটি নিয়েও থাকছে প্রশ্ন। কেননা ঋতু পরিবর্তন ঘটে। পৃথিবী হেলে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে বলে, জলবায়ু পরিবর্তন ঘটতে হলে পৃথিবীর এই হেলে থাকার মাত্রা কম-বেশি হতে হবে। না হলে ঋতু পরিবর্তন থাকবে একই রকম। মানুষের কর্মপ্রচেষ্টর ওপর পৃথিবীর হেলে থাকা মাত্রা আদৌ নির্ভরশীল নয়। তাই জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অর্থ ব্যয় অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। এ জন্য ট্রাম্প চাচ্ছেন না জলবায়ু পরিবর্তন রোধের আন্দোলনে মার্কিন অর্থ ব্যয় করতে।
আমাদের বাংলাদেশের কথাই ধরি, বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি হয়। কেননা এ সময় দক্ষিণ-পশ্চিম মওসুমি বায়ু বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প বহন করে আনে। আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে বৃষ্টির কারণ সুন্দরবন থাকা নয়। সুন্দরবন থাকলেও বৃষ্টি হবে গ্রীষ্মকালে, শীতকালে নয়। সুন্দরবন না থাকলেও গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতের হেরফের হবে না। ঋতুর ধারা একই রকম থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশের পরিবেশবাদীরা বলছেন যে, সুন্দরবন না থাকলে নাকি আমাদের দেশের জলবায়ু বদলে যাবে। যেটি কখনোই হওয়া সম্ভব নয়। সুন্দরবনের ইতিহাস খুব পুরনো নয়। শ’চারেক বছর আগেই সুন্দরবনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এখন যেখানে সুন্দরবন তার অনেক জায়গাতেই ছিল সমৃদ্ধ জনপদ। সুন্দরবনের মাটি খুঁড়ে যার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। তাই বলা যায় যে, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে যে আন্দোলন এখন হতে পারছে তার কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটলে, তা ঘটছে প্রাকৃতিক নিয়মে, মানুষের কোনো কর্মকাণ্ডের কারণে নয়।
বাংলাদেশে বিএনপি দল হিসেবে হয়ে উঠেছে খুব অদ্ভুত। দল হিসেবে সে এখন যোগ দিতে চাচ্ছে পরিবেশবাদীদের সাথে। বলছে বাংলাদেশের বাতাসকে নির্মল রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কলকারখানা চলেছে কয়লা পুড়িয়ে, যা থেকে উৎপন্ন হচ্ছে প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড, যা আমাদের দেশেও আসছে। যেটি বিএনপি আন্দোলন করে বন্ধ করতে সক্ষম হবে না। কেননা ভারত কয়লা পোড়ানো অর্থনীতি বাতিল করবে না। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন কলকারখানার অর্থনীতি গড়বার বিরোধী। তিনি চেয়েছিলেন হস্তচালিত কুটির শিল্পের বিকাশ। কিন্তু ভারত গান্ধিবাদী পথে চলেনি এবং চলবেও না। চীন এবং ভারত বিশ্বের বায়ুমণ্ডলে যথেষ্ট কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও সালফার-ডাই-অক্সাইড যোগ করছে। যে বাতাস বয়ে আসছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে যদি কয়লা পোড়ানো কলকারখানা কিছু গড়ে ওঠে তবে বায়ুমণ্ডল যে ভয়ঙ্করভাবে দূষিত হবে সেটি ভাবতে পারা যায় না। মনে হচ্ছে কোনো বিশেষ কারণে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা বলছেন বায়ুমণ্ডল নির্মল রাখার কথা। যেটি অনুসরণ করলে বাংলাদেশে কোনো প্রকার কলকারখানার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। বলা হচ্ছে সৌরশক্তিকে কাজে লাগাবার। কিন্তু সৌরশক্তিকে সেভাবে কাজে লাগাবার কোনো প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশের আকাশ অধিকাংশ সময়ে থাকে মেঘে ঢাকা। সূর্যরশ্মি আটকা পড়ে মেঘে। বাংলাদেশের ভূগোলের জ্ঞান থাকলে সৌরশক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা যেতে পারে না। যদিও সৌরশক্তি হতে পারে আমাদের শক্তির অভাব পূরণের একটি উৎস। বিশেষ করে শীতকালে যখন আকাশ থাকে মেঘমুক্ত।
কথাগুলো মনে আসছে এ কারণে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অন্যতম উল্লেখ্য ব্যক্তিত্ব অ্যালগোর বলেছেন বাংলাদেশের উচিত হবে কয়লার ব্যবহার না করে সৌরশক্তির ব্যবহার। যেটি বাংলাদেশের বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অ্যালগোর রামপালে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার বিরোধিতা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছেন রামপালে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র না গড়তে। ট্রাম্প কিন্তু এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যাপারে কিছু বলেননি। অ্যালগোর ছিলেন বিল ক্লিনটনের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি একজন খ্যাতনামা পরিবেশবাদী। পরিবেশবাদী আন্দোলনের জন্য তিনি পেতে পেরেছেন নোবেল পুরস্কার। বিএনপি, জানিনা কেন হিলারির পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাবার জন্য দুইজন সাংবাদিককে পাঠিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। হিলারি হেরেছেন ট্রাম্প জিতেছেন। ট্র্রাম্পকে অভিনন্দন পাঠিয়েছেন খালেদা জিয়া। তবে আমার মনে হয় যে, খালেদা জিয়ার অভিনন্দন ট্রাম্পকে আবেগ আপ্লুত করবে না।
দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭।