চলতি বছরের নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে পালন করা হয়েছিল দর্শন দিবস। বলা হয়েছিল এই দিবস পালনের লক্ষ্য হলো যুক্তি-অভিসারী মানুষ সৃষ্টি। কোনো বিশেষ দর্শন প্রচার নয়; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রতিষ্ঠানটি পরিত্যাগের ঘোষণা দিয়েছে। সে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানটি পরিত্যাগ করছে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও একবার ইউনেস্কো ছেড়ে গিয়েছিল ১৯৮৪ সালে। ব্রিটেন ইউনেস্কো ছেড়েছিল ১৯৮৫ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রিটেন একই যুক্তিতে ছেড়েছিল ইউনেস্কো। বলেছিল ইউনেস্কো হয়ে উঠেছে একটি বামপন্থী প্রতিষ্ঠান। ব্রিটেন ইউনেস্কোতে ফিরে এসেছিল ১৯৯৭ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিরেছিল ২০০৭ সালে।
ইউনেস্কো বলছে, দর্শন দিবস পালনের মাধ্যমে সে চাচ্ছে যুক্তি-অভিসারী মানুষ সৃষ্টি করতে। কিন্তু বলছে না যুক্তি বলতে আসলে সে কী বুঝছে। এখানে থেকে যাচ্ছে একটা বিরাট ফাঁক। ইউনেস্কো যখন গঠন করা হয়, তখন বলা হয়নি কাকে বলব শিক্ষা, কাকে বলব বিজ্ঞান আর কাকে বলব সংস্কৃতি। এখন বলা হচ্ছে না শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির মধ্যে দর্শনের অবস্থান কোথায়। বিজ্ঞান মানুষকে বস্তুনিষ্ঠভাবে ভাবতে শেখায়। কিন্তু বিজ্ঞানের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে দর্শনকে টেনে আনা হচ্ছে কেন? দর্শন আর যুক্তি সমার্থক নয়। যুক্তি ছাড়া বিজ্ঞান অচল। অথচ দর্শন দিবস উদযাপনে ইউনেস্কো নিচ্ছে বিশেষ উদ্যোগ।
কোন বক্তব্য সত্য অথবা মিথ্যা সেটা বিচারের সময় আমরা দু’টি পদ্ধতি গ্রহণ করি। একটিকে বলি প্রত্যক্ষ আর একটিকে বলি অনুমান। আমার বন্ধু এসে বললেন, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি জানালা খুলে দেখলাম, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি তার কথাকে সত্য বলে মেনে নিলাম। কিন্তু আমার বন্ধু অমুক লোককে খুন করেছে। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম, যাকে বলা হচ্ছে খুনি, তখন সে বিদেশে ছিল। আমি তাই আমার বন্ধুর ধারণাকে সত্য বলে মানলাম না। কেননা কোনো ব্যক্তি একই সময় কোনো জায়গায় থাকতে অথবা না থাকতে পারে না। কারো বক্তব্যে যখন এ রকম অসঙ্গতি থাকে, তখন আমরা তাকে মনে করি মিথ্যা। লোক খুন হয়েছে কিন্তু যাকে খুনি বলা হচ্ছে সে ওই লোককে খুন করেনি। এ হলো আমাদের যুক্তিঅভিসারীকার একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত। যুক্তি খোঁজা মন বলতে তাই আমরা ধরে নিতে পারি এমন মন যা খুঁজে দেখতে চাইবে কোনো বক্তব্য সত্যি কি না।
আর সেটা করতে গিয়ে সে দেখতে চাইবে, বক্তব্যের মধ্যে কোনো অসঙ্গতি বিরাজ করছে কি না। কিন্তু অসঙ্গতির ব্যাপারটাও খুঁজে পাওয়া অনেক ক্ষেত্রে হয় যথেষ্ট কঠিন। যখন আমি একটা ঢিল ছুড়লাম, ঢিলটা ক থেকে খ স্থানে যেতে সময় নিল ধরে নিই ২ মিনিট। অর্থাৎ সে এই সময়ের মধ্যে এক জায়গায় ছিল, আবার সেই সময় সে সেই জায়গায় ছিল না। কারণ যদি সে কোনো জায়গায় থাকত, তাবে তার গতি থেমে যেত। অর্থাৎ বেগবান জিনিসের গতিবেগ ব্যাপারটা সাধারণ যুক্তি দিয়ে বোঝা যায় না। ধরে নিতে হয় একই সময় সে কোনো জায়গায় থাকছে আবার থাকছে না। গতির ধারণা আসলে হলো আত্মঅসঙ্গতিপূূর্ণ। শত্রু কামান ছুড়ছে। কামানের গোলা এসে পড়ছে আমাদের ওপর। কামানের গোলাটা আমাদের ওপর এসে পড়াকে অসত্য বলে মনে করতে পারি না।
ইউনেস্কো বলছে না কাকে আমরা বলব যুক্তি। যুক্তির সংজ্ঞা কী হবে। মানুষ অপরাধ করে। আমরা অপরাধীকে শাস্তি দিই। ধরে নিই অপরাধী অপরাধ না করলেও পারত। সে নিজের ইচ্ছায় অপরাধ করেছে। আমরা ধরে নিই অপরাধীকে শাস্তি না দিলে, দণ্ড ভয় না থাকলে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। বিজ্ঞান বলে অকারণে কিছু ঘটে না। অপরাধীর অপরাধ করবারও একটা কারণ থাকে। আমরা যদি ধরে নিই কারণের বশবর্তী হয়েই অপরাধী অপরাধ করেছে। তবে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া যায় না। ধরে নিতে হয় সে নিজের ইচ্ছায় অপরাধ করেনি।
মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও কার্যকারণ তত্ত্বের মধ্যে সঙ্গতি করা যায় না। এটাও দর্শনের একটা বড় সমস্যা। মানুষ অনেক কিছু করে; কিন্তু সে নিজের ইচ্ছায় করে না পরিস্থিতির কারণে করে, তার ব্যাখ্যা করা কঠিন। খলিফা উমর রা: দুর্ভিক্ষের সময় কোনো খাদ্য চোরের হাত কেটে শাস্তি দিতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন দুর্ভিক্ষের সময় মানুষ বাঁচবার জন্য খাদ্য চুরি করতেই পারে। একজন স্বেচ্ছায় অপরাধ করছে না সে পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে অপরাধ করছে, সেটা নির্ণয় করা সহজ নয়। কত মা’র ছেলে মারা যাচ্ছে। সব মা পুত্রশোকে পাগল হয়ে যাচ্ছে না। কিছু মা পুত্রশোকে পাগল হয়ে যায়; যারা পুত্র না মরলে পাগল হতো না। অর্থাৎ একই কারণ সবার ওপর যে একই রকম কর্ম করে তা বলা যায় না। কার্যকারণ ঠিক করা হয়ে উঠে যথেষ্ট কঠিন। প্রশ্ন দেখা দেয় মানুষ কতটা যুক্তিবাদী হতে পারে, সেটা নিয়ে।
দর্শনের একটা প্রশ্ন হলো, জ্ঞানের স্বরূপ নিয়ে। আমরা বিশ্বজগৎকে জানতে চাই দূরবীক্ষণের সাহায্যে অথবা অন্য কোনো যন্ত্রের সাহায্যে। দূর নক্ষত্র থেকে আলো আসতে লাগছে কোটি কোটি বছর। আমরা ওই নক্ষত্র সম্পর্কে যা জানছি তা হলো তার কোটি কোটি বছর আগের অবস্থা; বর্তমান অবস্থা নয়। তার বর্তমান অবস্থা জানা আমাদের সাধ্যের বাইরে। বিজ্ঞান তাই কখনোই বলতে পারে না বর্তমান বিশ্বব্রহ্মান্ডের অবস্থার কথা। আলোর গতিবেগ সেকেন্ডে ৩০০০০০ কিলোমিটার। আমি সকালে সূর্যকে দেখি, কিন্তু দেখছি তার থেকে আসা আলোকে। যা আমার কাছে এসে পৌঁছাতে সময় লেগেছে ৮.৩ মিনিট। অর্থাৎ আমি সূর্যকে কখনোই দেখি না। যা দেখি সেটা হলো তা থেকে আসা আলো। আর সেই আলো আসতে সময় লাগে ৮.৩ মিনিট। জ্ঞান অর্জনের এই বাধা কখনোই অতিক্রম করা সম্ভব নয়।
৮.৩ মিনিট বেশি সময় নয়। এতে সূর্য যে বদলে যায়, তা নয়। কিন্তু যে নক্ষত্র থেকে আলো আসতে লেগেছে কয়েক কোটি আলোক-বছর; তার ক্ষেতে এটা খাটে না। তার বর্তমান অবস্থা জানবার কোনো উপায় আমরা এখনো আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি। আমরা পৃথিবীর মানুষ। পৃথিবীর অভিজ্ঞতা দিয়েই গড়ে উঠেছে আমাদের ভাষা। আমাদের ভাষা দিয়েই তাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে বর্ণনা করা উচিত কি না, সেটা হয়ে উঠে বিতর্কিত বিষয়। কিন্তু আমরা পৃথিবীর মানুষ; পৃথিবীর অভিজ্ঞতানির্ভর ভাষা দিয়েই বিবৃত করতে বাধ্য হই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপকে। আমাদের বর্ণনায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাস্তবতার সাম্যক চিত্র ধরা পড়ে বলে ভাবা যায় না।
তা হয়ে উঠতে চায় আমাদের চেনা পৃথিবীর রূপ। কিন্তু এই পৃথিবীতে আমরা তিন রকমের বাস্তবতার সাথে পরিচিত হই। এক রকম বাস্তবতাকে আমরা বলি জড়। আরেক রকম বাস্তবতাকে বলি শক্তি এবং আরেক রকম বাস্তবতাকে বলি চেতনা। চেতনার আবার দু’টি রূপ আছে। একটিকে আমরা বলি প্রাণ। আরেকটিকে বলি মন। মানুষের নিজের ক্ষেত্রে এই তিন রকম বাস্তবতারই পরিচয় আমরা পাই। আমাদের শরীর জড় পারমাণু দিয়ে তৈরি। যারা নিজেরা চেতন নয়। আমাদের দেহযন্ত্র চলতে লাগছে শক্তি। আমরা কাজ করতে প্রয়োগ করছি শক্তি। আমরা মরে গেলে জড় দেহ থাকে। কিন্তু প্রাণ ও চেতনা থাকে না। প্রাণ ও চেতনার স্বরূপ নিয়ে ওঠে নানা বিতর্ক। দার্শনিকেরা প্রশ্ন তোলেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু ঘটছে সবই পরিচালিত হচ্ছে জড়-বিজ্ঞানের নিয়মে, না এর পশ্চাতে আছে বিশ্ব-মন। ধর্মে যাকে বলা হয়েছে ঈশ্বর।
মনকে ঘিরে দর্শন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক ভাগকে বলা হয় ভাবাবাদ। যারা মনে বাস্তবতার ওপর করেন বিশেষ গুরুত্বারোপ। আর অন্য ভাগকে বলা হয় জড়বাদী। যারা জড়বস্তুর ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করেন। এমনকি মনের অস্তিত্বকেই স্বীকার করেন না। বাম-চিন্তকেরা হলেন জড়বাদী। অভিযোগ উঠছে ইউনেস্কো ঝুঁকে পড়তে চাচ্ছে জড়বাদেরই দিকে; কিন্তু জড়বাদকে মানলে মানুষের বিচার বুদ্ধিকে মানা যায় না। কারণ মানুষের মনের অন্যতম কাজ বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। আর তার দ্বারা নিজেকে পরিচালনা করা। মনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করলে আইনের প্রয়োজনীয়তাকে আর স্বীকার করা যায় না। সে দিক থেকে পড়তে হয় সামাজিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে। ইউনেস্কো এক দিকে বলছে যুক্তি অভিসারী মানুষ সৃষ্টি করবার কথা, অন্য দিকে আবার করতে চাচ্ছে মানুষের চেতনার গুরুত্বকে খর্ব।