রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাভাষী মুসলমান সমাজ

এবার খুব ঘটা করে নওগাঁর পতিসরে রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী পালিত হলো। ইতঃপূর্বে দেশের প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে কোথাও কোনো কবি অথবা লেখকের জন্মজয়ন্তী পালিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। শেখ মুজিবুর রহমান কাজী নজরুল ইসলামকে করে গিয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে চেষ্টা চলেছে যেন, রবীন্দ্রনাথকে জাতীয় কবি করার। শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এক জায়গায় বলেছেন, আমাদের বাঙালির মধ্যে দু’টি দিক আছে, একটি হলো আমরা মুসলমান আর একটি হলো, আমরা বাঙালি। তিনি তার এই উক্তির মাধ্যমে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন তা নিয়ে হতে পারে বিতর্ক। কিন্তু আমার মনে হয়, শেখ মুজিবুর রহমান অনুভব করেছিলেন বাংলাভাষী মুসলমানের মধ্যে একটা ইসলামের স্বাতন্ত্র্যবোধ কাজ করছে। আর এই স্বাতন্ত্র্যবোধ হলো বাংলাদেশের মানুষের স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনার আবেগগত ভিত্তি, যা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বেরও অন্তিম ভিত্তি। কিন্তু মনে হচ্ছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানের এই দৃষ্টিকোণ থেকে সরে আসারই পক্ষে।

পতিসরে বলা হলো, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তিনি ছিলেন মানুষের ধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু আমরা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যা জানি, তার সঙ্গে এই উক্তির খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ এ দেশে প্রবর্তন করেন শিবাজি-উৎসব। তিনি শিবাজি-উৎসব উপলক্ষে লিখেন বিখ্যাত শিবাজি-উৎসব কবিতা, যাতে তিনি আক্ষেপ করে বলেন- শিবাজি চেয়েছিলেন সারা ভারতকে একটি হিন্দুরাজ্যে পরিণত করতে। কিন্তু বাঙালিরা (অর্থাৎ বাংলাভাষী হিন্দুরা) সেটা বুঝতে পারেনি। এখন সময় এসেছে সেটাকে উপলব্ধি করার। রবীন্দ্রনাথ কবিতাটি লিখেছিলেন ১৩১১ বঙ্গাব্দে। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১১৩ বছর আগে। রবীন্দ্রনাথ তার এই কবিতাটিকে তার সঞ্চিতা নামক কাব্য সঙ্কলনে স্থান দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি মনে করেছেন, কবিতাটি তার স্মরণীয় কবিতাদের মধ্যে একটি।

রবীন্দ্রনাথ তার ‘আত্মপরিচয়’ নামক গ্রন্থে পরিচয় নামক প্রবন্ধে লিখেছেন ‘মুসলমান একটি বিশেষ ধর্ম কিন্তু হিন্দু কোনো বিশেষ ধর্ম নহে। হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি জাতিগত পরিণাম।’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন। আর এই জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হলো হিন্দুত্ব। রবীন্দ্র-চিন্তার সাথে বর্তমান ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজিপির চিন্তা এ ক্ষেত্রে হলো অভিন্ন। আমরা অনেকেই জানি না, ভারতের জাতীয়সঙ্গীত একটি নয়, দু’টি। একটি হলো বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘বন্দেমাতরম’ আর একটি হলো রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘ভারতবিধাতা’। বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম গানটি আছে তার ‘আনন্দমঠ’ নামক উপন্যাসে, যা মুসলিম বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। বন্দেমাতরম গানটি হলো ছাব্বিশ লাইনের। এর মধ্যে প্রথম কুড়ি লাইন হলো সংস্কৃত ভাষায় লিখিত। এই কুড়ি লাইনের মধ্যে প্রথম আট লাইন গৃহীত হয়েছে ভারতের জাতীয়সঙ্গীত রূপে। রবীন্দ্রনাথ এই আট লাইনের সুর প্রদান করেছেন। তিনি প্রথম এই আট লাইন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে গীত হওয়ার ব্যবস্থা করেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের ভাবধারার অনুরক্ত। তাই যারা বলতে চাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, তাদের বক্তব্য বস্তুনিষ্ঠ হচ্ছে বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথকে নির্ভর করেই বন্দেমাতরম গানটি কংগ্রেস-এ অনুপ্রবিষ্ট হয়। আর যেহেতু এর ভাষা সংস্কৃত আর হিন্দুরা ভাবেন সংস্কৃত হলো দেবভাষা, তাই গানটি হতে পারে অনেক সহজে আদ্রিত। নিতে পারে সর্বভারতীয় রূপ।

অন্য দিকে ভারতবিধাতা গানটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন সম্রাট পঞ্চম জর্জকে প্রশংসা করে। কেননা পঞ্চম জর্জ দিল্লিতে এসে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গকে রদ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এতে হতে পেরেছিলেন খুবই আনন্দ বিহ্বল। কিন্তু বাংলার মুসলমান লর্ড কার্জনের বঙ্গবিভাগকে সমর্থন করেছিলেন। কেননা এর ফলে যে নতুন প্রদেশ, পূর্ববঙ্গ, আসাম প্রদেশ গঠিত হয়, তাতে মুসলমানরা হন সংখ্যাগরিষ্ঠ আর ঢাকা হয় এই প্রদেশের রাজধানী। ভারতে বন্দেমাতরম ও ভারতবিধাতা গান দু’টিকে জাতীয়সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয় ১৯৪৯ সালের ২ নভেম্বর কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে, যার সভাপতি ছিলেন বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠেছে, ভারতবিধাতা গানটিকে ভারতের জাতীয়সঙ্গীত করার যুক্তিযুক্ততা নিয়ে। কেননা, রবীন্দ্রনাথ গানটি লিখেছিলেন সম্রাট পঞ্চম জর্জের প্রশস্তি করে। প্রসঙ্গত বলা যায়, লর্ড কার্জন আসলে ঠিক বঙ্গভঙ্গ করেছিলেন না, তিনি ভাগ করেছিলেন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, যার মধ্যে পড়ত বর্তমান বাংলাদেশ, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার এবং উড়িষ্যা। বঙ্গভঙ্গ রদ করে যে নতুন বাংলা প্রদেশ গঠিত হয়, তাতে সব বাংলাভাষাভাষী অঞ্চল বাংলা প্রদেশে এসেছিল না। অনেক বাংলাভাষাভাষী অঞ্চল যুক্ত হয় বিহার এবং নতুন গঠিত সে সময়ের আসাম প্রদেশের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ এতে মোটেও মনক্ষুণ্ন হননি। কেননা, একমাত্র উড়িষ্যায় ঠাকুর পরিবারের কিছু জমিদারি ছিল, যা পড়েছিল বিহার প্রদেশে। কারণ, উড়িষ্যা ও বিহার হয়েছিল একটি প্রদেশ। কিন্তু জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের আর সব জামিদারি পড়েছিল বাংলা প্রদেশে। ভারেতের কমিউনিস্ট পার্টির বিখ্যাত নেতা মুজাফফর আহমদ তার বিখ্যাত ‘আমার জীবন ও ভারতের কংগ্রেস পার্টি’ বইতে বলেছেন, বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলন খুব জোরাল হয়েছিল, এর একটি কারণ হলো, হিন্দু জমিদাররা এই আন্দোলনে প্রভূত অর্থ ব্যয় করেছিলেন। কেননা, তারা ভেবেছিলেন, মুসলিম অধ্যুষিত আসাম ও পূর্ববঙ্গ প্রদেশে মুসলমান প্রজারা জমিদারি প্রথা বিলোপ করার জন্য আন্দোলন করতে পারে। ফলে হতে পারে জমিদারি প্রথার অবসান। মুজাফফর আহমদের বক্তব্য থেকে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন, কেননা তার মনেও ছিল অনুরূপ ভয়।

বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গীত করা হয়েছে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে। ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ এটি রচনা করেছিলেন বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে। এটাকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার জাতীয়সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর চাপে। না হলে প্রস্তাব উঠেছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত করার। কিন্তু সেটা হতে পারেনি প্রধানত ইন্দিরা গান্ধীর কারণে। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৩৪ সালে এক বছর শান্তি নিকেতনে পড়েছিলেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। এ ছাড়া তিনি মনে করেছিলেন, ভারতের জাতীয়সঙ্গীত আর বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের লেখা হলে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদে রবীন্দ্র-প্রভাব অনেক সহজে পড়তে পারবে। আর এর ফলে ভারত যথেষ্ট সহজে পারবে বাংলাদেশকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এ ছিল একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।

এবার পতিসরে রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী খুব ঘটা করে পালন করা হলো। আলোচনা করা হলো রবীন্দ্রনাথের মানুষের ধর্ম নামক বইটির বিষয়বস্তু নিয়ে। বলা হলো, মানুষের ধর্ম বইটির বিষয়বস্তু হওয়া উচিত আমাদের জাতীয় আদর্শ। রবীন্দ্রনাথের মানুষের ধর্ম বইটির ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা নেই। এটা লিখিত হয় রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩০ সালে যে ‘হিবার্ট লেকচার’ দেন, তার ভিত্তিতে। বইটি ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় ইংরেজি ভাষায় The Religion of Man নামে লন্ডন থেকে। রবীন্দ্রনাথ এতে বলেন, বাংলার বাউলদের ধর্ম হলো মানবধর্ম। কেননা তারা কোনো প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাস করে না। সবাই বাউল হতে পারে। বাউল হতে কারো বাধা নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই কথা যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ নয়। কেননা, বাউলরা হলেন খুবই গুরুবাদী। তারা মনে করেন, কেবল গুরুর কাছ থেকেই শেখা সম্ভব প্রকৃত আরাধনা পদ্ধতি। যার মাধ্যমে আসতে পারে মানবাত্মার মুক্তি। বাউলদের মধ্যে আছে বিভিন্ন গুরুর শিষ্য। আছে চিন্তার ভেদ। তাই তাদের বলা চলে না, অসাম্প্রদায়িক।

বাউলরা খুবই গঞ্জিকা সেবী। এরা যাপন করেন শিথিল যৌন-জীবন। পালন করতে চান না, গারস্থ্য-ধর্ম। চান না সন্তান-সন্ততির দায়িত্ব নিতে। রবীন্দ্রনাথ এর আগে অনেক লেখায় বৈরাগ্যের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু মানুষের ধর্ম বইতে প্রশংসা করেছেন বাউলদের; যারা হলেন বৈরাগ্যবাদী। তিনি মানুষের ধর্মে এটা কেন করেছেন, সেটার ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে ক্ষিতিমোহন সেন দাবি করেছেন, মানুষের ধর্ম বইতে বাউল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন, সেই অংশটি লিখেছিলেন তিনি, রবীন্দ্রনাথ নন। ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বভারতীর একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক। তার খ্যাতির একটি কারণ হলো, ভারতীয় মরমিবাদী চিন্তার ওপর গবেষণা। অর্থাৎ যাকে এখন রবীন্দ্র-চিন্তা বলে প্রচার করা হচ্ছে, তা আসলে হলো ক্ষিতিমোহন সেনের চিন্তা। রবীন্দ্র-চিন্তার ফসল তা নয়। অবশ্য এক দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাউলদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়, বাউলরা খুবই গুরুবাদী। আর রবীন্দ্রনাথও চেয়েছেন কবিগুরু হতে। বিশ্বে আর কোনো কবি সম্ভবত এ রকম কবিগুরু হতে চাননি। তারা কেবলই চেয়েছেন কবি হতে। শেক্সপিয়রকে কেউ কবিগুরু শেক্সপিয়র বলেন না।

রবীন্দ্রনাথকে আমরা বলি বিশ্বকবি। এর একটি কারণ, রবীন্দ্রনাথকে ১৯১৩ সালে দেয়া হয়েছিল সুইডিস অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে নোবেল পুরস্কার। রবীন্দ্রনাথ এটা পেতে পেরেছিলেন তার কবিতার ইংরেজি অনুবাদ হওয়ার কারণে। যে অনুবাদের পরিমার্জনা করেছিলেন কবি ইয়েট্স। যিনি ছিলেন একজন খুবই বড় মাপের কবি। তার পরিমার্জনার কারণে রবীন্দ্রনাথের Song Offerings বই হতে পেরেছিল নোবেল প্রাইজ পাওয়ার যোগ্যতা। রবীন্দ্রনাথের কবিতার এই ইংরেজি অনুবাদ থেকে অঁদ্রেজিদ করেন ফরাসি অনুবাদ L`Offrande Lyrique নামে। ইয়েট্স ও অঁদ্রেজিদ উভয়েই ছিলেন বড় মাপের সাহিত্যিক। এরা প্রত্যেকেই পেয়েছেন সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ। রবীন্দ্রনাথকে খ্যাতিমান করার পেছনে আছে দু’জন খ্যাতিমান সাহিত্যিকের অবদান। কিন্তু আমরা যেন তা স্বীকার করতে চাই না।

আমরা বলতে চাচ্ছি রবীন্দ্রনাথের মতো কবি সাহিত্যিক বিশ্বে আর নেই, যা আমাদের তরুণ মনে সৃষ্টি করছে এক অন্ধ রবীন্দ্র-ভক্তি। সীমিত করছে আমাদের সাহিত্য-চেতনাকে। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গে এভাবে রবীন্দ্র-বন্দনা হচ্ছে না। হচ্ছে রবীন্দ্রসাহিত্যের বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ। তাদের বিশ্লেষণে ধরা পড়ছে রবীন্দ্রসাহিত্যের একটা বিরাট অংশ হলো বিশ্বসাহিত্য থেকে ভাবানুবাদ। রবীন্দ্রনাথকে যতটা মৌলিক ভাবা হয়, সেটা যথার্থ নয়। শ্রী প্রতাপ নারায়ণ বিশ্বাসের মতে, রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের মধ্যে আছে গল্স ওয়ার্দির ‘ফোরসাইট সাগা’ নামক উপন্যাসের বিশেষ প্রভাব। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের কাহিনী নাকি হলো জর্জ এলিয়ট-এর ‘ফেলিক্স হল্ট দি ল্যাডিক্যাল’ নামক উপন্যাস থেকে কার্যত তুলে নেয়া। এই সমালোচক আরো বলেছেন যে, রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ হলো বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক ও কবি তেওফিল গতিয়ে-এর লেখা ‘ল্য পিয়ে দ্য লা মমি’ থেকে অনুপ্রাণিত।

আমি সাহিত্যের লোক নই। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশে রবীন্দ্রনাথের মৌলিকত্ব নিয়ে উঠেছে অনেক প্রশ্ন। অর্থাৎ আমরা তাকে যত বড় ভাবি, তিনি হয়তো তা নন। বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। ফরাসি দেশের তুলনামূলক সাহিত্যের আলোচনা হলো যথেষ্ট উন্নতমানের। সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমাকে বলেছিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতার ফরাসি অনুবাদ পড়েছেন। এসব অনুবাদ পড়ে তার মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ কোনো কবিপদবাচ্য হওয়ারই যোগ্য নন। হতে পারে তার মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। তবে এটা ছিল একজন অধ্যাপকের মন্তব্য। তবে তিনি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন না। ছিলেন মনোবিজ্ঞানের।

আমরা বলছি রবীন্দ্রনাথ নাকি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবি। কিন্তু সর্বকালের কথা কে বলতে পারে। কারণ আমরা কেউই হতে পারি না সর্বকালের সাহিত্যের বিচারক। বাংলা একাডেমিতে একজন বক্তাকে একবার বলতে শোনা গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের বাংলা নাকি হওয়া উচিত আমাদের আদর্শ। এ রকম বাংলা নাকি তার সময়ে আর কেউ লিখতে পারেনি। অথচ রবীন্দ্রনাথের জীবতকালেই শরৎচন্দ্র উপন্যাস লিখে পেয়ে ছিলেন প্রভূত খ্যাতি। অনেকের মতে উপন্যাসের ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রকেই দেয়া উচিত অধিক মর্যাদা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শরৎচন্দ্রকে দিয়েছিল সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রি। কিন্তু এখন রবীন্দ্র-বন্দনা বাংলাদেশে ঢেকে দিচ্ছে বাংলা সাহিত্যের আর সব প্রতিভাকে।

এবার খুব ঘটা করে পতিসরে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হলো। ১৮৩০ সালে পতিসরের জমিদারি ক্রয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদু দারকানাথ ঠাকুর। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারির মধ্যে পতিসর (কালিগ্রাম) ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রতিসরের জমিদারি। উত্তরাধিকার সূত্রে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেয়েছিলেন শাহজাদপুরের জমিদারি। আর গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর পেয়েছিলেন কুষ্টিয়ার শিয়ালদহের জমিদারি। রবীন্দ্রনাথ একসময় এই তিন জমিদারিই দেখতেন। তবে পতিসরই হলো তার নিজস্ব জমিদারি এবং এই পতিসর ছিল তার আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পতিসরে বিশ্বভারতী স্থাপনের কথা ভাবতে পারেননি। কেননা এই অঞ্চল ছিল মুসলিম প্রজাপ্রধান। তিনি বিশ্বভারতী স্থাপন করেন বিরভূমের বোলপুরে, যা ছিল বিশেষভাবেই হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। বোলপুরের জমিদারি ছিল অনেক ছোট। এটা ক্রয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ অনেক পরে। যারা বলছেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে, অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান বিরোধের ঊর্ধ্বে। তাদের কাছে প্রশ্ন রাখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ কেন পতিসরে বিশ্বভারতীয় স্থাপন না করে বোলপুরে বিশ্বভারতী স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ প্রজাই ছিলেন মুসলমান কৃষক। রবীন্দ্র-সাহিত্যে এদের কোনো আলেখ্য অঙ্কিত হয়নি। মুসলমান সমাজ রবীন্দ্র-সাহিত্যে থেকেছে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কী জমিদার হিসেবে, কী সাহিত্যিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাঙালি মুসলমান সমাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলাভাষী মুসলমান সমাজেই হতে দেখা যাচ্ছে অধিক নাচানাচি।

কেবল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মাতামাতি নয়, অনেক অভাবিত ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে। বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত যার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। কিন্তু হঠাৎ করে এখানে দেখা গেল, সুপ্রিম কোর্টের অঙ্গনে গ্রিক বিচারের থেমিসের মূর্তি স্থাপিত হতে। কেন কী কারণে এটা স্থাপন করা হলো, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না এবারে পঁচিশে বৈশাখ নিয়ে এত মাতামাতি হওয়ার হেতু। মনে হচ্ছে একটি সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে চাচ্ছে একটি বিশেষ মহল। বিশ্বের নানা দেশে হচ্ছে যুদ্ধ। অনেকে ধারণা করছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা এসেছে কাছিয়ে। অথচ আমাদের দেশে আলোচ্য বিষয় হলো মানবধর্ম আর বাউল দর্শন। পতিসরে বলা হলো, বাউল দর্শনের মাধ্যমে আশা সম্ভব প্রকৃত শান্তি। রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ডে বাউলদের প্রশংসা করে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন ইউরোপজুড়ে চলেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি। রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা যার গতিরোধ করতে পারেনি। শান্তি কামনা করলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। বাংলাদেশকেও এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।

প্রকাশিত দৈনিক নয়া দিগন্তে, ১২ মে ২০১৭,শুক্রবার। 

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ