অনেকেরই জানা নেই যে, ভারতের জাতীয় সঙ্গীত একটি নয়, দুইটি। একটি হলো রবীন্দ্রনাথ রচিত ও সুরারোপিত গান ‘ভারত ভাগ্য বিধাতা’, আরেকটি হলো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত গান ‘বন্দেমাতরম’। বন্দেমাতরম গানটি ২৬ পঙ্ক্তির; এর মধ্যে বিশ ছত্র সংস্কৃত ভাষায় রচিত আর কেবল মাত্র ছয় ছত্র বাংলা ভাষার। গানটি আছে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস আনন্দমঠ-এ। গানটিতে দেশমাতৃকাকে তুলনা করা হয়েছে ‘মা দুর্গা’র সাথে। বলা হয়েছে, ‘ত্বংহি দুর্গা দশপ্রহরণ ধারিণী’। গানটিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কোনো সুর দেননি। রবীন্দ্রনাথ এ গানটির প্রথম স্তবকে সুর প্রদান করে ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে নিজে গেয়ে শোনান। সেই থেকে গানটির প্রথম স্তবক তার দেয়া সুরেই গীত হচ্ছে। ভারতের সংবিধান রচনা পরিষদের সভায় ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ২৪ জানুয়ারি রবীন্দ্রনাথের ‘ভারত ভাগ্যবিধাতা’ ও রবীন্দ্রনাথের সুর দেয়া বন্দেমাতরম গানের প্রথম স্তবককে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ভুক্ত।
ব্রাহ্মরা নিরাকার এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং সব ধরনের মূর্তি পূজারবিরোধী। কিন্তু ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ’ হয়ে ওঠে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হিন্দুত্ববাদের বিশেষ অনুরক্ত। তাই রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭০-১৮৩৩) নিরাকার একেশ্বরবাদের স্থলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মা দুর্গার ধারণাকে রবীন্দ্রনাথের গ্রহণ করতে বাধেনি। রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবন্ধ আছে, যার নাম ‘হিন্দুত্ব’। প্রবন্ধটি এখন হয়ে উঠেছে দুষ্প্রাপ্য। তাই লেখাটি পড়া সহজ নয়; কিন্তু যারা পড়েছেন, তাদের সবার মতই হলো, লেখাটিতে ফুটে উঠেছে সারা ভারতজুড়ে গোঁড়া হিন্দু সমাজ জীবন গড়ে তুলবার প্রত্যয়। এই সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য হলো- বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা। রাজা রামমোহন রায় যে ব্রাহ্ম সমাজ গড়েছিলেন তাতে জাতিভেদ প্রথা ছিল না। কিন্তু পরে আদি ব্রাহ্ম সমাজে প্রবর্তিত হয় জাতিভেদ প্রথা। বলা হয়, একমাত্র ব্রাহ্মণ থেকে যারা ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত হবে তাদের ওপর ন্যস্ত করতে হবে ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃত্বের ভার, অন্যদের ওপর নয়। রাজা রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধি দিয়েছিলেন দিল্লির নামমাত্র মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর।
তিনি রামমোহন রায়কে তার প্রতিনিধি করে ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনে পাঠান। এর উদ্দেশ্য ছিল রাজা রামমোহন ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করবেন, দ্বিতীয় আকবর মাসিক কী পরিমাণ ভাতা পাবেন। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে রামমোহন লন্ডনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দ্বিতীয় আকবরের মাসিক ভাতা স্থির করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি এরপর দেশে না ফিরে লন্ডনে থেকে যান এবং ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। তাকে ব্রিটেনের ব্রিস্টলে কবর দেয়া হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর নেতৃত্ব পান রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজের। তিনি ছিলেন রামমোহন রায়ের বিশেষ অনুরক্ত। তিনি তার শেষ জীবনে লন্ডনে গমন করেন এবং সেখানেই বাস করতেন। দেশে আর ফেরেননি। তিনি লন্ডনে মারা যাওয়ার পর তাকে সমাধিস্থ করা হয় ব্রিস্টলেই। কিন্তু আদি ব্রাহ্ম সমাজে মানুষ মারা যাওয়ার পর তাদের শব দাহ করা শুরু হয়। কবর দেয়া প্রথা বাদ পড়ে। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথের শব দাহ করা হয়। শব দাহ করা হয় রবীন্দ্রনাথেরও। এভাবেই আদি ব্রাহ্ম সমাজে ফিরে আসে হিন্দুত্বের নানা রীতি-নীতি; শব দাহ করা যার মধ্যে একটি।
১৯০৪ সালের আগস্ট মাসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তার বিখ্যাত শিবাজি উৎসব কবিতাটি। কবিতাটিতে তিনি বলেন যে, মারাঠা নেতা শিবাজি চেয়েছিলেন সারা ভারতে একটি হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। তার এই নীতি ছিল সঠিক। কিন্তু বাঙালিরা (অর্থাৎ বাঙালি হিন্দুরা) তার ডাকে সাড়া না দিয়ে করেছেন ভুল। সেই ভুল শুদ্ধ করার সময় এসেছে। তার নিজের কথায় :
“সেদিন শুনি নি কথা- আজ মোরা
তোমার আদেশ
শিরপাতি লব।
কণ্ঠে কণ্ঠে বক্ষে বক্ষে ভারতে
মিলিবে সর্বদেশ
ধ্যানমন্ত্র তব।
ধ্বজা করি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরীবসন-
দরিদ্রের বল।
‘একধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে’ এ মহাবচন
করিব সম্বল”।
আজকের পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের উদ্ভব হয়েছে তদানীন্তন পাকিস্তান আন্দোলনের জের ধরে। যা ছিল একদিন ‘পূর্ব পাকিস্তান’, তাই আজ ‘বাংলাদেশ’। পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসকে বাদ দিয়ে আজকের বাংলাদেশের উদ্ভব ব্যাখ্যা করা যায় বলে মনে হয় না।
কেউ কেউ বোঝাতে চাচ্ছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নাকি বর্তমান বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভিত্তি এবং তার কারণেই সম্ভব হতে পেরেছে আজকের পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশের উদ্ভব।’ কিন্তু বাংলা যত মানুষের মাতৃভাষা, তার মধ্যে ৬০ শতাংশের বাস হলো বাংলাদেশে। আর ৪০ শতাংশ বাস করেন ভারতে। সব বাংলাভাষী মানুষের পক্ষে এক বাংলা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের পতাকাতলে আসা সম্ভব হয়নি। আর তারা আসতেও চাচ্ছেন না। কেন আসতে চাচ্ছেন না? ‘রবীন্দ্রবাদী’রা তার ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য প্রয়াসী হচ্ছেন না।
যদি ’৪৭ সালে পাকিস্তান না হতো, তবে বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ হতো ভারত রাষ্ট্রেরই অংশ। আর তাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হয়তো মেনে নিতে হতো হিন্দিকেই; যেমন- হিন্দি হয়ে উঠেছে বিহার ও ঝাড়খণ্ডের ভাষা। একসময় বিহারের ভাষা ছিল মাগধী প্রাকৃত। কিন্তু সে ভাষা এখন হয়ে পড়েছে একেবারেই অপ্রচলিত। ভারতে জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলা ভাষার স্থান হলো তৃতীয়। প্রথম স্থানে আছে হিন্দি। দ্বিতীয় স্থান হলো তেলেগু ভাষার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষ বাংলা ভাষাকে পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। সেখানে প্রাদেশিক সরকারের ভাষা হিসেবে চলছে ইংরেজি, বাংলা এবং নেপালি ভাষা। আজ যারা বাংলাদেশে বাঙালিত্বে গৌরব অনুভব করছেন, তারা বোধ হয় জানেন না পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার ভিত্তি কতটা দুর্বল হয়ে উঠছে। যদি বাংলা ভাষা বেঁচে থাকে তাহলে থাকবে বর্তমান বাংলাদেশকে নির্ভর করে।
বর্তমান বাংলাদেশ ভারতের অংশ হলে বাংলা ভাষা নিয়ে তাদের সেই গৌরবের ভিত্তি রচিত হতে পারত না। পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসকে বাদ দিয়ে আজকের বাংলাদেশের অস্তিত্বের ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা যায় বলে মনে করা চলে না। রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন কলকাতায়। কলকাতায় কোনো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়নি। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন হয়েছে ঢাকায়। অথচ কলকাতায় ছিল একসময়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র।
এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়ও উল্লেখ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ একসময় চেয়েছিলেন কলকাতার বাংলাকে সারা বাংলাদেশের ভাষা করে তুলতে। কিন্তু আমরা সেটাকে মেনে নিতে পারিনি। আমরা রবীন্দ্রনাথের মতো ‘গেলুম, খেলুম, পেলুম’ লিখছি না। সব ব্যাপারেই আমরা হতে চাচ্ছি না রবীন্দ্র অনুসারী। আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী বলছেন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন মুক্ত চিন্তার মানুষ। কিন্তু তিনি বরাবরই খুশি হয়েছেন কেউ তাকে ‘কবিগুরু’ বললে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যিনি সাহিত্যে প্রথম ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সূচনা করেছিলেন; তাকে আমরা কবিগুরু বলি না; কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে বলি। রবীন্দ্রনাথ এর কোনো প্রতিবাদ করে যাননি।
ইংরেজি ভাষা এখন কার্যত হয়ে উঠেছে বিশ্বের প্রধান ভাষা। কিন্তু ইংরেজি ভাষার কোনো ‘একাডেমি’ নেই। ভাষাটা গড়ে উঠেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে নয়। কিন্তু আমরা গড়েছি বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষার উন্নতির লক্ষ্যে। বাংলা একাডেমির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। যা হোক, বাংলা একাডেমি থেকে ‘উত্তরাধিকার’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার ১৪১৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। এটি পড়লে মনে হয়, বাংলাদেশ যেন স্থাপিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারকে নির্ভর করে। সামনে ২২ শ্রাবণ আসছে; প্রতি বছরের মতোই রবীন্দ্রনাথের তিরোধান দিবসে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হবে বলে ধরে নেয়া যায়।