রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক খুন

অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী Photo: bangla.bdnews24.com

একসময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতাম। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেছি, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে অনেক ঝগড়া হতে দেখেছি। উপক্রম হতে দেখেছি হাতাহাতির। কিন্তু কাউকে খুন হতে দেখিনি। আমি নিজেও একবার ভীষণ গোলযোগের মধ্যে পড়েছিলাম। অনেকের ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যেহেতু উচ্চশিক্ষিত, তাই তারা খুব ভদ্র-নম্র এবং সংযত। কিন্তু এটা খুবই ভুল ধারণা। একটা গ্রাম্য সালিসে মানুষ সাধারণত এ দেশে যতটা সংযত আচরণ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মিটিংয়ে তারা তেমন আচরণেরও পরিচয় দেন না। আমি খুন হইনি, কারণ সে সময় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল তুলনামূলক ভালো। কিন্তু পরবর্তীকালে তা আর থাকেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সাধারণ অবনতির প্রভাব এসে পৌঁছেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় দেশের বাইরের একটি প্রতিষ্ঠান নয়। বিশ্ববিদ্যালয় অনেক সহজেই দেশের চলমান পরিস্থিতি দিয়ে প্রভাবিত হয় এবং বর্তমানে হচ্ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অধ্যাপক প্রথম খুন হন, তিনি হলেন মোহাম্মদ ইউনুস। তিনি অধ্যাপনা করতেন অর্থনীতি বিভাগে। কিন্তু অধ্যাপনার চেয়ে তিনি রাজনীতি করতেন বেশি। তিনি যুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে। কিন্তু যখন নিহত হন, তখন তিনি আর ঠিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন না। প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূস ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর খুব ভোরে খুন হন বিনোদপুর এলাকায়, তার নিজের বাসা থেকে ৩০০ গজ দূরে। রোজকার মতো তিনি বেরিয়েছিলেন প্রাতঃভ্রমণে। তাকে খুন করেছিল জেএমবির (জামা’আতুল মুজাহিদিন অব বাংলাদেশ) সদস্যরা। তাকে খুনের জন্য আটজন জেএমবি সদস্যের প্রাণদণ্ড হয়। কিন্তু পরে হাইকোর্ট এদের প্রাণদণ্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। প্রফেসর ইউনূস জড়িয়ে পড়েছিলেন বিশেষভাবে বিড়ালদাহ মাজারের সাথে। তিনি যদি এ রকম মাজারপন্থী না হয়ে উঠতেন, তবে হয়তো জেএমবির হাতে নিহত হতেন না। রাজশাহী একসময় ছিল ওহাবি আন্দোলনের ঘাঁটি। যার রেশ এখনো থেকে গেছে।

রাজশাহীর রাজনীতির পরিবেশকে বুঝতে হলে যার সম্পর্কে কিছুটা জানা এখনো আবশ্যিক। বিখ্যাত ব্রিটিশ গবেষক W. W. Hunter Zvi The Indian Musalmans গ্রন্থে রাজশাহী অঞ্চলের ওহাবি আন্দোলনের কথা বলেছেন। তার এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে লন্ডন থেকে। তিনি তার বইয়ে বলেছেন, রাজশাহী জেলায় প্রথম ওহাবি ভাবধারা প্রচার করেন এনায়েত এবং ওয়ালিয়াৎ আলী। রাজশাহী জেলায় ওহাবি আন্দোলনের একটি বড় কেন্দ্র ছিল জামিরা। ১৮৫০ সাল থেকে রাজশাহী অঞ্চলে আরম্ভ হয় ওহাবি আন্দোলন। ওহাবি আন্দোলনের জনক হলেন আরবের মুহাম্মদ ইবন আব্দ-আল-ওহাব। যিনি জন্মেছিলেন খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে। আরব থেকে ওহাবি ভাবধারা এসেছিল তদানীন্তন বাংলায়। ওহাবের নাম থেকে এই আন্দোলনের নাম হয় ওহাবি, ইংরেজদের কাছে। কিন্তু এই আন্দোলনের আরবি নাম হলো ‘আল মোহায়দ্বিন’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় আল্লাহর একত্ববাদ। হান্টার ওহাবি ভাবধারাকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন :

০১. এক নিরাকার আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও নির্ভরতা।

০২. আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যে কোনো মধ্যস্থতাকারীর অস্তিত্ব অস্বীকার। যার বাস্তব অর্থ হলো, পীরবাদের অস্বীকৃতি, এমনকি নবীপূজাকেও অস্বীকার করা। কোনো মানুষকেই পবিত্র মানুষ ভাবা চলবে না।

০৩. কুরআন শরিফকে ধরতে হবে খোলাকেতাব। অর্থাৎ তা বুঝবার জন্য কোনো ভাষ্যকারের প্রয়োজনকে স্বীকার করা যাবে না। আল্লাহ কুরআন নাজিল করেছেন সবাই বুঝতে পারবে, এ জন্য। কুরআন হলো সব মানুষের জন্য। কেবল কিছু পণ্ডিত ব্যক্তিদের জন্য নয়। এরা কুরআনের কোনো গুপ্ত অর্থ আছে বলে স্বীকার করেন না।

০৪. সর্বপ্রকার বাড়তি ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যা পরে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তাকে অস্বীকার করতে হবে।

০৫. বিধর্মীদের শাসন থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য জিহাদ করতে হবে।

০৬. নেতার নেতৃত্বকে নিষ্ঠার সাথে মেনে চলতে হবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনূস যদি অতটা পীরের মাজারে ওঠাবসা না করতেন, তবে মনে হয় তিনি খুন হতেন না। রাজশাহীর রাজনীতির পরিস্থিতি বুঝতে হলে জানতে হয় এই এলাকার ওহাবি আন্দোলনের ইতিহাসকে।

গত ২৩ এপ্রিল (২০১৬) সকালে খুন হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী। শোনা যাচ্ছে, তিনি খুন হয়েছেন তার গ্রামের বাড়ির কাছে গানের স্কুল করার জন্য। তার বাড়ি হলো রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায়। যেখানে এখনো যথেষ্ট ওহাবি ভাবধারা বিদ্যমান। ওহাবিরা গানবাজনা পছন্দ করেন না। ওহাবিরা মনে করেন, গানবাজনা মানুষের চরিত্রদোষ ঘটায়। তাদের এই ধারণার মূলে যে কোনো সত্য নেই, তা আমি মনে করি না।

রাজশাহী শহরে একসময় ছিল বিরাট এক গণিকাপল্লী। বহু মানুষ সেখানে যেত গান শুনতে। কিন্তু পরে ঘটত তাদের চরিত্রদোষ। যে এলাকায় এই বিরাট গণিকাপল্লী ছিল তা এখন গণকপাড়া নামে অভিহিত। গানবাজনা মানুষের চারিত্রিক অধঃগতি ঘটায়, এ ধারণা কেবল যে ওহাবি মুসলমানদের মধ্যেই প্রচলিত, তা নয়। সাধারণভাবেই এই ধারণা এখনো মুসলমান সমাজে বিদ্যমান। অবশ্য এর বিরুদ্ধমতও আছে। অনেকে মনে করেন, সব গান মানুষের চারিত্রিক অধঃগতি ঘটায় না। কথিত আছে, কাবা শরিফে দেয়াল ভেঙে যায়। একদল রাজমিস্ত্রি আসেন তা গেঁথে মেরামত করার জন্য। রাজমিস্ত্রিরা গান গেয়ে দেয়াল মেরামত করছিলেন। দেয়াল ঠিকতম গাঁথা হচ্ছে কি না, সেটা দেখার জন্য হজরত মুহাম্মদ সা: আসেন সরেজমিন। কিন্তু তিনি রাজমিস্ত্রিদের গান বন্ধ করতে বলেন না। অনেকে তাই মনে করেন, যে গান মানুষকে কর্মপ্রেরণা দেয়, সেই গান ইসলামে হারাম নয়।

এ ছাড়া বাংলাদেশে মুসলমান সমাজে বিয়ের উৎসবে গান গাওয়া হয়। সানাই ইত্যাদি (নহবত) বাজানো হতো। ইসলামে এর অনুমোদন আছে (দ্রষ্টব্য : তিরমিজি)। কিন্তু অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী খুন হলেন নাকি তার গ্রামের বাড়িতে গান শেখানোর স্কুল করার জন্য। বাগমারা উপজেলা অবশ্য একটি জটিল জায়গা। এখানে গোড়া ইসলামপন্থী যেমন আছেন, তেমন আবার গোঁড়া বামপন্থীও বেশ কিছু সংখ্যায় আছেন। ১৯৭৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর চীনপন্থী কমিউনিস্টদের একটি গোষ্ঠী বাগমারা থানার দামনাস ফাঁড়ি লুট করে এবং আটজন পুলিশকে খুন করে। একসময় এখানে উগ্র বামপন্থীদের প্রভাব খুব বেড়েছিল। এখন আবার বেড়েছে ইসলামপন্থী বলে কথিতদের প্রভাব। রেজাউল করিম সিদ্দিকীর বোঝা উচিত ছিল বাগমারার পরিস্থিতি। ওখানে তিনি গানের স্কুল না করলেও পারতেন। কেননা, পরিস্থিতি ছিল খুবই প্রতিকূল। বাগমারায় লোকেরা আছেন আর্থিক অনটনের মধ্যে। আমাদের মূল সমস্যা অর্থনৈতিক। গান গেয়ে এর পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব নয়। তিনি তার স্কুলে লোকসঙ্গীত শেখাচ্ছিলেন না, শেখাচ্ছিলেন নজরুল ও রবীন্দ্রসঙ্গীত। আসলে জোর পড়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর। যেটা ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে খুব বাঞ্ছিত মনে হয়নি। তবে যেটা ভাবনার বিষয় অধ্যাপক রেজাউল করিম খুন হয়েছেন রাজশাহীতে শালবাগ এলাকায়। বাগমারা থেকে লোক এসে তাকে খুন করে অত সহজে চলে গেল, এটা ভাবতে কষ্ট হয়। যারা তাকে খুন করেছে, খুনের ধরন দেখে মনে হয়, তারা ছিল এ ব্যাপারে খুবই প্রশিক্ষিত। গ্রামে যে ধরনের খুনখারাবি হয় এটা ঠিক সে ধরনের ছিল না। মনে হয় পুলিশের তদন্তে নিকট ভবিষ্যতে আমরা অনেক কিছু জানতে পারব। মরহুম অধ্যাপক রেজাউল করিম ছিলেন খুবই নির্মল চরিত্রের লোক। তার মৃত্যুতে অনেকেই তাই হয়েছেন শোকাভিভূত।

ঢাকার পত্রপত্রিকা পড়ে মনে হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকেরই মৃত্যু ঘটেছে যেন মতাদর্শগত কারণে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তা নয়। ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নিহত হন ভূতত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের। তিনি খুন হন তার বিভাগীয় কোন্দলের কারণে। আদালত ওই বিভাগেরই অধ্যাপক ড. মিয়া মুহাম্মদ মহিউদ্দিন এবং অধ্যাপক তাহেরের বাড়ির কেয়ারটেকারকে প্রাণদণ্ড দিয়েছেন। তাহেরের খুন হওয়ার পেছনে কোনো রাজনৈতিক কারণ ছিল না। ছিল না প্রগতিশীলদের সাথে প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্ঘাত। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হন সামাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক শফিউল ইসলাম। তিনি খুন হন ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর তার নিজ বাড়ির সামনে। তার বাড়ি ছিল চৌদ্দপায় নামক স্থানে। তিনি অধ্যাপক তাহেরের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া ক্যাম্পাসের মধ্যে কোনো বাড়িতে থাকতেন না। পুলিশ তার মৃত্যুর জন্য ১১ জনকে দায়ী করে আদালতে মামলা দায়ের করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, এই খুনের কারণ হলো ব্যক্তিগত আক্রোশ। কিন্তু ঢাকার পত্রিকার খবর পড়ে মনে হয়, অধ্যাপক শফিউল আলম ছিলেন প্রগতিশীল। তাই তাকে খুন হতে হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে। কিন্তু পুলিশ তদন্ত করে পেয়েছে কেবল ব্যক্তিগত আক্রোশকে খুন হওয়ার কারণ হিসেবে। প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূস ও প্রফেসর রেজাউল করিম সিদ্দিকীর মৃত্যুর ক্ষেত্রে মতাদর্শগত কারণ আছে বলেই মনে হয়। কিন্তু অপর দু’জন অধ্যাপকের ক্ষেত্রে তা নেই। কিন্তু চেষ্টা চলেছে চারজন অধ্যাপকের খুনকে এক ছকে ফেলে বর্ণনা করার। যেটা বাস্তবতা সম্পন্ন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।

দৈনিক নয়াদিগন্ত, ৩০ এপ্রিল ২০১৬

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ