রামকৃষ্ণ মিশনের ডাকে বাংলাদেশের সাড়া

বসুন্ধরা গ্রুপের কর্ণধারদের সাথে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।

বাংলাদেশে এখন এমন অনেক কিছু ঘটছে, যার কথা ক’দিন আগেও ভাবা যেত না। পত্রিকার খবরে পড়লাম, রামকৃষ্ণ মিশনের ডাকে বাংলাদেশ থেকে বিশেষ অতিথি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন আহমেদ আকবর সোবহান। আহমেদ আকবর সোবহান বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি এবং বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান। তাকে রামকৃষ্ণ মিশনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল একজন জনসেবক হিসেবে। ইতঃপূর্বে কোনো মুসলমানকে রামকৃষ্ণ মিশন এভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বলে আমাদের জানা নেই।

আকবর সোবহানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে পড়ছে ভারতের বিশেষ প্রভাব। তাই মনে হচ্ছে আকবর সোবহানের রামকৃষ্ণ মিশনের অনুষ্ঠানে যোগদানে আছে বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্য। রামকৃষ্ণ মিশন মানবসেবায় নিয়োজিত। কিন্তু তার এতে যোগদান কতটা মানবসেবাধর্মের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে হতে পারল সেটা হয়ে উঠেছে প্রশ্নের বিষয়। প্রশ্নের বিষয় হয়ে উঠেছে বসুন্ধরা গ্রুপের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। আমাদের দেশে অনেকেরই ধারণা নেই রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে। তাই আমরা রামকৃষ্ণ মিশন নিয়ে কিছু আলোচনা করতে যাচ্ছি।

যিনি এখন শ্রী শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬- ১৮৮৬) নামে খ্যাত, তার পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল গদাধর চট্টোপাধ্যায়। ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামের এক গরিব ব্রাহ্মণের ঘরে তার জন্ম হয়। পূজা-অর্চনাই ছিল এই ব্রাহ্মণ পরিবারের আয়ের উৎস। গদাধরকে তার অগ্রজ রাজকুমার কলকাতায় নিয়ে আসেন এবং নিজের টোলে ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা দেন। কলকাতার বিখ্যাত জমিদার রানী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে একটি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৫৫)। গদাধরের বড় ভাই রাজকুমার সেই মন্দিরের প্রথম পূজক নিযুক্ত হন। তার তিরোধানের পর তার ভাই গদাধর ওই কাজে নিযুক্তি পান। গদাধর ছিলেন কালী সাধক। তিনি বলতেন, তিনি কালী মাতার সাক্ষাৎ লাভ করে থাকেন যোগ পদ্ধতির মাধ্যমে। তিনি মা কালীকে মনে করতেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চালিকাশক্তি হিসেবে। তিনি তার শিষ্যদের নানা উপদেশ দিতেন।

একপর্যায়ে তার শিষ্যরা তাকে মনে করতে থাকেন অবতার হিসেবে। তিনি খ্যাত হয়ে ওঠেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস হিসেবে। পরমহংস মানে হলো, শুদ্ধচিত্ত, সংযত-আত্মা নির্বিকার সমদর্শী ব্রহ্মানন্দে মগ্ন যোগি পুরুষ। তিনি এক পর্যায়ে বলেন, মানবসেবার কথা। বলেন, মানবসেবাকে ধর্মের মূলকথা হিসেবে গ্রহণ করতে। তার বক্তব্যের মধ্যে এক দিকে থাকে কালীভক্তি অন্য দিকে থাকে মানবতার পূজার কথা। কালীপূজা মানুষকে করতে চায় রহস্যময় শক্তির সান্নিধ্য লাভে উদ্যোগী। অন্য দিকে মানবসেবা মানুষকে করে রক্তমাংসে গড়া আর্তমানুষকে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ। আর্তমানুষকে সাহায্য করার জন্য গঠিত হয় রামকৃষ্ণ মিশন। রামকৃষ্ণের অনেক শিষ্যের মধ্যে সর্বপেক্ষা খ্যাতিমান শিষ্য হলেন স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)।

স্বামী বিবেকানন্দের প্রকৃত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। নরেন্দ্রনাথ দত্তের পিতা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের ভক্ত। রামমোহন ছিলেন নিরাকার এক-ঈশ্বরবাদী ও মূর্তি পূজার ঘোরবিরোধী। তিনি গঠন করেন ব্রাহ্মসমাজ। কী করে এরকম পরিবারের একটি সন্তান রামকৃষ্ণের মাধ্যমে প্রভাবিত হতে পারলেন সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু তিনি বিশেষভাবেই প্রবাভিত হন রামকৃষ্ণের ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে এবং হয়ে ওঠেন সনাতন হিন্দুধর্মের প্রতি অনুরক্ত। মা কালীকে তিনিও মনে করেন বিশ্বের চালিকাশক্তি এবং সব শক্তির অন্তিম উৎস। বলেন, যোগ সাধনার কথা আর তার পাশাপাশি বলেন আর্তমানবতার সেবার কথাও।

ঊনবিংশ শতাব্দীজুড়ে ফরাসি দার্শনিক উগোস্ত কোঁতের (১৭৯৮-১৮৫৭) প্রবল প্রভাব পড়েছিল ইউরোপীয় চিন্তায়। আর ইউরোপীয় চিন্তার একটা প্রভাব এসে পড়ে কলকাতার হিন্দু সমাজেরও ওপর। কোঁত ছিলেন পজিটিভিস্ট। তিনি মরমিবাদী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন মানুষ পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যা জানে, তাই হলো যথার্থ জ্ঞান। এই জ্ঞানের পেছনে আরো জ্ঞান খুঁজতে যাওয়া বৃথা। বৈজ্ঞানিক চিন্তার লক্ষ্য হতে হবে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় ও মানুষের কল্যাণে এই জ্ঞানকে কাজে লাগানো। তিনি মনে করতেন, ধর্মের মূল শিক্ষা আধ্যাত্মিক চিন্তার মধ্যে নেই। ধর্মের মূল ভিত্তি হলো মানবসেবা। মানুষই মানুষের ভবিষ্যৎ। কোঁতের চিন্তা প্রভাব ফেলে ব্রিটিশ দার্শনিক স্টুয়ার্ট মিল-এর ওপর। মিলও মনে করেছেন ধর্মের মূলকথা হলো মানুষের জন্য মানুষের সহানুভূতির বিকাশ।

এই উপমহাদেশে হিন্দু-চিন্তায় কোঁতের পজিটিভিজম প্রভাব ফেলেনি। তবে তার চিন্তার মানবতন্ত্রী দিকটি ফেলেছে কিছু কিছু প্রভাব। এর এই প্রভাব প্রেরণা জুগিয়েছে আর্তমানবতার সেবায়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে থেকেছে বিদেশী খ্রিষ্টান মিশনারিদের অনুকরণেরও চেষ্টা। বিবেকানন্দ আর্তমানবতার সেবার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। বিবেকানন্দের জীবনে একটি ঘটনা হলো ১৮৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে আহূত ধর্মসংক্রান্ত সভায় গিয়ে বক্তৃতা দেয়। তার এই বক্তৃতার অন্যতম মূল বক্তব্য ছিল সর্বধর্ম সমন্বয়। তিনি বলেন, হিন্দুধর্মে অনেক কুসংস্কার আছে। কিন্তু হিন্দুধর্ম খুবই সহনশীল। হিন্দুরা কখনো ধর্মযুদ্ধ করেনি এবং করতে বলেনি। হিন্দুদের অন্যতম ধর্মগ্রন্থ ভগবত গীতায় বলা হয়েছে, যত মত তত পথ। হিন্দুধর্ম, ধর্মের নামে মানুষ খুন করতে বলে না। কিন্তু বিবেকানন্দের এই বক্তব্যের মধ্যে ছিল একটি বড় রকমের ফাঁক।

হিন্দুরা মা কালীর পূজা করতে গিয়ে দিয়েছে নরবলি। নরবলি হয়েছে তাদের ধর্মসাধনার অঙ্গ। কাপালিকরা কালীপূজা করেছে। মা কালীর নামে দিয়েছে নরবলি। ছিন্নমুণ্ড মানুষের শবের বুকের ওপর উপবিষ্ট হয়ে নগ্ন নারীর সান্নিধ্যে সুরা পান করেছে আগের আরো ছিন্নমস্ত মানুষের মাথার খুলিতে। আমরা যেমন তরল বস্তু পান করি বিভিন্ন পাত্রের সাহায্যে কাপালিকরা পাত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে নরবলি দেয়া মানুষের খুলিকে। এ ছিল এক বীভৎস ধর্ম সাধনা। ঊনবিংশ শতাব্দীতেও যার প্রচলন ছিল। হিন্দুধর্মে ছিল নানা যৌন দুরাচার। ধর্মের নামে নারীকে নগ্ন করে তার ওপর চালানো হতো বীভৎস যৌন অত্যাচার। যার কথা আধুনিক ভদ্র ভাষায় ব্যক্ত করা চলে না। ডাকাতেরা ডাকাতি করতে গিয়েছে কালীপূজা করে। তারা ভেবেছে মা কালী তাদের ডাকাতিতে সাহায্য করবেন।

হিন্দুদের মা কালীভক্তি পরবর্তীকালে হিন্দু রাজনীতিতে ফেলেছে বিশেষ প্রভাব। হিন্দু সন্ত্রাসবাদী রাজনীতিকেরা মা কালীর পূজা করেছেন। মা কালী হয়ে উঠেছে তাদের রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তি। এ প্রসঙ্গে মুজাফ্ফর আহমদ তার আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বইতে লিখেছেন- বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন নিঃসন্দেহে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছিল। কিন্তু তা হিন্দু উত্থানের আন্দোলনও ছিল। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু রাজত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা (ঢাকা সংস্করণ- ১৯৭৭, পৃষ্ঠা-১০)।

বিবেকানন্দ আর্তমানবতার সেবার ক্ষেত্রে হিন্দু জনসমাজের সেবার ব্যবস্থা করেছেন। মুসলিম জনসমাজ কার্যত এর দ্বারা কোনোভাবেই উপকৃত হয়নি। কিন্তু বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশন ডাকছে মুসলমানকেও তার কাজে সম্পৃক্ত হতে। এটা তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সূচক। কিন্তু এর মূলে থাকতে পারে অন্য রাজনৈতিক অভীষ্ট। যার সম্বন্ধে বাংলাভাষী মুসলমানদের সচেতন থাকা প্রয়োজন।

বিবেকানন্দ খুব চমৎকার বাংলা গদ্য লিখেছেন। তিনি চেয়েছেন, যাকে বলা হয় চলতি বাংলা, বাংলা সাহিত্যে তার প্রচলন করতে। বাংলা ভাষায় লেখা- ‘পরিব্রাজক’, ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’, ‘বর্তমান ভারত’ এবং ‘ভাববার কথা’ বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে উচ্চ স্থান অধিকার করে আছে। ‘ভাববার কথা’ গ্রন্থে একটি প্রবন্ধে তিনি চলতি ভাষাকেই সাহিত্যের বাহন করার জন্য যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। আমরা এখন, যাকে বলা হতো চলতি বাংলা, তার মাধ্যমে মনোভাব প্রকাশ করছি। তবে আমরা যে বাংলা ভাষা লিখছি সেটা বিবেকানন্দের চেয়ে প্রমথ চৌধুরীর দ্বারাই অনেক বেশি অনুপ্রাণিত।

বিবেকানন্দ বাংলা ভাষায় বই লিখেছেন। করেছেন বাংলা ভাষার চর্চা। কিন্তু তিনি কোনো দিনই ভাবেননি বাংলা ভাষার ভিত্তিতে একটা পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার কথা। তিনি ছিলেন অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী। আর যার ভিত্তি হতে হবে হিন্দু চেতনা। যেটা আজকের বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের চিন্তা-চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিবেকানন্দের চিন্তার সাথে আমাদের চিন্তার মিল ঘটাতে গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে বাধ্য। বসুন্ধরা গ্রুপ সম্পর্কে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। আমি জানি না, কেন তারা রামকৃষ্ণ মিশনমুখী হতে চাচ্ছেন।

১২ জানুয়ারি ছিল স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন। এতে যোগ দেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান প্রধান আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-চব্বিশ পরগনা জেলার আগরপাড়া নামক জায়গায় স্থাপন করা হলো বিবেকানন্দ মেমোরিয়াল কাম সেমিনার হলের ভিত্তিপ্রসর। এতে উপস্থিত ছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানটিকে তাই একান্তভাবে রাজনীতি-নিরপেক্ষ বলে ভাবা যাচ্ছে না। এই ভিত্তিপ্রস্তর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে করা হলো প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে।

Like this article?

Leave a comment

জনপ্রিয় লেখাসমূহ

জনপ্রিয় বিভাগসমূহ