রাষ্ট্র ও সাহিত্য একাধিক ভাবে পরস্পরের সাথে জড়িত। সাহিত্যের বাহন ভাষা। বিভিন্ন জাতির ভাষার বিভিন্নতার অনেক গুলি করাণের অন্যতম কারণ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাস। জাতীয় ভাষা মর্যাদা পায় জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। অন্যদিক আবার জাতীয় ভাষা ও সাহিত্য সহায়তা করে জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। ইংরাজী ভাষা বিকাশের ক্ষেত্রে দেখতে পাই জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় ভাষার প্রতিষ্ঠা। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে ঝগড়ার ফলে ইংল্যান্ড থেকে ফরাসি ভাষার ক্রম বিতাড়ন। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইংরাজির প্রতিষ্ঠা। অন্য দিকে জার্মানির ক্ষেত্রে ভাষা সহায়তা করেছিল তার একত্রি-করণের। গত শতকে জার্মানির অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক সঙ্গীতের বক্তব্য “জার্মান ভাষায় যারা কথা বলে তারা সবাই জার্মান। জার্মান যেখানে বাস করে তাই জার্মানি। আর জার্মানি হল সবার উপরে।” রাজনৈতিক কারণে ভাষার আঞ্চলিক বৈশিষ্টের ওপর রাজ-রাজড়ারা জোর দিয়েছেন বরাবর। ফলে নিকট সম্বন্ধের ভাষার পাথক্যও হয়ে উঠেছে অনেক বড়। জাতীয় ভাষার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতীয় রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে জাতীয় ভাষা ও সাহিত্য নানা ভাবে পরস্পর সহায়তা করেছে। একের ইতিহাস অপরের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত।
রাষ্ট্রের রূপ বদলের কাজে সাহিত্য কাজ করেছে বিরাট ভাবে। সাহিত্য বহন করে এনেছে রাষ্ট্র বিপ্লবের বাণী-নতুন দৃষ্টিকোণ। সাহিত্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে। প্রচলিত অযৌক্তিক সামাজিক বিধি-বিধানের সংস্কারের ব্যাপারেও সাহিত্যের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। সাহিত্য বরাবরই হয়েছে বিপদ জনক চিন্তার বাহন। দর্শন বিজ্ঞান যা পারে না, সাহিত্য তা পারে। কারণ, সাহিত্যের আবেদন নিছক যুক্তির নয়, আবেগের। আর আবেগ-প্রবুদ্ধ মানুষ সহজেই পারে জীবন মৃত্যুকে পায়ে ঠেলে এগিয়ে যেতে। তাই রাষ্ট্র-কর্ণধারেরা সব সময় চেয়েছেন সাহিত্যিকদের হাতে রাখতে। রাজা-বাদশারা ইনাম দিয়েছেন সভাকবিকে। সভাকবি প্রশস্তি গেয়েছেন দয়ালু প্রজা-পালক রাজার। সাহিত্যকে রাষ্ট্র নায়কেরা সব সময়ই চেয়েছেন বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণ অনেক দিন থেকেই চলে আসছে। নতুন কিছু না।
কিন্তু রাষ্ট্র ও সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে আবার প্রশ্ন উঠছে।
কারণ, রাষ্ট্র আজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে একদল বিপ্লব কর্মবীর সরবে ঘোষণা করেছিলেন : রাষ্ট্র যন্ত্রের বিলুপ্তির দিন ঘনিয়ে আসছে। আমলাতন্ত্র আর মানুষের স্বধীনতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে পারবে না। কিন্তু আজ তাদের কৃপায় প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র-যন্ত্র এক সর্বগ্রাসী রূপ পেতে বসেছে। ব্যক্তির মর্যাদা, চিন্তার স্বাধীনতা, সৃষ্টির স্বাধীনতা আজ পৃথিবীর বহু দেশেই রাষ্ট্রের যুপ-কাষ্টে বলি হচ্ছে। এই সব রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা চাইছেন, সাহিত্যিকদের তাদের নিছক বৈতালিক করে তুলতে। সাহিত্যের এই রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণ আজ বিশেষ ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ি পণ্য তৈরির মত সাহিত্য সৃষ্টিরও চেষ্টা চলছে। একনায়কত্ব আজ কেবল মাত্র রাজনৈতিক এলাকায় গÐি বদ্ধ থাকছে নাÑরূপ নিচ্ছে এক সর্বগ্রাসী সাংস্কৃতিক একনায়কত্বে।
পৃথিবীর দেশে দেশে তাই সাহিত্যিকরা নতুন করে ভাবতে বসেছেন : ঠিক কি ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থা তাঁদের প্রয়োজন। কি ধরনের রাষ্ট্রের আওতায় তাঁরা পাবেন তাঁদের সৃষ্টির পূর্ণতর স্বাধীনতা, অথচ অন্যান্যকে ভুগতে হবে না সীমাহীন দারিদ্রের নিষ্পেষনে। অনেকে আবার ভাবছেন সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আদৌ কোন বক্তব্য থাকা উচিৎ কিনা। কারণ, রাষ্ট্র বলতে শেষ অবধি দাঁড়িয়ে যায় রাষ্ট্র-নায়ক ও কর্মচারী, এদের লক্ষ্য, ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা লাভ-সুন্দরের আবাহন নয়। (ম্যাথু আরনর্লড এর মত দু’চার জন সিভিল সারভেন্ট-এর কথা বাদ দেওয়াই ভাল)। নতুন কোন কিছুকেই এরা সহজে স্বীকার করতে চান নাÑপুরাতনের ছকটানা পথেই এদের চিন্তা চক্র মন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে কোন নতুন আন্দোলনকে এদের পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না। এদের হাতে যদি সাহিত্যের বিচারের ভার তুলে দেওয়া হয়, তবে সাহিত্যের অপমৃত্যু বিচিত্র নয়। যে রাষ্ট্রে সব কিছুই রাষ্ট্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, ব্যক্তিগত মুদ্রাযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা যেখানে সম্ভব নয়, সম্ভব নয় স্বাধীন সাহিত্য চক্র সৃষ্টি-সেখানে সাহিত্যিকদের স্বাধীনতা থাকাও সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের ফরমাস অনুসারে সাহিত্যিকের দল সেখানে সাহিত্য সৃষ্টি করতে বাধ্য। তাই অনেক সাহিত্যিক আজ ভাবতে আরম্ভ করেছেন মিশ্র অর্থনীতির কথা। সব ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়ে সর্বাত্বক একনায়কত্বের বিপদ ডেকে আনবার চাইতে ক্ষমতাকে যতদূর সম্ভব বিভিন্ন হাতে ন্যাস্ত রাখতে চান এরা। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে চিন্তার স্বাধীনতা একান্ত ভাবেই প্রয়োজনীয় কিন্তু যে কোন প্রকার একনায়কত্ববাদের আওতায় সেটা সম্ভব নয়।
সাহিত্যিক কি নিয়ে লিখবেন, কি ভাবে লিখবেন, তার চ‚ড়ান্ত নির্ধারক হবেন তিনি নিজে। যদি কোন সাহিত্যিকের লেখা পাঠক সমাজের মনে দাগ কাটতে না পারে, যদি আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে তার মধ্যে মনে রাখবার মত কিছু না থাকে, তবে সে সাহিত্যের আসর থেকে আপনা হতেই বাদ পড়ে যাবে। তার জন্যে রাষ্ট্র কর্তৃক পুলিশি ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রশ্ন ওঠে না।
রাষ্ট্রের যদি সাহিত্যের ব্যাপারে কোন কিছু করণীয় থাকে, তবে তা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। যে সাহিত্যকে রাষ্ট্র সৎ ও মহৎ বলে মনে করবে, রাষ্ট্রের অধিকার থাকবে তাকে নানা ভাবে সম্মানিত করবাল, প্রচার ও প্রসারের সহায়তা করবার। কিন্তু তাই বলে অন্য সাহিত্যের গায়ের জোরে কণ্ঠ-রোধ চলবে না। একটা কথা মনে রাখতে হবে : সাহিত্যের সমকালীন বিচারই শেষ বিচার নয়। অনেক সাহিত্যই খ্যাতি পায় অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালে। সাহিত্যিক পাঠক তৈরির ক্ষমতা রাখেন। সাহিত্যিক শুধু সাহিত্যই সৃষ্টি করেন না, সৃষ্টি করেন মনের মানুষও।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমত সংগঠনের মাধ্যমে যেমন রাজনৈতিক চেতনাকে নিয়ন্ত্রিত করা চলে, সাহিত্য চেতনাকেও সেভাবে নিয়ন্ত্রিত করা অসম্ভব নয়। স্বাধীনতাকামী সাহিত্যিকদের তাই গণতান্ত্রিক আদর্শবাদের প্রতি নতুন করে ঝুঁকে পড়া ছাড়া গতি থাকছে না। বহুদিনের প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে তার অপূর্ণতাকে নিছক ব্যাঙ্ক-না করে সার্বিক পূর্ণতা সাধনে দায়িত্ব সহায়তা করাই হয়ে পড়েছে আজকের লেখকদের কোন রাজনৈতিক আদর্শ থাকলে তা পালনের শ্রেষ্ঠ উপায়।
প্রথম প্রকাশ: সমকাল, ১ম বর্ষ, ৭ম-৮ম সংখ্যা, ফাল্গুণ-চৈত্র, ১৩৬৪ (৪২৩-৪২৪পৃ.)